বিষয়বস্তুতে চলুন

চীন ভ্রমণ/রেঙ্গুন

উইকিসংকলন থেকে


রেঙ্গুন।

 ইরাবতীর পাইলট আসিয়া রাত্রেই জাহাজে ছিল। ভোর ৫টার সময় জাহাজ ছাড়িল, তখন পূর্ব্বদিক লাল হইয়া আসিতেছে মাত্র। একটু পরেই আলোক-রেখা ফুটিয়া উঠিল। দুই ধারে শস্যশ্যামলা তীরভূমি দেখা গেল। যতদুর চক্ষু যায়, কেবল সবুজ রঙ বই আর কিছু নাই। ভূমি এত উর্ব্বরা ও ধান এত প্রচুর পরিমাণে জন্মে যে, প্রতিবৎসর এক লোয়ার বর্ম্মা হইতেই মালয়, চীন ও জাপান, এমন কি ভারতবর্ষ ইউরোপ ও আমেরিকা প্রভৃতি বহু স্থানে পর্য্যাপ্ত পরিমাণ চাউল রপ্তানি হয়। মোট সাড়ে তের কোটি টাকারও অধিক চাউল বিদেশে যায়।

 অল্পক্ষণ পরেই রেঙ্গুন বন্দরের নিকটবর্ত্তী হইলাম। অতি সুন্দর কাষ্ঠ নির্ম্মিত বাড়ী সকল দেখা যাইতে লাগিল। দুই পাশেই বড় বড় কল-কারখানা ও উচ্চ উচ্চ সোণালী রংয়ের বৌদ্ধ-মন্দির-চুড়া (Pagoda) সকল গগনস্পৰ্শী হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। অসংখ্য অর্ণবপোত ও “সামপান” নামক দেশী নৌকা ইরাবতীর স্রোতে ভাসিতেছে।

 কলিকাতা হইতে জাহাজ আসিলেই প্লেগের জন্য এখানে বড় কড়া পরীক্ষা করে। পাছে প্লেগ আক্রান্ত রোগী বা প্লেগ বিষে দূষিত দ্রব্যাদির সংস্পর্শে রেঙ্গুনে প্লেগ রোগ প্রবেশ করে, তাহার জন্য সাবধান হওয়াই এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য। কোন ও লোকের উপর সন্দেহ হইলে, তাহাকে জাহাজ হইতে নামাইয়া লইয়া (Inspection Camp)পরীক্ষা-তীবুতে রাখা হয়। তাহার ব্যবহৃত কাপড়-চোপড়গুলি ধোঁয়া, দিয়া (Vapour bath) শোধিত করা হয়। এই জন্য যাত্রীদের প্রায় চারি পাঁচ ঘণ্টা আটক থাকিতে হয়।

 এই স্থানে আমি এ জাহাজ ছাড়িয়া চীন যাইবার জাহাজে চড়িলাম, ও তাহাতে আমার জিনিষ্ পত্র রাখিয়া সহর দেখিতে বাহির হইলাম।

 জাহাজ হইতে তীরে নামিতে হইলে সামপানে করিয়া নামিতে হয়। ঐ নৌকাগুলি ছোট ও হালকা এবং দেখিতে অতি সুন্দর একজন মাঝি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দুই হাতে দুইটি দাঁড় টানে। ইহাতে হালের আবশ্যক হয় না। দেখিলাম,সকল নৌকা গুলিরই মাঝি চট্টগ্রামের মুসলমান লস্কর। একটিতেও ব্রহ্মদেশীয় মাঝি নাই।

 তীরে নামিয়া দেখি, জাহাজ হইতে যে সব লোক জিনিষপত্র নামাইতেছে ও উঠাইতেছে, তাহারা সকলেই মাদ্রাজ দেশীয়। তাহাদের মধ্যে একজনও ব্রহ্ম দেশীয় লোক নহে। ঘোড়া গাড়ীতে উঠতে গিয়া দেখি,—সব গাড়োয়ানই উত্তর-পশ্চিম দেশের মুসলমান। রাস্তায় দেখি, যত পাহারাওলা সবই শিখজাতীয়; কেহই মগজাতীয় নহে। দুই ধারের দোকানে দেখি, সব দোকানদারই হয় সুরাটী মুসলমান, নয় ইহুদী, নয় পাৰ্শী, নয় চীনে, নয় সাহেব, বর্ম্মান এক জনও নহে। বাজারের ভিতরে ঢুকিয়া দেখি, ব্রহ্মদেশীয় স্ত্রীলোকগণ ছোট ছোট দোকানে বসিয়া নানা রঙের লুঙ্গী পরিয়া ও মুখে ঘন করিয়া “তা-না-খা” অর্থাৎ চন্দনকাঠের গুঁড়া মাখিয়া সুস্থ শরীরে হৃষ্টচিত্তে কেনা বেচা করিতেছে।

 এই সকল দেখিয়া আমার বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। সবইত দেখিলাম ভিন্ন দেশীয় লোক-চাটগাঁয়ের লস্কর, মাদ্রাজী কুলী, পশ্চিমে গাড়োয়ান, শিখ পাহারাওয়ালা, সুরাটী, ইহুদী, পার্শী ও চীনে ব্যবসাদার। এখানকার আদত ব্রহ্মদেশী লোক গেল কোথায়? স্ত্রীলোকেরা দোকান করিতেছে দেখিলাম; কিন্তু পুরুষেরা কোথায়? অনেকক্ষণ আমি এ সমস্যার কিছুই মীমাংসা করিতে পারিলাম না।

 রাস্তায় যে সকল ব্রহ্মবাসী পুরুষ দেখিলাম, তাদের ভিতর যেন প্রাণ নাই। দেহ তেজোহীন,—স্বাস্থ্যশূন্য। তাহাদিগকে দেখিয়া উৎসাহহীন, ভগ্নোদ্যম, ম্রিয়মান বলিয়া বোধ হইল। মধ্যে মধ্যে দুই একজন ব্রহ্ম যুবক টকটকে রঙের লুঙ্গা পরিয়া, মাথায় রেসমের চাদর বাধিয়া, সতেজে (Bicycle) বাইসাইকেল চড়িয়া যাইতেছিল বটে, অথবা কোন ধনী ব্রহ্মদেশীয় লোক সুসজ্জিত ব্রহ্মবাসিনী স্ত্রীলোকের সহিত ব্রুহাম গাড়ি চড়িয়া বেড়াইতে গোল বটে, কিন্তু অধিকাংশ বর্ম্মানকেই যেন ক্ষীণজীবী ম্রিয়মান বলিয়া মনে হ্ইল। ইহার কারণ কি?

 ব্রহ্মদেশে স্ত্রীলোকের প্রভুত্ব অত্যধিক। তাঁহারাই বাহিরের কাজ কর্ম্ম সকল করিয়া থাকেন, দোকান রাখেন ও কেনা-বেচা করেন। তাঁহারা অল্প কারণেই (Divorce) বিবাহ-বিচ্ছেদ করিতে পারেন। বাহিরের কাজ কর্ম্ম করেন বলিয়া তাঁহাদের শরীরও পুরুষ অপেক্ষা অনেক সুস্থ ও কর্ম্মঠ। ব্রহ্মের অনেক আফিঙ সেবী অলস পুরুষ ঘরে বসিয়া থাকেন-কতক কতক গৃহকর্ম্ম করেন-রাঁধেন, ঘর ঝাঁট দেন। তাঁহারা রৌদ্রের তাপ ও বৃষ্টির ছাট সহিতে পারেন না। বাহিরে আসা কাজের ভিতর কেবল স্ত্রীর খাবারটি দোকানে পৌছাইয়া দেওয়া। নিম্ন ব্রহ্মের ক্ষেত্র এমন উর্ব্বর যে, জমিতে আঁচড় দিয়া বীজ ছড়াইলে অনায়াসে ষোল আনা ফসল হয়। সে কাজেও তাঁহারা অধিকাংশ সময়ে মাদ্রাজী কুলীর সাহায্য লন।এরূপ কোণের ভিতর থাকা ও অলস অভ্যাসের দোষেই তাহাদের শরীর তত সবল হৃষ্ট হয় না। ব্রহ্ম দেশীয় স্ত্রীলোকদের গোলগাল সুগঠিত দেহ পুরুষদের অপেক্ষা অনেক বলিষ্ঠ বলিয়া মনে হয়। ব্রহ্মদেশের জমির অত্যধিক উর্ব্বল্পতাই ব্রহ্মদেশীয় পুরুষকে এত অসল ও শক্তিহীন কাব্লিয়াছে। চীন দেশে ঠিক ইহার বিপরীত অবস্থা দেখা যায়। যেমন অনুর্ব্বরা ভূমি, মানুষের পরিশ্রমশক্তিও সেখানে তত অধিক। রেঙ্গুনে বিস্তর চীনেমানের বাস। তাহারা সকলেই ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপৃত। (China Lane) চীনাগলির পশ্চিম দিকের সমস্ত অংশ চীনেম্যানের বসতি। অনেকে ব্রহ্ম দেশীয় স্ত্রীলোক বিবাহ করে। এইরূপে অনেক টীন ও ব্রহ্ম মিশ্রিত জাতির উৎপত্তি হইয়াছে। চীনেম্যান যেখানেই যায়,সেই খানেই এই নীতি অবলম্বন এবং এইরুপ বর্ণশঙ্কর জাতি উৎপন্ন করে। কলিকাতাতে ও অনেকে এই রূপ কারিয়াছে।

 রেঙ্গুন নূতন সহর; তাই আয়তনে ছোট ও এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রাস্তাগুলি সব সোজা সোজা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। মার্কিণের ন্যায় নম্বর দিয়া পথের নামকরণ হইয়াছে; যথা ১৬শ ষ্ট্রীট, ৩৫শ ষ্ট্রীট, ইত্যাদি। তবে জলকষ্ট প্রযুক্ত রাস্তাগুলিতে ভাল করিয়া জল দেওয়া হয় না বলিয়া কোনও কোন ও স্থানে বড় ধূলা হয়। ইরাবতীর জল লোণা সেই কারণে রেঙ্গুনে পানীয় জলের বড়ই কষ্ট। যেখানে-সেখানে এক একটা প্যাগোড়া বা বুদ্ধদেবের মন্দির আছে। অনেক রাস্তার নাম সেই সকল স্থানের প্যাগোড়ার নামে হইয়াছে। রেঙ্গুনে প্রধানতঃ দুইটি দেখবার জিনিষ আছে;—পশ্চিম রেঙ্গুনের দিকে প্রধান পাগোডা ও পূর্ব্ব রেঙ্গুনের দিকে লেক পার্ক।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি রেঙ্গুন সমতল ভূমি; তবে নদীর ধার হইতে জামি, ক্রমেই উচ্চ হইতে উচ্চতর হইয়া কতকগুলি ছোট ছোট পাহাড়ে গিয়া মিশিয়াছে। প্রধান প্যাগোড়া(Grand Pagoda) এইরূপ একটি পাঞ্ছাড়ে অবস্থিত। পাহাড়টী প্রায় পাঁচ শত ফিট উচ্চ হইবে। নদীর ধার হইতে সেখান পর্যন্ত এঞ্জিনের ট্রাম চলে; শত শত যাত্রী অহরহ তথায় উপাসনার জন্য গিয়া থাকে। আমিও অনেকবার সে প্যাগোড়াটা দেখিয়া আসিয়াছি। ঐ দৃশ্যটা আমার বড়ই ভাল লাগিত।

 নিম্ন হইতে স্তরে স্তরে চওড়া পাহাড়ের সিঁড়ি উঠিয়াছে। তাহার উপর বরাবর খিলান করা ছাত।তাহাতে অনেক প্রস্তরমূর্ত্তি রক্ষিত আছে দুই পাশে যাত্রিদের বসিবার জন্য কাষ্ঠাসন আছে ও তথায় ব্রহ্মদেশীয় স্ত্রীলোক্লেরা পূজার উপযোগী দ্রবাসম্ভার বেচিতেছে। ধূপ, ধুনা, বাতি, চুরুট, ফুল, ধ্বজা ইত্যাদি। কেহ বা আয়না সামনে করিয়া চুল আঁচড়াইতেছে। কেহ বা মুখে চন্দন কাঠের পাউডার মাখিতেছে। কেহ বা সেই খানেই বসিয়া পরিতোষের সহিত অন্ন সেবা করিতেছে। মন্দিরে উঠতে উঠিতে পায়ে ব্যথা হইয়া যায়। উঠয়াই সম্মুখ একটা বিস্তীর্ণ উচ্চ পরিখাবেষ্টিত বাঁধান উঠান। তাহার মধ্যদেশে সেই প্যাগোডাটী স্বর্ণচুড়া বিস্তার করিয়া রেঙ্গুনের শান্তি ঘোষণা করিতেছে। মন্দিরের ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বুদ্ধদেবের মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত। অনেকগুলি মূর্ত্তি ১৫ হইতে ২০ ফুট উচ্চ।
“ফুঙ্গী” বা বৌদ্ধ পুরোহিত
বাহিরে একটি ধ্যানস্থ মূর্ত্তি উপবিষ্ট; ঐ মূর্ত্তিটী প্রায় ৩০ফুট উচ্চ। সাদা মান্দালেমার্ব্বেলে খোদিত,বস্ত্র ও উত্তরীয়ের পাড়গুলি সোণালী রঙের। ধ্যানে গভীর চিন্তাশীলতা ব্যক্ত। যেন মনুষ্য হইতে কীট পতঙ্গ অবধি জগতের সকল প্রাণীর দুঃখ স্মরণে ব্যথিত। সে মূর্ত্তি দেখিলে, সে জীবনের পুণ্য-কথা স্মরণ করিলে হৃদয় পবিত্র হয়। মন্দিরের সর্ব্বত্রই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। জুতা পরিয়া যাইতে কোন আপত্তি নাই। তবে ব্রহ্মদেশীয় লোকেরা জুতা হাতে করিয়া লইয়া যায়। শত শত যাত্রীরা উপাসনায় রত দেখিলাম। মুণ্ডিত মস্তক হল‍্দে পোষাক পরা “ফুঙ্গী” বা পুরোহিতগণ চারি দিকে বিচরণ করিতেছেন,— কেহ বা কোন গ্রন্থ পড়িতেছেন। মন্দিরের ভিতর প্রদীপ জ্বলিতেছে, -বিলাতী চর্ব্বির বাতিও জ্বলে। ধূপধুনার সুগন্ধ চতুর্দ্দিকে ব্যাপ্ত। সম্মুখে ফুলের তোড়া সাজান রহিয়াছে। কাঁসর-ঘণ্টার মত কোনওরূপ বাদ্য-যন্ত্র নাই। জানু পাতিয়া বসিয়া যাত্রীরা করযোড়ে ভূমিতে দণ্ডবং করিতেছে। অম্পূর্টস্বরে স্তোত্র পাঠ করিতেছে, কেহ বা আপনার কামনা জানাইতেছে। কোনরূপ চীৎকার বা গোলমাল নাই। প্রজ্বলিত দীপ হস্তে কেহ বা দেবপদে পুষ্পাঞ্জলি দিতেছে। পূজার উপকরণের মধ্যে কোনরূপ খাদ্যদ্রব্য নাই।

 মন্দিরের দ্বারদেশে বসিয়া অনেকগুলি অন্ধ স্ত্রীলোক ও পুরুষ সমস্বরে স্তোত্র গান করিতেছে। কেহ বা সপ্ত-স্বরার মত একরূপ যন্ত্রে কাটি দিয়া বাজাইতেছে ও নিজেরাই পায়ে খঞ্জনী বাজাইয়া তাল রাখিতেছে। কেহ বা সারিঙ্গার মত একরূপ যন্ত্র বাজাইয়া সেই স্তুতিগানের সহিত সুর দিতেছে। অন্ধ গায়কগুলির মুখের ভাবে যেন তন্ময়ত্ব মাখান। সামনে অনেকগুলি পয়সা জড় হইয়াছে। ইচ্ছা হয় পয়সা দাও, – পুরোহিতের জবরদস্তী বা ভিখারীর উৎপাত নাই। আমি অনেক দিন, অনেকবার, অনেকক্ষণ ধরিয়া এই মন্দিরটি দেখিয়াছি

 মন্দিরের উপর হইতে রেঙ্গুনের চারিদিকের দৃশ্য অতি মনোহর। একদিকে সহর ও দূরে ইরাবতী নদী প্রবাহিত। অপর দিকে বৃক্ষলতা-সমাবৃত অসমতল পল্লীগ্রামের সুচারু দৃশ্য। সন্ধ্যাকালে পশ্চিম আকাশ রঞ্জিত করিয়া যখন সূর্যদেব অস্ত যান, এখান হইতে সে দৃশ্য তখন বড়ই সুন্দর দেখায়।

 মন্দিরের পথেও অনেকগুলি মঠ আছে। সেখানে মুণ্ডিত-মস্তক ভিখারিণীগণ মন্দিরের দিকে মুখ ফিরাইয়া ধূলায় জানু পাতিয়া বসিয়া উপসনা করেন এবং নিবিষ্টচিত্ত বসিয়া ধর্ম্মগ্রন্থ পাঠ করেন। রেঙ্গুনে পানীয় জলের অভাব বলিয়া তাঁহারা শ্রান্ত পথিককে জল পান করিতে দেন।

 এক দিকে যেমন পাহাড়ের উপর প্রধান প্যাগোড়া অবস্থিত, অপরদিকে তেমনি কতকগুলি ছোট পাহাড়ের জল নিকাশের পথ বন্ধ করিয়া একটী হ্রদ প্রস্তুত করা হইয়াছে। এইটাই রেঙ্গুনের (Lake Park) “লেক পার্ক” নামে অভিহিত। ইহা সহর হইতে প্রায় ৩ মাইল দূরে। সেই স্থানে যাইবার পথেই ধনী ইউরোপীয়ানদের বসতিস্থান বা বাগানবাড়ী। কাঠের ছোট ছোট বাঙ্গালাগুলি অতি সুন্দরভাবে গঠিত। নীচের তলা একেবারে খোলা। জমি স্যাঁৎসেঁতে বলিয়াই এইরূপ ব্যবস্থা। চূড়াগুলি নানারূপ কারুকার্য্য খচিত বাহির হইতে ঠিক যেন ছবিখানির মত দেখায়। তাহার চারিপাশে নানা-জাতীয় ফুলগাছ ও বাগান।


ব্রহ্মবাসীর বাসগৃহ।
 বাগানের ভিতর-কার পাহাড়গুলি খুব ছোট ছোট। হ্রদটী নানা ধরণে আঁকাবাকা। পাহাড়গুলির নীচে দিয়া সুরকির পথ। পাহাড়গুলির গায়ে ঘন সবুজ ঘাস সমান করিয়া ছাঁটা। যেখানে সেখানে বেশী গাছপালা নাই। একটী পাহাড়ের উপর একটী ইষ্টকনির্ম্মিত—— সিঁড়ি নামিয়াছে। জলের ধারে গাছের নীচে অনেকগুলি কাষ্ঠাসনও আছে। সেখানে বসিয়া, এই সকল দৃশ্য দেখিলে মনে বিমল আনন্দ হয়। আমার কত পুরান কথা মনে পড়িতে লাগিল। মাথার উপর গাছের ডালে অতি করুণস্বরে- অতি মিষ্টভাষায় কাকগুলি কোলাহল করিতেছিল। আমাদের এদেশের মত রেঙ্গুনের কাক কর্কশকণ্ঠ নয়।

 সেই মঞ্চে বসিয়া অনেকগুলি ব্রহ্মদেশীয় স্ত্রীলোক ও পুরুষ ভাত কিনিয়া খাইতেছিল। এখানে রাঁধা ভাত বেচে ও সকলেই তাহা কিনিয়া খায়। কি ব্রহ্মদেশে, কি মালয়দেশে, কি চীন রাজ্যে, কি জাপানে-লোকেদের প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ। যব ও গমের সঙ্গে সম্পর্ক তাদের বড়ই কম। দুধ তারা মোটেই পছন্দ করে না।

 কলিকাতা হইতে আমাদের জাহাজে অনেক চটের থলে (Gunny Bag) ও তামাকের পাতা গিয়াছিল। বর্ম্মাচুরট প্রস্তুত করিবার জন্য তামাকের পাতাগুলি এখানে নামাইয়া দেওয়া হইল। চটের থ’লেগুলিও বন্দরে নামান হইল। জাহাজে রাশি রাশি চাউল বোঝাই হইল। মালয় ও চীনে এই সকল চাউল আমদানি হয়। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, প্রতি বৎসর ব্রহ্মদেশ হইতে সাড়ে তেরকোটী টাকারও বেশী মূল্যের চাউল এসিয়ার বিভিন্ন দেশে, ইউরোপ ও আমেরিকায় রপ্তানী হয়। চাউলগুলি মোটা। ইউরোপ ও আমেরিকায় এই চাউল হইতে কাপড়ের মাড় ও মদ প্রস্তুত হয়; কিন্তু মালয় ও চীনদেশের ইহাই খাদ্য। ব্রহ্মের আর একটি প্রধান রপ্তানীদ্রব্য,—বাহাদুরী কাঠ (Timber)। উত্তর ব্রহ্মে স্বর্ণ ও হীরার খনি আছে। কেরোসিন তৈলের মত এক প্রকার তেলও { Burma oil) এখানে পাওয়া যায়। দেশে এত মূল্যবান্ দ্রব্যাদি সত্ত্বেও ব্রহ্মদেশ যে দরিদ্র তাহার প্রধান কারণ, ব্রহ্মবাসী পুরুষদের দারুণ আলস্য এবং বিবেচনা না করিয়া আমোদ প্রমোদে অযথা অর্থ ব্যয়। এ সকল বিষয় পর প্রবন্ধে বলিব।