বিষয়বস্তুতে চলুন

ঘরে-বাইরে/১৪

উইকিসংকলন থেকে

বিমলার আত্মকথা

এক জন্মে যে এতটা ঘটতে পারে সে মনেও করা যায় না। আমার যেন সাত জন্ম হয়ে গেল। এই কয় মাসে হাজার বছর পার হয়ে গেছে। সময় এত জোরে চলছিল যে চলছে বলে বুঝতেই পারি নি। সেদিন হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পেরেছি।

 বাজার থেকে বিদেশী মাল বিদায় করবার কথা যখন স্বামীর কাছে বলতে গেলুম তখন জানতুম, এই নিয়ে খানিকটা কথা-কাটাকাটি চলবে। কিন্তু আমার একটা বিশ্বাস ছিল যে, তর্কের দ্বারা তর্ককে নিরস্ত করা আমার পক্ষে অনাবশ্যক। আমার চার দিকের বায়ুমণ্ডলে একটা জাদু আছে। সন্দীপের মতাে অত বড়াে একটা পুরুষ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতাে যে আমার পায়ের কাছে এসে ভেঙে পড়ল— আমি তাে ডাক দিই নি, সে আমার এই হাওয়ার ডাক। আর সেদিন দেখলুম, সেই অমূল্যকে— আহা, সে ছেলেমানুষ— কচি মুরলি-বাঁশটির মতাে সরল, এবং সরস— সে আমার কাছে যখন এল তখন ভােরবেলাকার নদীর মতাে দেখতে দেখতে তার জীবনের ধারার ভিতর থেকে একটি রঙ ফুটে উঠল। দেবী তার ভক্তের মুখের দিকে চেয়ে যে কিরকম মুগ্ধ হতে পারেন সেদিন অমূল্যর দিকে চেয়ে আমি তা বুঝতে পারলুম। আমার শক্তির সােনার কাঠি যে কেমনতরাে কাজ করে এমনি করে তাে তা দেখতে পেয়েছি।

 তাই সেদিন নিজের ’পরে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বজ্রবাহিনী বিদ্যুৎশিখার মতাে আমার স্বামীর কাছে গিয়েছিলুম। কিন্তু হল কী? আজ ন বছরে একদিনও স্বামীর চোখে এমন উদাস দৃষ্টি দেখি নি। সে যেন মরুভূমির আকাশের মতাে, তার নিজের মধ্যেও একটুখানি রসের বাষ্প নেই, আর যার দিকে তাকিয়ে আছে তার মধ্যেও যেন কোথাও কিছুমাত্র রঙ দেখা যাচ্ছে না। একটু যদি রাগও করতেন তা হলেও বাঁচতুম। কোথাও তাঁকে ছুঁতেও পারলুম না। মনে হল, আমি মিথ্যে। যেন আমি স্বপ্ন— স্বপ্নটা যেই ভেঙে গেল অমনি কেবল অন্ধকার রাত্রি।

 এতকাল রূপের জন্যে আমার রূপসী জা’দের ঈর্ষা করে এসেছি। মনে জানতুম বিধাতা আমাকে শক্তি দেন নি, আমার স্বামীর ভালােবাসাই আমার একমাত্র শক্তি। আজ যে শক্তির মদ পেয়ালা ভরে খেয়েছি, নেশা জমে উঠেছে। এমন সময় হঠাৎ পেয়ালাটা ভেঙে মাটির উপর পড়ে গেল। এখন বাঁচি কী করে!

 তাড়াতাড়ি খোঁপা বাঁধতে বসেছিলুম। লজ্জা! লজ্জা! লজ্জা! মেজোরানীর ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি বলে উঠলেন, কী লাে ছােটোরানী, খোঁপাটা যে মাথা ডিঙিয়ে লাফ মারতে চায়, মাথাটা ঠিক আছে তাে?

 সেদিন বাগানে স্বামী আমাকে অনায়াসে বললেন, তােমাকে ছুটি দিলুম। ছুটি কি এতই সহজে দেওয়া যায় কিংবা নেওয়া যায়! ছুটি কি একটা জিনিস! ছুটি যে ফাঁকা। মাছের মতাে আমি যে চিরদিন আদরের জলে সাঁতার দিয়েছি; হঠাৎ আকাশে তুলে ধরে যখন বললে ‘এই তােমার ছুটি’ তখন দেখি, এখানে আমি চলতেও পারি নে, বাঁচতেও পারি নে।

 আজ শােবার ঘরে যখন ঢুকি তখন দেখি শুধু আসবাব, শুধু আলনা, শুধু আয়না, শুধু খাট; এর উপরে সেই সর্বব্যাপী হৃদয়টি নেই। রয়েছে ছুটি, কেবল ছুটি, একটা ফাঁক। ঝরনা একেবারে শুকিয়ে গেল, পাথর আর নুড়িগুলাে বেরিয়ে পড়েছে। আদর নেই, আসবাব।

 এ জগতে সত্য আমার পক্ষে কোথায় কতটুকু টিঁকে আছে সে সম্বন্ধে হঠাৎ যখন এত বড়াে একটা ধাঁধা লাগল তখন আবার দেখা হল সন্দীপের সঙ্গে। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের ধাক্কা লেগে সেই আগুন তাে আবার তেমনি করেই জ্বলল। কোথায় মিথ্যে। এ যে ভরপুর সত্য, দুই-কূল-ছাপিয়ে পড়া সত্য। এই-যে মানুষগুলাে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা কচ্ছে, হাসছে— ঐ-যে বড়ােরানী মালা জপছেন, মেজোরানী থাকো দাসীকে নিয়ে হাসছেন, পাঁচালির গান গাচ্ছেন— আমার ভিতরকার এই আবির্ভাব যে এই-সমস্তর চেয়ে হাজার গুণে সত্য।

 সন্দীপ বললেন, পঞ্চাশ হাজার চাই। আমার মাতাল মন বলে উঠল, পঞ্চাশ হাজার কিছুই নয়। এনে দেব। কোথায় পাব, কী করে পাব, সেও কী একটা কথা! এই তাে আমি নিজে এক মুহূর্তে কিছু-না থেকে একেবারে সব-কিছুকে যেন ছাড়িয়ে উঠেছি; এমনি করেই এক ইশারায় সব ঘটনা ঘটবে। পারব, পারব, পারব। একটুও সন্দেহ নেই।

 চলে তাে এলুম। তার পর চার দিকে চেয়ে দেখি, টাকা কই? কল্পতরু কোথায়? বাহিরটা মনকে এমন করে লজ্জা দেয় কেন? কিন্তু তবু টাকা এনে দেবই। যেমন করেই হােক, তাতে গ্লানি নেই। যেখানে দীনতা সেখানেই অপরাধ, শক্তিকে কোনাে অপরাধ স্পর্শ করে না। চোরই চুরি করে, বিজয়ী রাজা লুঠ করে নেয়। কোথায় মালখানা, সেখানে কার হাতে টাকা জমা হয়, পাহারা দেয় কারা— এই-সব সন্ধান করছি। অর্ধেক রাত্রে বাহির-বাড়িতে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দফতরখানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কাটিয়েছি। ঐ লােহার গরাদের মুঠো থেকে পঞ্চাশ হাজার ছিনিয়ে নেব কী করে? মনে দয়া ছিল না; যারা পাহারা দিচ্ছে তারা যদি মন্ত্রে ঐখানে মরে পড়ে তা হলে এখনই আমি উন্মত্ত হয়ে ঐ ঘরের মধ্যে ছুটে যেতে পারি। এই বাড়ির রানীর মনের মধ্যে ডাকাতের দল খাঁড়া হাতে নৃত্য করতে করতে দেবীর কাছে বর মাগতে লাগল; কিন্তু বাইরের আকাশ নিঃশব্দ হয়ে রইল, প্রহরে প্রহরে পাহারা বদল হতে লাগল, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজল, বৃহৎ রাজবাড়ি নির্ভয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে রইল।

 শেষকালে একদিন অমূল্যকে ডাকলুম। বললুম, দেশের জন্যে টাকার দরকার খাজাঞ্চির কাছ থেকে এ টাকা বের করে আনতে পারবে না?

 সে বুক ফুলিয়ে বললে, কেন পারব না?

 হায় রে, আমিও সন্দীপের কাছে এমনি করে বলেছিলুম, ‘কেন পারব না’। অমূল্যর বুক ফোলানাে দেখে একটুও আশ্বাস পেলুম না।

 জিজ্ঞাসা করলুম, কী করবে বলাে দেখি।

 অমূল্য এমনি-সব আজগুবি প্ল্যান বলতে লাগল যে, সে মাসিক কাগজের ছােটো গল্পে ছাড়া আর কোথাও প্রকাশ করবারই যােগ্য নয়।

 আমি বললুম, না অমূল্য, ও-সব ছেলেমানুষি রাখাে।

 সে বললে, আচ্ছা, টাকা দিয়ে ঐ পাহারার লােকদের বশ করব।

 টাকা পাবে কোথায়?

 সে অম্লানমুখে বললে, বাজার লুঠ করে।

 আমি বললুম, ও-সব দরকার নেই, আমার গয়না আছে, তাই দিয়ে হবে।

 অমূল্য বললে, কিন্তু খাজাঞ্চির উপর ঘুষ চলবে না। খুব একটা সহজ ফিকির আছে।

 কিরকম?

 সে আপনার শুনে কাজ নেই। সে খুব সহজ।

 তবু শুনি।

 অমূল্য কোর্তার পকেট থেকে প্রথমে একটা পকেট-এডিশন গীতা বের করে টেবিলের উপর রাখলে, তার পরে একটি ছােটো পিস্তল বের করে আমাকে দেখালে— আর কিছু বললে না।

 কী সর্বনাশ! আমাদের বুড়াে খাজাঞ্চিকে মারার কথা মনে করতে ওর এক মুহূর্তও দেরি হল না। ওর মুখখানি এমনতরাে যে মনে হয়, একটা কাক মারাও ওর পক্ষে শক্ত, অথচ মুখের কথা একেবারে অন্য জাতের। আসল কথা, এই সংসারে বুড়াে খাজাঞ্চি যে কতখানি সত্য তা ও একেবারে দেখতে পাচ্ছে না, সেখানে যেন ফাঁকা আকাশ। সেই আকাশে প্রাণ নেই, ব্যথা নেই, কেবল শ্লোক আছে: ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।

 আমি বললুম, বলাে কী অমূল্য! আমাদের রায়-মশায়ের যে স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে— তার যে—

 স্ত্রী নেই, ছেলেমেয়ে নেই, এমন মানুষ এ দেশে পাব কোথায়? দেখুন আমরা যাকে দয়া বলি, সে কেবল নিজের ’পরেই দয়া। পাছে নিজের দুর্বল মনে ব্যথা লাগে সেইজন্যেই অন্যকে আঘাত করতে পারি নে, এই তাে হল কাপুরুষতার চূড়ান্ত।

 সন্দীপের মুখের বুলি বালকের মুখে শুনে বুক কেঁপে উঠল। ও যে নিতান্ত কাঁচা, ভালোকে ভালাে বলে বিশ্বাস করবারই যে ওর সময়। আহা, ওর যে বাঁচবার বয়েস, বাড়বার বয়েস। আমার ভিতরে মা জেগে উঠল যে। নিজের দিক থেকে আমার ভালােও ছিল না, মন্দও ছিল না; ছিল কেবল মরণ মধুর রূপ ধরে। কিন্তু যখন এই আঠারাে বছরের ছেলে এমন অনায়াসে মনে করতে পারলে একজন বুড়াে মানুষকে বিনা দোষে মেরে ফেলাই ধর্ম, তখন আমার গা শিউরে উঠল। যখন দেখতে পেলুম ওর মনে পাপ নেই, তখন ওর এই কথার পাপ বড়াে ভয়ংকর হয়ে আমার কাছে দেখা দিলে। যেন বাপ-মায়ের অপরাধকে কচি ছেলের মতাে দেখতে পেলুম।

 বিশ্বাসে-উৎসাহে-ভরা বড়াে বড়াে ঐ দুটি সরল চোখের দিকে চেয়ে আমার প্রাণের ভিতর কেমন করতে লাগল। অজগর সাপের মুখের মধ্যে ঢুকতে চলেছে, একে কে বাঁচাবে?— আমার দেশ কেন সত্যিকার মা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এই ছেলেটিকে বুকে চেপে ধরছে না? কেন একে বলছে না, ওরে বাছা, আমাকে তুই বাঁচিয়ে কী করবি, তােকে যদি বাঁচাতে না পারলুম?

 জানি, জানি, পৃথিবীর বড়াে বড়াে প্রতাপ শয়তানের সঙ্গে রফা করে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু মা যে আছে একলা দাঁড়িয়ে এই শয়তানের সমৃদ্ধিকে তুচ্ছ করবার জন্যে। মা তাে কার্যসিদ্ধি চায় না, সে সিদ্ধি যত বড়াে সিদ্ধিই হােক; মা যে বাঁচাতে চায়। আজ আমার সমস্ত প্রাণ চাচ্ছে এই ছেলেটিকে দুই হাতে টেনে ধরে বাঁচাবার জন্যে।

 কিছু আগেই ওকে ডাকাতি করতে বলেছিলুম, এখন যত বড়ো উলটো কথাই বলি সেটাকে ও মেয়েমানুষের দুর্বলতা বলে হাসবে। মেয়েমানুষের দুর্বলতাকে ওরা তখনই মাথা পেতে নেয় যখন সে পৃথিবী মজাতে বসে।

 অমূল্যকে বললুম, যাও তােমাকে কিছু করতে হবে না; টাকা সংগ্রহ করার ভার আমারই উপর।

 যখন সে দরজা পর্যন্ত গেছে তখন তাকে ডাক দিয়ে ফেরালুম; বললুম, অমূল্য, আমি তােমার দিদি। আজ ভাইফোঁটার পাঁজির তিথি নয়, কিন্তু ভাইফোঁটার আসল তিথি বছরে তিনশাে পয়ষট্টি দিন। আমি তােমাকে আশীর্বাদ করছি, ভগবান তােমাকে রক্ষা করুন।

 হঠাৎ আমার মুখ থেকে এই কথা শুনে অমূল্য একটু থমকে রইল। তার পরেই প্রণাম করে আমার পায়ের ধুলাে নিলে। উঠে যখন দাঁড়ালাে তার চোখ ছল্‌ছল্‌ করছে। ভাই আমার, আমি তাে মরতেই বসেছি— তােমার সব বালাই নিয়ে যেন মরি— আমা হতে তােমার কোনাে অপরাধ যেন না হয়।

 অমূল্যকে বললুম, তােমার পিস্তলটি আমাকে প্রণামী দিতে হবে।

 কী করবে দিদি?

 মরণ প্র্যাক্‌টিস করব।

 এই তাে চাই দিদি, মেয়েদেরও মরতে হবে, মারতে হবে। এই বে অমূল্য পিস্তলটি আমার হাতে দিল।

 অমূল্য তার তরুণ মুখের দীপ্তিরেখা আমার জীবনের মধ্যে নূতন ঊষার প্রথম অরুণলেখাটির মতাে এঁকে দিয়ে গেল। পিস্তলটাকে বুকের কাপড়ের ভিতর নিয়ে বললুম, এই রইল আমার উদ্ধারের শেষ সম্বল, আমার ভাইফোঁটার প্রণামী।

 নারী-হৃদয়ে যেখানে মায়ের আসন আমার সেইখানকার জানলাটি হঠাৎ এই একবার খুলে গিয়েছিল। তখন মনে হল, এখন থেকে বুঝি তবে খােলাই রইল।

 কিন্তু, শ্রেয়ের পথ আবার বন্ধ হয়ে গেল, প্রেয়সী নারী এসে মাতার স্বস্ত্যয়নের ঘরে তালা লাগিয়ে দিলে।

 পরের দিন সন্দীপের সঙ্গে আবার দেখা। একটা উলঙ্গ পাগলামি আবার হৃৎপিণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য শুরু করে দিলে। কিন্তু এ কী এ!

 এই কি আমার স্বভাব! কখনােই না।

 এই নির্লজ্জকে, এই নিদারুণকে এর আগে কোনােদিন দেখি নি। সাপুড়ে হঠাৎ এসে এই সাপকে আমার আঁচলের ভিতর থেকে বের করে দেখিয়ে দিলে। কিন্তু কখনােই এ আমার আঁচলের মধ্যে ছিল না, এ ঐ সাপুড়েরই চাদরের ভিতরকার জিনিস। অপদেবতা কেমন করে আমার উপর ভর করেছে। আজ আমি যা-কিছু করছি সে আমার নয়, সে তারই লীলা।

 সেই অপদেবতা একদিন রাঙা মশাল হাতে করে এসে আমাকে বললে, আমিই তােমার দেশ, আমিই তােমার সন্দীপ, আমার চেয়ে বড়াে তােমার আর কিছুই নেই! বন্দে মাতরং!

 আমি হাত জোড় করে বললুম, তুমিই আমার ধর্ম, তুমিই আমার স্বর্গ, আমার যা-কিছু আছে সব তােমার প্রেমে ভাসিয়ে দেব! বন্দে মাতরং!

 পাঁচ হাজার চাই? আচ্ছা, পাঁচ হাজারই নিয়ে যাব। কালই চাই? আচ্ছা, কালই পাবে। কলঙ্কে দুঃসাহসে ঐ পাঁচ হাজার টাকা দান মদের মতাে ফেনিয়ে উঠবে— তার পরে মাতালের উৎসব— অচলা পৃথিবী পায়ের তলায় টলমল করতে থাকবে, চোখের উপর আগুন ছুটবে, কানের ভিতর দিয়ে ঝড়ের গর্জন জাগবে, সামনে কী আছে কী নেই তা বুঝতেই পারব না তার পরে টলতে টলতে পড়ব গিয়ে মরণের মধ্যে। সমস্ত আগুন এক নিমেষে নিবে যাবে, সমস্ত ছাই হাওয়ায় উড়বে, কিছুই আর বাকি থাকবে না।


টাকা কোথায় পাওয়া যেতে পারে সে কথা এর আগে কোনােমতেই ভেবে পাচ্ছিলুম না। সেদিন তীব্র উত্তেজনার আলােতে এই টাকাটা হঠাৎ চোখের সামনে প্রত্যক্ষ দেখতে পেলুম।

 ফি বছর আমার স্বামী পুজোর সময় তাঁর বড়ো ভাজ আর মেজো ভাজকে তিন হাজার টাকা করে প্রণামী দিয়ে থাকেন। সেই টাকা বছরে বছরে তাঁদের নামে ব্যাঙ্কে জমা হয়ে সুদে বাড়ছে। এবারেও নিয়মমত প্রণামী দেওয়া হয়েছে কিন্তু জানি টাকাটা এখনাে ব্যাঙ্কে পাঠানাে হয় নি। কোথায় আছে তাও আমার জানা। আমাদের শােবার ঘরের সংলগ্ন কাপড় ছাড়বার ছােটো কুঠরির কোণে লােহার সিন্দুক আছে, তারই মধ্যে টাকাটা তােলা হয়েছে।

 ফি বছর এই টাকা নিয়ে আমার স্বামী কলকাতায় ব্যাঙ্কে জমা দিতে যান, এবারে তাঁর আর যাওয়া হল না। এইজন্যেই তাে দৈবকে মানি। ঐ টাকা দেশ নেবেন বলেই আটক আছে, এ টাকা ব্যাঙ্কে নিয়ে যায় সাধ্য কার! আর, এই টাকা আমি না নিই এমন সাধ্যই বা আমার কই। প্রলয়ংকরী খর্প‌র বাড়িয়ে দিয়েছেন; বলছেন, আমি ক্ষুধিত, আমাকে দে! আমি আমার বুকের রক্ত দিলুম, ঐ পাঁচ হাজার টাকায়। মা গাে, এই টাকা যার গেল তার সামান্যই ক্ষতি হবে কিন্তু আমাকে এবার তুমি একেবারে ফতুর করে নিলে।

 এর আগে কত দিন বড়ােরানী মেজোরানীকে আমি মনে মনে চোর বলেছি— আমার বিশ্বাসপরায়ণ স্বামীকে ভুলিয়ে তারা ফাঁকি দিয়ে কেবল টাকা নিচ্ছেন, এই ছিল আমার নালিশ। তাঁদের স্বামীদের মৃত্যুর পরে অনেক সরকারি জিনিসপত্র তাঁরা লুকিয়ে সরিয়েছেন, এ কথা অনেকবার আমার স্বামীকে বলেছি। তিনি তাঁর কোনাে জবাব না করে চুপ করে থাকতেন। তখন আমার রাগ হত; আমি বলতুম, দান করতে হয় হাত তুলে দান করাে, কিন্তু চুরি করতে দেবে কেন? বিধাতা সেদিন আমার এই নালিশ শুনে মুচকে হেসেছিলেন। আজ আমি আমার স্বামীর সিন্দুক থেকে ঐ বড়ােরানীর মেজোরানীর টাকা চুরি করতে চলেছি।

 রাত্রে আমার স্বামী সেই ঘরেই তাঁর কাপড় ছাড়েন, সেই কাপড়ের পকেটেই তাঁর চাবি থাকে। সেই চাবি বের করে নিয়ে লােহার সিন্দুক খুললুম। অল্প যে একটু শব্দ হল, মনে হল, সমস্ত পৃথিবী যেন জেগে উঠল। হঠাৎ একটা শীতে আমার হাত পা হিম হয়ে বুকের মধ্যে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগল।

 লােহার সিন্দুকের মধ্যে একটা টানা দেরাজ আছে। সেইটে খুলে দেখলুম, নােট নেই, কাগজের মােড়কে ভাগ করা গিনি সাজানাে। প্রতি মােড়কে কত গিনি আছে, আমার কত দরকার, সে তখন হিসেব করবার সময় নয়। কুড়িটি মােড়ক ছিল, সব-কটা নিয়েই আমার আঁচলে বাঁধলুম।

 কম ভারী নয়। চুরির ভারে আমার মন যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হয়তাে নােটের তাড়া হলে সেটাকে এত বেশি চুরি বলে মনে হত না। এ যে সব সােনা!

 সেই রাত্রে নিজের ঘরে যখন চোর হয়ে ঢুকতে হল তখন থেকে এ ঘর আমার আর আপন রইল না। এ ঘরে আমার কত বড়াে অধিকার— চুরি করে সব খােওয়ালুম।

 মনে মনে জপতে লাগলুম, বন্দে মাতরং! বন্দে মাতরং! দেশ, আমার দেশ! আমার সােনার দেশ! সব সােনা এই দেশের সােনা, এ আর-কারাে নয়।

 কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে মন যে দুর্বল হয়ে থাকে। স্বামী পাশের ঘরে ঘুমােচ্ছিলেন, চোখ বুজে তাঁর ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলুম—অন্তঃপুরের খােলা ছাদের উপর দিয়ে সেই আঁচলে-বাঁধা চুরির উপর বুক দিয়ে মাটিতে পড়ে রইলুম— সেই মােড়কগুলাে বুকে বাজতে লাগল। নিস্তব্ধ রাত্রি আমার শিয়রের কাছে তর্জনী তুলে রইল। ঘরকে তাে আমি দেশ থেকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারলুম না। আজ ঘরকে লুটেছি, দেশকেই লুটেছি— এই পাপে একই সঙ্গে ঘর আমার ঘর রইল না, দেশও হয়ে গেল পর। আমি যদি ভিক্ষে করে দেশের সেবা করতুম, এবং সেই সেবা সম্পূর্ণ না করেও মরে যেতুম, তবে সেই অসমাপ্ত সেবাই হত পুজো; দেবতা তা গ্রহণ করতেন। কিন্তু চুরি তাে পূজা নয়; এ জিনিস কেমন করে দেশের হাতে তুলে দেব? চোরাই মালে দেশের ভরা ডােবাতে বসলুম গাে! নিজে মরতে বসেছি, কিন্তু দেশকে আঁকড়ে ধরে তাকে সুদ্ধ কেন অশুচি করি!

 এ টাকা লােহার সিন্দুকে ফেরবার পথ বন্ধ। আবার এই রাত্রে সেই ঘরে ফিরে গিয়ে সেই চাবি নিয়ে সেই সিন্দুক খােলবার শক্তি আমার নেই। আমি তা হলে স্বামীর ঘরের চৌকাঠের কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। এখন সামনে রাস্তা ছাড়া রাস্তাই নেই।

 কত টাকা নিলুম তাই যে বসে বসে গুনব সে আমি লজ্জায় পারলুম না। ও যেমন ঢাকা আছে তেমনি ঢাকা থাক্‌, চুরির হিসেব করব না।

 শীতের অন্ধকার রাত্রে আকাশে একটুও বাষ্প ছিল না; সমস্ত তারাগুলি ঝক্‌ ঝক্‌ করছে। আমি ছাদের উপর শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম: দেশের নাম করে ঐ তারাগুলি যদি একটি একটি মােহরের মতাে আমাকে চুরি করতে হত, অন্ধকারের বুকের মধ্যে সঞ্চিত ঐ তারাগুলি, তার পরদিন থেকে চিরকালের জন্যে রাত্রি একেবারে বিধবা, নিশীথের আকাশ একেবারে অন্ধ, তা হলে সে চুরি যে সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি হত। আজ আমি এই-যে চুরি করে আনলুম এও তাে টাকা চুরি নয়, এ যে আকাশের চিরকালের আলাে চুরিরই মতাে; এ চুরি সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি; বিশ্বাস চুরি, ধর্ম চুরি।

 ছাদের উপর পড়ে রাত্রি কেটে গেল। সকালে যখন বুঝলুম আমার স্বামী এতক্ষণে উঠে চলে গেছেন তখন সর্বাঙ্গে শাল মুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে গেলুম। তখন মেজোরানী ঘটিতে করে তাঁর বারান্দার টবের গাছ-কটিতে জল দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ওলাে ছােটোরানী, শুনেছিস খবর?

 আমি চুপ করে দাঁড়ালুম, আমার বুকের মধ্যে কাঁপতে লাগল। মনে হতে লাগল, আঁচলে বাধা গিনিগুলাে শালের ভিতর থেকে বড়াে বেশি উঁচু হয়ে আছে। মনে হল, এখনই আমার কাপড় ছিঁড়ে গিনিগুলাে বারান্দাময় ঝন্ ঝন্ করে ছড়িয়ে পড়বে; নিজের ঐশ্বর্য চুরি করে ফতুর হয়ে গেছে এমন চোর আজ এই বাড়ির দাসী-চাকরদের কাছেও ধরা পড়ে যাবে।

 মেজোরানী বললেন, তােদের দেবীচৌধুরানীর দল ঠাকুরপাের তহবিল লুঠ করবে শাসিয়ে বেনামি চিঠি লিখেছে।

 আমি চোরের মতােই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম।

 আমি ঠাকুরপােকে বলছিলুম তােমার শরণাপন্ন হতে। দেবী, প্রসন্ন হও গাে, তােমার দলবল ঠেকাও। আমরা তােমার বন্দে মাতরমের শিন্নি মানছি। দেখতে দেখতে অনেক কাণ্ডই তাে হল; এখন দোহাই তােমার, ঘরে সিঁদটা ঘটতে দিয়াে না।

 আমি কিছু না বলে তাড়াতাড়ি আমার শােবার ঘরে চলে গেলুম। চোরাবালিতে পা দিয়ে ফেলেছি, আর ওঠবার জো নেই, এখন যত ছট্‌ফট্‌ করব ততই ডুবতে থাকব।

 এ টাকাটা এক্ষনি আমার আঁচল থেকে খসিয়ে সন্দীপের হাতে দিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচি। এ বােঝা আমি আর বইতে পারি নে, আমার পাঁজর যেন ভেঙে যাচ্ছে।

 সকালবেলাতেই খবর পেলুম, সন্দীপ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আজ আর আমার সাজসজ্জা ছিল না— শাল মুড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেলুম।

 ঘরের মধ্যে ঢুকেই দেখি, সন্দীপের সঙ্গে অমূল্য বসে আছে। মনে হল, আমার মানসম্ভ্রম যা-কিছু বাকি ছিল সমস্ত যেন ঝিম্ ঝিম্ করে আমার গা বেয়ে নেবে গিয়ে পায়ের তলা দিয়ে একেবারে মাটির মধ্যে চলে গেল। নারীর চরম অমর্যাদা ঐ বালকের সামনে আজ আমাকে উদ্‌ঘাটিত করে দিতে হবে। আমার এই চুরির কথা এরা আজ দলের মধ্যে বসে আলােচনা করছে! এর উপরে অল্প একটুখানিও আব্‌রু রাখতে দেয় নি।

 পুরুষ-মানুষকে আমরা বুঝব না। ওরা যখন ওদের উদ্দেশ্যের রথ টানবার পথ তৈরি করতে বসে তখন বিশ্বের হৃদয়কে টুকরাে টুকরাে করে ভেঙে পথের খােওয়া বিছিয়ে দিতে ওদের একটুও বাধে না। ওরা নিজের হাতে সৃষ্টি করবার নেশায় যখন মেতে ওঠে তখন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে চুরমার করতেই ওদের আনন্দ। আমার এই মর্মান্তিক লজ্জা ওদের চোখের কোণেও পড়বে না; প্রাণের ’পরে দরদ নেই ওদের, ওদের যত ব্যগ্রতা সব উদ্দেশ্যের দিকে। হায় রে, এদের কাছে আমি কেই বা! বন্যার মুখের কাছে একটা মেঠো ফুলের মতাে।

 কিন্তু আমাকে এমন করে নিবিয়ে ফেলে সন্দীপের লাভ হল কী? এই পাঁচ হাজার টাকা? কিন্তু আমার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না কি? ছিল বৈকি। সেই খবরই তাে সন্দীপের কাছে শুনেছিলুম, আর সেই শুনেই তাে আমি সংসারের সমস্তকে তুচ্ছ করতে পেরেছিলুম। আমি আলাে দেব, আমি জীবন দেব, আমি শক্তি দেব, আমি অমৃত দেব, সেই বিশ্বাসে সেই আনন্দে দুই-কূল ছাপিয়ে আমি বাহির হয়ে পড়েছিলুম। আমার সেই আনন্দকে যদি কেউ পূর্ণ করে তুলত তা হলে আমি মরে গিয়েও বাঁচতুম, আমার সমস্ত সংসার ভাসিয়ে দিয়েও আমার লােকসান হত না।

 আজ কি এরা বলতে চায়, এ-সমস্তই মিথ্যে কথা? আমার মধ্যে যে দেবী আছে ভক্তকে বরাভয় দেবার শক্তি তার নেই? আমি যে স্তবগান শুনেছিলুম, যে গান শুনে স্বর্গ হতে ধুলােয় নেমে এসেছিলুম, সে কি এই ধুলােকে স্বর্গ করবার জন্যে নয়? সে কি স্বর্গকেই মাটি করবার জন্যে?

 সন্দীপ আমার মুখের দিকে তার তীব্র দৃষ্টি রেখে বললে, টাকা চাই রানী।

 অমূল্য আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল— সেই বালক— যে আমার মায়ের গর্ভে জন্মায় নি বটে, কিন্তু সে তাে তার মায়ের গর্ভে জন্মেছিল— সেই মা, সে যে একই মা! আহা, ঐ কচি মুখ, ঐ স্নিগ্ধ চোখ, ঐ তরুণ বয়েস! আমি মেয়েমানুষ, আমি ওর মায়ের জাত, ও আমাকে বললে কিনা ‘আমার হাতে বিষ তুলে দাও’— আর, আমি ওর হাতে বিষই তুলে দেব।

 টাকা চাই রানী!— রাগে লজ্জায় আমার ইচ্ছে হল, সেই সােনার বােঝা সন্দীপের মাথার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিই। আমি কিছুতেই আঁচলের গিরে যেন খুলতে পারছিলুম না, থর্‌ থর্‌ করে আমার আঙুলগুলাে কাঁপতে লাগল। তার পর টেবিলের উপর সেই কাগজের মােড়কগুলাে যখন পড়ল তখন সন্দীপের মুখ কালাে হয়ে উঠল। সে নিশ্চয় ভাবলে, ঐ মােড়কগুলাের মধ্যে আধুলি আছে। কী ঘৃণা! অক্ষমতার উপরে কী নিষ্ঠুর অবজ্ঞা! মনে হল, ও যেন আমাকে মারতে পারে। সন্দীপ ভাবলে, আমি বুঝি ওর সঙ্গে দর করতে বসেছি, ওর পাঁচ হাজার টাকার দাবি দু-তিনশাে টাকা দিয়ে রফা করতে চাই। একবার মনে হল, এই মােড়কগুলাে নিয়ে ও জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ও কি ভিক্ষুক? ও যে রাজা!

 অমূল্য জিজ্ঞাসা করলে, আর নেই রানীদিদি?

 করুণায় ভরা তার গলা। আমার মনে হল, আমি বুঝি চীৎকার করে কেঁদে উঠব। প্রাণপণে হৃদয়কে চেপে ধরে একটু কেবল ঘাড় নাড়লুম। সন্দীপ চুপ করে রইল; মােড়কগুলাে ছুঁলেও না, একটা কথাও বললে না।

 চলে যাব ভাবছি, কিন্তু কিছুতেই আমার পা চলছে না। পৃথিবী দু-ফাঁক হয়ে আমাকে যদি টেনে নিত তা হলেই এই মাটির পিণ্ড মাটির মধ্যে আশ্রয় পেয়ে বাঁচত।

 আমার অপমান ঐ বালকের বুকে গিয়ে বাজল। সে হঠাৎ খুব একটা আনন্দের ভান করে বলে উঠল, এই কম কী! এতেই ঢের হবে। তুমি আমাদের বাঁচিয়েছ রানীদিদি।

 বলেই সে একটা মোড়ক খুলে ফেললে, গিনিগুলো ঝক্‌ ঝক্ করে উঠল।

 এক মুহূর্তে সন্দীপের মুখের যেন একটা কালো মোড়ক খুলে গেল। তারও মুখ-চোখ আনন্দে ঝক্‌ ঝক্‌ করতে লাগল। মনের ভিতরকার এই হঠাৎ উলটো হাওয়ার দমকা সামলাতে না পেরে সে চৌকি থেকে লাফিয়ে উঠে আমার কাছে ছুটে এল। কী তার মতলব ছিল জানি নে। আমি বিদ্যুতের মতো অমূল্যের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলুম— হঠাৎ একটা চাবুক খেয়ে তার মুখ যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমি আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে সন্দীপকে ঠেলা দিলুম। পাথরের টেবিলের উপর মাথাটা তার ঠক্ করে ঠেকল, তার পরে সেখান থেকে সে মাটিতে পড়ে গেল; কিছুক্ষণ তার আর সাড়া রইল না। এই প্রবল চেষ্টার পরে আমার শরীরে আর একটুও বল ছিল না; আমি চৌকির উপরে বসে পড়লুম। অমূল্যের মুখ আনন্দে দীপ্ত হয়ে উঠল; সে সন্দীপের দিকে ফিরেও তাকালে না, আমার পায়ের ধুলো নিয়ে আমার পায়ের কাছে বসল। ওরে ভাই, ওরে বাছা, তোর এই শ্রদ্ধাটুকু আজ আমার শূন্য বিশ্বপাত্রের শেষ সুধাবিন্দু। আর আমি পারলুম না, আমার কান্না ভেঙে পড়ল। আমি দুই হাতে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলুম। মাঝে মাঝে আমার পায়ের উপর অমূল্যর করুণ হাতের স্পর্শ যতই পাই আমার কান্না ততই ফেটে পড়তে চায়।

 খানিকক্ষণ পরে সামলে উঠে চোখ খুলে দেখি, যেন একেবারে কিছুই হয় নি এমনিভাবে সন্দীপ টেবিলের কাছে বসে গিনিগুলো রুমালে বাঁধছে। অমূল্য আমার পায়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়ালো; ছল্‌ ছল্‌ করছে তার চোখ।

 সন্দীপ অসংকোচে আমাদের মুখের দিকে চোখ তুলে বলল, ছ হাজার টাকা।

 অমুল্য বললে, এত টাকা তো আমাদের দরকার নেই, সন্দীপবাবু। হিসেব করে দেখেছি, সাড়ে তিন হাজার টাকা হলেই আমাদের এখনকার কাজ উদ্ধার হবে।

 সন্দীপ বললে, আমাদের কাজ তো কেবলমাত্র এখনকার কাজই নয়। আমাদের যা দরকার তার কি সংখ্যা আছে?

 অমূল্য বলল, তা হােক, ভবিষ্যতে যা দরকার হবে তার জন্যে আমি দায়ী; আপনি ঐ আড়াই হাজার টাকা রানীদিদিকে ফিরিয়ে দিন।

 সন্দীপ আমার মুখের দিকে চাইলে। আমি বলে উঠলুম, না না, ও টাকা আমি আর ছুঁতেও চাই নে। ও নিয়ে তােমাদের যা-খুশি তাই করাে।

 সন্দীপ অমূল্যের দিকে চেয়ে বললে, মেয়েরা যেমন করে দিতে পারে এমন কি পুরুষ পারে?

 অমূল্য উচ্ছ্বসিত হয়ে বললে, মেয়েরা যে দেবী!

 সন্দীপ বললে, আমরা পুরুষরা বড়াে-জোর আমাদের শক্তিকে দিতে পারি, মেয়েরা যে আপনাকে দেয়। ওরা আপনার প্রাণের ভিতর থেকে সন্তানকে জন্ম দেয়, পালন করে, বাহির থেকে নয়। এই দানই তাে সত্য দান।

 এই বলে সন্দীপ আমার দিকে চেয়ে বললে, রানী, আজ তুমি যা দিলে এ যদি কেবলমাত্র টাকা হত তা হলে আমি ছুঁতুম না, তুমি আপনার প্রাণের চেয়ে বড়াে জিনিস দিয়েছ।

 মানুষের বােধ হয় দুটো বুদ্ধি আছে। আমার একটা বুদ্ধি বুঝতে পারে, সন্দীপ আমাকে ভােলাচ্ছে, কিন্তু আমার আর-একটা বুদ্ধি ভােলে। সন্দীপের চরিত্র নেই, সন্দীপের শক্তি আছে। সেইজন্যে ও যে-মুহূর্তে প্রাণকে জাগিয়ে তােলে সেই মুহূর্তে মৃত্যুবাণও মারে। দেবতার অক্ষয় তূণ ওর হাতে আছে, কিন্তু তূণের মধ্যে দানবের অস্ত্র।

 সন্দীপের রুমালে সব গিনি ধরছিল না; সে বললে, রানী, তােমার একখানি রুমাল আমাকে দিতে পার?

 আমি রুমাল বের করে দিতেই সে রুমালটি নিয়ে মাথায় ঠেকালে। তার পরেই হঠাৎ আমার পায়ের কাছে বসে পড়ে আমাকে প্রণাম করে বললে, দেবী, তােমাকে এই প্রণামটি দেবার জন্যেই ছুটে এসেছিলুম, তুমি আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে। তােমার ঐ ধাক্কাই আমার বর। ঐ ধাক্কা আমি মাথায় করে নিয়েছি।

 বলে মাথায় যেখানে লেগেছিল সেইখানটা আমাকে দেখিয়ে দিলে।

 আমি কি সত্যি ভুল বুঝেছিলুম? সন্দীপ কি দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে তখন আমাকে প্রণাম করতেই এসেছিল? তার মুখে চোখে হঠাৎ যে মত্ততা ফেনিয়ে উঠল সে তাে মনে হল অমূল্যও দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু স্তবগানে সন্দীপ এমন আশ্চর্য সুর লাগাতে জানে যে তর্ক করতে পারি নে, সত্য দেখবার চোখ যেন কোন্ আফিমের নেশায় বুজে আসে। সন্দীপকে আমি যে আঘাত করেছি সে আঘাত সে আমাকে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিলে, তার মাথার ক্ষত আমার বুকের ভিতরে রক্তপাত করতে লাগল। সন্দীপের প্রণাম যখন পেলুম আমার চুরি তখন মহিমান্বিত হয়ে উঠল। টেবিলের উপরকার গিনিগুলি সমস্ত লোকনিন্দাকে, ধর্মবুদ্ধির সমস্ত বেদনাকে উপেক্ষা করে ঝক্‌ ঝক্‌ করে হাসতে লাগল।

 আমারই মতো অমূল্যেরও মন ভুলে গেল। ক্ষণকালের জন্যে সন্দীপের প্রতি তার যে শ্রদ্ধা প্রতিরুদ্ধ হয়েছিল সে আবার বাধামুক্ত হয়ে উছলে উঠল, আমার পূজায় এবং সন্দীপের পূজায় তার হৃদয়ের পুষ্পপাত্রটি পূর্ণ হয়ে গেল। সরল বিশ্বাসের কী স্নিগ্ধসুধা ভোরবেলাকার শুকতারার আলোটির মতো তার চোখ থেকে বিকীর্ণ হতে লাগল। আমি পূজা দিলেম, আমি পূজা পেলেম, আমার পাপ জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল। অমূল্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলল, বন্দে মাতরং।


কিন্তু স্তবের বাণী তো সব সময় শুনতে পাই নে। নিজের মনের ভিতর থেকে নিজের ’পরে নিজের শ্রদ্ধাকে বাঁচিয়ে রাখবার সম্বল আমার যে কিছুই নেই। আমার শোবার ঘরে ঢুকতে পারি নে। সেই লোহার সিন্দুক আমার দিকে ভ্রুকুটি করে থাকে, আমাদের পালঙ্ক আমার দিকে যেন একটা নিষেধের হাত বাড়ায়। আপনার ভিতরে আপনার এই অপমান থেকে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে; কেবলই মনে হয় সন্দীপের কাছে গিয়ে আপনার স্তব শুনি গে। আমার অতলস্পর্শ গ্লানির গহ্বর থেকে জগতে সেই একটুমাত্র পূজার বেদী জেগে আছে; সেখান থেকে যেখানেই পা বাড়াই সেখানেই শূন্য। তাই দিনরাত্রি ঐ বেদী আঁকড়ে পড়ে থাকতে চাই। স্তব চাই, স্তব চাই, দিনরাত্রি স্তব চাই; ঐ মদের পেয়ালা একটুমাত্র খালি হতে থাকলেই আমি আর বাঁচি নে। তাই সমস্ত দিনই সন্দীপের কাছে গিয়ে তার কথা শোনবার জন্যে আমার প্রাণ কাঁদছে; আমার অস্তিত্বের মূল্যটুকু পাবার জন্যে আজ পৃথিবীর মধ্যে সন্দীপকে আমার এত দরকার।

 আমার স্বামী দুপুরবেলা যখন খেতে আসেন আমি তাঁর সামনে বলতে পারি নে। অথচ না-বসাটা এতই বেশি লজ্জা যে সেও আমি পারি নে। আমি তাঁর একটু পিছনের দিকে এমন করে বসি যে তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি ঘটে না। সেদিন তেমনি করে বসে আছি, তিনি খাচ্ছেন, এমন সময় মেজোরানী এসে বসলেন। বললেন, ঠাকুরপো, তুমি ঐ-সব ডাকাতির শাসানি-চিঠি হেসে উড়িয়ে দাও, কিন্তু আমার ভয় হয়। আমাদের এবারকার প্রণামীর টাকাটা তুমি এখনো ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দাও নি?

 আমার স্বামী বললেন, না, সময় পাই নি।

 মেজোরানী বললেন, দেখাে ভাই, তুমি বড়াে অসাবধান, ও টাকাটা—

 স্বামী হেসে বললেন, সে যে আমার শােবার ঘরের পাশের ঘরে লােহার সিন্দুকে আছে।

 যদি সেখান থেকে নেয়, বলা যায় কি?

 আমার ও ঘরেও যদি চোর ঢােকে তা হলে কোন্ দিন তােমাকেও চুরি হতে পারে।

 ওগাে, আমাকে কেউ নেবে না, ভয় নেই তােমার। নেবার মতাে জিনিস তােমার আপনার ঘরেই আছে। না ভাই, ঠাট্টা না, তুমি ঘরে টাকা রেখাে না।

 সদর-খাজনা চালান যেতে আর দিন-পাঁচেক আছে, সেইসঙ্গেই ও টাকাটা আমি কলকাতার ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেব।

 দেখাে ভাই, ভুলে বােস না। তােমার যেরকম ভােলা মন, কিছুই বলা যায় না।

 এ ঘর থেকে যদি টাকা চুরি যায় তা হলে আমারই টাকা চুরি যাবে, তােমার কেন যাবে বউরানী?

 ঠাকুরপাে, তােমার ঐ-সব কথা শুনলে আমার গায়ে জ্বর আসে। আমি কি আমার-তােমার ভেদ করে কথা কচ্ছি? তােমারই যদি চুরি যায় সে কি আমাকে বাজবে না? পােড়া বিধাতা সব কেড়ে নিয়ে আমার যে লক্ষ্মণ দেওরটি রেখেছেন তার মূল্য বুঝি আমি বুঝি নে? আমি ভাই, তােমাদের বড়ােরানীর মতাে দিনরাত্রি দেবতা নিয়ে ভুলে থাকতে পারি নে; দেবতা আমাকে যা দিয়েছেন সেই আমার দেবতার চেয়েও বেশি। কী লাে ছােটোরানী, তুই যে একেবারে কাঠের পুতুলের মতাে চুপ করে রইলি? জান ভাই ঠাকুরপাে, ছােটোরানী মনে ভাবে, আমি তােমাকে খােশামােদ করি। তা, তেমন দায়ে পড়লে খােশামােদই করতে হত। কিন্তু তুমি কি আমাদের তেমনি দেওর যে খােশামােদের অপেক্ষা রাখ? যদি হতে ঐ মাধব চক্রবর্তীর মতাে তা হলে আমাদের বড়ােরানীরও দেবসেবা আজ ঘুচে যেত, আধ-পয়সাটির জন্যে তােমার হাতে-পায়ে ধরাধরি করেই দিন কাটত। তাও বলি, তা হলে ওর উপকার হত, বানিয়ে বানিয়ে তােমার নিন্দে করবার এত সময় পেত না।

 এমনি করে মেজোরানী অনর্গল বকে যেতে লাগলেন, তারই মাঝে মাঝে ছেঁচকিটা ঘণ্টটা চিংড়িমাছের মুড়ােটার প্রতিও ঠাকুরপাের মনােযােগ আকর্ষণ করা চলতে থাকল। আমার তখন মাথা ঘুরছে। আর তাে সময় নেই, এখনই একটা উপায় করতে হবে। কী হতে পারে, কী করা যেতে পারে, এই কথা যখন বার বার মনকে জিজ্ঞাসা করছি তখন মেজোরানীর বকুনি আমার কাছে অত্যন্ত অসহ্য বােধ হতে লাগল। বিশেষত আমি জানি, মেজোরানীর চোখে কিছুই এড়ায় না। তিনি ক্ষণে ক্ষণে আমার মুখের দিকে চাচ্ছিলেন, কী দেখছিলেন জানি নে; কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমার মুখে যেন সমস্ত কথাই স্পষ্ট ধরা পড়ছিল।

 দুঃসাহসের অন্ত নেই। আমি যেন নিতান্ত সহজ কৌতুকে হেসে উঠলুম; বলে উঠলুম, আসল কথা আমার ’পরেই মেজোরানীর যত অবিশ্বাস, চোর ডাকাত সমস্ত বাজে কথা।

 মেজোরানী মুচকে হেসে বললেন, তা ঠিক বলেছিস লাে, মেয়েমানুষের চুরি বড়াে সর্বনেশে। তা আমার কাছে ধরা পড়তেই হবে, আমি তাে আর পুরুষ-মানুষ নই! আমাকে ভােলাবি কী দিয়ে?

 আমি বললুম, তােমার মনে এতই যদি ভয় থাকে তবে আমার যা-কিছু আছে তােমার কাছে নাহয় জামিন রাখি, যদি কিছু লােকসান করি তাে কেটে নিয়াে।

 মেজোরানী হেসে বললেন, শােনাে একবার, ছােটোরানীর কথা শোনো। এমন লােকসান আছে যা ইহকাল-পরকালে জামিন দিয়ে উদ্ধার হয় না।

 আমাদের এই কথাবার্তার মধ্যে আমার স্বামী একটি কথাও বললেন না। তাঁর খাওয়া হয়ে যেতেই তিনি বাইরে চলে গেলেন, আজকাল তিনি আর বিশ্রাম করতে ঘরের মধ্যে বসেন না।

 আমার অধিকাংশ দামি গয়না ছিল খাজাঞ্চির জিম্মায়। তবু আমার নিজের কাছে যা ছিল তার দাম ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার কম হবে না। আমি সেই গয়নার বাক্স নিয়ে মেজোরানীর কাছে খুলে দিলুম। বললুম, মেজোরানী, আমার এই গয়না রইল তােমার কাছে। এখন থেকে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।

 মেজোরানী গালে হাত দিয়ে বললেন, ওমা, তুই যে অবাক করলি। তুই কি সত্যি ভাবিস, তুই আমার টাকা চুরি করবি এই ভয়ে রাত্রে আমার ঘুম হচ্ছে না?

 আমি বললুম, ভয় করতেই বা দোষ কী? সংসারে কে কাকে চেনে বলাে, মেজোরানী!

 মেজোরানী বললেন, তাই আমাকে বিশ্বাস করে শিক্ষা দিতে এসেছ বুঝি? আমার নিজের গয়না কোথায় রাখি ঠিক নেই, তােমার গয়না পাহারা দিয়ে মরি আর-কি। চার দিকে দাসী চাকর ঘুরছে, তােমার ও গয়না তুমি নিয়ে যাও ভাই।

 মেজোরানীর কাছ থেকে চলে এসেই বাইরের বৈঠকখানা-ঘরে অমূল্যকে ডেকে পাঠালুম। অমূল্যর সঙ্গে সঙ্গে দেখি সন্দীপ এসে উপস্থিত। আমার তখন দেরি করবার সময় ছিল না; আমি সন্দীপকে বললুম, অমূল্যর সঙ্গে আমার একটু বিশেষ কথা আছে, আপনাকে একবার—

 সন্দীপ কাষ্ঠহাসি হেসে বললে, অমূল্যকে আমার থেকে আলাদা করে দেখ নাকি? তুমি যদি আমার কাছ থেকে ওকে ভাঙিয়ে নিতে চাও তা হলে আমি ওকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না।

 আমি এ কথার কোনাে উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম।

 সন্দীপ বললে, আচ্ছা বেশ, অমূল্যর সঙ্গে তােমার বিশেষ কথা শেষ করে নিয়ে তার পরে আমার সঙ্গেও একটু বিশেষ কথা কবার অবসর দিতে হবে কিন্তু। নইলে আমার হার হবে। আমি সব মানতে পারি, হার মানতে পারি নে। আমার ভাগ সকলের ভাগের বেশি। এই নিয়ে চিরজীবন বিধাতার সঙ্গে লড়ছি। বিধাতাকে হারাব, আমি হারব না।

 তীব্র কটাক্ষে অমূল্যকে আঘাত করে সন্দীপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 অমূল্যকে বললুম, লক্ষ্মী ভাই আমার, তােমাকে আমার একটি কাজ করে দিতে হবে।

 সে বললে, তুমি যা বলবে আমি প্রাণ দিয়ে করব দিদি।

 শালের ভিতর থেকে গয়নার বাক্স বের করে তার সামনে রেখে বললুম, আমার এই গয়না বন্ধক দিয়ে হােক, বিক্রি করে হােক, আমাকে ছ হাজার টাকা যত শীঘ্র পার এনে দিতে হবে।

 অমূল্য ব্যথিত হয়ে বলে উঠল, না দিদি না, গয়না বিক্রি-বন্ধক না, আমি তােমাকে ছ হাজার টাকা এনে দেব।

 আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ও-সব কথা রাখাে। আমার আর একটুও সময় নেই। এই নিয়ে যাও গয়নার বাক্স। আজ রাত্রের ট্রেনেই কলকাতা যাও, পরশুর মধ্যে ছ হাজার টাকা আমাকে এনে দিতে হবে।

 অমূল্য বাক্সের ভিতর থেকে হীরের চিকটা আলােতে তুলে ধরে আবার বিষণ্ণমুখে রেখে দিলে। আমি বললুম, এই-সব হীরের গয়না ঠিক দামে সহজে বিক্রি হবে না, সেইজন্যে আমি তােমাকে যে গয়না দিচ্ছি এর দাম ত্রিশ হাজারেরও বেশি হবে। এ সবই যদি যায় সেও ভালাে— কিন্তু ছ হাজার টাকা আমার নিশ্চয়ই চাই।

 অমূল্য বললে, দেখাে দিদি, তােমার কাছ থেকে এই-যে ছ হাজার টাকা নিয়েছেন সন্দীপবাবু, এর জন্য আমি তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করেছি। বলতে পারি নে, এ কী লজ্জা! সন্দীপবাবু বলেন, দেশের জন্যে লজ্জা বিসর্জন করতে হবে। তা হয় তাে হবে। কিন্তু এ যেন একটু আলাদা কথা। দেশের জন্যে মরতে ভয় করি নে, মারতে দয়া করি নে, এই শক্তি পেয়েছি। কিন্তু তােমার হাত থেকে এই টাকা নেওয়ার গ্লানি কিছুতে মন থেকে তাড়াতে পারছি নে। এইখানে সন্দীপবাবু আমার চেয়ে অনেক শক্ত, ওঁর এক-তিলও ক্ষোভ নেই। উনি বলেন, টাকা যার বাক্সে ছিল টাকা যে সত্যি তারই এই মােহটা কাটানাে চাই, নইলে বন্দে মাতরং মন্ত্র কিসের!

 বলতে বলতে অমূল্য উৎসাহিত হয়ে উঠতে লাগল। আমাকে শ্রোতা পেলে ওর এই-সব কথা বলবার উৎসাহ আরাে বেড়ে যায়। ও বলতে লাগল, গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আত্মাকে তাে কেউ মারতে পারে না। কাউকে বধ করা, ও একটা কথা মাত্র। টাকা হরণ করাও সেইরকম একটা কথা। টাকা কার? ওকে কেউ সৃষ্টি করে না, ওকে কেউ সঙ্গে নিয়ে যায় না, ও তাে কারাে আত্মার অঙ্গ নয়। ও আজ আমার, কাল আমার ছেলের, আর-এক দিন আমার মহাজনের। সেই চঞ্চল টাকা যখন তত্ত্বত কারােই নয় তখন তােমার অকর্মণ্য ছেলের হাতে না পড়ে দেশসেবকদের সেবায় যদি লাগে তা হলে তাকে নিন্দা করলেই সে কি নিন্দিত হবে?

 সন্দীপের মুখের কথা যখন এই বালকের মুখে শুনি তখন ভয়ে আমার বুক কাঁপতে থাকে। যারা সাপুড়ে তারা বাঁশি বাজিয়ে সাপ নিয়ে খেলুক, মরতে যদি হয় তারা জেনেশুনে মরুক। কিন্তু, আহা, এরা যে কাঁচা। সমস্ত বিশ্বের আশীর্বাদ এদের যে নিয়ত রক্ষা করতে চায়। এরা সাপকে সাপ না জেনে হাসতে হাসতে তার সঙ্গে খেলা করতে যখন হাত বাড়ায় তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারি, এই সাপটা কী ভয়ংকর অভিশাপ! সন্দীপ ঠিকই বুঝেছে— আমি নিজে তার হাতে মরতে পারি, কিন্তু এই ছেলেটিকে তার হাত থেকে ভাঙিয়ে নিয়ে আমি বাঁচাব।

 আমি একটু হেসে অমূল্যকে বললুম, তােমাদের দেশসেবকদের সেবার জন্যেও টাকার দরকার আছে বুঝি?

 অমূল্য সগর্বে মাথা তুলে বললে, আছে বৈকি। তারাই যে আমাদের রাজা, দারিদ্রে তাদের শক্তি ক্ষয় হয়। আপনি জানেন, সন্দীপবাবুকে ফার্স্ট ক্লাস ছাড়া অন্য গাড়িতে কখনাে চড়তে দিই নে, রাজভােগে তিনি কখনাে লেশমাত্র সংকুচিত হন না। তাঁর এই মর্যাদা তাঁকে রাখতে হয় তাঁর নিজের জন্যে নয়, আমাদের সকলের জন্যে। সন্দীপবাবু বলেন, সংসারে যারা ঈশ্বর, ঐশ্বর্যের সম্মােহনই হচ্ছে তাদের সবচেয়ে বড়াে অস্ত্র। দারিদ্র্যব্রত গ্রহণ করা তাদের পক্ষে দুঃখগ্রহণ করা নয়, সে হচ্ছে আত্মঘাত।

 এমন সময় নিঃশব্দে সন্দীপ হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি আমার গয়নার বাক্সর ওপর শাল চাপা দিলুম। সন্দীপ বাঁকা সুরে জিজ্ঞাসা করলে, অমূল্যর সঙ্গে তােমার বিশেষ কথার পালা এখনাে ফুরােয় নি বুঝি?

 অমূল্য একটু লজ্জিত হয়ে বললে, না, আমাদের কথা হয়ে গেছে। বিশেষ কিছু না।

 আমি বললুম, না অমূল্য, এখনাে হয় নি।

 সন্দীপ বললে, তা হলে দ্বিতীয়বার সন্দীপের প্রস্থান?

 আমি বললুম, হাঁ।

 তা হলে সন্দীপকুমারের পুনঃপ্রবেশ—

 সে আজ নয়। আমার সময় হবে না।

 সন্দীপের চোখদুটো জ্বলে উঠল। বললে, কেবল বিশেষ কাজেরই সময় আছে, আর সময় নষ্ট করবার সময় নেই?

 ঈর্ষা! প্রবল যেখানে দুর্বল সেখানে অবলা আপনার জয়ডঙ্কা না বাজিয়ে থাকতে পারে কি? আমি তাই খুব দৃঢ় স্বরেই বললুম, না, আমার সময় নেই।

 সন্দীপ মুখ কালি করে চলে গেল। অমূল্য কিছু উদ্‌বিগ্ন হয়ে বললে, রানীদিদি, সন্দীপবাবু বিরক্ত হয়েছেন।

 আমি তেজের সঙ্গে বললুম, বিরক্ত হবার ওঁর কারণও নেই, অধিকারও নেই। একটি কথা তােমাকে বলে রাখি অমূল্য, আমার এই গয়না-বিক্রির কথা তুমি প্রাণান্তেও সন্দীপবাবুকে বলতে পারবে না।

 অমূল্য বললে, না, বলব না।

 তা হলে আর দেরি কোরাে না, আজ রাত্রের গাড়িতেই তুমি চলে যাও।

 এই বলে অমূল্যর সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। বাইরে এসে দেখি, বারান্দায় সন্দীপ দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলুম, এখনই সে অমূল্যকে ধরবে। সেইটে বাঁচাবার জন্যে তাঁকে ডাকতে হল, সন্দীপবাবু, কী বলতে চাচ্ছিলেন?

 আমার কথা তাে বিশেষ কথা নয়, কেবল বাজে কথা, সময় যখন নেই তখন—

 আমি বললুম, আছে সময়।

 অমূল্য চলে গেল। ঘরে ঢুকেই সন্দীপ বললে, অমূল্যর হাতে একটা কী বাক্স দিলে, ওটা কিসের বাক্স?

 বাক্সটা সন্দীপের চোখ এড়াতে পারে নি। আমি একটু শক্ত হয়েই বললুম, আপনাকে যদি বলবার হত তা হলে আপনার সামনেই দিতুম।

 তুমি কি ভাবছ অমূল্য আমাকে বলবে না?

 না, বলবে না।

 সন্দীপের রাগ আর চাপা রইল না; একেবারে আগুন হয়ে উঠে বললে, তুমি মনে করছ তুমি আমার উপর প্রভুত্ব করবে। পারবে না। ঐ অমূল্য, ওকে যদি আমার পায়ের তলায় মাড়িয়ে দিই তা হলে সেই ওর সুখের মরণ হবে। ওকে তুমি তােমার পদানত করবে? আমি থাকতে সে হবে না।

 দুর্বল, দুর্বল! এতদিন পর সন্দীপ বুঝতে পেরেছে, ও আমার কাছে দুর্বল। তাই হঠাৎ, এই অসংযত রাগ। ও বুঝতে পেরেছে, আমার যে শক্তি আছে তার সঙ্গে জোর জবরদস্তি খাটবে না; আমার কটাক্ষের ঘায়ে ওর দুর্গের প্রাচীর আমি ভেঙে দিতে পারি। সেইজন্যেই আজ এই আস্ফালন। আমি একটি কথা না বলে একটুখানি কেবল হাসলুম। এতদিন পরে আমি ওর উপরের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছি; আমার এ জায়গাটুকু যেন না হারায়, যেন না নাবি। আমার দুর্গতির মধ্যেও যেন আমার মান একটু থাকে।

 সন্দীপ বললে, আমি জানি তােমার ও বাক্স গয়নার বাক্স।

 আমি বললুম, আপনি যেমন-খুশি আন্দাজ করুন, আমি বলব না।

 তুমি অমূল্যকে আমার চেয়ে বেশি বিশ্বাস কর? জান, ঐ বালক আমার ছায়ার ছায়া, আমার প্রতিধ্বনির প্রতিধ্বনি, আমার পাশের থেকে সরে গেলে ও কিছুই নয়।

 যেখানে ও তােমার প্রতিধ্বনি নয়, সেইখানে ও অমূল্য, সেইখানে আমি ওকে তােমার প্রতিধ্বনির চেয়ে বিশ্বাস করি।

 মায়ের পূজা-প্রতিষ্ঠার জন্যে তােমার সমস্ত গয়না আমাকে দিতে প্রতিশ্রুত আছ, সে কথা ভুললে চলবে না। সে তােমার দেওয়াই হয়ে গেছে।

 দেবতা যদি আমার কোনাে গয়না বাকি রাখেন তা হলে সেই গয়না দেবতাকে দেব। আমার যে গয়না চুরি যায় সে গয়না দেব কেমন করে?

 দেখাে, তুমি আমার কাছ থেকে অমন করে ফসকে যাবার চেষ্টা কোরাে না। এখন আমার কাজ আছে, সেই কাজ আগে হয়ে যাক, তার পরে তােমাদের ঐ মেয়েলি ছলাকলা-বিস্তারের সময় হবে। তখন সেই লীলায় আমিও যােগ দেব।

 যে মুহূর্তে আমি আমার স্বামীর টাকা চুরি করে সন্দীপের হাতে দিয়েছি সেই মুহূর্ত থেকেই আমাদের সম্বন্ধের ভিতরকার সুরটুকু চলে গেছে। কেবল যে আমারই সমস্ত মূল্য ঘুচিয়ে দিয়ে আমি কানা কড়ার মতাে সস্তা হয়ে গেছি তা নয়, আমার ’পরে সন্দীপেরও শক্তি ভালাে করে খেলবার আর জায়গা পাচ্ছে না। মুঠোর মধ্যে যা এসে পড়ে তার উপর আর তীর মারা চলে না। সেইজন্যে সন্দীপের আজ আর সেই বীরের মূর্তি নেই। ওর কথার মধ্যে কলহের কর্কশ ইতর আওয়াজ লাগছে।

 সন্দীপ আমার মুখের উপর তার উজ্জ্বল চোখদুটো তুলে বসে রইল, দেখতে দেখতে তার চোখ যেন মধ্যাহ্ন-আকাশের তৃষ্ণার মতাে জ্বলে উঠতে লাগল। তার পা দুই-একবার চঞ্চল হয়ে উঠল। বুঝতে পারলুম সে উঠি-উঠি করছে, এখনই সে উঠে এসে আমাকে চেপে ধরবে। আমার বুকের ভিতরে দুলতে লাগল— সমস্ত শরীরের শির দব্ দব্ করছে, কানের মধ্যে রক্ত ঝাঁ ঝাঁ করছে। বুঝলুম, আর-একটু বসে থাকলে আমি আর উঠতে পারব না। প্রাণপণ শক্তিতে আপনাকে চৌকি থেকে ছিড়ে নিয়ে উঠেই দরজার দিকে ছুটলুম। সন্দীপের রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠের মধ্যে থেকে গুমরে উঠল, কোথায় পালাও রানী?

 পরক্ষণেই সে লাফ দিয়ে উঠে আমাকে ধরতে এল। এমন সময় বাইরে জুতাের শব্দ শােনা যেতেই সন্দীপ তাড়াতাড়ি চৌকিতে ফিরে এসে বসল। আমি বইয়ের শেল্‌ফের দিকে মুখ করে বইগুলাের নামের দিকে তাকিয়ে রইলুম।

 আমার স্বামী ঘরে ঢােকামাত্রই সন্দীপ বলে উঠল, ওহে নিখিল, তােমার শেলফে ব্রাউনিং নেই? আমি মক্ষীরানীকে আমাদের সেই কলেজ-ক্লাবের কথা বলছিলুম। মনে আছে তাে? ব্রাউনিঙের সেই কবিতাটা তর্জমা নিয়ে আমাদের চারজনের মধ্যে লড়াই? বল কী? মনে নেই? সেই যে—

She should never have looked at me,
If she meant I should not love her!
There are plenty... men you call such.
I suppose... she may discover
All her soul to, if she pleases,
And yet leave much as she found them:
But I'm not so, and she knew it
When she fixed me, glancing round them.

আমি হিঁচড়ে-মিচড়ে তার একটা বাংলা করেছিলুম, কিন্তু সেটা এমন হল না ‘গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি’। এক সময়ে ঠাউরেছিলুম কবি হলেম বুঝি, আর দেরি নেই। বিধাতা দয়া করে আমার সে ফাঁড়া কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের দক্ষিণাচরণ, সে যদি আজ নিমক-মহালের ইন্‌স্পেক্টর না হত তা হলে নিশ্চয় কবি হতে পারত; সে খাসা তর্জমাটি করেছিল; পড়ে মনে হয়, ঠিক যেন বাংলাভাষা পড়ছি; যে দেশ জিয়ােগ্রাফিতে নেই এমন কোনাে দেশের ভাষা নয়—

আমায় ভালাে বাসবে না সে এই যদি তার ছিল জানা,
তবে কি তার উচিত ছিল আমার পানে দৃষ্টি হানা?
তেমন-তেমন অনেক মানুষ আছে তাে এই ধরাধামে
(যদিচ ভাই, আমি তাদের গনি নেকো মানুষ নামে)—
যাদের কাছে সে যদি তার খুলে দিত প্রাণের ঢাকা,
তবু তারা রইত খাড়া যেমন ছিল তেমনি ফাঁকা।
আমি তাে নই তাদের মতন সে কথা সে জানত মনে।
যখন মােরে বাঁধল ধরে বিদ্ধ করে নয়নকোণে।

 মক্ষীরানী, তুমি মিথ্যে খুঁজছ— নিখিল বিবাহের পর থেকে কবিতা-পড়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, বােধ হয় ওর আর দরকার হয় না। আমি ছেড়ে দিয়েছিলুম কাজের তাড়ায়, কিন্তু বােধ হচ্ছে যেন ‘কাব্যজ্বরাে মনুষ্যাণাং’ আমাকে ধরবে ধরবে করছে।

 আমার স্বামী বললেন, আমি তােমাকে সতর্ক করে দিতে এসেছি, সন্দীপ।

 সন্দীপ বললে, কাব্যজ্বর সম্বন্ধে?

 স্বামী ঠাট্টায় যােগ না দিয়ে বললেন, কিছুদিন ধরে ঢাকা থেকে মৌলবি আনাগােনা করতে আরম্ভ করেছে, এ অঞ্চলের মুসলমানদের ভিতরে ভিতরে খেপিয়ে তােলবার উদ্‌যােগ চলছে। তােমার উপর ওরা বিরক্ত হয়ে আছে, হঠাৎ একটা-কিছু উৎপাত করতে পারে।

 পালাতে পরামর্শ দাও নাকি?

 আমি খবর দিতে এসেছি, পরামর্শ দিতে চাই নে।

 আমি যদি এখানকার জমিদার হতুম তা হলে ভাবনার কথা হত মুসলমানদেরই, আমার নয়। তুমি আমাকেই উদ্‌বিগ্ন করে না তুলে ওদের দিকে যদি একটু উদ্‌বেগের চাপ দাও তা হলে সেটা তােমার এবং আমার উভয়েরই যােগ্য হয়। জান, তােমার দুর্বলতায় পাশের জমিদারদের পর্যন্ত তুমি দুর্বল করে তুলেছ?

 সন্দীপ, আমি তােমাকে পরামর্শ দিই নি, তুমিও আমাকে পরামর্শ না দিলে চলত। ওটা বৃথা হচ্ছে। আর-একটি কথা আমার বলবার আছে। তােমরা কিছুদিন থেকে দলবল নিয়ে আমার প্রজাদের ’পরে ভিতরে ভিতরে উৎপাত করছ। আর চলবে না, এখন তােমাকে আমার এলেকা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।

 মুসলমানের ভয়ে, না, আরাে কোনাে ভয় আছে?

 এমন ভয় আছে যে ভয় না থাকাই কাপুরুষতা; আমি সেই ভয় থেকেই বলছি তােমাকে যেতে হবে সন্দীপ। আর দিন-পাঁচেক পরে আমি কলকাতায় যাচ্ছি, সেই সময় তােমারও আমার সঙ্গে যাওয়া চাই। আমাদের কলকাতার বাড়িতে থাকতে পার, তাতে কোনাে বাধা নেই।

 আচ্ছা, পাঁচ দিন ভাববার সময় পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে মক্ষীরানী, তােমার মউচাক থেকে বিদায় হবার গুঞ্জনগান করে নেওয়া যাক। হে আধুনিক বাংলার কবি, খােলো তােমার দ্বার, তােমার বাণী লুঠ করে নিই— চুরি তােমারই তুমি আমারই গানকে তােমার গান করেছ— নাহয় নাম তােমার হল, কিন্তু গান আমার।

 এই বলে তার বেসুর-ঘেঁষা মােটা ভাঙা গলায় ভৈরবীতে গান ধরলে—

মধুঋতু নিত্য হয়ে রইল তােমার মধুর দেশে!
যাওয়া-আসার কান্নাহাসি হাওয়ায় সেথা বেড়ায় ভেসে।
যায় যে জনা সেই শুধু যায়,  ফুল ফোটা তাে ফুরােয় না হায়,
ঝরবে যে ফুল সেই কেবলই ঝরে পড়ে বেলাশেষে।
যখন আমি ছিলেম কাছে তখন কত দিয়েছি গান।
এখন আমার দূরে-যাওয়া, এরও কি গাে নাই কোনাে দান?
পুষ্পবনের ছায়ায় ঢেকে  এই আশা তাই গেলেম রেখে—
আগুন-ভরা ফাগুনকে তাের কাঁদায় যেন আষাঢ় এসে।

 সাহসের অন্ত নেই— সে সাহসের কোনাে আবরণও নেই, একেবারে আগুনের মতাে নগ্ন। তাকে বাধা দেওয়ার সময় পাওয়া যায় না; তাকে নিষেধ করা যেন বজ্রকে নিষেধ করা, বিদ্যুৎ সে নিষেধ হেসে উড়িয়ে দেয়।

 আমি বাইরে বেরিয়ে এলুম। বাড়ির ভিতরের দিকে যখন চলে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি, অমূল্য কোথা থেকে এসে আমার সামনে দাঁড়ালাে। বললে, রানীদিদি, তুমি কিচ্ছু ভেবাে না। আমি চললুম, কিছুতেই নিষ্ফল হয়ে ফিরব না।

 আমি তার নিষ্ঠাপূর্ণ তরুণ মুখের দিকে চেয়ে বললুম, অমূল্য, নিজের জন্যে ভাবব না, যেন তােমাদের জন্যে ভাবতে পারি।

 অমূল্য চলে যাচ্ছিল, আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম, অমূল্য, তােমার মা আছেন?

 আছেন।

 বােন?

 নেই, আমি মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা আমার অল্প বয়সে মারা গেছেন।

 যাও তুমি, তােমার মায়ের কাছে ফিরে যাও, অমূল্য।

 দিদি, আমি যে এখানে আমার মাকেও দেখছি, আমার বােনকেও দেখছি।

 আমি বললুম, অমূল্য, আজ রাত্রে যাবার আগে তুমি এখান থেকে খেয়ে যেয়াে।

 সে বললে, সময় হবে না দিদিরানী, তােমার প্রসাদ আমার সঙ্গে দিয়াে, আমি নিয়ে যাব।

 তুমি কী খেতে ভালােবাস অমূল্য?

 মায়ের কাছে থাকলে পৌষে পেট ভরে পিঠে খেতুম। ফিরে এসে তােমার হাতের তৈরি পিঠে খাব দিদিরানী।