বিষয়বস্তুতে চলুন

ঘর-পোড়া লোক (মধ্যম অংশ)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 হেদায়েতের কন্যাকে হত্যার অপরাধে, গোফুর খা এবং তাঁহার পুত্র ওসমান খাঁ মাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলেন। দাবোগা সাহেবও প্রাণপণে সেই মোকদ্দমার আয়োজন করিতে লাগিলেন। পিতা পুত্র উভয়েই হাজতে রহিলেন। পুলিসের নিকট যে সকল সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, যাহাতে তাহারা মাজিস্ট্রেটের নিকট অন্যরূপ সাক্ষ্য প্রদান করে, তাহার নিমিত্ত হোসেন অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া, অনেক চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। বরং পুলিসের নিকট তাহারা যেরূপ বলিয়াছিল, মাজিষ্ট্রেটের নিকট তাহা অপেক্ষা আরও অনেক অধিক কথা কহিল।

 সমস্ত সাক্ষীর এজাহার হইয়া যাইবার পর, মাজিষ্ট্রেট সাহেব দেখিলেন যে, আসামীদ্বয়ের বিরুদ্ধে হত্যাকরা অপরাধ উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়াছে। সুতরাং চুড়ান্ত বিচারের নিমিত্ত তিনি এই মোকদ্দমা দায়রায় প্রেরণ করিলেন।

 এই মোকদ্দমার বিচারের নিমিত্ত যখন দায়রায় দিন স্থির হইল, সেই সময় বিচারক মফঃস্বল পরিভ্রমণ উপলক্ষে, জেলা হইতে সুদূর মফঃস্বলে অবস্থান করিতেছিলেন। যখন যে গ্রামে বিচারক উপস্থিত হইতেছিলেন, সেই সময় সেই গ্রামেই আপন কাছারি করিয়া মোকদ্দমার বিচারও করিয়া আসিতেছিলেন।

 যে দিবস গফুর খাঁ এবং তাঁহার পুত্র ওসমানের এই হত্যাপরাধ-বিচার আরম্ভ হইল, সে দিবস একটা নিতান্ত ক্ষুদ্র পল্লিগ্রামের ভিতর জজসাহেবের তাম্বু পড়িয়াছিল। সুতরাং সেই স্থানেই এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল।

 এলাহাবাদ হাইকোর্ট হইতে উকীল কৌন্সলি আনাইয়া এই মোকদ্দমায় দোষ-ক্ষালনের যতদুর উপায় হইতে পারে, হোসেন প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই আপনার মনোবাঞ্চা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলেন না। সরকারী উকীল মোকদ্দমার অবস্থা জজসাহেবকে উত্তমরূপে সর্বপ্রথম বুঝাইয়া দিবার পর হইতেই, জজসাহেবের মনে কেমন এক বিশ্বাস হইয়া গেল যে, আসামী পক্ষীয় উকীল কৌন্সলি অনেক চেষ্টা করিলেও, তাঁহার মন হইতে সেই বিশ্বাস অপনোদন করিতে পারিলেন না। তিন দিবস পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার সাক্ষিগণের এজাহার গৃহীত হইল। তাহাদিগের উপর যথেষ্ট জেরা হইল। উভয় পক্ষীয় উকীল কৌন্সলিগণ স্বপক্ষে সাধ্যমত বক্তৃতাদি করিতে ক্রটি করিলেন না; কিন্তু কিছুতেই আসামীদ্বয়ের পক্ষে কোনরূপ উদ্ধারের উপায় লক্ষিত হইল না।

 জজসাহেব এই মোকদ্দমার রায় প্রদান করিবার কালীন কহিলেন, “আসামীগণ! তিন দিবস পর্য্যন্ত বিশেষ যত্ন ও মনোযোগের সহিত, এই মোকদ্দমার সমস্ত ব্যাপার আমি উত্তম রূপে শ্রবণ করিয়াছি, এবং তোমাদিগের পক্ষীয়, সুশিক্ষিত উকীল কৌন্সলিগণ সবিশেষ যত্নের সহিত তোমাদিগের পক্ষ সমর্থন করিয়া, তোমাদিগের স্বপক্ষে যাহা কিছু বলিবার আছে, তাহা অপেক্ষাও অনেক কথা বলিয়াছেন; কিন্তু উভয় পক্ষের সমস্ত ব্যাপার শ্রবণ করিয়া এবং সাক্ষিগণের সাক্ষ্য দিবার কালীন, তাহাদিগের ভাব-ভঙ্গি দেখিয়া আমার স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, তোমাদিগের বিপক্ষে তাহার বিন্দুমাত্রও মিথ্যা কথা কহে নাই। অবশ্য, অনেক সাক্ষ্যের অনেক স্থান অপর সাক্ষিগণের সাক্ষ্যের সহিত এক মিল হয় নাই। কিন্তু তাহা বলিয়া তাহারা যে, একবারে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, এ কথা আমি কখনই স্বীকার করিতে পারিব না। তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর তালাবন্ধ গৃহের মধ্যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ যে পাওয়া গিয়াছে, সে সম্বন্ধে কোন আপত্তি উত্থাপিত হয় নাই। বিশেষতঃ তোমাদিগের বিরুদ্ধে যে সকল ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাহারা সকলেই তোমাদিগের জমিদারীর প্রজা। প্রজাগণ তাহাদিগের জমিদারের বিপক্ষে কখনই মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতে সম্মত হয় না। আর নিতান্ত সত্যের অনুরোধে যদি কোন প্রজাকে তাহার জমিদারের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে হয়, তাহা হইলেও সেই প্রজা যতদুর সম্ভব, তাহার জমিদারকে বাঁচাইয়া যাইতে চেষ্টা করে, ইহাই এদেশীয় নিয়ম। তোমাদের প্রজাগণ তোমাদিগের বিপক্ষে যে সকল সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, আমার বিশ্বাস, তাহারা তাহা অপেক্ষাও অনেক অধিক কথা অবগত আছে। কোনরূপে যদি আপনাদের জমিদারের উপকার করিতে পারে, এই ভাবিয়া সকল কথা তাহারা বলে নাই। সেই সকল সাক্ষী ওসমানের অত্যাচারে অত্যাচারিত হইয়া, তোমাদিগকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে মিথ্যা কথা কহিতেছে, এ কথা সময় সময় তোমাদিগের কৌন্সলি উত্থাপিত করিলেও, তাহারা সেই সকল কথা একবারে অস্বীকার করে। অথচ তোমরাও তাহার সত্যাসত্য প্রমাণ করিতে সমর্থ হও নাই, বা তাহার চেষ্টাও কর নাই। এইরূপ নানা কারণে আমি সাক্ষিগণের সাক্ষ্য কোনরূপেই একবারে অবিশ্বাস করিতে পারি না।

 “সাক্ষিগণের দ্বারায় বেশ প্রমাণিত হইয়াছে যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিবার মানসে, তাহার অবর্তমানে তাহার যুবতী কন্যাকে তোমরা বলপূর্বক তাহার পরদার বাহিরে আনিয়া সর্বসমক্ষে তাহাকে যেরূপ অবমাননা করিয়াছ, সেরূপ কার্য্য ভদ্রবংশীয় কোন লোকের দ্বারা কোনরূপেই সম্ভবে না। কেবল মাত্র সামান্য খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে তোমরা সেই যুবতীর উপর কেবল যে এইরূপ ভয়ানক অত্যাচার করিয়াছ, তাহা নহে। আমার অনুমান হয় যে, তোমাদিগের এরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার অপর কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এইরূপে যুবতীর উপর ভয়ানক অত্যাচার করিয়াই যে, তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি দিয়াছ, তাহা নহে। সর্বসমক্ষে সেই অবলাকে বিনাদোষে ধৃত করিয়া, বিশেষরূপে অবমাননার সহিত কয়েক খানি গ্রামের মধ্য দিয়া তোময়া তোমাদিগের বাটী পর্যন্ত তাহাকে লইয়া গিয়াছ। এ কথা গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই একবাক্যে কহিতেছে। অবলা স্ত্রীলোকের উপর বিনাদোষে এরূপ অত্যাচার করা নিতান্ত পিশাচের কার্য্য ভিন্ন আর কিছুই বলিতে পারা যায় না। এইরূপ অত্যাচার করিয়াই কি তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি দিয়াছ? তোমাদিগের নিজের অনুচর এবং ভৃত্যবর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে যে, সেই হতভাগিনীকে অনশনে রাখিয়া হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে তাহাকে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর একটা নির্জন গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলে। অনশনে যে লোকের মৃত্যু ঘটে, তাহা কি তোমরা জান না? ক্ষুৎপিপাসা সহ্য করিতে কোন্ ব্যক্তি কয়দিবস সমর্থ হয়, তাহা কি তোমাদিগের মনে একবারের নিমিত্তও উদয় হয় নাই? কেবল তাহাই নহে, তোমাদিগের নিজের পরিচারক কি বলিতেছে, তাহা একবার শোন। “এক দিবস কোন গতিতে আমি সেই গৃহের চাবি সংগ্রহ করিয়া ঘর খুলিয়া দেখিলাম যে, ক্ষুধায় এবং তৃষ্ণায় যুবতী মৃত্যুশয্যায় শায়িতা। এই অবস্থা দেখিয়া আমার কঠিন হৃদয়েও দয়ার উদ্রেক হইল। দ্বারবানের সহিত পরামর্শ করিয়া আমি কিছু আহারীয় এবং পানীয় আনিয়া উহাকে দিবার উদ্যোগ করিতেছি, এরূপ সময়ে ওসমান সাহেব তাহা জানিতে পারিয়া, সেই সকল দ্রব্য আমার হস্ত হইতে কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন, ও আমাকে যৎপরোনাস্তি গালি দিয়া পুনরায় সেই গৃহের তালা বন্ধ করিয়া দিলেন। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে নিতান্ত কষ্ট হইল। আমি গিয়া গোফুর মিঞার নিকট এই কথা বলিলে, কোথায় তিনি তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিবেন, না তাঁহার পরিবর্তে আমাকে সহস্র গালি প্রদান করিয়া, তাঁহাদিগের বিনা, অনুমতিতে আমি সেই গৃহের দরজা খুলিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে চাকরী হইতে জবাব দিলেন, এবং তদ্দণ্ডেই আমাকে তাঁহাদিগের বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিলেন।”  “কি ভয়ানক! কি পৈশাচিক ব্যবহার! এই ব্যক্তি ও তাহার পোষকতাকারী দ্বারবানের সাক্ষ্য যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই যুবতীকে অনশনে রাখিয়া, ইচ্ছা-পূর্ব্বক তাহাকে যে হত্যা করিয়াছ, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যাহাদিগের দ্বারা এরূপ কার্য্য হইতে পারে, তাহারা কোনরূপেই দয়ার পাত্র নহে। আমার বিবেচনায় এরূপ প্রকৃতি-বিশিষ্ট লোকের উপর দয়া প্রকাশ করিলে ঈশ্বর তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। গোফুর খাঁ! তোমার বৃদ্ধ বয়স দেখিয়া, এবং তোমার পূর্ব্ব-চরিত্র শ্রবণ করিয়া আমি পূর্বে মনে করিয়াছিলাম, এরূপ মোকদ্দমায় যদি কেহ দয়ার পাত্র হয়, তাহা তুমি। কিন্তু এখন আমি দেখিতেছি, দস্যু তস্করকে দয়া করা যাইতে পারে, মনুষ্য হত্যাই যাহাদিগের জীবিকা, তাহাদিগকেও দয়া করা যাইতে পারে, তথাপি তোমার উপর সে দয়া প্রকাশ করিতে নাই। তোমরা ইচ্ছা করিয়া যেরূপ ভয়ানক অপরাধ করিয়াছ, তাহার প্রকৃত দণ্ড আমাদিগের আইনে নাই। তোমাদিগের জাতীয় রাজার রাজত্বকালে যেরূপ কুকুর দিয়া খাওয়াইয়া ও ক্ষতস্থানে লবণ নিক্ষিপ্ত করিয়া মারিয়া ফেলিবার নিয়ম ছিল, আমার বিবেচনায় তোমরা সেইরূপ দণ্ডের উপযুক্ত। কিন্তু সেরূপ দণ্ড যখন আমাদিগের আইনে নাই, তখন আমাদিগের আইনের চরম দণ্ড আমি তোমাদিগের উপর বিধান করিলাম। যে পর্য্যন্ত তোমরা না মরিবে, সেই পর্য্যন্ত তোমাদিগের উভয়কেই ফাঁসিকাষ্ঠে লটকাইয়া রাখা হইবে।”

 জজসাহেবের মুখে বিষম দণ্ডের কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ আর দাড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না, মুর্চ্ছিত অবস্থায় সেই

 স্থানে পড়িয়া গেলেন। প্রহরীগণ তাঁহার মুখে জল সিঞ্চন করাতে তাহার সংজ্ঞা হইলে, তাঁহার তাহাকে সেই স্থান হইতে বাহির করিয়া লইয়া গেল। ওসমান স্থিরভাবে এই দণ্ডাজ্ঞা সহ্য করিলেন, কোন কথা কহিলেন না; কেবল দায়োগা সাহেবের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন মাত্র।