চীন ভ্রমণ/সিঙ্গাপুর (দ্বিতীয় প্রস্তাব)

উইকিসংকলন থেকে


সিঙ্গাপুর।

[ দ্বিতীয় প্রস্তাব। ]

 জাহাজও জোঁটতে লাগিল আমি ও জাহাজ হইতে নামিলাম। জেটিতে লাগে বলিয়া, এ সকল স্থানে জাহাজ হইতে নাম-উঠার কোনও গোলমাল নাই। রেঙ্গুনের মত সামপানের সাহায্য লইতে হয় না। নামিয়া আর দুই পা’ গেলেই অসংখ্যা রিকস ঠেলাগাড়ী পাওয়া যায়; সুতরাং এ সকল স্থানে ভ্রমণ করার বিশেষ সুবিধা। পূর্বেই বলিয়াছি, ঘণ্টায় দুই জনার ৩০ সেণ্ট মাত্র ভাড়া;—রিকসগাড়ী ঘোড়ার গাড়ীর মত বেগে চলে; সুতরাং অতি অল্প সময়ে ও অতি কম খরচে সকল স্থান দেখা যায়।

 প্রতি সাগর বা প্রণালীতে প্রবেশের পথেই ইংরাজ অধিকৃত একটু না একটু স্থান আছেই। সমুদ্রের উপর ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য এরূপ আবশ্যক। এক সিঙ্গাপুরই কতদিকের পথ আগুলিয়া আছে। চীন, জাপান ও অষ্ট্রেলিয়া যাইবার পথে সকল জাহাজকেই এখান দিয়া যাইতে হয়। শুধু এখানে নহে, ভূমধ্য সাগরের প্রবেশের পথ জিব্রালটার হইতে দেখিয়া আসিলে, সর্ব্বত্রই এরূপ দেখা যায়। ভূমধ্য সাগরের মধ্যপথে মালটা দ্বীপ ইংরাজ অধিকৃত। মিসর দেশ ইংরাজেরই ক্ষমতাধীনে; ইহা ভূমধ্য সাগর হইতে লোহিত সমুদ্রে প্রবেশের পথে অবস্থিত। লোহিত সমুদ্র হইতে বাহির হইবার পথেই এডেন-বন্দর। তার পর ভারতবর্ষ, লঙ্কাদ্বীপ ও ব্রহ্মদেশ ত ইংরাজেরই করতলগত। মালয়-প্রণালীর পথে পিন্যাঙ ও সিঙ্গাপুর এবং চীনসমুদ্রের একদিকে লাবুয়ান দ্বীপ এবং অপর দিকে হংকং দ্বীপ ইংরেজাধিকৃত।  শেষোক্ত এই অধিকারগুলির একটু বিশেষত্ব আছে। ইহা জমির খানিকটা অংশ ও তাহার নিকটবর্ত্তী কতকগুলি দ্বীপ লইয়া গঠিত। পিনাঙ একটা দ্বীপ; কিন্তু নিকটবর্ত্তী ভূখণ্ডের অংশটুকুর নাম ওয়েলেশলী টাউন। এইরূপ সিঙ্গাপুরও একটী দ্বীপে অবস্থিত; কিন্তু নিকটবর্ত্তী ভূখণ্ডকে মালাক্কা বলে। যতগুলি প্রধান আড়া আছে, তাহা দ্বীপেই অবস্থিত। বিদেশে দ্বীপই সর্ব্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থান। পিনাঙ, সিঙ্গাপুর,হংকং,—সবগুলিই দ্বীপ। ভুখণ্ডস্থ জমি, আভ্যস্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আবশ্যক। সেই স্থান হইতেই রেলযোগে ইউরোপীয় পণ্যদ্রব্যাদি দেশের ভিতর নীত হয়।

 বহুপূর্ব্বে এই সকল স্থানের নিকটবর্ত্তী দ্বীপপুঞ্জে পর্তুগীজদের। ক্ষমতাই প্রবল ছিল। তাহাদের হাত হইতে ওলন্দাজেরা অনেক স্থান কাড়িয়া লয়েন এবং অনেক স্থান আবার ইহাদের হাত হইতে ইংরাজ,ফরাসী,জার্ম্মাণ ও আমেরিকা প্রভৃতির হাতে গিয়াছে। এইরূপে নিকটবর্ত্তী স্থানগুলি বিদেশীয় জাতির মধ্যে ভাগাভাগী হইয়াছে।

 নামিয়াই প্রথমে জেটীতে খানিক পরিভ্রমণ করিলাম। ক'ত মাইল উহা লম্বা,তাহার আমি শেষ পর্যন্ত যাইতে পারিলাম না। চীনে কুলির ভিড় ও মালপত্র নামানর গোলমালে তাহার উপর দিয়া যাতায়াতও সহজ নাহে। চীনে কুলি অতি সুদক্ষ, তাহারা নিঃশব্দে কাজ করে। জিনিষপত্র ফেলা বা ভাঙ্গা-চুরা কদাচ ঘটিয়া থাকে। কলিকাতার কুলি বা রেঙ্গুনের মাদ্রাজী কৃলি কত রকম সুর করিয়া গান করে। ইহাদেৱ মুখে কিন্তু কোন শব্দই নাই। যতক্ষণ কাজ করিবে, ক্ষণেকেব তরে ও ইহারা একবার বিশ্রাম কবে না, কেবল ঠিক আহারের সময় ফিরিওয়ালার কাছে হইতে ভাত-তরকারী কিনিয়া খাইবার জন্য স্বল্পক্ষণ ছুটা পায়। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত অবিরাম পরিশ্রমের মূল্য অধিকাংশ স্থলেই ২০ বা ৩০ সেণ্ট অর্থাৎ ৫ আনা মাত্র। বেশী লোক বলিয়া

চীনদেশে মজুরী এত সস্তা। তাই চীনেম্যানরা মালয় ব্রহ্মদেশ প্রভৃতি স্থানে এত ছড়িয়ে পড়েছে; ও ভারতবর্ষ, ও দক্ষিণ আফরিকা প্রভৃতি স্থানে অসংখ্য চীনেম্যান কারিকর ও কুলির কাজ করিবার জন্য যাইতেছে রা্ণ্ড স্বর্ণখনির জন্য বহু চীনে কুলি চালান হয়। তাহারা সব ৸০ আনা রোজে যাইতেছে। জাহাজের অফিসের লোকেদের নিকট হইতে খবর পাইলাম যে,এক একটা চীনে কুলি চারটি ভারতবর্ষীয় কুলির কাজ করে। সুতরাং হিসাব মত কত সস্তা পড়িল। প্রকৃতই দেখিলাম,রেঙ্গুনে যে সব বস্তা দুটি তিনটী ক্ষীণদেহ মাদ্রাজী কুলিতে গান গাহিতে গাহিতে মুখভঙ্গী করিয়া তুলে ও ফেলিয়া জখম করে, এক একটি চীনে কুলি অবলীলাক্রমে তাহা বহন করিয়া থাকে। কিরূপ দ্রুতবেগে ও কতকক্ষণ ধরিয়া ইহাৱা যাত্রীসহ রিকস গাড়ী টানিয়া লইয়া বেড়ায় তাহা দেখিলে তাহাদের কত যে ক্ষমতা তাহা বুঝা যায়। বটানিকাল গার্ডেন দেখিতে যাইবার কালে ঘন ছায়াযুক্ত বড় বড় নারিকেল-নিকুঞ্জের ভিতর দিয়া সুগঠন চীনে রিকস ওয়ালা দ্বারা যখন ' তীর বেগে আমাদের রিকস গাড়ী নীতি হইতেছিল, সে স্থানে - সে সময়কাল্প আমার মনের আনন্দ ভাষায় বুঝান যায় না।

 এই পরিশ্রমের সহিত তাহাদের আহারের তুলনা করিলে বিস্মিত হইতে হয়। দিনে-তিনবারে ৬পেয়ালা মাএ ভাত তরকারী ও অতি সামান্য মাত্র মাংস ও কিছু মাছ খাইয়া ইহাদের দেহ কেমন করিয়া। এত পুষ্ট ও বলবান থাকে, তাহ। বুঝা যায় না। আমার মনে হইল,আমাদের দেশের সাধারণ লোকেরা দুই বেলায় অন্ততঃ ইহাদের একজনের দৈনিক আহারের দুই তিন গুন আহার করে। অল্প আহার ও কায়িক পরিশ্রমে এবং মনের চির প্রফুল্লতাতেই ইহাদের শরীরে বলাধান করে। সু-হজমের যে সব লক্ষণ,তার সব গুলিই এদের ভিতর দেখা যায়। এর ঘুমাবে একেবারে অকাতরে,—ঠিক যেন মৃত ব্যক্তির মত। মাদুরে শুয়ে এবং বাশ বা কাঠের বালিশ মাথায় দিয়ে যে অবস্থায় শুইবে,সেই অবস্থায়ই উঠিবে -একবারও পাশ ফিরে না। এদের প্রতিদিন মলত্যাগের প্রথা নাই,—তিন চার দিন অন্তর,যখন আবশ্যক হইবে,তখন যাইবে। আর সে দাস্তও যত সুহজমব্যঞ্জক হইতে হয়। বায়ুর প্রাচুর্য্য বা তরলতার লেশ মাত্র তাহাতে নাই। অতি অল্পমাএ সময়ে ইহাদের মলত্যাগ সমাধা হয়।

 এদের পোষাক ঢলঢ’লে ইজের ও কোট; তবে কেহ কেহ গা' খুলিয়াও কাজ করে। চীনজাতি বড় নীলরঙ প্রিয়। তাদের পোষাক নীলরঙের, সামপান নীলরঙে্‌র, বাড়ীগুলিতে নীল রঙ মাখান ও সাইনবোর্ডগুলির হয় জমি না হয় হরফ নীল রঙের।

 এদের সুহজমের কারণ কি ও এমন সুগঠন মাংশপেশীবহুল দেহে অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রমের কুফলই বা কি,—সে সব কথা বিস্তৃতরূপে পরে বলিব। তাহা হইতে আমাদের দেশের লোকের অনেক শিখিবার আছে। তবে এই টুকু মাত্র এখানে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে, চীনেদের ভিতরে হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব বড়ই দেখা যায়। পিনাঙ প্রবন্ধে রিকস ওয়ালার কথায় বলিয়াছি যে, দশ বার বৎসর এরূপ গুরুতর পরিশ্রম করিয়া তাহারা হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কুলি ও নৌকার মাঝিরও সেইরূপ। হৃদরোগই এরূপ মৃত্যুর কারণ।

 প্রতোহ দিনের কার্য্য শেষ হইলে চীনে কুলিরা সমুদ্রে গা’ধুইয়া থাকে; কিন্তু মাথায় জল দেয় না, -পাছে বিনানীতে লোণা জল লাগে ও চুল ভিজিয়া যায়! মধ্যে মধ্যে আপনাদের কাপড়গুলিও কেচে দেয়। মাথা ধুইবার জন্য আলাহিদা দোকান আছে, সেখানে গরম জল ও সাবাঙ দিয়া মাথা ধুইয়া চুল বিনাইয়া দেয়। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ফিরিওয়ালারা ভাত, মাছ, মাংস, তরকারী ইত্যাদি বেচিয়া বেড়ায়। কোনও কুলিকে রেঁধে খেতে হয় না। দিনে তিন বার, খাইবার খরচ ১২ সেণ্ট মাএ। কাপড় জামা ছিঁড়িয়া গেলে চীনে ফিরিওয়ালী স্ত্রীলোক দুই এক সেণ্ট লইয়া তাহা রীপু করিয়া দেয়। শুইবার জন্য এদের একটি মাদুরি ও একটী কাঠের বা বাঁশের বালিশ মাত্র দরকার হয়। এরা কখনও আহারের সময় জলপান করে না, অথবা কখনও সরবৎ বা ঠাণ্ডা জল পান করে না। আবশ্যক মত ছোট ছোট পিয়ালায় স'বজে চা খায়; তাতে চিনি বা দুধ দেয় না। আবশ্যকীয় সকল দ্রব্যই ফিরিওয়ালারা সেই স্থানে আনিয়া যোগায়; সুতরাং তাদের কাজের ভাবনা ছাড়া আর কোনও ভাবনা ভাবিতে হয় না।  সিঙ্গাপুর প্রবন্ধে চীনেম্যান সম্বন্ধে বেশী কথা বলার আমার ইচ্ছা ছিল না; সে কথা হংকং, এময় প্রভৃতি চীন দেশীয় স্থান সম্বন্ধে বলিলেই ভাল হইত। তবে মালয় দেশ ও তথাকার আদিমবাসী সম্বন্ধে পিনাঙ সম্বন্ধে বলিতে গিয়া অনেক কথা বলিয়াছি আর ইহাও বলিয়াছি যে, এ সকল দেশে শতকরা ৯০ জন চীনেম্যান বাস করে। যদিও দেশটী মালয়-উপদ্বীপ বটে, কিন্তু চীনে অধিবাসীই বেশী ও ব্যবসাদিসূত্রে তাহারাই প্রধান। এই কারণে চীনেম্যানের কথা আপনিই আসিয়া পড়িল। বিশেষ সিঙ্গাপুরের মত একটি প্রধান বন্দরে বিপুল জেটীর কথা বলিতে বলিতে চীনে কুলির কথা না বলিলেই নয়।

 জেটীতে কত বিভিন্ন প্রকার মালপত্র দেখিলাম। রেঙ্গুন হইতে আনীত চালের বস্তা ঠাসা রহিয়াছে। আমরা আবার আরও কতকগুলি চালের বস্তা নামাইয়া দিলাম। বাহাদুরী কাঠ, লোহার কড়ি, কারুগেটেড আয়ারণ, অনেক বিলাতী কাপড়ের গাঁট ও অন্যান্য নানা রকমের বিলাতী দ্রব্যাদি নামিল। জেটীতে অধিকাংশই বিদেশী পণ্যদ্রব্য। জাপানী দেশলাইয়ের অসংখ্য বড় বড় বাক্স এখান হইতে চালান হইয়া ভিন্ন ভিন্ন জাহাজে রেঙ্গুন, পিনাঙ প্রভৃতি দেশে নীত হইতেছে। আপকার কোম্পানীর জাহাজেই সর্ব্বাপেক্ষা ভিড়। চীনদেশে মালপত্র বা লোকজন নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা সম্বন্ধে আপকার কোম্পানীর জাহাজই প্রধান।

 সহরের ভিতর ঢুকিয়া যতদূর দেখিলাম, সমস্ত সহরটী কেবল দোকানে পরিপূর্ণ। লোকে লোকারণ্য, তার অধিকাংশই চীনে। পৃথিবীর সকল দেশের লোকই এখানে ব্যবসাসুত্রে আসিয়াছে। সকল লোককে দেখিলেই মনে হয় তাহারা অস্থায়ী, কেবল ধন লুটিতে আসিয়াছে। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে আমেয়িকাবাসীই বেশীর ভাগ। বিস্তুর ফরাসীও আছে, তাহারা মদের দোকান বা থিয়েটার বা কেশ পারিপাট্যের দোকান করে, কেহ বা হোটেলের স্বত্বাধিকারী ও ম্যানেজার। তাহারা দোকানে অতি সুন্দর সুন্দর মোম নির্ম্মিত অৰ্দ্ধনগ্ন স্ত্রীমূর্ত্তি রাখিয়াছে।

 এদেশের লোক সম্বন্ধে আর একটা কথা বিশেষ করিয়া বলা উচিত। ইউরোপীয় ও চীনে মিশ্রিত একরূপ সঙ্কল্প জাতি এ অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। তাদের নাসিক উন্নত, কিন্তু গালের হাড় উচু ও চোক বাঁকা। তারা অনেকেই সাহেবদের মত পোষাক পরে; আবার অনেকে ঠিক চীনেম্যানের মত ঢল ঢ’লে বেশ করিয়া থাকে। আর কতক গুলি আছে,তাহারা ইউরোপীয়ানদের মত আঁটা সোটা পোষাক পরে বটে, কিন্তু টুপির ভিতর চীনেদের মত বিনানীও লুকাইয়া রাখে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি,—চীনেম্যান যেখানে যায় সেই খানেই বর্ণসঙ্কর জাতি উৎপন্ন করে। ইউরোপীয় জাতি ও মগজাতির সঙ্গে, এমন কি কলিকাতার চীনেপাড়া বেণ্টিঙ্ক ষ্ট্রীটে ও অনেক চীনেম্যানের ঔরসে এবং ফিরিঙ্গী মেয়েদের গর্ভে অনেক দো-আসলা জাতি উৎপন্ন হইয়াছে। অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফরিকার উপনিবেশসমূহে চীনেকুলি আমদানি করিতে যে আপত্তি, তার একটা কারণ,—এইরূপ দো-আঁসলা জাতির সৃষ্টির ভয়।

 এ ছাড়া অনেক জাপানদেশীয় লোক,ইহুদি ও পার্শী এখানে বড় বড় দোকান করিয়াছে। এ অঞ্চলের সর্ব্বএই শিখ পাহারাওয়ালা দেখা যায়। তাদের সাহায্য ব্যতীত ইংরাজ গবর্ণমেণ্টের যেন শান্তিরক্ষা চলে না। বেছে বেছে ভীমাকৃতি শিখ আমদানী করা হয়েছে। অধিকাংশই দেখিলাম ৬ ফুটের উপর ঢেঙ্গা। তাহারা রাস্তার মাঝে দাঁড়াইয়া শান্তি রক্ষা করিতেছে। খর্ব্বাকৃতি মালয় পুলিস তাদের চারিদিকে দাঁড়াইয়া হুকুম তামিল করিতেছে। শিখ পাহারাওয়ালাকে সেখানে সকলেই যমের মত তয় করে। দোষীর বিচারও তাদের হাতে সঙ্গে সঙ্গেই হইয়া যায়। গালি, ঘুষি, চপেটাঘাত, যষ্টিপ্রহার ও চীনেদের বিনানী ধ’রে টানিয়া উৎপীড়ন,—ইহা প্রায়ই দেখা যায়। লঘুপাপে গুরুদণ্ড সচরাচর হইয়া থাকে। শিখ পাহারাওয়ালা একবার হাক দিলেই হ’ল-সকল লোকই ভয়ে কাঁপে। আমরা তাদের সঙ্গে হিন্দীতে কথা কহিলে, তাদের আর আনন্দের সীমা থাকিত না। দেশের লোক দেখিয়া তাদের যেন আত্মীয়তার স্পৃহা। জাগিয়া উঠিত। চীন রিকসাওয়ালাকে আমাদিগকে দেখাইবার স্থান সকল বুঝাইয়া দিত, এবং আমাদের যেন কোনও বিষয়ে অসুবিধা না ঘটে, সে সম্বন্ধেও শাসাইয়া দিত। এখানে মাদ্রাজীৱও অসদ্ভাব নাই। তারা অনেকেই সাহেবদের চাকরী করে; অনেকে স্বাধীনভাবে নিজে নিজে দোকান করিতেছে।

 আৱ স্ত্রীলোকের তা সংখ্যা নাই! এত স্ত্রীলোক কোথাও কখন দেখি নাই। যত বিভিন্ন জাতীয় স্ত্রীলোক আসিয়া এখানে জুটিয়াছে, তার মধ্যে জার্ম্মাণদেশীয় ইহুদী ও জাপানী স্ত্রীলোকই বেশী। তাহারা যেখানে থাকে সে পথ দিয়া চলিলেই “আপনার সঙ্গে একটী মাত্র কথা কহিতে চাই” স্ত্রীকণ্ঠ উচ্চারিত এই কথাগুলি অহরহ শুনিতে পাওয়া যায়। সহরের অনেক স্থানে কেবল তাদেরই বসতি। সেই স্থানেই থিয়েটার, সেই স্থানেই হোটেল, সেই স্থানেই মদের দোকান। সারারাত্রি দিনের মত জনতা। ঘুরে ঘুরে বড় পিপাসা হওয়ায় চীনে রিক্সওয়ালাকে অঙ্গভঙ্গী করিয়া,—সঙ্কেতে বুঝাইয়া দিলাম যে জল থাইতে চাই। সে মদের দোকানে নিয়ে গেল। তারাই ২০ সেণ্ট বা ৫আনার বিনিময়ে লেমনেড় ও বরফ খাওয়াইল। একটি ফরাসী রমণী আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,— “আপনি কি খানিক ক্ষণের জন্য উপরে আসিয়া একটু বিশ্রাম করিবেন না?” সে স্থলেও চীনে স্ত্রীলোকের গাম্ভীর্য্য যায় নাই, চারিদিকের সাজসজ্জা শব্দবিন্যাস ও অঙ্গ-বিভ্রমের মাঝে তাদের গাম্ভীর্য্য অক্ষুণ্ণ আছে।  বাড়ী গুলি সব তিন চারিতলা উচু। সর্ব্বোপরের ছাত ঢালু। গায়ে গায়ে গাঁথা সবগুলি এক রকম দেখিতে ও অধিকাংশই নীল রঙ মাখান। নীচে দোকান; উপরে থাকিবার আড্ডা। দোকানের সামনে নীল রঙের সাইনবোৰ্ড ঝুলচে। চীনে হরফগুলি নীচে নীচে লেখা,—দেখিতে ঠিক যেন ঘর বাড়ীর মত। প্রতি বাড়ীর সম্মুখেই ঢাকা বারান্দা। সব বাড়ীর বারান্দাগুলি সংযুক্ত; সুতরাং তার ভিতর দিয়া যেন একটা ঢাকা ফুটপাথ হইয়াছে। বরাবর যাইলে মাথায় রৌদ্র বা বৃষ্টির ছাঁট লাগে না।

 রাস্তায় রথযাত্রার মত ভীড়। দ্রুতবেগে রিক্সা গাড়ী প্রভৃতি অনবরত যাতায়াত করিতেছ। এমন কি কলিকাতা হইতে গিয়াও আমাদের ভাবোচেকা লাগিত। মধ্যে মধ্যে সমুদ্র হইতে এক একটা খাল কাটা হইয়াছে,তাহা দিয়া কত নৌকা মালপত্র আনিয়া একেবারে দোকনের কাছে পৌঁছাইয়া দিতেছে। জলের উপর দিয়া বহিয়া আনিবার খরচ, জমির উপর দিয়া আনার খরচের এক তৃতীয়াংশ মাত্র। এখানে ভাল ভাল ডাক্তারখানা আছে,—কিন্তু খুব ভাল ডাক্তার নাই। বড় লাইব্রেরী নাই,যাহা আছে তাহা নভেলে পূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় নাই,—উচ্চ শ্রেণীর বিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া হয়।

 এখানে এত ঘন বসতি যে সমস্ত সহরটিতে,রেঙ্গুন ও পিনাঙের মত একটাও বড় উদ্যান বা মন্দির দেখিলাম না। ঘোড়দৌড়ের মাঠ আছে বটে কিন্তু তাহা ছোট ও তাহার চারিদিকে বসতি। সহরের অনেক দূরে, শিবপুরের কোম্পানীর বাগানের মত,বটানিকাল গার্ডেন আছে। সেখানকার দৃশ্য অতি মনোহর। তার নিকটে কোথাও বসতি নাই। চারিদিক নিস্তব্ধ; যেন পৃথিবীর সহিত সকল সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন। সেখানকার স্বচ্ছ সরোবরে “ভিকটোরিয়া রিজিয়া” (রাণী ভিকটোরিয়া) নামক আমাদের পদ্ম জাতীয় এক প্রকার প্রকাণ্ড আকৃতিবিশিষ্ট শতদল ফুল রাশি রাশি ফুটিয়া থাকে। কোন কোনটীর ব্যাস দেড় বা দুই ফুট হইবে। ঐ পদ্মের পাতাগুলিও অতি প্রকাণ্ড। দেখিলে মনে হয়, এরূপ পদ্মের উপর বীণা বাজাইয়া নাচা কিছু অসম্ভব নহে। আর সেখানকার সোজা লম্বা নারিকেল গাছের ঘন কুঞ্জবন,—ঠিক বেতসকুঞ্জের মত। বট ও অশ্বত্থ গাছ অপেক্ষাও প্রকাণ্ড ছায়া-তরুর তলায় বেলা দ্বিপ্রহরে বসিলে আর উঠিয়া আসিতে ইচ্ছা হয় না। চারিদিক নিস্তব্ধ। দূরাগত পাখীর গান ঠিক যেন দূরাগত বংশীধ্বনির মত শ্রুতিসুখকর। মাথার উপরে,গাছের ঘন পাতায় লুকাইয়া একটি পাখী করুণস্বরে ডাক’ছিল। আর যেন আমারই জীবনের অতীতইতিহাস সুস্পষ্ট ভাষায় ব’লছিল।

 সেখান হ’তে ফিরতে আমার প্রায় সন্ধ্যা হ’ল। আসিবার পথে সহর হইতে অনেক দূরে মালয়পল্লী দেখিলাম। ছোট ছোট পাহাড়সমাকুল একটী স্থানে ঐ পল্লী অবস্থিত। কাঠের বাড়ীর ঢালু চালাগুলি বহুদূর অবধি ক্রমান্বয়ে চলিয়াছে।

 সেই সকল গাছ-পালা সমাচ্ছন্ন পাহাড়েরই পাদমূল ধৌত করিয়া সমুদ্রের জল কুল-কুল রবে জোয়ারভাটা খেলে। কত প্রকার শামুক ও জলজ প্রাণীর চিত্র-বিচিত্র খোলা তথায় দেখিলাম; ঢেউয়ের সহিত তীরের দিকে উঠতেছে ও নামিতেছে। পল্লীর ছোট ছেলেগুলি সমুদ্রজল থেকে সেই সকল কুড়িয়ে গুলি ছোড়াছুড়ি করে। আর ছোট মেয়েরা ভিজে বালি দিয়ে খেলাঘর প্রস্তুত করে,—মুক্ত হাওয়ায় সুস্থ শরীরে মনের আনন্দে সময় কাটায়। তাহদের বয়স্ক বোনেরা বনফুলের মালা গেঁথে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়। সে মালার তলা দিয়ে দিবাবসানে যে চলে, তারই মনের ভাব পরিবর্ত্তিত হয়,তাদের এইরূপ বিশ্বাস।

 সন্ধ্যার অল্পক্ষণ পূর্ব্বেই আমাদের জাহাজ ছাড়িল। এইবার আমরা ভীষণ চীন-সমুদ্রে বহুদিনের জন্য ভাসমান হইলাম।