গ্রহ-নক্ষত্র/চাঁদের গ্রহণ

উইকিসংকলন থেকে

চাঁদের গ্রহণ

পাঁজি খোঁজ করিলে প্রতি বৎসরে একটা দুইটা বা তাহারো বেশি চন্দ্রগ্রহণের কথা তাহাতে লেখা আছে দেখিতে পাইবে। পূর্ণিমা তিথি ভিন্ন চন্দ্রগ্রহণ হয় না। গ্রহণের সময়ে চাঁদথানিকে কি রকম দেখায়, দেখিয়াছ ত? কখনো কখনো সব চাঁদটাই এক-একটু করিয়া ক্ষয় পাইয়া যায়, এই রকম গ্রহণকে পূর্ণগ্রাস বলে। আবার এ রকমও দেখা যায়, চাঁদের খানিকটা ক্ষয় পাইয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে যেমন পূর্ণচন্দ্র ছিল তাহাই হইয়া দাঁড়াইল।

 কিন্তু সূর্য্যগ্রহণের সময়ে সূর্য্য যেমন একেবারে কালো হইয়া যায়, চন্দ্রগ্রহণে চাঁদ ক্ষয় পাইলেও সে রকম কালো হয় না। যেন এক রকম তামার মত অল্প লাল আলো চাঁদের ক্ষয়-পাওয়া অংশে দেখা যায়।

 ইহা দেখিয়াছ কি? যদি না দেখিয়া থাক, এবার যখন চন্দ্রগ্রহণ হইবে তখন দেখিও।

 চাঁদের গ্রহণ কি রকমে হয়, এখন দেখা যাউক। আলোর কাছে কোনো জিনিস রাখিলে সেই জিনিসটার একটা ছায়া পড়ে। তুমি রৌদ্রে গিয়া দাঁড়াও দেখিবে তোমার একটি ছায়া পড়িয়াছে। এই রকমে যে ছায়া হয়, তাহা তোমার কোন্‌দিকে দেখা যায়, লক্ষ্য করিয়াছ কি? তোমার যে দিকে সূর্য্য থাকে ঠিক তাহার উল্টা দিকে ছায়া পড়ে। মনে কর, প্রাতঃকালে তুমি পশ্চিমমুখ হইয়া রৌদ্রে দাঁড়াইয়াছ,


চন্দ্রগ্রহণ

—সূর্য্য তখন পূর্ব্বদিকে আছে। এখন ছায়াটা কি রকম পড়িয়াছে যদি লক্ষ্য কর, তাহা হইলে দেখিবে, তোমার একটা লম্বা ছায়া সূর্য্যের উল্টা দিকে অর্থাৎ পশ্চিমে পড়িয়াছে।

 মহাকাশে পৃথিবী, চন্দ্র প্রভৃতি যে-সব গ্রহ-উপগ্রহ সূর্য্যকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে তাহাদের নিজের আলো নাই। কাজেই সূর্য্যের আলো তাহাদের এক পিঠে পড়িলে, উল্টা দিকে তাহাদের এক একটা প্রকাণ্ড ছায়া আকাশে পড়ে। এই ছায়াকে আমরা অবশ্য সর্ব্বদা দেখিতে পাই না, কারণ ছায়া যতই বড় হউক, কোনো জিনিসের উপরে না পড়িলে তাহা দেখা যায় না। কাজেই সূর্য্যের আলোতে পৃথিবীর ছায়া বা চাঁদের ছায়া সর্ব্বদা আকাশে থাকিলেও তাহা আমাদের নজরে পড়ে না। যখন তাহা আকাশের কোনো বড় জিনিসের উপরে পড়ে তখনই আমরা তাহা দেখিতে পাই।

 চাঁদের গ্রহণ কি রকমে হয়, তাহা বলিতে গিয়া জ্যোতিষীরা বলেন, পৃথিবীর যে একটা প্রকাণ্ড ছায়া আকাশে সর্ব্বদাই আছে তাহা চাঁদের উপরে পড়িলেই গ্রহণ হয়। ছায়ার ভিতরে প্রবেশ করিলে সকল জিনিসেরই উজ্জ্বলতা কমিয়া আসে, ইহা ত তোমরা সর্ব্বদাই দেখিতে পাও। কাজেই চাঁদ যখন পৃথিবীর ছায়ার ভিতরে প্রবেশ করে, তখন তাহারো উজ্জ্বলতা কমিয়া আসে। এই জন্যই গ্রহণের চাঁদে আলো থাকে না, তাহা প্রায় অন্ধকার হইয়া পড়ে।

 চাঁদের গ্রহণের একটা ছবি দিলাম, এই ছবিটি দেখিলেই চাঁদ কি রকমে পৃথিবীর ছায়ার ভিতরে যায় তাহা বুঝিতে পারিবে। ছবিতে দেখ, সূর্য্য ও চাঁদের মাঝে পৃথিবী দাঁড়াইয়া আছে। সূর্য্যের আলোতে যে ছায়া হইয়াছে, তাহা মহাকাশের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। চাঁদ এই ছায়ার মধ্যে আছে বলিয়াই চাঁদের গ্রহণ হইয়াছে।

 আমরা আগে বলিয়াছি, পূর্ণিমা তিথিতে চাঁদ যখন সম্পূর্ণ গোলাকার থাকে, তাহার গ্রহণ কেবল সেই সময়েই হয়। ইহার কারণ তোমরা এখন নিজেরাই বাহির করিতে পারিবে। চাঁদের ক্ষয়বৃদ্ধি বুঝাইবার সময়ে যে ছবিটি দিয়াছি, তাহা দেখিলেই বুঝিবে, পূর্ণিমা তিথি ভিন্ন অন্য কোনো সময়ে পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য্যের মাঝে পড়ে না; কাজেই পৃথিবীর ছায়া এই সময় ভিন্ন অপর কোনো সময়ে চাঁদের উপরে পড়িতে পারে না। অন্য সকল সময়েই পৃথিবীর ছায়া চাঁদের অনেক তফাতে থাকিয়া যায়। কাজেই পূর্ণিমা ছাড়া অপর কোনো তিথিতে চাঁদের গ্রহণ হয় না।

 গ্রহণের সময় চাঁদখানি পৃথিবীর ছায়ার ভিতরে গেলে সূর্য্যের একটুও আলো চাঁদে পড়িতে পায় না; কাজেই সেই সময়ে চাঁদকে একেবারে অন্ধকার দেখিবার কথা। কিন্তু পূর্ণগ্রহণের সময়েও চাঁদ একেবারে অন্ধকার হয় না—তামার মত এক রকম লাল্‌চে অস্পষ্ট আলো তখনো চাঁদে থাকিয়া যায়। যদি চাঁদের নিজের আলো থাকিত, তাহা হইলে না হয় বলিতাম, এই আলো চাঁদের নিজেরি আলো। কিন্তু চাঁদ ত আমাদেরই মাটি-পাথরের মত অনুজ্জ্বল! তবে ঐ লাল্‌চে আলোটা কোথা হইতে চাঁদের উপরে পড়ে?

 এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক হইয়া গিয়াছে। জ্যোতিষীরা বলেন, পৃথিবী যখন সূর্য্য ও চাঁদের মাঝে দাঁড়াইয়া সূর্য্যের আলো রোধ করে, তথন সব আলোকে যে আট্‌কাইতে পারে না। পৃথিবীর চারিদিকে যে পঞ্চাশ মাইল গভীর বাতাসের আবরণ আছে, তাহাই সূর্য্যের এক একটু আলোকে বাঁকাইয়া চাঁদে লইয়া গিয়া ফেলে। আলো সকল সময়েই সরল পথে অর্থাৎ সোজা পথে যায়, তাহা কখনই বাঁকা পথে চলে না। কিন্তু যখনই তাহা কোনো ঘন বা হাল্‌কা স্বচ্ছ জিনিসের ভিতর দিয়া যাইতে চায়, তখন তাহার পথ বাঁকিয়া যায়। মহাশূন্য হইতে যে-সব আলোর রেখা সোজাপথ ধরিয়া পৃথিবীর উপরে আসিয়া পড়ে, তাহাও ঐ কারণে স্বচ্ছ বাতাসে ঠেকিয়া বাঁকিয়া যায়। কাজেই প্রহণের সময়ে সোজা আলোর রেখাগুলি চাঁদে না পড়িলেও, বাঁকা আলোর রেখার কিছু কিছু চাঁদে গিয়া পড়ে। ইহাতেই পূর্ণগ্রহণের সময়ে চাঁদখানি একেবারে কালো হয় না।