গল্পের বই/লোভের শাস্তি

উইকিসংকলন থেকে

লােভের শাস্তি।

 একটী ভাঙা কুঁড়ে ঘরে এক জেলে আর তার জেলেনী থাকে। জেলে রােজ তার জালখানি নিয়ে মাছ ধর্‌তে যায়।

 একদিন সে জলে জাল ফেলে বসে আছে, এমন সময় হটাৎ জালটা ভয়ানক নড়ে উঠল, দড়ি টড়ি সব ছিঁড়ে গেল, আর কিসে যেন জালটাকে টেনে নিয়ে সমুদ্রের ভিতর দিকে চল্‌ল।

 জেলে তাড়াতাড়ি ছুটে জাল উঠাতে গিয়ে দেখে, সেটা এমনি ভারি যে তাকে টেনে তুলতেই পারে না। অনেক কষ্টে জাল ডাঙ্গায় তুলে দেখ্‌ল তাতে এই বড় এক বােয়াল মাছ পড়েছে। সেই মাছটা জেলেকে মিনতি করে বল্‌ল, “আমাকে ছেড়ে দাও। আমি মাছ নই, এক রাজার ছেলে, ডাইনীতে যাদু করে আমাকে মাছ করে দিয়েছে। তুমি আমাকে মেরে কি করবে? আমাকে খেতে একটুও ভাল লাগবেনা।”

 মাছ কথা বল্‌ছে দেখে জেলে ভারি থতমত খেয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি তাকে জলে ফেলে দিল। বাড়ী আস্‌তেই জেলেনী জেলেকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “কই, আজ বুঝি মাছ টাছ কিছু ধর্‌তে পারনি?”

 জেলে বল্‌ল, “একটা মস্ত বােয়াল মাছ ধরেছিলাম। কিন্তু সে কথা বল্‌তে পারে। সে নাকি মাছ নয়, এক রাজার ছেলে, ডাইনেতে যাদু করেছে। তাই তাকে ছেড়ে দিয়েছি।”

 জেলেনী বল্‌ল, “তার কাছে কিছু চাইলেনা?” জেলে বল্‌ল, “চাইব আবার কি?”

 জেলেনী বল্‌ল, “কি বােকা! সে এক রাজার ছেলে, তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছ; তার কাছে কিছু চাইলে সে নিশ্চয় দিত। যাও, আবার যাও। গিয়ে তাকে বল আমাদের এই ভাঙ্গা ঘরটাকে নূতন করে দিক্‌।”

 জেলে বল্‌ল, “না, আমার চাইতে ভয় করে। আর, তাকে কোথায় পাব?”

 জেলেনী বল্‌ল, “কেন? জলের ধারে গিয়ে ডাক্‌বে। আর যদি চাইতে ভয় করে তবে ব’লো যে আমি চেয়েছি।”

 জেলে কিছুতেই যেতে চায় না, জেলেনীও ছাড়বে না। শেষে জেলেকে যেতেই হল। সমুদ্রের ধারে গিয়ে জেলে ডাক্‌ল, “বােয়াল মাছ। বােয়াল মাছ।”

 অমনি সেই মাছটা জল থেকে মাথা বার করে বল্‌ল, “কি?”

 জেলে ভয়ে ভয়ে বল্‌ল, “জেলেনী আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে চায় যে, তুমি আমাদের ভাঙা ঘর খানিকে নূতন করে দাও।”

 মাছ বল্‌ল, “আচ্ছা তাই হবে।” ব’লে সে টুপ্‌ কর, ডুবে গেল।

 তারপর বাড়ী এসে জেলে দেখে, সত্যি সত্যি তার সে ভাঙ্গা ঘর আর নেই! তার যায়গায় সুন্দর নূতন একখানি ঘর হয়েছে আর জেলেনী দরজায় দাঁড়িয়ে।

 সে আস্‌তেই জেলেনী বল্‌ল, “দেখ্‌লে কেমন হল।”

 দিন পনের বেশ চল্‌ল। তারপর একদিন জেলেনী জেলেকে বল্‌ছে, “এ বাড়ীটা বড্ড ছােট, আর এর খড়ের চাল, ভাল বাগানও নেই। তুমি আবার মাছের কাছে যাও; সে আমাদের একটা মস্ত দালান করে দিক্‌।”

 জেলে বল্‌ল, “এখানে ত আমরা বেশ আছি। আবার চেয়ে কি হবে?”

 কিন্তু জেলেনী সে কথা শুন্‌লনা; তাকে জোর করে পাঠাল। কাজেই জেলে আবার সমুদ্রের ধারে গিয়ে ডাক্‌ল, “বোয়াল মাছ, বোয়াল মাছ। জেলেনী কি চায় শোন।

 আবার সেই মাছ এসে বল্‌ল “কি চায়?” জেলে বল্‌ল “মস্ত। বড় কোঠা বাড়ী।” মাছ বল্‌ল, “আচ্ছা তাই হবে।” তারপর বাড়ী ফিরে গিয়ে জেলে দেখ্‌ল তার কুড়ে ঘরের জায়গায় মস্ত দালান আর তার চারদিকে কেমন সুন্দর বাগান হয়েছে। জেলেনী হাস্‌তে হাস্‌তে এসে বল্‌ল, “কি? দেখ্‌লে ত?”

  এমনি করে কিছুদিন যায়, তারপর আবার জেলেনী বল্‌ছে, “এ বাড়ী খানা খুবই সুন্দর। কিন্তু আহা! আমি যদি রাণী হতে পারতাম তবে কেমন মজা হত! তুমি আবার মাছের কাছে যাও।”

 জেলে বল্‌ল “এ ভারি অন্যায়! আমরা ত খুব সুখেই আছি। আবার চাও কেন? শেষে মাছ রাগ কর্‌বে।”

 জেলেনী বল্‌ল, “কি আপদ! একবার গিয়েই দেখনা।” জেলে এবার কিছুতেই যেতে রাজি হয় না। জেলেনী তার সঙ্গে অনেক ঝগড়া কর্‌ল, শেষে বল্‌ল, “তুমি না যাও আমি নিজেই যাব। কাজেই জেলে আর কি করে, আবার সমুদ্রের ধারে গিয়ে মাছকে ডাক্‌ল, “বোয়াল মাছ, বোয়াল মাছ, জেলেনী আবার কি চায় শোন।”

 মাছ বল্‌ল, “কি চায়?”

 জেলে ভয়ে ভয়ে বল্‌ল, “রাণী হতে চায়।” “তবে রাণীই হবে,” ব’লে মাছ চলে গেল। অমনি জেলের ছোট দালান প্রকাণ্ড বড় রাজার বাড়ী হয়ে গেল। চারিদিকে লোক জন; সিপাই প্রকাণ্ড লোহার দরজার কাছে তলোয়ায় খুলে দাঁড়িয়ে আছে। জেলে যেতেই তাকে সকলে সেলাম করে,“জয় মহারাজ, আসুন মহারাজ” ব’লে ভিতরে নিয়ে গেল। সেখানে মস্ত সভা জমেছে, কত বড় বড় লোক বসে আছে, তাদের সোনালী পোষাক ঝক্‌ঝক্ করছে, মাঝখানে উচু বেদীতে সোনার সিংহাসনে জেলেনী বসে আছে। তার চার পাশে, নানারঙ্গের পোষাক প’রে সখীরা সব দাঁড়িয়ে আছে। সিংহাসনের উপর সোনার চাঁদোয়াতে মুক্তার ঝালর; আর সভার চারিদিকে কতই রঙ্‌ বেরঙের রেশমী কাপড়, জরির ঝালর, ঝাড় লণ্ঠন, সব ঝক্‌ঝক্ কর্‌ছে। জেলে জেলেনীকে বল্‌ল “এখন যা চাও তাই হল ত? এর চেয়ে আর কি বেশী হতে পারে।” কিন্তু যার লোভ বেশী সে কিছুতেই সুখী হয় না। যত পায়, আরও তত চায়। রাণী হয়েও জেলেনী খুসী হ’ল না। সে পৃথিবীর রাণী হয়েছে, চাঁদ সূর্য্যের রাণীত হয়ে দেখেনি। এখন সে আকাশের রাণী হতে চায়। সে জেলেকে আবার মাছের কাছে যাবার জন্য ধর্‌ল। জেলে বল্‌ল, “দেখ, বেশী বাড়াবাড়ি ভাল না। আমি যাচ্ছি কিন্তু যদি কিছু হয় শেষে আমাকে দোষ দিতে পার্‌বে না।”

 জেলে আবার সমুদ্রের ধারে গিয়ে মাছকে ডাক্‌ল, “বােয়াল মাছ, বােয়াল মাছ।”

 মাছ বল্‌ল, “আবার কেন?

 জেলে বল্‌ল, “জেলেনী এবার চাঁদ সূর্য্যের রাণী, আকাশের রাণী হবে।”

 তা শুনে মাছ বল্‌ল, “তবে আবার সে তার সেই ভাঙা কুঁড়েতে ফিরে যাক্।”