জগন্নাথের রথ/জগন্নাথের রথ

উইকিসংকলন থেকে

জগন্নাথের রথ

 আদর্শ সমাজ মনুষ্য-সমষ্টির অন্তরাত্মা ভগবানের বাহন, জগন্নাথের যাত্রার রথ। ঐক্য স্বাধীনতা জ্ঞান শক্তি সেই রথের চারি চক্র।

 মনুষ্যবুদ্ধির গঠিত কিম্বা প্রকৃতির অশুদ্ধ প্রাণস্পন্দনের খেলায় সৃষ্ট যে সমাজ, তাহা অন্য প্রকার। এটি সমষ্টির নিয়ন্তা ভগবানের রথ নহে, মুক্ত অন্তর্যামীকে আচ্ছাদিত করিয়া যে বহুরূপী দেবতা ভগবৎ-প্রেরণাকে বিকৃত করে, ইহা সমষ্টিগত সেই অহঙ্কারের বাহন। এটি চলিতেছে নানা ভোগপূর্ণ লক্ষ্যহীন কর্ম্মপথে, বুদ্ধির অসিদ্ধ অপূর্ণ সঙ্কল্পের টানে, নিম্নপ্রকৃতির পুরাতন বা নূতন অবশ প্রেরণায়। যতদিন অহঙ্কারই কর্ত্তা, ততদিন প্রকৃত লক্ষ্যের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব,—লক্ষ্য জানা গেলেও সেদিকে সোজা রথ চালানো অসাধ্য। অহঙ্কার যে ভাগবত পূর্ণতার প্রধান বাধা, এই তথ্য যেমন ব্যষ্টির, তেমনই সমষ্টির পক্ষেও সত্য।

 সাধারণ মনুষ্যসমাজের তিনটি মুখ্য ভেদ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমটি নিপুণ কারিগরের সৃষ্টি, সুঠাম চাকচিক্যময় উজ‍্জ্বল অমল সুখকর, তাহাকে বহিয়া লইয়াছে বলবান সুশিক্ষিত অশ্ব, সে অগ্রসর হইতেছে সুপথে সযত্নে ত্বরারহিত অমন্থর গতিতে। সাত্ত্বিক অহঙ্কার ইহার মালিক আরোহী। যে উপরিস্থ উতুঙ্গ প্রদেশে ভগবানের মন্দির, রথ তাহারই চারিদিকে ঘুরিতেছে, কিন্তু কিছু দূরে দূরে রহিয়া, সেই উচচভূমির খুব নিকটে সে পৌঁছিতে পারে না। যদি উঠিতে হয়, তবে রথ হইতে নামিয়া একা পদব্রজে উঠাই নিয়ম। বৈদিকযুগের পরে প্রাচীন আর্যদের সমাজকে এই ধরণের রথ বলা যায়।

 দ্বিতীয়টি বিলাসী কর্ম্মঠের মোটরগাড়ী। ধূলার ঝড়ের মধ্যে ভীমবেগে বজ্রনির্ঘোষে রাজপথ চূর্ণ করিয়া অশান্ত অশ্রান্ত গতিতে সে ধাইয়াছে, ভেরীর রবে শ্রবণ বধির, যাহাকে সম্মুখে পায় দলিয়া পিষিয়া চলিয়া যায়। যাত্রীর প্রাণের সঙ্কট, দুর্ঘটনা অবিরল, রথ ভাঙ্গিয়া যায়, আবার কষ্টেসৃষ্টে মেরামতের পর সদর্প চলন। নিদিষ্ট লক্ষ্য নাই, তবে যে নূতন দৃশ্য অনতিদূরে চোখের সম্মুখে পড়ে, “এই লক্ষ্য, এই লক্ষ্য” চীৎকার করিয়া রথের মালিক রাজসিক অহঙ্কার সেই দিকে ছুটে। এই রথে চলায় যথেষ্ট ভোগ সুখ আছে, বিপদ ও অনিবার্য্য, ভগবানের নিকট পোঁছা অসম্ভব। আধুনিক পাশ্চাত্যসমাজ এই ধরণেরই মোটরগাড়ী।

 তৃতীয়টি মলিন পুরাণ কচছপগতি আধভাঙ্গা গরুরগাড়ী, টানে কৃশ অনশনক্লিষ্ট আধমরা বলদ, চলিতেছে সঙ্কীর্ণ গ্রাম্যপথে; একজন ময়লাকাপড়পরা ভূঁড়িসর্ব্বস্ব শ্লথ অন্ধ বুদ্ধ ভিতরে বসিয়া মহাসুখে কাদামাখা হুঁকা টানিতে টানিতে গাড়ীর কর্কশ ঘ্যান্‌ ঘ্যান্‌ শব্দ শুনিতে শুনিতে অতীতের কত বিকৃত আধ আধ সমৃতিতে মগ্ন। এই মালিকের নাম তামসিক অহঙ্কার। গাড়োয়ানের নাম পুঁথি-পড়া জ্ঞান, সে পঞ্জিকা দেখিতে দেখিতে গমনের সময় ও দিক নির্দ্দেশ করে, মুখে এই বুলি “যাহা আছে বা ছিল, তাহাই ভাল, যাহা হইবার চেষ্টা তাহাই খারাপ।” এই রথে ভগবানের নিকট না হৌক শূন্য ব্রহ্মে পেীঁছিবার বেশ আশু সম্ভাবনা আছে।

 তামসিক অহঙ্কারের গরুর গাড়ী যতক্ষণ গ্রামের কাঁচাপথে চলে, ততক্ষণ রক্ষা। যেদিন জগতের রাজপথে সে উঠিয়া আসিবে যেখানে ভূরি ভুরি বেগদৃপ্ত মোটরের ছুটাছুটি, তখন তাহার কি পরিণাম হইবে, সে কথা ভাবিতেই প্রাণ শিহরিয়া উঠে। বিপদ এই যে রথ বদলানের সময় চেনা বা স্বীকার করা তামসিক অহঙ্কারের জ্ঞান শক্তিতে কুলায় না। চিনিবার প্রবৃত্তিও নাই, তাহা হইলে তাহার ব্যবসা ও মালিকত্ব মাটি। সমস্যা যখন উপস্থিত, যাত্রীদের মধ্যে কেহ কেহ বলে “না থাক্, ইহাই ভাল, কেননা ইহা আমাদেরই” —তাঁহারা গোড়া অথবা ভাবুক দেশভক্ত। কেহ কেহ বলে, “এদিকে ওদিকে মেরামত করিয়া লও না” —এই সহজ উপায়ে নাকি গরুরগাড়ী অমনি অনিন্দ্য অমূল্য মোটরে পরিণত হইবে; —ইঁহাদের নাম সংস্কারক। কেহ কেহ বলে, “পুরাতন কালের সুন্দর রথটি ফিরিয়া আসুক” —তাঁহারা সেই অসাধ্য-সাধনের উপায়ও খুঁজিতে মাঝে মাঝে প্রয়াসী। আশার অনুরূপ ফল যে হইবে, তাহার বিশেষ কোন লক্ষণ কোথাও কিন্তু নাই।

 তিনটির মধ্যেই যদি পছন্দ করা অনিবার্য্য হয়, আরও উচচতর চেষ্টা যদি আমরা পরিহার করি, তবে সাত্ত্বিক অহঙ্কারের নতন রথ নির্ম্মাণ করা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু জগন্নাথের রথ যতদিন সৃষ্টি না হয়, আদর্শ সমাজও ততদিন গঠিত হইবে না। সেইটিই আদর্শ, সেইটিই চরম, গভীরতম উচচতম সত্যের বিকাশ ও প্রতিকৃতি। মনুষ্যজাতি গুপ্ত বিশ্বপুরুষের প্রেরণায় তাহাকেই গড়িতে সচেষ্ট, কিন্তু প্রকৃতির অজ্ঞানবশে গড়িয়া বসে অন্যরূপ প্রতিমা—হয় বিকৃত অসিদ্ধ কুৎসিত, নয় চলনসই অৰ্দ্ধসুন্দর বা সৌন্দর্য্য সত্ত্বেও অসম্পূর্ণ; শিবের বদলে হয় বামন, নয় রাক্ষস, নয় মধ্যম লোকের অৰ্দ্ধদেবতা।

 জগন্নাথের রথের প্রকৃত আকৃতি বা নমুনা কেহ জানে না, কোন জীবন-শিল্পী আঁকিতে পারগ নন। সেই ছবি বিশ্বপুরুষের হৃদয়ে প্রস্তুত, নানা আবরণে আবৃত। দ্রষ্ট। কর্ত্তা অনেক ভগবদ‍্বিভূতির অনেক চেষ্টায় আস্তে আস্তে বাহির করিয়া স্থ‌ূল জগতে প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্যামীর অভিসন্ধি।

⁕ ⁕

 জগন্নাথের এই রথের আসল নাম সমাজ নয়, সংঘ। বহুমুখী শিথিল জনসংঘ বা জনতা নয়; আত্মজ্ঞানের, ভাগবতজ্ঞানের ঐক্যমুখী শক্তির বলে সানন্দে গঠিত বন্ধনরহিত অচ্ছেদ্য সংহতি, ভাগবত সংঘ।

 অনেক সমবেত মনুষ্যের একত্র কর্ম্ম করিবার উপায় যে সংহতি, তাহাই সমাজ নামে খ্যাত। শব্দের উৎপত্তি বুঝিয়া অর্থও বোঝা যায়। সম্ প্রত্যয়ের অর্থ একত্র, অজ্ ধাতুর অর্থ গমন ধাবন যুদ্ধ। সহস্র সহস্র মানব কর্ম্মার্থে ও কামার্থে সমবেত, এক ক্ষেত্রে নানা লক্ষ্যের দিকে ধাবিত, কে আগে যায় কে বড় হয়, তাহা লইয়া বস্তাধবস্তি— competition— যেমন অন্য সমাজের সঙ্গে তেমন পরস্পরের সঙ্গেও যুদ্ধ ও ঝগড়াবঁটি —এই কোলাহলের মধ্যেই শৃঙ্খলার জন্য, সাহায্যের জন্য, মনোবৃত্তির চরিতার্থতার জন্য নানা সম্বন্ধ স্থাপন, নানা আদর্শের প্রতিষ্ঠা, ফলে কষ্টসিদ্ধ অসম্পূর্ণ অস্থায়ী কিছু, ইহাই সমাজের, প্রাকৃত সংসারের চেহারা।

 ভেদকে ভিত্তি করিয়া প্রাকৃত সমাজ। সেই ভেদের উপর আংশিক অনিশ্চিত ও অস্থায়ী ঐক্য নির্ম্মিত। আদর্শ সমাজের গড়ন ঠিক ইহার বিপরীত। ঐক্য ভিত্তি; আনন্দ-বৈচিত্র্যের জন্য —ভেদের নয় —পার্থক্যের খেলা। সমাজে পাই শারীরিক, মানসকল্পিত ও কর্ম্মগত ঐক্যের আভাস, আত্মগত ঐক্য সংঘের প্রাণ।

 আংশিকভাবে সঙ্কীর্ণক্ষেত্রে সংঘস্থাপনের নিষ্ফল চেষ্টা কতবার হইয়াছে, হয় তাহা বুদ্ধিগত চিন্তার প্রেরণায়—যেমন পাশ্চাত্যদেশে, নয় নির্ব্বাণোন্মুখ কর্ম্মবিরতির স্বচ্ছন্দ অনুশীলনার্থে—যেমন বৌদ্ধদের, নয় বা ভাগবত ভাবের আবেগে—যেমন প্রথম খৃষ্টীয় সংঘ। কিন্তু অল্পের মধ্যেই সমাজের যত দোষ অসম্পূর্ণতা প্রবৃত্তি চুকিয়া সংঘকে সমাজে পরিণত করে। চঞ্চল বুদ্ধির চিন্তা ঢেঁকে না, পুরাতন বা নূতন প্রাণ-প্রবৃত্তির অদম্য স্রোতে ভাসিয়া যায়। ভাবের আবেগে এই চেষ্টার সাফল্য অসম্ভব, ভাব নিজের খরতায় পরিশ্রান্ত হইয়া পড়ে। নির্ব্বাণকে একাকী খোঁজা ভাল, নির্ব্বাণপ্রিয়তায় সংঘসৃষ্টি একটা বিপরীত কাণ্ড। সংঘ স্বভাবতঃ কর্ম্মের, সম্বন্ধের লীলাভূমি।

 যেদিন জ্ঞান কর্ম্ম ও ভাবের সামঞ্জস্যে ও একীকরণে আত্মগত ঐক্য দেখা দিবে, সমষ্টিগত বিরাটপুরুষের ইচ্ছাশক্তির প্রেরণায়, সেদিন জগন্নাথের রথ জগতের রাস্তায় বাহির হইয়া দশ দিক আলোকিত করিবে। সত্যযুগ নামিবে পৃথিবীর বক্ষে, মর্ত্ত্য মানুষের পৃথিবী হইবে দেবতার খেলার শিবির, ভগবানের মন্দির-নগরী, temple city of God - আনন্দপুরী।