চীন ভ্রমণ/সিঙ্গাপুর (প্রথম প্রস্তাব)

উইকিসংকলন থেকে

সিঙ্গাপুর

[প্রথম প্রস্তাব]

 মালয় দেশে আমি তিনটি স্থান দেখিয়াছি। প্রথমটি পিনাঙ। 'পিনাঙের কথা' পূর্ব্বের দুই প্রবন্ধে বলা হইয়াছে। মালয়ের সর্ব্বাপেক্ষা বড় সহর সিঙ্গাপুর। পিনাঙ হইতে সিঙ্গাপুর যাইতে তিন দিন লাগে। তবে পথে পোর্ট সুইটেনহাম নামক এক বন্দরে ঘণ্টা ক’তকের জন্য জাহাজ থামে।

 সুটেনহাম একটি ছোট বন্দর; সবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে মাত্র। সমতল ভূমির উপর এ স্থানটি অবস্থিত বলিয়া এখান হইতে রেলযোগে মালপত্র মালয় দেশের ভিতরে বহুদূর পর্যন্ত লইয়া যাওয়া হয়। পিনাঙ বা সিঙ্গাপুর দুইটি স্থানই দ্বীপে অবস্থিত, এই কারণে এই সকল স্থান হইতে মালয় উপদ্বীপের মধ্যভাগে রেলে যাওয়া অসম্ভব। তাই এ স্থানে একটি নূতন আড্ডা করা হইয়াছে। এ স্থানটি নিচু সমতলভূমির উপর; অল্পদিন হইল নিবিড় জঙ্গল কাটিয়া স্থাপিত। সহরটি বড় স্যাঁতস্যাঁতে; মশার উৎপাত ও জ্বরের প্রদুর্ভাবও এইজন্য এখানে বেশী। প্রতিভাশালী ডাক্তার রসের আবিষ্কারানুসারে আজকাল স্থির হইয়াছে যে, এক জাতীয় দূষিত মশক দংশনই ম্যালেরিয়া জ্বরের উৎপত্তির কারণ; সেই কারণে বর্ষার ঠিক শেষে ও শীতের প্রারম্ভে অর্থাৎ পূজার সময় ও পরে যখন মাটি অত্যন্ত ভিজা থাকে,সেই সময় মশাও বিস্তর জন্মে। তাহার ফলে ঐ সময় আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া জ্বরের যত প্রদুর্ভাব হয় অন্য সময় তত হয় না। কিন্তু সুইটেনহাম বন্দরে সমুদ্রোপকূলের মাটি অনবরত ভিজা থাকাতে বার মাসই এখানে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব। সে ম্যালেরিয়া হইতে কাহারও,—বিশেষ ইউরোপবাসীদের রক্ষা পাওয়া দায়। তা'ছাড়া আসাম অঞ্চলে যে “কালা-আজর” নামক এক প্রকার জ্বর হয়, সে জ্বরও এখানে খুব দেখিতে পাওয়া যায়। এই সকল কারণে স্থানটীর স্বাস্থ্যোন্নতি ও ব্যবসার উন্নতি হইতেছে না। আমরা রেঙ্গুন হইতে আনীত বিস্তর চাল ও কতকগুলি বিলাতী কাপড়ের গাঁট নামাইয়া দিলাম মাত্র, সেখান হইতে কিছুই লইলাম না।

 আজকাল মশা মারিয়া এখানকার ম্যালেরিয়া কমাইবার প্রস্তাবও হইতেছে। এ বিষয়ে কৃতকার্য্য হইলে শীঘ্রই স্থানটির উন্নতি হইবে। সেখানে যে ৫।৬ ঘণ্টা ছিলাম, তার মধ্যে আমি ভয়ে ভয়েই স্থানটী দেখিয়া বাড়াইয়াছি। ভয়ের কারণ, পাছে এই অল্প সময়ের মধ্যেই ম্যালেরিয়া ধরে! দেখিবারও তথায় বেশী কিছুই নাই। রেঙ্গুনের মত নিচু সমতল ভূমি বলিয়া এখানকার রাস্তাগুলিও চাওড়া ও সোজা। বাড়ীগুলি কাঠের। আমাদের দেশে ম্যালেরিয়ার একটি প্রধান আড্ডা বর্দ্ধমান জেলার মত এখানেও এটেল মাটি দেখিলাম। জমি নরম ও ভিজা বলিয়া হালকা করিয়া বাড়ী তৈয়ার করিতে হয় এবং বায়ু যাতায়াতের জন্য তাহার তলা খুলিয়া রাখিতে হয়। এখানেও প্রায় সকল বাসীন্দাই চীনেম্যান। তারাই দোকান করে। চুল ধুইবার ও বিনাইবার দোকানের পাশেই চণ্ডুর দোকান। তার পাশেই জুয়া খেলিবার আড্ডা। কালো মালয়বাসীরা মাটি কাটিয়া কুলির কাজ করিয়া বেড়াইতেছে। এখানকার জলবায়ুতে চির অভ্যস্ত বলিয়া,তাহারা ম্যালেরিয়ায় তত ভোগে না।

 এখান হইতে জাহাজ ছাড়িয়া তার পর পরদিন প্রাতে সিঙ্গাপুর পৌছিলাম। শুধু মালয়-উপদ্বীপ নয়, সমগ্র এসিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুৱাই সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান বন্দর। বন্দরে ঢুকিবার সময় দূর হইতেই তাহার আভাস পাওয়া যায়। অসংখ্য ছোট ছোট পাহাড় জল ভেদ করায়া উঠিয়াছে। তাহাদের উপর অতি সুন্দর সুন্দর বাঙ্গালা নির্ম্মিত, ও তাহার চারি পাশেই পিনাঙএর মত প্রকাণ্ড প্রকাগু মাছ ধরিাবার আড্ডা। নানা রকম নূতন নূতন মাছ এখানে পাওয়া যায়। পুর্ব্বেই পিনাঙ প্রবন্ধে বলা হইয়াছে “কাটেল্ ফিস্” নামক এক প্রকার বড় বড় দাড়া সংযুক্ত গোল মাছ জলের নীচে মাথা নিচু করিয়া চলে। অতিশয় হিংস্র স্বভাব বলিয়া ইহাদের দৃষ্টিশক্তি অতি প্রখর। দেখিতে এক রকম বলিয়া পার্শ্বে ইহার ছবি দেওয়া গেল।

 একটি কথা আছে, -এ সকল দেশের লোক যত ভাত খায়, তত মাছ খায়া অসংখ্য ছোট বড় সামপান কৌশলে ও দ্রুতগমনে, ষে দিকে ইচ্ছা পাল তুলিয়া যইতেছে। হওয়া যে দিকেই হউক না কেন, এ দেশের মত সমুদ্র-পরিবেষ্টিত স্থানে মাঝিরা নৌকা চালাইতে এমন বিচক্ষণ যে যেদিকে ইচ্ছা পাল তুলিয়া তাহারা যাইতে পারে। বায়ুভরে পাল স্ফীত হইয়া যখন নীল রঙে চিত্রিত চোখ আঁকা “ড্রাগন” ঝোলান সমপানগুলি সমুদ্র আচ্ছন্ন করিয়া এদিক ওদিক ভাসিয়া বেড়ায়, দূর হইতে তখন সে দৃশ্য অতি সুন্দর দেখায়। ছোট বড় অর্ণব-পোতের তা সংখ্যাই নাই। নানা দেশের নানা রকম নিশান তুলিয়া বাণিজ্য-তরী সকল সমুদ্রে ভাসমান। এস্থানে কত রকমের বিভিন্ন জাতির যুদ্ধ-জাহাজ দেখিলাম। কেহ আসিতেছে, কেহ যাইতেছে,কেহ মাঝদরিয়ায় নঙ্গর করিয়া আছে,কেহ জেটিতে কয়লা বোঝাই লইতেছে। তাদের শিটির বিকট স্বর শুনলে যেন প্রাণ কেঁপে উঠে। ভীমদৰ্শন গোরা ও কাফরী সৈন্যগুলি ঠিক যেন যমদূতের মত দেখিতে। আর তাদের ব্যবহারও পশুর মত। রুষ-জাপান যুদ্ধের জন্যই বিভিন্ন দেশের এত রণতরী এখানে জমা হইয়াছে; আবশ্যক বুঝিলেই যুদ্ধে যোগ দিবে। “ষ্টীমলঞ্চ”গুলি তীরবেগে নিকটবর্ত্তী স্থানে যাতায়াত করিতেছে। বন্দরে ঢুকিয়া যতদূর দেখা যায়, কেবল নৌকা আর জাহাজ; তা’ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। কলিকাতার বন্দরের তুলনায় এ বন্দর অন্ততঃ দশগুণ বড়। সহরের প্রকাণ্ড বাড়ীগুলি সব যেন তীরে সারবন্দী হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।

 জাহাজ জেটির যতই নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল,ছোটছোট ডিঙ্গিতে চড়িয়া মালয় দেশের কতকগুলি কালো কালো নগ্নমূর্ত্তি লোক আসিয়া জাহাজের চারিদিকে ঘিরিল। তাদের মধ্যে ৮।৯ বৎসরের ছেলেও অনেকগুলি ছিল। আমার ইচ্ছা হ'তে লাগল, এদের কাণ ম'লে স্কুলে দিয়ে আসি। কিন্তু তা’হলে এদের আর এমন স্বাস্থা থাকত না। এরা খুব জবর ডুবুরী। জাহাজের উপর হইতে সিকি দুয়ানি জলে ফেলে দিলে এরা তৎক্ষণাৎ ডুব দিয়ে তা’ তুলে আনে। এরা মাছের মত অবলীলাক্রমে সাঁতার দিতে পারে। সমস্ত দিনই এরা ছোট ডিঙ্গীতে চ’ড়ে সমুদ্রতীরে ঘুয়ে বেড়ায়; আর জাহাজ আসিলেই এইরূপে সিকি দুয়ানী রোজগার করে। এইরূপে প্ৰতিদিন এদের আয়ও যথেষ্ট হয়। এদের অন্য কোন কাজ নাই; শ্যাম ও মালয়ের সমুদ্রতীরবর্ত্তী লোকেরা সন্তরণ-কাৰ্য্যে অতি পটু। শুনিয়াছি এডেনেও নাকি এরূপ ডুবুরী আছে।


বন্দরে প্রবেশ করিবার সময় জাহাজের বেগ কমান হইল। চারিদিকে অজস্র “জেলি" মাছ দেখা গেল। সূর্যরশ্মিতে নানা রঙে রঞ্জিত হইয়া তাহারা জলের নীচে খেলিয়া বেড়াইতেছে; দেখিতে ঠিক যেন শ্বেত ও লোহিত আভাযুক্ত পদ্মফুলের মত, অথচ তাদের সারাংশ অতি কম। জল হইতে তুলিলে একফুট লম্বা একটি জেলি মাছ সঙ্কুচিত হইয়া এক ইঞ্চি হয়। ডারউইনের ক্রমবিকাশ মতে, এই জেলী মাছই জীবের বিকাশের দ্বিতীয় অবস্থা। স্থুল দেহের ভিতর দেহ-নলেরও আবির্ভাব হইয়াছে। প্ৰথম জীব  সিঙ্গাপুরে আর একটি সুন্দর দৃশ্য দেখিলাম। কালো ফিরিঙ্গীৰ পোষাক-পরা কতকগুলি মাদ্রাজী জাহাজের ধারে ধারে ছোট নৌকা করিয়া অনেক রকম প্রবাল ও নানাবিধ ছোট বড় চিত্র-বিচিত্র শামুক বেচিয়া বেড়াইতেছে। সেগুলি দেখিতে এত সুন্দর যে, মনে হয়। ঠিক যেন গজদন্ত নির্ম্মিত সাদা সাদা ফুল। এই প্রবলগুলি ক্রমবিকাশপর্য্যায়ে জেলি মাছ হইতে এক স্তর উঁচু, শুধু দেহনল নয়, ইহাদের দেহে খাদ্যনলও সংযুক্ত আছে। দামও অতি অল্প। এক ডলার দিলে নানা রকম রঙ ও আকারের এক ঝুড়ি প্রবাল পাওয়া যায়। আমি অনেকগুলি কিনিয়া আনিয়াছি ও আমার অনেক বন্ধুবান্ধবকে উপহার দিয়াছি।

 সিঙ্গাপুর দ্বীপটীর উপকূলের অৰ্দ্ধেক অংশ ক্রমিক জেটী দিয়ে বাঁধান। এসকল স্থানে বাহাদুরী কাঠের অভাব নাই। বড় বড় বাহাদুরী কাঠ দিয়ে জেটী প্রস্তুত। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য এত বেশী যে, জাহাজ একবারে জেটীতে লাগিয়া মালপত্র নাবাইয়া না দিলে বা বোঝাই না নিলে চলে না। যতদূর চক্ষু যায়, জেটিতে সারি সারি জাহাজ বাঁধা রহিয়াছে। অতি ক্ষিপ্রতার সহিত আমাদের জাহাজ জেটীতে ভিড়ান হইল। চীনেম্যান কুলি, কুলির সরদার, কেরাণী ইত্যাদিতে জেটী পরিব্যাপ্ত। সবই চীনেম্যান। মাংসপেশী বহুল সুগঠন অর্দ্ধনগ্ন দেহে তাহারা অকাতরে ১০।১২ ঘণ্টা করিয়া খাটিয়া মাল নাবান-উঠান কাজ করিতেছে। জেটীর পাশেই বিস্তৃত আয়তন ঢেউতোলা টিনের গুদাম-ঘর। তার ভিতর হইতেই ছোট ট্টেণযোগে মালপত্র সহরের ভিতর নীত হইতেছে। তার নিকটেই পাথুরে কয়লার স্তুপ! বহুদূর ধরিয়া পর্ব্বতাকারে কয়লা রক্ষিত হইয়াছে। যেন সমুদ্রের ধারে বরাবর একটা অবিচ্ছিন্ন কয়লার পাহাড়ের সারি চলিয়া গিয়াছে। সিঙ্গাপুর জাহাজে কয়লা লইবার একটি প্রধান আড্ডা। জাহাজের জন্য পাথুরে কয়লা বোঝাই হইবার স্থান। এ অঞ্চলের সকল জাহাজই এখানে থামে। জাপান যাইবার জাহাজই ইউক, আর চীন যাইবার বা অষ্ট্রেলিয়া যাইবার জাহাজই হউক,—সকল জাহাজই এখানে আগে লাগে ও এখান হইতে কয়লা ও আবশ্যকীয় দ্রবাদি বোঝাই লয়। সিঙ্গাপুর যে কেবল বড় ব্যবসার স্থান বা কয়লা বোঝাই হইবার আড্ডা, তাহা নয়; এ স্হানটি অতি সুদৃঢ়রূপে রক্ষিত। এখনে একটী কেল্লা আছে, তাহা অতি সুকৌশলে গঠিত ও দুর্জ্জেয়।

 সিঙ্গাপুরের আবহাওয়া অতি সুন্দর। বিষুবরেখার অতি সন্নিকট, সুতরাং এস্থানটি খুব গরম হইবারই কথা; প্রকৃতপক্ষে এখানে কিন্তু বেশী গরম পড়ে না। সমুদ্রের নিকটবর্ত্তী সকল স্থানেই যেমন বেশী শীত বা বেশী গরম হয় না। এখানেও সেইরূপ। এখানে প্রায় সারা বছর ধরিয়াই একরূপ নাতিশীতোষ্ণ ঋতু বিরাজ করে। এখানে বর্ষাকাল বলিয়া কোনও কাল নাই। বৃষ্টি সারা বছরই মাঝে মাঝে হইয়া থাকে।

 যেখানে এমন চিরবসন্ত বিরাজমান, সেই স্থানের সেই ছোট ছোট পাহাড়ের উপরকার ছোট ছোট বাংলাগুলির দিকে চাহিলেই আমার মনে হইত,—যে ভাগ্যবান পুরুষেরা ঐ স্থানে বাস করেন,তাঁহারা কত সুস্থ শরীরে কত মনের সুখে থাকেন। উন্মুক্ত বিমল বাতাস দিবারাত্রি বাহিতেছে। কলিকাতার ঘন অবস্থিত ধূলি ও ধূমসমাকীর্ণ বাড়ীর তুলনায় এবাড়ীগুলি ত স্বৰ্গপুরী। অনন্ত সুনীল সমুদ্র চতুর্দ্দিকে বিস্তৃত। সূর্য্যোদয়ে, সূর্য্যাস্তে ও পূর্ণিমার বিমল আলোকে সমুদ্র বক্ষে নভোমণ্ডলের প্রতিবিম্ব পড়িয়া কতই না জানি শোভা হয়।