বিষয়বস্তুতে চলুন

চন্দ্রলোকে যাত্রা/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

দ্বৈরথ সমর

 রদিন অতি প্রভাতে ম্যাট্‌সন্ ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া আসিয়া মাইকেল আর্দ্দানের শয়নকক্ষের দ্বারে ঘন ঘন করাঘাত করিতে লাগিলেন। তখন সমাগত ঊষার মন্দ পবন বহিতে আরম্ভ হইয়াছে বটে, কিন্তু রাজপথের দীপালোক নির্ব্বাপিত হয় নাই।

 আর্দ্দানের সাড়া না পাইয়া ম্যাট্‌সন্ আবার দ্বারে আঘাত করিতে করিতে কহিলেন—“খুলুন—খুলুন—দ্বার খুলুন। দোহাই ধর্ম্মের খুলুন। বড় বিপদ উপস্থিত।”

 আর্দ্দান্ শশব্যস্তে শয্যাত্যাগ করিয়া দ্বার খুলিবামাত্র ম্যাট্‌সন্ একলম্ফে প্রবেশ করিয়া কহিলেন—“কাল সভায় একজন ভদ্রলোক বার্বিকেনকে অপমানিত করেছিলেন বলে’ বার্বিকেন তাঁকে দ্বৈরথ সমরে আহ্বান করেছেন। সে অপমানকারী বার্বিকেনের চিরশত্রু কাপ্তান নিকল্! আজ প্রভাতেই সমর। হয় নিকল্ না হয় বার্বিকেন——দু’জনের একজনকে আজ মর্‌তেই হবে! বার্বিকেন নিজেই আমাকে এ কথা বলেছেন। যেমন করেই হোক্ এ যুদ্ধ এখন বন্ধ রাখ্‌তেই হবে। বার্বিকেনকে আমরা এখন কিছুতেই মর্‌তে দিতে পারি না। আপনি চেষ্টা না কর্‌লে আর উপায় দেখ্‌ছি না।”

 আর্দ্দান্ ক্ষিপ্রহন্তে বেশ পরিবর্ত্তন করিতে করিতে কহিলেন— “আপনাদের দেশের লোক দেখ্‌ছি তুচ্ছ কথায় বন্য পশুর মত নরহত্যা করতে কুণ্ঠিত নন! বার্বিকেন্ কোথায়?”

 “জানি না—বোধ হয় এতক্ষণ সমরাঙ্গণে।”

 “কোথায় সে সমরাঙ্গণ?”

 “সহরের নিকটেই যে বন আছে—সেই বনে।”

 উভয়ে কালবিলম্ব না করিয়া কাননাভিমুখে অগ্রসর হইলেন। রাজ পথ দিয়া গেলে বিলম্ব হইবে আশঙ্কায় তাঁহারা শিশির-সিক্ত উন্মুক্ত প্রান্তরে নামিলেন এবং পরে পয়ঃনালী উল্লম্ফনপূর্ব্বক তীরবেগে ধাবিত হইলেন। ম্যাট্‌সন্ যাইতে যাইতে বার্বিকেনের সহিত নিকলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিরোধের সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলিতে লাগিলেন। এমন সময় একজন কাঠুরিয়ার সঙ্গে তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইল।

 কাঠুরিয়াকে দেখিয়াই আর্দ্দান্ জিজ্ঞাসা করিলেন, “বনে একজন শিকারীকে দেখেছ কি?”

 “হাঁ, দেখেছি।”

 “কখন দেখ্‌লে?”

 “সে অনেকক্ষণ—প্রায় এক ঘণ্টা হবে।”

 ম্যাট্‌সন্ ও আর্দ্দান্ সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন,—এক ঘণ্টা! তবে বুঝি এতক্ষণ শেষ হ’য়ে গেল! তুমি বন্দুকের শব্দ শুনেছ কি?”

 কাঠুরিয়া কহিল,—“না।”

 “একবারও না?

 না।”

 “কোন্ দিকে শিকারীকে দেখ্‌লে?”

 কাঠুরিয়া অঙ্গুলি নির্দ্দেশে বনের গভীর অংশ দেখাইল। ম্যাট্‌সনের হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া আর্দ্দান সেই দিকে ধাবিত হইলেন। তখনো কাননে অরুণের রক্তরাগ প্রবেশ করে নাই। তখনো তিমিরাবৃতা রজনীর অন্ধকার স্নেহালিঙ্গনে বৃক্ষশাখাদিগকে জড়াইয়া রাখিয়াছিল। সুদীর্ঘ ওক, পত্রবহুল তিন্তিড়ী, বৃহৎ ম্যাগ নোলিয়া প্রভৃতির উচ্চশির তখন অরুণ রাগে উজ্জ্বল হইতেছিল মাত্র। বৃক্ষে বৃক্ষে, শাখায় শাখায়, শাখায় পল্লবে, লতায় শাখায়, জড়াজড়ি, মিশা-মিশি করিয়া কাননের সেই অংশকে এতই নিবিড় ঘন করিয়াছিল যে দশ হস্ত মাত্র দূরে কেহ দণ্ডায়মান থাকিলেও সহসা দেখিবার উপায় ছিল না। স্থান হইতে স্থানান্তরে বনে বনে ঘুরিয়াও যখন বার্বিকেনকে দেখা গেল না, তখন আর্দ্দান্ কহিলেন,—“হয়ত বার্বিকেন্ দ্বৈরথ সমরের সঙ্কল্প ত্যাগ ক’রেছেন—বনে আসেন নাই।”

 গর্ব্বিত-কণ্ঠে একটু তিরস্কারের সুরে ম্যাট্‌সন্ কহিলেন,—“অসম্ভব! আমেরিকান্ কোনো দিন কথার খেলাপ করে না। তার যে কথা, সেই কাজ।”

 আর্দ্দান্ সে কথার উত্তর না দিয়া আবার অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। উচ্চ-কণ্ঠে ডাকিতে লাগিলেন,—“বার্বিকেন! বার্বিকেন! নিকল্! নিকল্!” তাঁহার চীৎকার শুনিয়া পক্ষিগণ ইতস্ততঃ উড়িয়া বসিতে লাগিল। তাঁহারা উভয়ে আরও উচ্চ-কণ্ঠে ডাকিতে লাগিলেন। দুই একটা ভীত মৃগ তাঁহাদিগের পার্শ্ব দিয়া উদ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 উভয়ে আরও গহন বনে প্রবেশ করিলেন। কিছু দুর অগ্রসর হইয়াই ম্যাট্‌সন্ থমকিয়া দাঁড়াইলেন। কহিলেন,—“ওটা কে দেখুন দেখি—”

 “নিঃসন্দেহে বলা যায় একজন মানুষ।”

 “জীবিত? না মৃত? কৈ নড়ে চড়ে না ত? কৈ বন্দুক ত হাতে নাই? লতার আড়ালে মুখখানা ঢাকা পড়েছে দেখ্‌ছি!”

 “চলুন নিকটে যাই।”

 উভয়ে প্রচ্ছন্নভাবে আর একটু অগ্রসর হইবামাত্রই ম্যাট্‌সন্ চিনিলেন,—“কাপ্তান্ নিকল্। তাঁহার দুই চক্ষু দিয়া অগ্নি নির্গত হইতে লাগিল। দন্তে দন্তে নিষ্পেষণ করিয়া তিনি কহিলেন, “কাপ্তান নিকল্! নিশ্চয়ই তবে বার্বিকেনের মৃত্যু ঘটেছে?”

 “নি-ক-ল্?” আর্দ্দান অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন— “নি-ক-ল্!” উভয়ে নিকটে যাইয়া দেখিলেন, একটী পক্ষী বিষাক্ত ঊর্ণনাভের জালে আবদ্ধ হইয়া ছট্‌ফট্ করিতেছে, আর নিকল্ অতি যত্নে পক্ষীকে জালমুক্ত করিতেছেন। তাঁহার বন্দুকটী পদ-নিম্নে ঘাসের মধ্যে পড়িয়া আছে। পক্ষীটী জালমুক্ত হইয়া উড়িয়া উঠিল এবং নিকটবর্ত্তী বৃক্ষের শাখায় বসিয়া পুচ্ছ নাড়িতে লাগিল। নিকল্ অতিশয় স্নেহ-পূর্ণদৃষ্টিতে পক্ষীর দিকে চাহিয়া রহিলেন।

 এ দৃশ্য দেখিয়া আর্দ্দান্ ভাবিলেন,—এত করুণা যাঁর, তিনি কি কখনো নৃশংস নরঘাতক হ’তে পারেন! আর্দ্দান্ নিকটে যাইয়া কহিলেন,—

 “কাপ্তান নিকল্! সত্যই আপনি দয়ালু-হৃদয় বীর-পুরুষ।” নিকল চমকিত হইয়া উঠিলেন। বিস্ময়ে বলিলেন,—

 “এ কে? মাইকেল আর্দ্দান্? আপনি এখানে কেন?”

 “আপনার সঙ্গে বন্ধুতা করে’ দ্বৈরথ সমর বন্ধ ক’র্‌তে এসেছি। এ যুদ্ধে লাভ কি? হয় আপনি মর্‌বেন, না হয় বার্বিকেনের মৃত্যু হ’বে?”

 “কি বল্লেন—বার্বিকেন? আমি দু’ঘণ্টা ধ’রে তার সন্ধানে ফির্‌ছি! দ্বৈরথ-যুদ্ধের নিমন্ত্রণ ক’রে আমেরিকান্ যে এমন ক’রে পালায় তা’ জান্‌তাম না!”

 ম্যাট্‌সন্ তীব্র-কণ্ঠে কহিলেন,—“আমেরিকান্ পালাতে জানে না। প্রভাত হ’বার বহু পূর্ব্বেই বার্বিকেন্ এ দিকে এসেছেন।”

 “তবে আর বিলম্বে প্রয়োজন কি? আমার অনেক কাজ আছে। চলুন, তাঁকে খুঁজে দেখা যাক্‌। এ সামান্য কাজটার জন্য এত সময় নষ্ট করা যায় না!”

 আর্দ্দান্ বলিলেন,—

 “ব্যস্ত হ’বেন না। বার্বিকেন্ যদি জীবিত থাকেন, তা’হ’লে আমরা নিশ্চয় এখনই তাঁকে পাব। কিন্তু আমি ঠিক বল্‌ছি, আপনাদের দু’জনের দেখা হ’লে যুদ্ধ আর হ’বে না।”

 “সে আর হয় না—আজ আমাদের এক জনকে মর্‌তেই হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার জ্বালা বুকে নিয়ে এমন ক’রে কি বেঁচে থাকা যায়?”

 ম্যাট্‌সন্ তখন অপেক্ষাকৃত কাতর কণ্ঠে কহিলেন,—

 “কাপ্তান্! আমি বার্বিকেনের পরম বন্ধু। যদি আজ নরহত্যা করাই আপনার আবশ্যক হয়, তবে আমাকেই হত্যা করুন। আমাকে মারাও যা’ বার্বিকেনকে মারাও তাই!”

 ম্যাট্‌সন্ মুহূর্ত্তে তাঁহার কোট্‌টী ভূমে নিক্ষেপ করিয়া প্রশস্ত-বক্ষে দাঁড়াইলেন! নিকলের নয়নে ও বদনে সহসা শয়তানের আবির্ভাব হইল! তিনি চকিতে বন্দুক তুলিলেন! উভয়ের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া আর্দ্দান্ কহিলেন—“বন্ধু ম্যাট্‌সন্ তাঁর সখার জীবন রক্ষা ক’র্‌তে আত্মদান কর্‌ছেন দেখ্‌ছি। কিন্তু আমি এখনো বল্‌ছি, এ হত্যা হ’তে দিব না। আমি আপনাদের কাছে এমন একটা লোভনীয় প্রস্তাব ক’র্‌ব যে মর্‌তে আপনাদের ইচ্ছা হ’বে না!”

 একটু বিদ্রূপ-মিশ্রিত অবিশ্বাসের কণ্ঠে নিকল্ কহিলেন—“কি সে প্রস্তাব শুন্‌তে পাই কি?”

 “ধৈর্য্য ধরুন। বার্বিকেনের অসাক্ষাতে সে কথা বলা ঠিক হ’বে না।”

 “তবে, চলুন, তাঁকে খুঁজে দেখি।”

 “বেশ চলুন।”

 তিন জনে তখন বার্বিকেনের সন্ধানে বাহির হইলেন। কিছু দুর অগ্রসর হইয়াই নিকল্ থমকিয়া দাঁড়াইলেন এবং দূরে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিলেন। ম্যাট্‌সন্ ও আর্দ্দান্ দেখিলেন, সুদীর্ঘ তৃণাদির ভিতর একটা প্রকাণ্ড বৃক্ষ-কাণ্ডে ঠেস্ দিয়া বার্বিকেন দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। তাঁহার দেহের সকল অংশ দেখা যাইতেছে না।

 মাইকেল আর্দ্দান্ বার্বিকেনকে ডাকিতে ডাকিতে তাঁহার দিকে অগ্রসর হইলেন। বার্বিকেন নীরব—যেন পাষাণ-প্রতিমা। আরও নিকটে যাইয়া আর্দ্দান্ দেখিলেন, বার্বিকেন তন্ময় হইয়া কতকগুলি জ্যামিতিক চিত্র অঙ্কিত করিতেছেন! তাঁহার পদনিম্নে রাইফেলটী পড়িয়া আছে।

 আর্দ্দান্ তাঁহার অঙ্গ-স্পর্শ করিয়া ডাকিলেন,—“বার্বিকেন!”

 বার্বিকেন চমকিত হইয়া কহিলেন—“এ কি! আর্দ্দান্ যে! হয়েছে—হয়েছে—আমি উপায় পেয়েছি—আর চিন্তা নাই!”

 “কিসের উপায়?”

 “সেই-টে করার।”

 “কি করার?”

 “গোলাটা যখন কামানের মুখ থেকে বেরিয়ে পড়বে তখন ত প্রবল একটা ধাক্কা লাগ্‌বে, যাতে তা’ না লাগে তার পথ পেয়েছি।”

 হর্ষোৎফুল্লকণ্ঠে আর্দ্দান্ কহিলেন—“সত্যি?”

 ঈষৎ একটু হাসিয়া বার্বিকেন বলিলেন——“বেশী কিছু নয়—জলকে স্প্রিংএর কাজে লাগালেই হয়। তার উপর বস্‌বার আসন থাক্‌বে। আরে—ম্যাট্‌সনও যে এখানে।”

 আর্দ্দান্ বার্বিকেনের কর ধারণ করিয়া কহিলেন—“ওই গাছের কাছে কাপ্তেন নিকলও আছেন। আসুন, তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি।”

 বার্বিকেনের কপোলের শিরাগুলি স্ফীত হইয়া উঠিল। বদনমণ্ডল আরক্তিম হইল। তিনি সলজ্জভাবে বলিলেন—“কি লজ্জা! কথা রাখ্‌তে পারি নি!” নিকল্‌কে অগ্রবর্ত্তী হইতে দেখিয়া তিনি উচ্চকণ্ঠে কহিলেন—“কাপ্তেন্ নিকল্! ক্ষমা কর্‌বেন। আমারই দোষে আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা কর্‌তে হয়েছে। আমাদের গোলাটা সম্বন্ধে ভাবতে ভাবতে আমি যুদ্ধের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম! তা’ আসুন, আমি ত প্রস্তুত।” বার্বিকেন তাঁহার বন্দুকটা তুলিয়া লইলেন।

 মাইকেল আর্দ্দান্ কহিলেন—“পৃথিবীর সৌভাগ্য যে আপনাদের মত দু’টী বীরের এর পূর্ব্বে আর দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই। আপনাদের উভয়ের হৃদয়ই দেখ্‌ছি মহৎ! এত মহত্ত্ব কি পরস্পর পরস্পরের কণ্ঠচ্ছেদ করার জন্যই আপনাদের হৃদয়ে স্থান পেয়েছিল?”

 বার্বিকেন ও নিকল্ নীরব হইয়া ভূমির দিকে চাহিয়া রহিলেন। আর্দ্দান্ বলিতে লাগিলেন—“আমি বেশ বুঝেছি, আপনারা দু’জনেই একটা ভুলের চারিদিকে ঘুর্‌ছেন। সেই ভুলটাকে যতই বড় করে’ দেখ্‌ছেন ততই আপনাদের মনের আগুন জ্বলে উঠ্‌ছে! বার্বিকেন বিশ্বাস করেন যে তাঁর গোলা নিশ্চয়ই চন্দ্রলোকে যাবে। বন্ধু নিকল্ ভাব্‌ছেন—কখনো যাবে না।”

 নিকল্ কহিলেন—“ঠিক তাই। ও গোলা কি কখনো চন্দ্রে যেতে পারে?”

 বার্বিকেন বলিলেন—“কেন যাবে না? ঠিক যাবে।”

 মাইকেল আর্দ্দান্ বলিলেন—“বেশ ত, দুজনেই তবে আমার সঙ্গে চন্দ্রলোকে চলুন। গোলাটা যায় কি না যায়, তা দেখ্‌তেই পাবেন।”

 বার্বিকেন ও নিকল্ যুগপৎ কহিলেন—“আমি প্রস্তুত।”

 হর্ষে আর্দ্দানের মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। তিনি দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর কর ধারণ করিয়া উভয়েরই জয় ঘোষণা করিলেন।

 দ্বৈরথ-সমর আর ঘটিল না।