গৌড়রাজমালা/দেবপালের দিগ্বিজয়
গৌড়াধিপ দেবপালের সেনা-নায়কের পক্ষে প্রাগ্জ্যোতিষপতিকে বা উৎকলপতিকে পরাভূত করা খুব সহজ হইয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু পিতার বিলুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ধার সাধনে প্রয়াসী হইয়া, দেবপালকে ভারতের প্রধান প্রধান নরপালগণের সহিত যে বিরোধে লিপ্ত হইতে হইয়াছিল, তাহাতেই তাঁহার শক্তির প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। ধর্ম্মপালের মন্ত্রী [গর্গের পুত্র] দর্ভপাণি দেবপালের প্রথম মন্ত্রী ছিলেন। দর্ভপাণির প্রপৌত্র গুরবমিশ্র-প্রতিষ্ঠিত হরগৌরীর (বাদলের) স্তম্ভে দর্ভপাণি-সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—“তাঁহার নীতিকৌশলে শ্রীদেবপালনৃপ হস্তীর মদজলসিক্ত-শিলাসংহতি-পূর্ণ নর্ম্মদার জনক বিন্ধ্যপর্ব্বত হইতে আরম্ভ করিয়া, মহেশ-ললাট-শোভি-ইন্দুকিরণে উদ্ভাসিত হিমাচল পর্য্যন্ত, এবং সূর্য্যের উদয়াস্তকালে অরুণরাগরঞ্জিত জলরাশির আধার পূর্ব্ব সমুদ্র এবং পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্ত্তী সমগ্র ভূভাগ করপ্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন (৫)।” সকল উত্তরাপথ দেবপাল করদ করিয়াছিলেন একথা সত্য না হইতেও পারে; কিন্তু তিনি রাজ্যলাভ করিয়াই, উত্তরাপথের নরপতিগণের সহিত যে যুদ্ধে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, এবং সেই যুদ্ধে লাভবান্ না হউন, বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ যে হয়েন নাই, একথা অকাতরে অনুমান করা যায়। দর্ভপাণির পর তাঁহার পৌত্র কেদারমিশ্র দেবপালের মন্ত্রিপদ লাভ করিয়াছিলেন। তখনও দেবপালের সহিত অন্যান্য প্রধান প্রধান নৃপতিগণের যুদ্ধ চলিয়াছিল। হরগৌরীর স্তম্ভে কেদারমিশ্র-সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—“তাঁহার পরামর্শমতে গৌড়েশ্বর উৎকলকুল উন্মূলিত করিয়া, হূণ-গর্ব্ব হরণ করিয়া, দ্রবিড়রাজ এবং গুর্জ্জররাজের দৰ্প খর্ব্ব করিয়া, দীর্ঘকাল সাগরাম্বরা বসুন্ধরা সম্ভোগ করিয়াছিলেন (১৩)।” এই দ্রবিড়রাজ অবশ্য মান্যখেটের রাষ্ট্ৰকূট-রাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ [আনুমানিক ৮৭৭—৮১৩ খৃষ্টাব্দ], এবং গুর্জ্জর-নাথ গুর্জ্জরের প্রতীহার-বংশীয় মিহিরভোজ, যিনি তৎকালে কান্যকুব্জের সিংহাসনে অধিরূঢ় ছিলেন। রাষ্ট্ৰকূট-রাজ তৃতীয় কৃষ্ণের [কর্হাদে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে দেবপাল ও দ্বিতীয় কৃষ্ণের বিরোধের পরিণামের অন্যরূপ বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। এই শাসনের পঞ্চদশ শ্লোকে দ্বিতীয় কৃষ্ণ সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে,[১] “প্রথম অমোঘবর্ষের, গুর্জ্জরের ভয় উৎপাদনকারী, লাটের ঐশ্বর্য্যজনিত বৃথা-গর্ব্ব-হরণকারী, গৌড়গণের বিনয়ব্রতের শিক্ষাগুরু, সাগরতীরবাসিগণের নিদ্রাহরণকারী, দ্বারস্থ অঙ্গ, কলিঙ্গ, গাঙ্গ, এবং মগধগণকে আজ্ঞাবহনকারী, সত্যবাদী, দীর্ঘকাল ভুবনপালনকারী শ্রীকৃষ্ণরাজ নামক পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিল (১৫)।”
উভয় পক্ষের প্রশস্তিকার যেখানে সমস্বরে বিজয়-ঘোষণা করে, সেখানে সত্য-উদ্ধার সুকঠিন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে দেবপাল ও দ্বিতীয় কৃষ্ণরাজের বিরোধের পরিণামের কিঞ্চিৎ আভাস তৃতীয় পক্ষের প্রশস্তিতেও দেখিতে পাওয়া যায়। ত্রিপুরির (জবলপুরের নিকটবর্ত্তী তেবারের) কলচুরিরাজ কর্ণের [১০৪২ খৃষ্টাব্দের বারাণসীতে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে কলচুরি-রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কোক্কল্ল সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—[২]
“भोजे वल्लभराजे श्रीहर्षे चित्रकूट-भूपाले।
शङ्करगणे च राजनि यस्यासी दभयदः पाणिः॥“ (६ श्लोकः)
বিল্হরিতে প্রাপ্ত শিলালিপিতে কোক্কল্ল-সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—[৩]
“जित्वा कृत्स्नं येन पृथ्वी मपूर्व्वङ्कीर्त्तिस्तम्भ-द्वन्द्व मारोप्यते स्म।
कौम्भोद्भव्यान्दिश्यसौ कृष्णराजः कौवेर्याञ्च श्रीनिधि भोर्ज्जदेवः॥” (१७ श्लोकः)
“যিনি সমস্ত পৃথিবী জয় করিয়া, দুইটি অপূর্ব্ব কীর্ত্তিস্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন,—দক্ষিণদিকে প্রসিদ্ধ কৃষ্ণরাজ এবং উত্তরদিকে শ্রীনিধি ভোজদেব।”
দ্বিতীয় কৃষ্ণরাজ কৃষ্ণবল্লভ নামেও পরিচিত ছিলেন। সুতরাং কোক্কল্লের নিকট অভয়প্রাপ্ত বল্লভরাজ, এবং তাঁহার দ্বারা দক্ষিণদিকে প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণরাজ একই ব্যক্তি, কোক্কল্লের জামাতা দ্বিতীয় কৃষ্ণরাজ। ভোজদেব অবশ্যই গুর্জ্জর-প্রতীহার মিহির-ভোজ; চিত্রকূটপতি শ্রীহৰ্ষ জেজাভুক্তির চান্দেল্ল-বংশীয় রাজা শ্রীহৰ্ষ।[৪] এখন জিজ্ঞাস্য, কোন্ শত্রুর হস্ত হইতে কোক্কল্ল এই সকল প্রবল পরাক্রান্ত নরপালগণকে রক্ষা করিয়াছিলেন? তৎকালে গৌড়েশ্বর দেবপাল ভিন্ন রাষ্ট্রকূট-রাজ বা কান্যকুব্জ-রাজের সহিত প্রতিযোগিতা করিতে সমর্থ আর কোন নরপালের পরিচয় এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত করিতে বাধ্য, প্রতীহার-রাজ মিহির-ভোজ, কলচুরি-রাজ কোক্কল্ল, রাষ্ট্রকূট-রাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ, এবং চান্দেল্ল-রাজ শ্রীহৰ্ষ, আত্মরক্ষার জন্য সম্মিলিত হইয়া, বিজিগীষু দেবপালের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এইরূপ প্রবল বাধা না পাইলে, হয়ত দেবপাল উত্তরাপথের সার্ব্বভৌমের পদ-লাভে সমর্থ হইতেন।
দেবপাল যে কলচুরি বা চেদিরাজ্য অতিক্রম করিয়া, মধ্যভারতের পশ্চিমাংশ আক্রমণে কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন, “হূণ-গর্ব্ব-হরণ”-প্রসঙ্গই তাহার প্রমাণ। ষষ্ঠ শতাদের প্রথমার্দ্ধে যশোধর্ম্ম কর্ত্তৃক পরাজিত হূণ-রাজ মিহিরকুলের মৃত্যুর পর, হূণ-রাজ্যের অস্তিত্বের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না; কিন্তু উত্তরাপথের স্থানে স্থানে, বিশেষত মধ্যভারতে, দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত হূণ-প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল, এরূপ যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। “হর্ষচরিতে” থানেশ্বরের অধিপতি প্রভাকরবর্দ্ধন “হূণহরিণের-সিংহ” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন; এবং [৬০৫ খৃষ্টাব্দে] তাঁহার মৃত্যুর পূর্ব্বে, তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্দ্ধনকে “হূণ-হত্যার জন্য উত্তরাপথে প্রেরণ করিয়াছিলেন,” এরূপ উল্লেখ আছে। মিহির-ভোজের পুত্র কান্যকুব্জরাজ মহেন্দ্রপালের সৌরাষ্ট্রের মহাসামন্ত দ্বিতীয় অবনিবর্ম্মা-যোগের, উনায় প্রাপ্ত ৯৫৬ বিক্রম সম্বতের (৮৯৯ খৃষ্টাব্দের) তাম্রশাসনে, তাঁহার পিতা বলবর্ম্মা সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে,—তিনি জজ্জপাদি নৃপতিগণকে নিহত করিয়া, “ভুবন হূণবংশহীন করিয়াছিলেন।”[৫] দেবপালের পরবর্ত্তী-যুগে, খৃষ্টীয় দশম শতাব্দে, হূণগণ মালবে উদীয়মান পরমার-রাজবংশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। পদ্মগুপ্তের “নবসাহসাঙ্ক চরিত”[৬] এবং পরমার-রাজগণের প্রশস্তি[৭] হইতে জানা যায়,—পরমাররাজ দ্বিতীয় শিয়ক, তদীয় পুত্র উৎপল-মুঞ্জরাজ (৯৭৪–৯৯৪ খৃঃ অঃ) এবং সিন্ধুরাজ যথাক্রমে হূণরাজগণের সহিত যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন। দেবপাল সম্ভবত মালবের হূণগণের গর্ব্ব খর্ব্ব করিয়াছিলেন।
গৌড়েশ্বর দেবপালের প্রতীহার, চান্দের, কলচুরি, এবং রাষ্ট্রকূট-রাজের সহিত বিরোধ, গৌড়গণের সকলোত্তরা-পথের একাধিপতা লাভের তৃতীয় চেষ্টা। শশাঙ্ক এবং ধর্ম্মপাল এ ক্ষেত্রে যতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন, ঘটনাক্রমে দেবপাল ততদুর কৃতকার্য্য হইতে (কান্যকুব্জ পর্য্যন্ত পঁহুছিতে) না পারিলেও, পরাক্রমে তিনি শশাঙ্ক এবং ধর্ম্মপালের তুল্য আসন, এবং সমসাময়িক নরপালগণের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ আসন, পাইবার যোগ্য। দেবপালের [মুঙ্গেরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে প্রশস্তিকার যে লিখিযছেন,—“একদিকে হিমাচল, অপরদিকে শ্রীরামচন্দ্রের কীর্ত্তিচিহ্ন সেতুবন্ধ, একদিকে বরুণালয় (সমুদ্র), অপরদিকে লক্ষ্মীর জন্মনিকেতন (অপর সমুদ্র) এই চতুঃসীমাবচ্ছিন্ন ভূমণ্ডল সেই রাজা নিঃসপত্নভাবে উপভোগ করিতেছেন,”—একথা কবিকল্পিত হইলেও, ইহার অভ্যন্তরে গৌড়াধিপ এবং গৌড়জনের অন্তর্নিহিত উচ্চাভিলাষের ছায়া প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে; এবং দেবপাল এই অভিলাষপূরণে সমর্থ না হইলেও, উহার উদ্যোগ করিতে গিয়া, তিনি যে তৎকালীন ভারতীয় নরপতিসমাজে বাহুবলে স্বীয় শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদনে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহ স্বীকার না করিয়া পারা যায় না।
দশম শতাব্দের প্রারম্ভে, দেবপালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, গৌড়রাজ্যের উন্নতির যুগের অবসান হইয়াছিল। প্রায় একই সময়ে, [৯০৭ হইতে ৯১৪ খৃষ্টাব্দের মধ্যে,] মিহির-ভোজের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী মহেন্দ্রপালের মৃত্যুতে, প্রতিযোগী কান্যকুব্জ-রাজ্যেরও অধঃপতনের সূচনা হইয়াছিল। এই দুইটি পরাক্রান্ত রাজ্যের অধঃপতনের সূচনা হইতেই, উত্তরাপথের অধঃপতনের সূত্রপাত। মুইজুদ্দীন মহম্মদ ঘোরী কর্ত্তৃক উত্তরাপথ বিজিত হইবার এখনও প্রায় তিনশত বৎসর বাকী ছিল। কিন্তু উত্তরাপথের এই তিনশত বৎসরের ইতিহাস তুরূষ্ক-বিজেতার সাদর অভ্যর্থনার উদ্যোগের সুদীর্ঘ কাহিনীমাত্র।
- ↑
तस्सोत्तर्ज्जित गुर्ज्जरो हृतहटलाटोद्भटश्रीमदो
गौड़ानां विनयव्रतार्प्पणगुरुः सामुद्रानिद्राहरः।
द्वारस्थाङ्ग-कलिङ्ग-गाङ्गमगधै रभ्यर्च्चिताज्ञ श्चिरं
सूनु स्सुनृतवाग्भुवः परिवृढ़ः श्रीकृष्णराजो भवत्॥”Epigraphia Indica, Vol. IV, p. 283. - ↑ Epigraphia Indica, II, p. 306.
- ↑ Epigraphia Indica, I, p. 258.
- ↑ Ibid, Vol. II, pp, 300-301.
- ↑ Ibid, IX, p. 8.
- ↑ Indian Antiquary of 1907.
- ↑ Indian Antiquary, Vol. XVI, p. 23; Epigraphia Indica, vol. I, p. 236.