গৌড়লেখমালা (প্রথম স্তবক)/মহীপালদেব-প্রস্তরলিপি

উইকিসংকলন থেকে

মহীপালদেব-প্রস্তরলিপি।

[সারনাথ-লিপি।]
প্রশস্তি-পরিচয়।

 বারানসীর নিকটবর্ত্তী সারনাথ নামক সুবিখ্যাত বৌদ্ধ-তীর্থক্ষেত্রে যে সকল পুরাকীর্ত্তির নিদর্শন ক্রমে ভূগর্ভ হইতে আবিষ্কৃত হইতেছে, ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে তাহার প্রথম সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায়।আবিষ্কার-কাহিনী। সেই বৎসরে, একটি বুদ্ধমূর্ত্তির পাদপীঠে, এই প্রস্তর-লিপিটি ক্ষোদিত থাকা দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। ১৭৯৮ খৃষ্টাব্দে জোনাথন্ স্কট্‌ তাহার বিবরণ এসিয়াটিক্ সোসাইটির পত্রিকায়[১] প্রকাশিত করেন। তাহার পর, এই লিপিটি বহুবার মুদ্রিত ও আলোচিত হইয়াছে।

 এই প্রস্তর-লিপির অক্ষরগুলি সুদৃশ্য এবং সুস্পষ্ট বলিয়াই কথিত হইতে পারে। তথাপি এই লিপির প্রকৃত পাঠ কি, তদ্বিষয়ে নানা তর্কবিতর্ক প্রচলিত হইয়াছিল। ডাক্তার হুল্‌জ্ কর্ত্তৃকপাঠোদ্ধার-কাহিনী। উদ্ধৃত পাঠই[২] এক্ষণে প্রকৃত পাঠ বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে। এই প্রস্তর-লিপির প্রতিকৃতি সংযুক্ত একটি পাঠ ডাক্তার ভোগেল্ কর্ত্তৃক মুদ্রিত হইয়াছে;[৩] এবং যে পাদপীঠে এই প্রস্তর-লিপি খোদিত আছে, তাহারও একটি প্রতিকৃতি প্রকাশিত হইয়াছে। মূল-লিপি লক্ষ্ণৌ নগরের যাদুঘরে রক্ষিত হইতেছে।

 অনেকেই এই প্রস্তর-লিপির ব্যাখ্যা-কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। ইহাতে ১০৮৩ সম্বৎ [১০২৬ খৃষ্টাব্দ] উল্লিখিত থাকায়, তদ্বারা কাল-নির্ণয়ের সুযোগ প্রাপ্ত হইয়া, বহু লেখক এই প্রস্তর-লিপিরব্যাখ্যা-কাহিনী। উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। ডাক্তার হুল্‌জ্ যে ব্যাখ্যা প্রকাশিত করিয়াছিলেন, তাহাতে কষ্ট-কল্পনার অভাব ছিল না। ডাক্তার ভোগেল্, তাহা পরিহার করিয়া, একটি মূলানুগত ব্যাখ্যা প্রকাশিত করিবার চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার ব্যাখ্যাও সর্ব্বাংশে মূলানুগত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না।

 মূললিপি দুইটি পংক্তিতে বিন্যস্ত। সংস্কৃত ভাষানিবদ্ধ “ওঁ নমো বুদ্ধায়” এই মঙ্গলাচরণের পর, ইহাতে চারিটি কবিতা উৎকীর্ণ রহিয়াছে। তৃতীয় পংক্তিতে কেবল সন তারিখ। চতুর্থ-পঞ্চমলিপি-পরিচয়। পংক্তিতে “যে ধর্ম্মো” মন্ত্র। যে পাদপীঠে এই লিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল, তাহার শ্রীমূর্ত্তি বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে; কেবল পাদপদ্ম ও পাদপীঠস্থ ধর্ম্মচক্রাদির চিহমাত্রই বর্ত্তমান আছে।



১০৪ পৃষ্ঠা]
সারনাথ লিপি।

 ইহা গৌড়াধিপ মহীপালদেবের লিপি। তিনি সুপণ্ডিত স্থিরপাল এবং বসন্তপাল নামক ভ্রাতৃদ্বয়কে[৪] নিযুক্ত করিয়া, তাঁহাদিগের সাহায্যে, কাশীধামে ও সারনাথে, নানা কীর্ত্তি ও জীর্ণ-সংস্কারলিপি-বিবরণ। সুসম্পন্ন করাইয়াছিলেন বলিয়া এই প্রস্তর-লিপিতে উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়।[৫] কিন্তু এতদ্বারা কোন্ কোন্ অট্টালিকা সূচিত হইতেছে, তদ্বিষয়ে এখনও বাদানুবাদের অবসান হয় নাই। এই লিপির সহিত বরেন্দ্র-মণ্ডলের ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্ত্তমান থাকায়, অনুসন্ধান-সমিতির সদস্যগণ [১৯১০ খৃষ্টাব্দে] কাশীধাম এবং সারনাথেও তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন।

 এই প্রস্তরলিপির প্রথম পংক্তিতে “গৌড়াধিপ” মহীপালের আদেশে, কাশীধামে “ঈশানচিত্র-ঘণ্টাদির” শত-কীর্ত্তিরত্ন নির্ম্মিত হইবার, দ্বিতীয় পংক্তিতে “ধর্ম্মরাজিকা ও সাঙ্গ-ধর্ম্মচক্র” সংস্কৃতলিপি-তাৎপর্য্য। হইবার, এবং “অষ্টমহাস্থান-শৈলগন্ধকূটী” পুনরায় নূতন করিয়া নির্ম্মিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর প্রথম পাদ, এই সকল কার্য্য-সম্পাদনের কাল বলিয়া, ইহাতে উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এই সময়ে, [মহীপালদেবের শাসন-কালের একাদশ সংবৎসরে] নালন্দার বিশ্ববিখ্যাত বৌদ্ধ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্নিদাহ-বিনষ্ট-মন্দিরের জীর্ণোদ্ধার সাধিত হইবার পরিচয় [নালন্দা-লিপিতে] প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। এই যুগে, অন্যান্য স্থানেও, পুরাকীর্ত্তির সংস্কার-কার্য্য প্রবর্ত্তিত হইয়া থাকিতে পারে। তন্মধ্যে শাক্য-বুদ্ধদেবের জন্মস্থানের [লুম্বিনী-বনের] কথা উল্লেখযোগ্য। তথায় রাজাধিরাজ অশোক [তদীয় অভিষেকোত্তর-বিংশতিতম-বর্ষে] তীর্থ ভ্রমণ করিতে আসিয়া, একটি লিপি-সংযুক্ত শিলাস্তম্ভ প্রতিষ্ঠাপিত করাইয়াছিলেন। তাহার অর্দ্ধাংশ [ইউয়ন্‌ চুয়ঙ্গের ভারত-ভ্রমণকালে] খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে, বজ্রদীর্ণ ও ভূপতিত অবস্থায়, দেখিতে পাওয়া যাইত।[৬] তাহা এক্ষণে ভূগর্ভ-খননে প্রাচীর-বেষ্টিত অবস্থায় [যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিতবৎ] আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাহার প্রতি লক্ষ্য করিয়া, ভিন্‌সেণ্ট স্মিথ্ লিখিয়াছেন,—তাহা খৃষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ-শতাব্দীর কোনও পাল-নরপাল কর্ত্তৃক পুনঃস্থাপিত হইয়া থাকিবে।[৭] ইহা অনুমান মাত্র। তথাপি, ইহাকেও সংস্কার-যুগের নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। বৌদ্ধ-মতানুরক্ত পাল-নরপালগণের শাসন-সময়ে বিলুপ্ত-প্রায় পুরাতন বৌদ্ধ-কীর্ত্তিনিচয়ের সংস্কার-কার্য্য আরব্ধ হইবার সম্ভাবনার অভাব ছিল না। এই সকল প্রমাণ, তাহার অনুকুল প্রমাণ বলিয়া, গৃহীত হইতে পারে। কিন্তু ডাক্তার ভোগেল কর্ত্তৃক মুদ্রিত পাঠ প্রকাশিত হইবার পর, বেনারস-কলেজের সুযোগ্য অধ্যক্ষ [অধ্যাপক ভিনিস্] সোসাইটির পত্রিকায় “ঈশান, ঘণ্টাদি এবং গৌড়” এই কয়টি শব্দ যথাযথভাবে উদ্ধৃত হইয়াছে কিনা, তৎপ্রতি সংশয় প্রকাশ করিয়াছেন।[৮] এরূপ সংশয়ের কারণ কি, তাহা প্রতিভাত হয় না,—শব্দগুলি প্রস্তর-ফলকে ক্ষোদিত রহিয়াছে, তাহার অপলাপ-সাধনের সম্ভাবনা নাই। “কাশ্যাং” এবং “অকারয়ৎ”-শব্দে “ঈশান-চিত্রঘণ্টাদি-কীর্ত্তিরত্নশতানি” কাশীধামে নির্ম্মিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। লিপিটি সারনাথে আবিষ্কৃত হইয়াছিল, সুতরাং তদুক্ত অন্যান্য কার্য্য সারনাথেই সম্পাদিত হইয়াছিল বলিয়া, সকলেই ধরিয়া লইয়াছেন। সে কার্য্যগুলি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হইবার যোগ্য। এক শ্রেণীর কার্য্য “পুনর্নবং”, আর এক শ্রেণীর কার্য্য “নবীনাং” বলিয়া দুইটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দে উল্লিখিত রহিয়াছে। ইহাতে মনে হয়,—পূর্ব্ব-রচিত যে সকল কীর্ত্তি [সংস্কারাভাবে] জীর্ণ হইয়াছিল, তাহাকে “পুনর্নবং”; এবং যাহা কালক্রমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহাকে “নবীনাং” করা হইয়াছিল। এইরূপ ব্যাখ্যাই মূলানুগত বলিয়া প্রতিভাত হয়। এইরূপ অর্থে শিলা-লিপির উক্তিগুলি গ্রহণ করিলে, দেখিতে পাওয়া যায়,—“ধর্ম্মরাজিকা” এবং “সাঙ্গ-ধর্ম্মচক্র” এই দুইটিকে “পুনর্নবং” করা হইয়াছিল;—এবং “অষ্ট-মহাস্থান-শৈলগন্ধকূটীকে” “নবীনাং” করা হইয়াছিল। এক্ষণে ইহার কোনরূপ চিহ্ন বর্ত্তমান আছে কি না, অনুসন্ধান-সমিতি তাহারই অনুসন্ধান-কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন। সারনাথের মূল-মন্দিরের দক্ষিণাংশে যে বৃহৎ স্তূপের ধ্বংসাবশেষ দেওয়ান জগৎ সিংহ কর্ত্তৃক স্থানান্তরিত হইয়াছিল, তাহা এক্ষণে “জগৎসিংহ-স্তূপ” নামে কথিত হইতেছে। তাহার ভূগর্ভ-নিহিত ইষ্টক-সন্নিবেশ-ব্যাপারে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে,—একটি পুরাতন স্তূপের বহির্ভাগে আর একটি স্তূপাবরণ রচিত করিয়া, সংস্কার-কার্য্য সম্পন্ন করা হইয়াছিল। ইহার অনতিদূরে যে অশোক-স্তম্ভ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার শীর্ষদেশে, [সিংহ-চতুষ্টয়ের মধ্যস্থলে] কীলক-সংযোগে সংস্থাপিত একটি “ধর্ম্মচক্র” বিদ্যমান ছিল;—তাহার ভগ্নাংশমাত্রই প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। সুতরাং “জগৎসিংহ-স্তূপ” নামে কথিত স্তূপটিকে এবং অশোক-স্তম্ভশীর্ষস্থ ধর্ম্মচক্র-চিহকে যথাক্রমে “ধর্ম্মরাজিকাং” এবং “সাঙ্গং ধর্ম্মচক্রং” বলিয়া গ্রহণ করিলে, “পুনর্নবং”-শব্দ ব্যবহৃত হইবার কারণ বুঝিতে পারা যায়। শাক্য-বুদ্ধদেব স্বয়ং যে সকল স্থানে বাস করিয়া “ধর্ম্মচক্র-প্রবর্ত্তন” করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে সারনাথই প্রথম এবং ভুবনবিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র। এই সকল স্থানে উত্তরকালে ‘আলয়’ নির্ম্মিত হইয়াছিল। তিব্বতীয় গ্রন্থে তাহা “গন্ধালয়” [অপভ্রংশে গন্ধোলা] নামে উল্লিখিত।[৯] তাহাই “গন্ধকূটী” নামেও পরিচিত ছিল। মূল-মন্দিরকে সেই “গন্ধকূটী” বলিয়া গ্রহণ করিলে, দেখিতে পাওয়া যায়,—তাহার উপাদান ও রচনা-রীতি খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর পরিচয় প্রদান করে; দুই এক স্থলে প্রস্তর-গাত্রে যে সকল অক্ষর ক্ষোদিত আছে, তাহাও প্রথম মহীপালদেবের শাসন-সময়ের বঙ্গাক্ষরের অনুরূপ। নানা স্থান হইতে সংগৃহীত প্রস্তরের সহিত ইষ্টক-সংযোগে এই অট্টালিকা নূতন করিয়া নির্ম্মিত হইয়াছিল। কারণ,—অশোক-স্তম্ভের অবস্থান-ভূমির সহিত এই মন্দিরের দ্বার-সংস্থাপনের সামঞ্জস্য নাই, ইহার রচনা-রীতিও উচ্চশ্রেণীর শিল্প-কোঁশলের পরিচয় প্রদান করে না। এই সকল কারণে মনে হয়,—যাহা মূল-মন্দির নামে কথিত হইতেছে, তাহাই “অষ্টমহাস্থান-শৈলগন্ধকূটী”—এবং তাহা গৌড়াধিপ মহীপালের কীর্ত্তি। সারনাথের “ধামেক” নামক সুবৃহৎ স্তূপটিকে “ধর্ম্মরাজিকা” মনে করিয়া, ডাক্তার ভোগেল তাহাকেই গৌড়াধিপ মহীপালের সংস্কার-কার্য্যের নিদর্শনরূপে ব্যক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু “ধামেক-স্তূপ” কখনও সংস্কৃত হইয়াছিল বলিয়া কল্পনা করিবার উপায় নাই; বরং তাহার রচনা-কার্য্য সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত না হইবারই পরিচয় বর্ত্তমান আছে। এই স্তূপ একটি “বোধিসত্ব-স্তূপ”, এবং ইহার প্রকৃত নাম “ধর্ম্মেক্ষা”,—এইরূপ পরিচয় [১৬৬৯ সংবতে লিখিত] জিনপ্রভ নামক জৈন যতি-বিরচিত “তীর্থকল্প” গ্রন্থে প্রাপ্ত হইয়া, অধ্যাপক ভিনিস্ তাহা উদ্ধৃত করিয়াছেন। যথা—

 “अस्यां क्रोश-त्रितये धर्मेक्षा नाम सन्निवेशो यत्र बोधिसत्वस्योच्चैस्तर-शिखर-चुम्बिन(त)-गगन मायतनम्॥”


প্রশস্তি-পাঠ।

 ॐ नमो बुद्धाय॥
वारान(ण)शी(सी)-सरस्यां गुरव-श्रीवामराशि-पादाब्जं।
आराध्य नमितभूपति-शिरोरुहैः शैवलाधीशं॥(১)

इ(ई)शान-चित्रघण्टादि-कीर्त्तिरत्नशतानि यौ।
गौड़ाधिपो महीपालः काश्यां श्रीमानकार[यत्]॥(২)
सफलीकृत-पाण्डित्यौ बोधाव-विनिवर्त्तिनौ।
तौ धर्म्मराजिकां साङ्गं धर्म्मचक्रं पुन र्नवं॥(৩)
कृतवन्तौ च नवीना मष्टमहास्थान-शैलगन्धकूटीं।
एतां श्रीस्थिरपालो वसन्तपालोऽनुजः श्रीमान्॥(৪)
संवत् १०८३ पौषदिने ११
ये धर्म्मा हेतुप्रभवा हेतुं तेषां तथागतोऽह्यवदत्।
तेषाञ्च यो निरोध एवं वादी महाश्रमणः॥(৫)


বঙ্গানুবাদ।

(১)

 সরসী-সদৃশ-বারাণসীধামে, চরণাবনত-নৃপতিমস্তকাবস্থিত-কেশপাশ-সংস্পর্শে শৈবালাকীর্ণরূপে প্রতিভাত, শ্রীবামরাশি নামক গুরুদেবের[১০] পাদপদ্মের আরাধনা করিয়া,—

(২)

 গৌড়াধিপ মহীপাল [যাহাদিগের দ্বারা ঈশান-চিত্রঘণ্টাদি[১১] শত-কীর্ত্তিরত্ন নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন,

(৩)

 তাঁহাদিগের পাণ্ডিত্য সফল হইয়াছে,—তাঁহারা সম্বোধি-পথ হইতে বিনিবর্ত্তন করেন নাই। সেই শ্রীমান্‌ স্থিরপাল ও শ্রীমান্ বসন্তপাল [নামক] অনুজ[১২] “ধর্ম্মরাজিকার”[১৩] ও “সাঙ্গ ধর্ম্মচক্রের” জীর্ণসংস্কার এবং 

১০৪ পৃষ্ঠা]
সারনাথ-লিপি।
K. V. Seyne & Bros.


(৪)

 “অষ্ট-মহাস্থান”-শৈলবিনির্ম্মিত[১৪] “গন্ধকূটী”[১৫] নূতন করিয়া নির্ম্মাণ করিয়া দিয়াছেন।

(৫)

 যে সকল ধর্ম্ম হেতু হইতে সমুদ্ভূত, তাহাদিগের হেতু কি, তথাগত (বুদ্ধদেব) তাহা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। তাহাদিগের যাহা নিরোধ তাহা এইরূপ, মহাপ্রমণ (বুদ্ধদেব) এইরূপ বলিতেন।[১৬]

 সংবৎ ১০৮৩। ১১ই পৌষ।

  1. Asiatic Researches, Vol. V, p. 131.
  2. Indian Antiquary, Vol. XIV, p. 139.
  3. A. S. R. of 1903-4, p. 222.
  4. স্থিরপাল এবং বসন্তপাল যে পরস্পরের ভ্রাতা ছিলেন, তাহাতে সংশয় নাই। তাঁহারা বিশ্বকোষে [একাদশ ভাগের ৩১৪ পৃষ্ঠায়] মহীপালদেবের “পুত্র” বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন কেন, তাহার কারণ বুঝিতে পারা যায় না। প্রমাণ স্থলে Archæological Survey Report, Vol. IX, p. 182 উল্লিখিত হইয়াছে। “গৌড়ের ইতিহাসে” [১২৩ পৃষ্ঠায়] ইঁহারা মহীপালদেবের “আত্মীয়” বলিয়া উল্লিখিত। ইঁহাদের সহিত মহীপালদেবের কোন সম্বন্ধ ছিল কি না, এই প্রস্তর-লিপি ভিন্ন, তাহার আর কোনও প্রমাণ এ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। প্রস্তর-লিপির “অনুজ”-শব্দের পুত্র-বাচক অর্থ গ্রহণ করা সমীচীন বলিয়া বোধ হয় না।
  5. ডাক্তার হুল্‌জ্ এই সকল কীর্ত্তির যেরূপ ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহার অনুসরণ করিয়াই, “গৌড়ের ইতিহাসে” (১২৩ পৃষ্ঠায়] “ঈশান”-শব্দ দীপস্তম্ভ, এবং “চিত্র-ঘণ্টা” কারুকার্য্যময় ঘণ্টা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।
  6. Near these topes was a stone-pillar set up by Asoka with the figure of a horse on the top. Afterwards the pillar had been broken in the middle, and laid on the ground (that is, half of it) by a thunder-bolt from a malicious dragon.—Watter’s Yuan Chawang, Vol. II, pp. 14-15.
  7. The pillar, which was prostrate (?) in the seventh century, may have been set up again by one of the Buddhist Pála-kings in the eleventh or twelfth century—Prefatory Note to a Report on a Tour of Exploration, 1899. স্মিথ্ সমগ্র স্তম্ভটি ভূপতিত হইবার প্রমাণ কোথায় পাইয়াছেন, তাহার উল্লেখ করেন নাই। সুতরাং তাঁহার সিদ্ধান্ত যাহাই হউক, তাহার কারণটি বিচারসহ হয় নাই। পরলোকগত পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই অশোক-স্তম্ভের খনন-কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়া দেখিতে পাইয়াছিলেন,—এই স্তম্ভের চারিদিকে একটি পুরাতন ও একটি অপেক্ষাকৃত নূতন ইষ্টক-প্রাচীর বর্ত্তমান আছে। শেষ প্রাচীরকে মুখোপাধ্যায় মহাশয় সংস্কার-কার্য্যের নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন।
  8. Isāna, Ghantādi and Gauda, are happy readings, for which we are indebted to Professor Hultzsch. Personally I am unable to see these aksaras.—J. A. S. B. (New Series) Vol. II, No. 9, p. 447.
  9. Pag-Sam-Jon-Zang—Edited by Rai Bahadur Sarat Chandra Das, C.I.E., p. 77.
  10. “গুরব-শ্রীবামরাশিপাদাব্জং” শিষ্ট প্রয়োগ বলিয়া বোধ হয় না। অধ্যাপক ভিনিসও এই পদকে “অনন্বিত” বলিয়াছেন। মহীপালদেবের গুরুদেব এখনও বরেন্দ্রমণ্ডলে সুপরিচিত। লোকে তাঁহার ভদ্রাসনের ধ্বংসাবশেষ দেখাইয়া দিয়া, নানা অলৌকিক আখ্যায়িকার অবতারণা করিয়া থাকে।
  11. “इयं हि चित्रघण्टेशी घण्टाकर्णस्त्वयं ह्रदः।” কাশীখণ্ডে [৩৩।৭৫] “চিত্রঘণ্টেশীর” এইরূপ যে উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে “নবদুর্গার” একতমা সূচিত হইয়াছেন। কাশীধামে “নবদুর্গার” পুরাতন প্রস্তরমূর্ত্তির ধ্বংসাবশেষগুলি অদ্যাপি পূজিত হইতেছে। “চিত্র-ঘণ্টাদি” শব্দে সকলগুলিই সূচিত হইয়া থাকিলে, মহীপালদেব তাঁহাদের জন্যও মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন বলিয়া বুঝিতে হইবে।
  12. ডাক্তার ভোগেল বসন্তপালকে স্থিরপালের “অনুজ” বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু, রচনা-ভঙ্গী স্থিরপাল এবং বসন্তপাল উভয়কেই মহীপালদেবের “অনুজ” বলিয়া ব্যক্ত করিতে পারে। পদমর্য্যাদা-বিজ্ঞাপক “শ্রীমান্” শব্দ সাধারণ রাজকর্ম্মারীর সম্বন্ধে ব্যবহৃত হইবার সম্ভাবনা অল্প বলিয়াই বোধ হয়। এই শ্লোকের “বোধাবিনিবর্ত্তিনৌ” বিশেষণ-পদেও স্থিরপাল-বসন্তপালের প্রাধান্য কীর্ত্তিত হইয়াছে। তাঁহারা সাধনপথ অবলম্বন করিয়া, সম্বোধি লাভের আশায় জলাঞ্জলি দিয়া, সংসারে বিনিবর্ত্তন করেন নাই বলিয়া, তাঁহাদের পাণ্ডিত্য “সফলীকৃত” হইয়াছিল। যে দেশে অনেক রাজকুমার চিরপ্রব্রজ্যা গ্রহণ করিতেন, সে দেশে মহীপালদেবের অনুজদ্বয়ের পক্ষে তাহা গ্রহণ করা আশ্চর্য্যের বিষয় বলিয়া কথিত হইতে পারে না। “অনুজ”-শব্দ স্থিরপাল এবং বসন্তপাল উভয়ের পক্ষেই তুল্যরূপে প্রযোজ্য; সুতরাং তাঁহারা যে পরস্পরের ভ্রাতা ছিলেন, এই মাত্রই বলা হয় নাই,—তাঁহারা উভয়েই “অনুজ”-পদবাচ্য, ইহাও বলা হইয়াছে। এরূপ রচনাভঙ্গীর প্রতি লক্ষ্য করিলে, তাঁহাদিগকে মহীপালদেবের “অনুজ” বলিয়াই গ্রহণ করা যাইতে পারে।
  13. “अशोको नाम धर्म्मराजो(?) चतुरशीतिं धर्म्मराजिका-सहस्रं प्रतिष्ठापयिष्यति”—দিব্যাবদান গ্রন্থের [৩৭৯ পৃঃ] এই উক্তি উদ্ধৃত করিয়া, অধ্যাপক ফুসে “ধর্ম্মরাজিকা”-শব্দের অর্থ প্রকাশিত করিয়াছেন। তদনুসারে অশোক-কৃত স্তূপই “ধর্ম্মরাজিকা” এবং তাহাই সংস্কৃত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তৎপ্রতি লক্ষ্য না করিয়া, অনেকেই সারনাথের “ধামেক” নামক স্তূপকে “ধর্ম্মরাজিকা” বলিয়া বর্ণনা করিয়া আসিতেছেন।
  14. বৌদ্ধ-সাহিত্যে দুই শ্রেণীর “অষ্ট-মহাস্থানের” পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। অধ্যাপক ভিনিস্ আপনাকে “শুষ্ক-বৈয়াকরণ” বলিয়া অভিহিত করিয়া লিথিয়াছেন, “অষ্টমহাস্থান-শৈলগন্ধকূটী” ব্যাকরণ-শাস্ত্রানুসারে “অষ্টমহাস্থান হইতে সংগৃহীত শিলা দ্বারা নির্ম্মিত গন্ধকূটী” এইক্লপ অর্থ প্রকাশিত করিলে, শৈল-শব্দের পরিবর্ত্তে শিলা-শব্দের ব্যবহার করিতে হইত। এই সমাস-নিবদ্ধ-পদে অষ্টমহাস্থান [নামক রচনা-বিজ্ঞাপক স্থানে] সংযুক্ত শিলা-নির্ম্মিত গন্ধকূটী সূচিত হইয়া থাকিবে,—ইহাই তাঁহার অভিপ্রায়। যথা,—“The idea of stones, brought from eight places, might have been extracted from the compound, if it had contained the word Silā instead of Saila. But as it reads in the inscription, the compound, when resolved into sentences, can strictly mean no more than this:—the shrine is made of stones; and, in the shrine are, eight great places (positions). I would therefore make over the word, mahāsthāna, great or lofty place or position, as an architectural term, to the Indian Archæologist to explain or even to explain away, according to his needs. A “mere grammarian” Suska-vaiyákarana, like myself does well to attempt no more.—J. A. B. B. (New Series) Vol. II, No. 9, p. 447.
  15. বুদ্ধদেবের বাসস্থানের উপর যে সকল মন্দির নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহাই “গন্ধকূটী” নামে পরিচিত। “গন্ধকূটীতে” বুদ্ধমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত থাকিত। “প্যাগ্-সাম-জন্-জাঙ্গ” নামক তিব্বতীয় গ্রন্থে “গন্ধালয়” নামের অপভ্রংশ “গন্ধোলার” উল্লেখ আছে।
  16. বৌদ্ধমত-বিজ্ঞাপক এই মন্ত্রটি বিনয়-পিটকের অন্তর্গত। ইহাতে সূত্ররূপে শাক্যসিংহের উপদেশের সার মর্ম্ম নিহিত আছে বলিয়া, ইহা উত্তরকালে মন্দিরে, চৈত্যে, শ্রীমূর্ত্তিতে উৎকীর্ণ হইত। হৃজ্ ডেভিডস্ (Vinaya Texts I, p. 146) ইহার এইরূপ ইংরাজী অনুবাদ করিয়াছেন। যথা,—

    Of all objects which proceed from a Cause
    The Tathāgata has explained the cause,
    And he has explained their Cessation also;
    This is the doctrine of the great Samana."