গুপ্ত রহস্য/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 তারামণির কথা শুনিয়া তখন আমরা বুঝিতে পারিলাম যে কেন আমরা মহাভ্রমে পতিত হইয়াছিলাম, তারামণিকে হত্যাকরা অপরাধে মসলিম্ প্রভৃতিকে বিচারার্থ প্রেরণ করিয়া কেনই বা আমরা বিশেষরূপে লাঞ্ছিত ও অবমানিত হইয়াছিলাম। তারামণির লোহার সিন্ধুকের ভিতর যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, রাসায়ণিক পরীক্ষকের পরীক্ষায় ঐ মৃতদেহের অভ্যন্তর হইতে যে কেন বিষের চিহ্ন প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল তাহা এখন জানিতে পারিলাম। এখন জানিতে পারিলাম কবরস্থান হইতে মতিয়া বিবি নামী স্ত্রীলোকের মৃতদেহের হঠাৎ অন্তর্ধানের রহস্য কি, এখন জানতে পারিলাম সেই সময় বহু অনুসন্ধান করিয়াও আমরা কেন মতিয়া বিবির মৃতদেহের অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই।

 এই সমস্ত অবস্থা তারামণির নিকট হইতে অবগত হইয়া পুনরায় তাহাকে কহিলাম, “তারামণি তোমার কথা শুনিয়া আজ আমাদের চক্ষু ফুটিল। যে বিষয় আমরা কখনও স্বপ্নেও অনুমান করিতে পারি নাই, আজ দেখিতেছি দস্যগণ, সেই সকল বিষয় হাঁসিতে হাঁসিতে সম্পন্ন করিয়া থাকে। যে সকল বিষয় মানব চক্ষুর অগোচর যে সকল বিষয় মানব হৃদয়ে সহজে স্থান পায় না, এখন দেখিতেছি সেই সকল বিষয় দস্যুগণের চক্ষুর সম্মুখে সতত বিদ্যমান থাকে ও উহা সতত হয়ে সতত বিরাজ করে। দস্যুগণ ও মনুষ্য, কিন্তু জানি না কোনরূপ দৈব অনুগ্রহে উহারা মনুষ্য জ্ঞানের অতিরিক্ত বুদ্ধি ও কৌশল অবগত হইয়া থাকি কি না? সে যাহা হউক তারামণির জন্য আমরা মসলিম্ ও তাহার কয়েক জন অনুচরকে ধৃত করিয়াছিলাম, সেই সময়ে উহারা একটী স্থান আমাদিগকে দেখাইয়া দিয়াছিল ও কহিয়াছিল যে উহারা সেই স্থানে বাস করিয়া থাকে। কিন্তু এখন তুমি যে বাড়ীর কথা বলিতেছ, যে বাড়ীতে উহাদিগকে বাস করিতে তুমি স্বচক্ষে দেখিয়াছ সেই বাড়ী, ও যে বাড়ী আমরা দেখিয়াছিলাম ইহা এক বাড়ী নহে। তুমি বলিতে পার ইহার ভিতরেও আর কোনরূপ রহস্য আছে কি না?”

 তারামণি। আমার মনে হইতেছে, যে রাত্রিতে মতিয়া বিবি হত হয়, মসলিম্ তাহার সঙ্গিগণকে তাহার পর দিবসেই বলিয়াছিল, যদি কেহ কোনরূপে ধৃত হও তাহা হইলে আমাদিগের এই বাসস্থান কেহ পুলিশকে দেখাইয়া দিও না। কারণ পুলিশ যদি আমাদের এই বাসস্থান জানিতে পারে তাহা হইলে তারামণি বাহির হইয়া পড়িবে ও তারামণিকে প্রাপ্ত হইলে পুলিশ অনেক কথা তাহার নিকট হইতে জানিতে পারিবে। তাহা হইলে আমাদের বিপদের আর সীমা থাকিবে না। অথচ বাসস্থান দেখাইয়া না দিলে পুলিশ কোনরূপেই ছাড়িবে না। এরূপ অবস্থায় আমার বিবেচনায় অপর কোন স্থানে আর একটা ঘর স্থির করিয়া রাখ। পুলিশ যখন যাহাকে জিজ্ঞাসা করিবে তখন সে যেন ঐ ঘর পুলিশকে দেখাইয়া দেয়।

 আমি। তারামণি, তোমার কথাই প্রকৃত বলিয়া বোধ হইতেছে। যখন আমরা উহাদিগকে ধরিয়াছিলাম তখন প্রকৃতই উহারা আমাদিগকে একটা ঘর দেখাইয়া দিয়াছিল, কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া আমাদের মনে প্রতীত জন্মিয়াছিল যে উহারা যে ঘর, আমাদিগকে দেখাইয়া দিতেছে সে ঘরে উহারা বাস্তবিকই বাস করে না। আচ্ছা তারামণি, তোমাকে আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, বেশ মনে করিয়া দেখ, উহাদিগের নিকট হইতে মতিয়া বিবি সম্বন্ধে যদি কোন কথা শুনিয়া থাক? কারণ যে স্ত্রীলোকটীকে উহারা বিষ প্রয়োগে হত্যা করিয়াছিল, ও যাহাকে মসলিমের স্ত্রী মতিয়া বিবি পরিচয়ে কবর স্থলে লইয়া গিয়াছিল ও এখন জানতে পারিতেছি তোমার ঘরে তোমার লোহার সিন্ধুকের ভিতর যাহার মৃত দেহ উহারা লুকিয়া রাখিয়াছিল, সেই স্ত্রীলোকটী কে?

 তারামণি। আমার যেন অল্প অল্প মনে হইতেছে, যে এক দিবস উহাদের মধ্যে এই রূপ কথা বার্ত্তা হইতেছিল—এক ব্যক্তি কহিল সহরে উহার সম্বন্ধে কোনরূপ উচ্চ-বাচ্য বা কোন রূপ কথাবার্ত্তা কিছু শুনিতে পাইতেছ?

 অপর ব্যক্তি। না কিছুই তো শুনিতে পাইতেছি না। যাহার ত্রিকুলে কেহ নাই তাহার আর কে অনুসন্ধান করিবে?

 প্রথম ব্যক্তি। ত্রিকুলে কেহ নাই একথা তুমি কিরূপে বলিতেছ। আমি শুনিয়াছি উহার একটা চাকর আছে দুইটা চাকরাণি আছে ও উপপতীর ন্যায় এক ব্যক্তির আশ্রয়ে সে বাস করিয়া থাকে; ইহা যদি প্রকৃত হয় তাহা হইলে উহাকে বেওয়ারিস্ বলিব কিরূপে?

 দ্বিতীয় ব্যক্তি। তুমি যাহা বলিলে তাহা সত্য, কিন্তু সময়ে সময়ে ও একাকী বাহিরে গমন করিয়া থাকে ও এমন কি দশ পোনের দিবস পর্য্যন্ত কোন বাবুর বাগানে একাকী বাস করিয়া আমোদ আহি্লাদ করিতে পরান্মুখ হয় না। এই জন্য উহার কেহ অনুসন্ধান করে না।

 তারামণির নিকট হইতে মতিয়া বিবির কথা যাহা কিছু জানিতে পারিলাম তাহাতে বুঝিলাম যে ইহাতে আমাদিগের অনেকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে। আরও জানিতে পারিলাম, মসলিম্ মতিয়া বিবিকে তাহার বণিতা বলিয়া যে পরিচয় দিয়াছিল তাহা মিথ্যা, সে এক জনের বণিতা নহে, বার বণিতা। সে এক জনের আশ্রয়ে কখনও বাস করিত না-দশ জনের আশ্রয় অবলম্বন করিয়া জীবন ধারণ করিত। তাহার থাকিবার নির্দিষ্ট স্থান থাকিলেও সময়ে সময়ে সে বাবুদিগের সহিত বাগানে গিয়া দিন যাপন করিত। এরূপ অবস্থায় মতিয়া বিবি যে কে, কোথায় তাহার বাস স্থান, তাহার চাকর চাকরাণী ও উপপতী প্রভৃতি কে কোথায় আছে তাহা এখন অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে বিশেষরূপ কষ্ট হইলেও একেবারে দুঃসাধ্য হইবে না। আরও মনে করিলাম মতিয়া বিবির বন্ধু বান্ধব প্রভৃতিকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারলে আরও আনক নূতন কথা নিশ্চয়ই বাহির হইবে। তখন হয় ত মস‍্লিম্ ও তাহার অনুচরবর্গের পুনরায় অনুসন্ধানের বিশেষ প্রয়োজন হইয়া পড়িবে। তখন হয় ত উহাদিগের উপর মতিয়া বিবিকে হত্যা করার নিমিত্ত হত্যা মোকর্দ্দমার অবতারণা করিয়া পুনরায় ঐ মোকর্দ্দমা অনুসন্ধান ক্ষেত্রে আমাদিগকে বিচরণ করিতে হইবে। তারামণির মোকর্দ্দমায় উহাদিগকে কোনরূপ দণ্ড প্রদান করাইতে আমরা সমর্থ হয় নাই। কিন্তু জানি না, মতিয়া বিবির মোকর্দ্দমায় উহারা পুনরায় নিষ্কৃতি পাইবে কি না।