ছিন্নমুকুল/অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ

মিলন

 এইরূপে বোটের দিন গুলি কাটিতে লাগিল। বালিকার ক্রমে আরো লজ্জা ভাঙ্গিয়া গেল। হিরণকুমারের নিকট আস্তে আস্তে সে তাহার জীবনের কত গল্পই করিত, কতই অর্থহীন অমৃতময় আবল তাবল বকিত। কনক জীবনে কখনো আর কাহারো নিকট ওরূপ করিয়া গল্প করিতে পায় নাই, তাহার গল্প ওরূপ আগ্রহ সহকারে কেহই শুনে নাই। ছেলেবেলা যদি কখনো কোন কথা প্রমোদকে শুনাইতে যাইত, প্রমোদ বিরক্তির সহিত “কাজ আছে” বলিয়া উঠিয়া যাইতেন; এখন হিরণের সহিত প্রাণ খুলিয়া কথা কহিয়া সে যেরূপ আনন্দ পাইত, এরূপ পরমানন্দ জীবনে আর কখনো পায় নাই। হিরণকুমারেরও বালিকার সেই সকল অসংলগ্ন এলোথেলো অথচ মর্ম্ম-গাঁথুনীতে গ্রথিত কথাগুলি যেরূপ প্রতিপূর্ণ অর্থময় সারবচন বলিয়া মনে হইত এপর্য্যন্ত কোন দর্শনবিজ্ঞানে কোন মুনিবচনে তিনি সেরূপ আনন্দময় জ্ঞানের কথা শুনেন নাই। কত ঔৎসুক্যের সহিত কনকের মুখের দিকে চাহিয়া তিনি সেই কথাগুলি পান করিতেন বলা যায় না। জীবনের কিছু শুনিতে তাঁহার ওরূপ মিষ্ট লাগে নাই, কিছু দেখিয়া তাঁহার ওরূপ অতৃপ্তিময় তৃপ্তি জন্মায় নাই। গল্প করিতে করিতে যদি কোন কাজে তিনি উঠিয়া যাইতেন, অমনি বালিকার হৃদয়মধ্যে বিপ্লব উপস্থিত হইত, সমস্ত স্ফূর্তি চলিয়া যাইত, কতক্ষণে তিনি ফিরিয়া আসিবেন, কতক্ষণে সে তাহার গল্পটি শেষ করিবে এই ভাবনায় অস্থির হইয়া উঠিত। তিনি ফিরিয়া আসিলে তবে সে আরামের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিত। ফিরিয়া আসিলেই সে অমনি কথা কহিতে পারিত না কিন্তু নীরব নয়নে তাঁহাকে কত মৃদু তিরস্কার করিত, মনে মনে বলিত “না, তোমার গল্প শুনিতে তোমাকে দেখিতে আমার যেমন ভাল লাগে কখনই তোমার তেমন ভাল লাগে না। হিরণ তাহা বুঝিয়া একটু যেন অপ্রতিভ হইয়া একটু আদরের হাসি হাসিয়া বলিতেন “নিতান্ত দরকার ছিল তাই গিয়েছিলুম, দেখ দেখি কাজ অসমাপ্ত রেখেই আবার কত শীঘ্র ফিরে এসেছি।” অমনি বালিকা সকল ভুলিয়া যাইত, আবার গল্প করিতে আরম্ভ করিত, কিন্তু একটি গল্পও তাহার কখনও শেষ হইত না, একটি কথাও যেন তাহার ভাল করিয়া বলা হইত না।

 কিন্তু তাহাদের সেই সুখ ফুরাইয়া আসিল। ক্রমে তাঁহারা এলাহাবাদে পৌঁছিলেন। তাঁহাদের আগমন বার্ত্তা পাইয়া প্রমোদ মহা আহ্লাদের সহিত কনককে লইয়া যাইবার জন্য ঘাটে আসিলেন। কতদিন কনকের সহিত দেখা হয় নাই, আর যে কখনও দেখা হইবে তাহারও আশা ছিল না, মনে মনে কনকের রক্ষাকর্ত্তাকে ধন্যবাদ দিতে দিতে নদীতীরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হিরণ প্রমোদকে যে ইংরাজি চিঠি লেখেন তাহাতে তাঁহার পূর্ণ নাম সই ছিল না। ইংরাজি দস্তুর মত পদবীর পূর্ব্বে শুধু নামের প্রথম অক্ষর মাত্র লিখিয়াছিলেন! প্রমোদ সেই জন্য কে যে কনকের রক্ষাকর্ত্তা তাহা জানিতে পারেন নাই। এখন হিরণকুমারকে তীরে নামিয়া হাস্যমুখে তাঁহার সম্মুখীন্ হইতে দেখিয়া সহসা প্রমোদ একটু পিছাইয়া দাঁড়াইলেন, সহসা তাঁহার মূর্ত্তি কেমন ভিন্নভাব ধারণ করিল। প্রমোদ দেখিলেন তিনি যাহাকে আন্তরিক ঘৃণা করেন, তিনি যাহাকে শত্রু বলিয়া জানেন সেই হিরণই কনকের উদ্ধারকর্ত্তা। কি দৈব। হিরণের নিকট হইতে প্রমোদের আজ এমন উপকার গ্রহণ করিতে হইল? কনকের মৃত্যুও যে ইহা অপেক্ষা ভাল ছিল!

 হিরণকুমার প্রমোদের ভাবান্তর লক্ষ্য করিলেন, তাহাতে কিছু বিস্মিত হইলেন, কিন্তু ইহার কোন কারণই খুঁজিয়া পাইলেন না। প্রথম মনোবেগ কিছু শান্ত হইলে প্রমোদ ভাবিলেন “হিরণকুমার হাজার শত্রু হইলেও কনকের প্রাণ বাঁচাইয়াছে,”—এই ভাবিয়া মনের অসন্তুষ্টি ভাব দমন করিতে চেষ্টা করিয়া হিরণকুনারকে নিতান্ত কষ্টসৃষ্টে সাধুবাদ দিয়া কনককে গৃহে লইয়া আসিলেন। প্রমোদের ব্যবহারে হিরণ সন্তুষ্ট হইলেন না।

 কনক কতনি পরে আজ প্রমোদকে দেখিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইল। প্রায় দুই মাসের পর বাড়ী আসিয়া কনক অনেক পরিবর্ত্তন দেখিল। দেখিল তাহার ভ্রাতার বিবাহ হইয়া গিয়াছে, তাহার একটি সঙ্গিনী জুটিয়াছে!

 সুশীলার মৃত্যুর পর প্রমোদ সমস্ত বিভবের অধিপতি হইয়া নববধূ লইয়া এখন এলাহাবাদেই আছেন। প্রমোদ কলিকাতায় আর পড়েন না, স্ত্রী এবং বিদ্যা দুই রত্নের আদর এক সময়ে হয় না, প্রমোদের এখন পড়া সাঙ্গ হইয়াছিল। সুশীলার মৃত্যুর কিছু দিন পরেই প্রমোদের বিবাহ হইয়াছিল। সুশীলার মৃত্যু এবং কনকের জলমগ্ন সংবাদ তাড়িততারে পাইবামাত্র প্রমোদ বাড়ী আসেন। অনেক অনুসন্ধান করিয়াও কনকের দেহ পর্য্যন্ত পাওয়া গেল না।এদিকে সুশীলার মৃত্যুর একমাস পরেই দয়ানন্দ কন্যা লইযা এখানে আসিয়া কন্যার বিবাহ দিয়া গেলেন। কনকের মৃত্যুসংবাদে যামিনীনাথ অত্যন্ত হতাশ হইলেন, যে লোভে নীরজাকে ছাড়িলেন তাঁহার সে লোভও ব্যর্থ হইল।

বাড়ী আসিয়া কনক নববধূ নীরজার সহিত সাক্ষাৎ করিল, অমন সুন্দরী বধূ দেখিয়াও কনকের মনে হইল “দাদার সমযোগ্য বৌ হয় নাই।”

 নীরজা এখানে আসিয়া অল্প দিনের মধ্যেই কুলবধূর মত হইয়া পড়িয়াছে, এখন আর সে আগেকার মত অরণ্যবালিকা নাই, এখন নীরজা প্রমােদের কাছে থাকিয়া সহরের অনেক হাবভাব কথাবার্ত্তা শিখিয়া ফেলিয়াছে। সংসারের কাজকর্ম্ম করা, ভদ্রতার অভিধানের চলিত কথাগুলি মুখস্থ করা, সাজসজ্জা করিয়া অন্যের কাছে নিজের সম্মান রক্ষা করা, এ সকলে সে নূতন দীক্ষিত হইতেছিল। দিন কতকের জন্য তাহাব মনে যে বিষণ্ণ ভাব আসিয়াছিল তাহা গিয়া নীরজার হৃদয় এখন হর্ষোচ্ছ্বাসে পূর্ণ। মনের মত লােক পাইয়া এখন আর সে কাকাতুয়াব সহিত কথা কহে না, ফুল লইয়া খেলে না, এখন তাহাব খেলা, আমােদ, গল্প, সকলি মানুষেব সহিত। এখন লীলাময়ী যমুনার উপর, কুলস্থ বটবৃক্ষ পতনের মত নীরজার তরল স্বভাবে গৃহস্থের ভাব আসিয়া পড়িয়াছে; এখন বনের পক্ষী পিঁজরায় আবদ্ধ হইয়া লোজরঞ্জন কথা কহিতে শিখিয়াছে; এখন বনবালা নীরজা আবার সাংসারিক নীরজা হইয়াছে। ক্রমে দিনে দিনে নীরজার সহিত কনকের বন্ধুতা জন্মিতে লাগিল।