চন্দ্রলোকে যাত্রা/দশম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দশম পরিচ্ছেদ

যাত্রা

 জ পয়লা ডিসেম্বর। আজ রাত্রি দশটা ছয়চল্লিশ মিনিট চল্লিশ সেকেণ্ডের সময় আমেরিকার সেই অদ্ভুত গোলক যাত্রী লইয়া চন্দ্রলোকাভিমুখে ধাইবে——আজ আমেরিকা চন্দ্রলোক জয় করিতে ছুটিবে! হয় আজ——না হয় আবার সেই দীর্ঘ অষ্টাদশ বর্ষ পর!

 প্রভাত হইতে না হইতেই ষ্টোনিহিলের চতুর্দ্দিকে লোক সমাগম আরম্ভ হইল। সপ্তাহ পূর্ব্বেই চারিদিকে পটাবাসের নগর বসিয়াছিল, সারির পর সারি দোকান, সারির পর সারি পান্থশালা বসিয়াছিল। আজ সে সকল লোকে পূর্ণ হইয়া উঠিল। প্রতি পনের মিনিটে যাত্রীপূর্ণ ট্রেণ আসিতে লাগিল। বার্বিকেন্ সেই নূতন নগরের নাম রাখিয়াছিলেন—আর্দ্দান্ নগর।

 পৃথিবীর সকল দেশ হইতে জার্দ্দান্ নগরে দর্শক আসিয়াছিল। আর্দ্দান্ নগরে পৃথিবীর সকল জাতির সমাবেশ ঘটিল—পৃথিবীর সকল ভাষার কথোপকথন হইতে লাগিল। ধনী ও নির্ধন, পণ্ডিত ও মূর্খ সকলে সেখানে গায়ে গায়ে মিলিয়া রাজপথে ভ্রমণ করিতে লাগিল।

 দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যা হইল। সাতটার সময় চন্দ্রদেব আকাশে দেখা দিলেন। মেঘ-নির্ম্মুক্ত পরিচ্ছন্ন আকাশ জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হইয়া গেল। লক্ষ লোক তখন চন্দ্রের দিকে চাহিয়া জয়ধ্বনি করিতে লাগিল। রজনীর পর রজনী তাহারা কতবার চন্দ্রদেবকে আকাশ পথে শীতল কিরণ ধারা বর্ষণ করিতে দেখিয়াছে— কিন্তু তখন যেমন দেখিল, মনে হইল যেন তেমন আর কখনো দেখে নাই। সেদিন চন্দ্রের রূপ যেমন মধুর লাগিল—চন্দ্রের কর যেমন সুন্দর ও শীতল লাগিল, মনে হইল যেন তেমন আর কখনো লাগে নাই! চন্দ্র সেদিন পরমাত্মীয়েরও অধিক বলিয়। বোধ হইল—চাহিতে চাহিতে চক্ষে জালা ধরিলেও নয়ন ফিরাইতে ইচ্ছা হইল না! সেই লক্ষাধিক লোক সহসা যেন এক মন্ত্রবলে সঞ্জীবিত হইয়া আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত গাহিতে লাগিল। সে গীতিধ্বনি এক একবার ষ্টোর্নিহিলের নিকট হইতে ক্রমে দূরে সরিয়া যাইতে লাগিল— আবার পরমুহূর্ত্তেই স্তরে স্তরে ভাসিতে ভাসিতে নিকটবর্ত্তী হইল।

 ফরাসী আর্দ্দান্, কাপ্তান নিকল্ ও বার্বিকেন্ হাসিতে হাসিতে কামানের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন। রেলে উঠিয়া দূরদেশে ভ্রমণে যাইবার সময় মানুষের মুখে যতটুকু চাঞ্চল্য প্রকাশ পায়, তাঁহাদের নয়নে বদনে কেহ সেটুকুও লক্ষ্য করিতে পারিল না। ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিল। তাঁহারা গোলকের মধ্যে প্রবেশ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। সাশ্রুনয়নে ম্যাট‍্সন্ কহিলেন—

 “বার্বিকেন্, এখনো সময় আছে— আমিও আসি।”

 “না ম্যাট‍্সন্, তা’ হ’বে না। আমরা আমেরিকার অগ্রদূত হ’য়ে চন্দ্রলোকে যাই। কামান ত’ রৈলই, দরকার হ’লে তোমরা আমাদের কাছে দেশের সংবাদ পাঠাতে পার‍্বে।”

 আর্দ্দান্। ঠিক বার্বিকেন্। সেটা এঁদের করতেই হবে। আর কিছু না হোক্, মধ্যে মধ্যে এঁরা খাবার-টাবার ত পাঠাতে পারবেন।

 এ কথা শুনিয়া ম্যাট্‌সনের হৃদয়ের ভার অনেক কমিয়া গেল। তিনি উৎসাহিত হইয়া কহিলেন,—“প্রতি বৎসর বড়দিনের সময় আপনারা খাবার পাবেন, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে পাবেন, সমস্ত যুক্ত-রাজ্যের আশীর্ব্বাদ।”

 বিদায়ের ক্ষণ আসিল। ম্যাট‍্সন্ আবেগভরে বন্ধুদিগের সহিত কর মর্দ্দন করিলেন। এ দিকে দুই মাইল দূরে পর্ব্বত-শিখরে দাঁড়াইয়া এঞ্জিনিয়র মার্টিসন্ তখন একদৃষ্টে তাঁহার ঘড়ীর কাঁটার দিকে চাহিয়াছিলেন।

 আর কালবিলম্ব না করিয়া নিকল্, আর্দ্দান্ ও বার্বিকেন্ যন্ত্রের সাহায্যে গোলকের মধ্যে নামিলেন। সেখানে তখন কি সূচীভেদ্য অন্ধকার! জাতীয় সঙ্গীতের ধ্বনি তখনো তাঁহাদের কর্ণে আসিয়া পৌঁছিতেছিল। গোলকের মধ্যে নামিয়া তাঁহারা প্রবেশপথ রুদ্ধ করিয়া দিলেন। ভূপৃষ্ঠের সহিত তাঁহাদের সকল সম্বন্ধ দুর হইয়া গেল!

 যতই সময় নিকট হইতে লাগিল, দর্শক-মণ্ডলী ততই উদ্বিগ্ন ও চঞ্চল হইতে লাগিল। ক্রমে জাতীয় সঙ্গীত থামিয়া গেল, সহস| হাস্য-কৌতুক স্তব্ধ হইল। সেই বিরাট প্রান্তর—প্রান্তর মধ্যে সেই বিশাল আর্দ্দান‍্নগরী তখন একেবারে নীরব হইল। মনে হইতে লাগিল, সেই লক্ষাধিক লোকের হৃদয়ও যেন তখন আর স্পন্দিত হইতেছে না। সকলে তখন কামানের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

 মার্চিসন্ নীরবে তাঁহার ঘড়ির কাঁটার দিকে চাহিয়াছিলেন। দশটা বাজিয়া ছয়চল্লিশ মিনিট হইল। আর চল্লিশ সেকেণ্ড! মার্চিসনের হৃদয়, কাঁপিয়া উঠিল! তিনি অপেক্ষাকৃত উচ্চ-কণ্ঠে সেকেণ্ড গণনা করিতে লাগিলেন। দশ—পনেরো—কুড়ি—পঁচিশ—ত্রিশ—! আর দশ সেকেণ্ড মাত্র! সেই চন্দ্রালোকে দর্শকদিগের মধ্যে যাহারা ঘড়ি দেখিতেছিল, তাহারা দারুণ উৎকণ্ঠায় চীৎকার করিয়া উঠিল। পর্ব্বত শিখরে থাকিয়া মার্চিসন্ আবার গণনা করিতে লাগিলেন,—পঁয়ত্রিশ—ছত্রিশ—সাঁইত্রিশ—আটত্রিশ—! মার্চিসনের দক্ষিণ কর বৈদ্যুতিক যন্ত্রের চাবির দিকে প্রসারিত হইল। তাঁহার করাঙ্গুলী একবার কাঁপিয়া উঠিল— তাঁহার নিশ্বাস একবার রুদ্ধ হইয়া আসিল। তিনি আবার গণিলেন—ঊনচল্লিশ—চ—ল্লি—শ!

 তাহার পর কি যে ঘটিল, তাহা বর্ণনা করা অসম্ভব! শত-সহস্র বজ্র এক সঙ্গে ধ্বনিত হইলে যে শব্দ হয়—কামানের গর্জ্জনের তুলনায় তাহা কিছুই নয় বলিয়া বোধ হইল! অকস্মাৎ যেন একটা বিশাল আগ্নেয়গিরি যোজন-ব্যাপী অগ্নি-শিখা ঊর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত করিল। সেই শিখা মুহূর্ত্তের জন্য শুধু ষ্টোনিহিল নয়, সমগ্র ফ্লোরিডা প্রদেশকে আলোকোদ্ভাসিত করিয়া দিল। ষ্টোনিহল এবং নিকটবর্ত্তী স্থান সমূহের অধিবাসীরা দেখিল, সহসা যেন সূর্য্যোদয় হইয়াছে! পরে জানা গিয়াছিল যে সমুদ্রগামী কোন কোন জাহাজের অধ্যক্ষ সহসা আকাশ পথে এই অভূত-পূর্ব্ব আলোক শিখা দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়াছিলেন।

 গর্জ্জনের সঙ্গে সঙ্গেই দারুণ কম্পন উপস্থিত হইল—সে কম্পনে ষ্টোনিহিল কাঁপিল, আর্দ্দান্ নগর কাঁপিল-টম্পা কাঁপিল—এমন কি সমগ্র ফ্লোরিডা পর্য্যন্ত কাঁপিয়া উঠিল। দর্শকগণ অনেকেই ধরাশায়ী হইলেন। কে কাহার গায়ে পড়িল—কে কাহাকে মথিত করিল— প্রাণভয়ে পলায়ন করিতে যাইয়া কে আছাড় খাইয়া নিজের হস্ত-পদ ভাঙ্গিল কে তখন তাহার সংবাদ লয়! ভীষণ চীৎকারে ও দারুণ আর্তনাদে সেই কানন-ভূমি প্রেত-ভুমি হইয়া উঠিল। যাহারা কামানের অপেক্ষাকৃত নিকটে ছিল, তাহারা বন্দুকের গুলির মত দূরে ছিট‍্কাইয়া পড়িল!

 বায়ুমণ্ডলে তখন এমন ভীষণ কম্পন উপস্থিত হইয়াছিল যে অবিলম্বে ঘোর ঝড় উঠিল। সেই ঝড়ে পটাবাস উড়িল—গৃহ পড়িল—কাননে বৃক্ষ ভাঙ্গিয়া নির্মূল হইয়া গেল! টম্পার পথে ট্রেণ রেলপথ হইতে গড়াইয়া গড়াইয়া প্রান্তর মধ্যে পতিত হইল! বন্দরে যে সকল জাহাজ বাঁধা ছিল, তাহাদের শিকল ছিঁড়িল—নোঙ্গর খসিল— ছাদ উড়িল—মাস্তুল ভাঙ্গিল। তাহারা বন্ধনমুক্ত হইয়া এ উহাকে প্রবল বেগে আঘাত করিতে লাগিল— কেহ বা তীরে আসিয়া ধাক্কা খাইয়া পড়িল— কতক বা ভাসিয়া গেল! এই প্রবল ঝটিকা ঘূর্ণিবায়ুর আকার ধারণ করিয়া আট‍্লাণ্টিক মহাসাগরের উপর দিয়া হাহারবে ছুটিতে লাগিল! যে সকল জাহাজ সেই দৈত্যের পথে পড়িল সে সমস্তই মুহূর্ত্তে ডুবিয়া গেল!

 দর্শকদিগের দুর্ভাগ্য! নিমেষে সেই পরিচ্ছন্ন আকাশ মেঘলিপ্ত হইয়া উঠিল। সে মেঘের আবরণ ভেদ করিয়া কাহারো দৃষ্টি আকাশ পথে চলিল না। চন্দ্র, তারকা, সমস্তই সে মেঘে ঢাকিয়া দিল। কামানের গোলার কি যে হইল, তাহা কেহ দেখিতে পাইল না! হাতের দূরবীক্ষণ হাতেই রহিয়া গেল।

 পরদিন প্রভাতেও আকাশ মেঘাচ্ছন্নই রহিল। রাত্রিতেও কেহ চন্দ্রোদয় দেখিতে পাইল না। তার পরদিন কেম্ব্রিজ মান-মন্দির হইতে সংবাদ আসিল যে কামানের গোলা বিপুল বেগে ধাইয়া চলিয়াছে! যুক্তরাজ্যের গৃহে গৃহে সেদিন মুহুর্মুহুঃ জয়ধ্বনি হইতে লাগিল।

সমাপ্ত