বিষয়বস্তুতে চলুন

জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ/যৌবনের সাধনা

উইকিসংকলন থেকে

যৌবনের সাধনা

 রবীন্দ্রনাথ যখন নবীন যুবক তখন বাঙলা দেশে ‘বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ’। বঙ্কিমচন্দ্র কেবল সাহিত্যস্রষ্টা ছিলেন না, তৎকালীন বাঙলার চিন্তা ও ভাব জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন তিনিই। যাঁহারা মনে করেন, বঙ্কিমচন্দ্র কেবল বাঙলা সাহিত্যকে নূতন করিয়া গড়িয়াছিলেন, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখিয়া, সাময়িক পত্র প্রকাশ করিয়া দেশবাসীর চিত্তে মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাঁহাদের দৃষ্টি অতীব সংকীর্ণ। প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন একটা নবযুগের স্রষ্টা—নবীন বাঙালী জাতির পথপ্রদর্শক। সাহিত্যের মধ্য দিয়া তিনি যে প্রবল ভাবের বন্যা প্রবাহিত করিয়াছিলেন, তাহার তরঙ্গ রাষ্ট্রে, সমাজে, ধর্মে সর্বত্র আঘাত করিয়া জাতির সম্মুখে নূতন দ্বার খুলিয়া দিয়াছিল। এক কথায় ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ পাদে তিনিই ছিলেন যুগনায়ক। কালিদাস হিমালয়ের বর্ণনা করিতে গিয়া বলিয়াছেন,—“পূর্বাপরৌ তোয়নিধী বগাহ্য স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদণ্ডঃ।” বাঙলার নবযুগের আন্দোলনে বঙ্কিমচন্দ্রের সম্বন্ধেও এই বর্ণনাই করা যাইতে পারে।

 ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে পাশ্চাত্য শিক্ষা সভ্যতার সংঘর্ষে আমাদের সমাজ ও সভ্যতা বিপর্যস্ত হইবার উপক্রম হইয়াছিল। পাশ্চাত্যের বিদ্যুৎ-ঝলকে আমাদের শিক্ষিত সমাজের চোখ ধাঁধিয়া গিয়াছিল, তাঁহারা ভাবিয়া দেখেন নাই,—

যে বিদ্যুৎ-ছটা
রমে আঁখি, মরে নর, তাহার পরশে।

‘মেঘনাদবধ কাব্য’, তৃতীয় সর্গ

তাই তাঁহারা তাল সামলাইতে পারেন নাই; পাশ্চাত্যের সঙ্গে তুলনায় তাঁহারা নিজেদের সমাজের সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে অবজ্ঞা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং সর্ববিষয়ে পশ্চিমেরই অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্য দিয়া এই বিজাতীয় ভাবটা খুব বেশী পরিমাণে সংক্রামিত হইয়াছিল। বাঙলার নবীন যুগের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন এই বিপর্যয়ের ট্রাজেডির একটা বড় দৃষ্টান্ত। এই সর্বনাশা স্রোতের বিপরীত গতি হইতে জাতিকে রক্ষা করিবার প্রথম চেষ্টা আরম্ভ করেন পুণ্যশ্লোক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরভূদেব মুখোপাধ্যায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুররাজনারায়ণ বসুও ওই কার্যে যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিলেন। ইঁহারা সকলেই জাতির পূর্ব গৌরবের স্মৃতি ফিরাইয়া আনিয়া তাহাকে আত্মস্থ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া বাঙালী জাতিকে নূতন ভিত্তির উপরে গঠন করিবার কার্যে বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্ব অসামান্য। পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক সভ্যতা, তাহার প্রত্যক্ষবাদ ও কার্যকরী শক্তিকে তিনি উপেক্ষা করেন নাই, বরং উহার মধ্যে যে নবশক্তির রসায়ন আছে, তাহা স্বজাতির চিত্তে সঞ্চার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। অন্য দিকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতার গৌরব ও মহত্বও তিনি জাতির সম্মুখে উজ্জ্বলভাবে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন। আমাদের ধর্ম ও সমাজকে প্রাচীন জড়তা হইতে মুক্ত করিয়া একটা নব রূপান্তরের প্রেরণা দিয়াছিলেন। যাহাকে ইংরেজী ভাষায় বলে জাতি ও সমাজের Re-construction বা পুনসংগঠন— তাহাই ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের মহাব্রত এবং সমস্ত জীবন সাহিত্য ও সাময়িক পত্রের মধ্য দিয়া তিনি এই মহাব্রত পালন করিয়া গিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্রকে বুঝিতে হইলে, তাঁহার যুগকে বুঝিতে হইলে এই মূল সূত্রটি ধরিতে ও বুঝিতে হইবে।

 বাঙলার জাতীয় আন্দোলন ও স্বাদেশিকতার উপর এই বঙ্কিম-প্রতিভার প্রভাব অপরিসীম। তাঁহার জাতীয় আদর্শের মূল ভিত্তি ছিল আত্মশক্তির সাধনা ও ভিক্ষা-নীতি বর্জন। প্রভুজাতির নিকট আবেদন-নিবেদন করিয়া যে কোন জাতি স্বাধীন হইতে পারে না, রাজনীতিতে ভিক্ষুকের যে কোন স্থান নাই, নিজের শক্তির উপর নির্ভর করিয়া কঠোর সাধনার পথেই যে জাতিকে স্বপ্রতিষ্ঠ হইতে হইবে, বঙ্কিমচন্দ্র নানাভাবে নানাদিক দিয়া এই নিষ্ঠুর সত্যই দেশবাসীকে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছিলেন। একদিকে অতীত ইতিহাসের পৃষ্ঠা উদ্ঘাটন করিয়া তিনি জাতির ত্রুটি ও দৌর্বল্য প্রদর্শন করিতে যেমন দ্বিধা করেন নাই, অন্যদিকে স্বজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করিয়া আশার বাণীও শুনাইয়াছিলেন। জননী জন্মভূমি তাঁহার নিকট কেবল আকাশ, জল, মাটি ও লোকসমষ্টিমাত্র ছিল না,—তিনি ইহার মধ্যে চিন্ময়ী দেবী রূপই প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। “বন্দে মাতরম্” সংগীতে মায়ের এই চিন্ময়ী রূপই ধ্যান করা হইয়াছে। তাঁহার স্বদেশপ্রেম ছিল ভক্তিরই নামান্তর। সর্বস্ব ত্যাগ—এই প্রেমের সাধনায় সিদ্ধি লাভের উপায়। স্বদেশপ্রেমের ‘গীতা’স্বরূপ ‘আনন্দমঠে’ এই সর্বস্ব ত্যাগের সাধনারই পথ প্রদর্শিত হইয়াছে। ‘সন্তানেরা’ বলিতেছেন,—জননী জন্মভূমিই আমাদের মা, আমাদের অন্য মা নাই;— আমাদের গৃহ নাই, পত্নী নাই, পুত্র পরিজন নাই,—আছেন কেবল জননী জন্মভূমি, তাঁহার সেবাতেই আমরা জীবন উৎসর্গ করিয়াছি।

 ‘বঙ্গদর্শন’-এর মধ্য দিয়াই বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে স্বদেশ-যজ্ঞের হোমানল প্রজ্বলিত করিয়াছিলেন। এই মহাযজ্ঞে তাঁহাকে সহায়তা করিবার জন্য যাঁহারা সহকর্মীরূপে তাঁহার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই ছিলেন এক একজন দিকপাল, শক্তিমান পুরুষ। স্বদেশপ্রেমের অনির্বাণ অগ্নি তাঁহাদের হৃদয়ে প্রজ্বলিত হইয়াছিল এবং সেই অগ্নি চারিদিকে তাঁহারা ছড়াইয়া দিয়াছিলেন। দীনবন্ধু মিত্র, কবি হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, রজনীকান্ত গুপ্ত, রামদাস সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতি স্বনামধন্য কবি, মনীষী ও সাহিত্যিকেরা বঙ্কিম-মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত। এই সৌরমণ্ডলের বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন সূর্য, আর অন্য সকলে জ্যোতিষ্মান গ্রহ। বাঙলার স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তার উদ্বোধনে ইঁহাদের দানের তুলনা নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের ন্যায় ইঁহারা সকলেই ছিলেন আত্মশক্তির সাধক—ভিক্ষা-নীতির ঘোর বিরোধী। ইঁহাদের মধ্যে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। স্বদেশপ্রেম ও স্বজাতিপ্রীতির উদ্বোধনই ছিল তাঁহার সাহিত্যসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। ম্যাটসিনি ও গ্যারিবল্ডির জীবনী, স্বাধীনতাকামী রাজপুত বীরদের জীবন-কাহিনী, এবং বহু স্বদেশ-প্রেমোদ্দীপক প্রবন্ধ প্রভৃতি লিখিয়া তিনি স্বজাতির মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।

 বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দে মাতরম”-মন্ত্র সাহিত্যক্ষেত্রে তিনিই বোধ হয় প্রথম প্রয়োগ করেন। ১৮৯০ খৃঃ তিনি গ্যারিবল্ডির জীবনবৃত্ত প্রকাশ করেন। ঐ গ্রন্থের “উদ্বোধনী”র শেষে তিনি লিখিয়াছিলেন—“এস আর দেরী করিও না। সময় আসিয়াছে!! গগন বিদারিয়া গাও “বন্দে মাতরম্”—স্বদেশানুরাগ ভগদ্ভক্তির সহিত মিশ্রিত হইয়া ভারতে আবার নবযুগের উৎপত্তি করুক!!!”

 স্বদেশপ্রেমিক প্রত্যেক বাঙালী যুবকের যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের গ্রন্থাবলী পুনঃ পুনঃ পাঠ করা উচিত। উহা স্বদেশপ্রেম ও জাতীয় ভাবের মহান্ উৎসস্বরূপ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

 বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক স্বনামধন্য কেশবচন্দ্র সেনের নামও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করিতে হইবে। কেশবচন্দ্র কেবল ধর্ম প্রবর্তক ও সমাজসংস্কারক ছিলেন না। জাতীয় আন্দোলনের মূলেও তাঁহার দান প্রচুর। সংবাদপত্র প্রচার, বক্তৃতা প্রভৃতির মধ্য দিয়া স্বদেশপ্রেম ও স্বজাতিপ্রীতিও তিনি দেশবাসীর মনে জাগ্রত করিয়াছিলেন। তখনকার দিনের বহু ইংরেজী-শিক্ষিত নব্যযুবক তাঁহারই মন্ত্রশিষ্য ছিলেন এবং উত্তরকালে রাজনৈতিক আন্দোলনে অগ্রণী হইয়াছিলেন। তন্মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে।

 এস্থলে উল্লেখযোগ্য যে, বাঙলায় একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন রাজা রামমোহন রায়ের সময় হইতেই চলিয়া আসিতেছিল। বৃটিশ-প্রভুদের নিকট আবেদন-নিবেদন, তাঁহাদের প্রসাদ ভিক্ষাই ছিল এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল মন্ত্র। রাজা রামমোহনের পরে তাঁহার রাজনৈতিক শিষ্যেরা এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রাখিয়াছিলেন। ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ এই উদ্দেশ্য লইয়াই স্থাপিত হইয়াছিল। এই যুগে রামগোপাল ঘোষ, ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল, কিশোরীচাঁদ মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ (সাংবাদিক) প্রভৃতি ছিলেন ঐ আন্দোলনের মুখপাত্র। তারপর আসিল ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘ইণ্ডিয়ান লীগ’। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, মনোমোহন ঘোষ, দুর্গামোহন দাস, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, শিশিরকুমার ঘোষ, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রভৃতি ছিলেন ইহার নেতা। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্ম হয়। কংগ্রেস ঐ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেরই উত্তরাধিকারীরূপে দেখা দেয় এবং স্বদেশী আন্দোলনের সময় পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক পন্থা বা ভিক্ষা-নীতিই ছিল তাহার প্রধান পন্থা। এই কারণেই আত্মশক্তির সাধক ও স্বাধীনতার আদর্শবাদী বাঙলার কবি ও সাহিত্যিকেরা ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, কংগ্রেস প্রভৃতির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না। তাঁহারা ঐ ভিক্ষা-নীতিকে বরং নানাভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রূপই করিতেন। প্রকৃতপক্ষে বাঙলা সাহিত্যের সূতিকাগারেই স্বাধীনতা আন্দোলন তথা স্বদেশী আন্দোলনের জন্ম এবং বাঙলার কবি ও সাহিত্যিকেরাই ধাত্রীর ন্যায় ইহাকে পালন করিয়া আসিয়াছেন। এজন্য কেবল বাঙলা দেশ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষই ইহাদের নিকট ঋণী। পূর্বোল্লিখিত বিখ্যাত হিন্দু মেলায় বাঙলার কবি ও সাহিত্যিকেরাই ছিলেন কর্ণধার। তাই ইহার মধ্য দিয়া আত্মশক্তি সাধনার সুরই ফুটিয়া উঠিয়াছিল।

 কবি রবীন্দ্রনাথ পূর্বগামী বাঙলা সাহিত্যিকদের নিকট হইতেই আত্মশক্তির সাধনার এই ধারা লাভ করিয়াছিলেন,—এ বিষয়ে তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রেরই যোগ্য শিষ্য। বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্য-শিষ্য হিসাবে তরুণ রবীন্দ্রনাথের গলায় নিজের মালা পরাইয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু কেবল তাহাতেই বঙ্কিমচন্দ্র সন্তুষ্ট হন নাই। রবীন্দ্রনাথকে আত্মশক্তির সাধনাতেও তিনি দীক্ষা দিয়াছিলেন। তরুণ রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং প্রায়ই তাঁহার নিকট যাইতেন। এই বিরাট ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসিয়া রবীন্দ্রনাথের চিত্তে যে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়ভাবের বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই।

 ১৮৯২ সালে ‘সাধনা’ পত্র প্রকাশিত হয় এবং সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে সম্পাদক থাকিলেও প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ উহার সম্পাদনের ভার গ্রহণ করেন। ইহা তাঁহার জীবনের একটি প্রধান ঘটনা। এই ‘সাধনা’ পত্রে রবীন্দ্রনাথের বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রবন্ধ, জাতীয়ভাবপূর্ণ কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হয়। তাঁহার বিখ্যাত কবিতা ‘এবার ফিরাও মোরে’ এই ‘সাধনা’তেই প্রকাশিত হয়।

“কী গাহিবে কী শুনাবে। বল মিথ্যা আপনার সুখ,
মিথ্যা আপনার দুঃখ। স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ,
বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।
মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা।
মৃত্যুরে না করি শঙ্কা। দুর্দিনের অশ্রুজলধারা;

মস্তকে পড়িবে ঝরি, তারি মাঝে যাব অভিসারে
তার কাছে, জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে
জন্ম জন্ম ধরি।

* * *

শুধু জানি
সে বিশ্বপ্রিয়ার প্রেমে ক্ষুদ্রতারে দিয়া বলিদান
বর্জিতে হইবে দূরে জীবনের সর্ব অসম্মান,
সম্মুখে দাঁড়াতে হবে, উন্নত মস্তক উচ্চে তুলি
যে মস্তকে ভয় লেখে নাই লেখা, দাসত্বের ধূলি
আঁকে নাই কলঙ্কতিলক।

* * *

 এই সমস্ত লেখারই মূল নীতি ছিল,— আত্মশক্তির দ্বারাই জাতিকে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হইতে হইবে—‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ’। বস্তুত ‘সাধনা’কে রবীন্দ্রনাথের যৌবনের সাধনার যুগও বলা যাইতে পারে।

 এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ জনসভায় যে সমস্ত বক্তৃতা ও প্রবন্ধ পাঠ করেন, তাহারও মূল সুর ছিল ঐরূপ। ১৮৯৩ সালে তিনি কলিকাতার এক জনসভায় (চৈতন্য লাইব্রেরীতে) তাঁহার বিখ্যাত প্রবন্ধ “ইংরেজ ও ভারতবাসী” পাঠ করেন। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন এই সভার সভাপতি। রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে বলেন,—“সম্মান বঞ্চনা করিয়া লইব না, সম্মান আকর্ষণ করিব। নিজের মধ্যে সম্মান অনুভব করিব। সেদিন যখন আসিবে, তখন পৃথিবীর যে সভায় ইচ্ছা প্রবেশ করিব—ছদ্ম বেশ, ছদ্ম নাম, ছদ্ম ব্যবহার এবং যাচিয়া মান, কাঁদিয়া সোহাগের কোন প্রয়োজন থাকিবে না।

 “সকল দিক পর্যালোচনা করিয়া রাজা-প্রজার বিদ্বেষ ভাব শাসিত রাখিবার প্রকৃষ্ট উপায় এই দেখা যাইতেছে—ইংরেজ হইতে দূরে থাকিয়া আমাদের নিকট কর্তব্যসকল পালনে একান্ত মনে নিযুক্ত হওয়া। কেবলমাত্র ভিক্ষা করিয়াই কখনই আমাদের মনের যথার্থ সন্তোষ হইবে না। আজ আমরা মনে করিতেছি, ইংরেজের নিকট কতকগুলি অধিকার পাইলেই আমাদের সকল দুঃখ দূর হইবে। ভিক্ষা স্বরূপে সমস্ত অধিকারগুলি যখন পাইব, তখনো দেখিব অন্তর হইতে লাঞ্ছনা কিছুতেই দূর হইতেছে না—বরং যতদিন না পাইয়াছি ততদিন যে সান্ত্বনাটুকু ছিল, সে সান্ত্বনাও আর থাকিবে না।... ইংরেজের কাছে আদর কুড়াইয়া কোন ফল নাই, আপনাদের মনুষ্যত্বকে সচেতন করিয়া তোলাতেই যথার্থ গৌরব; অন্যের নিকট ফাঁকি দিয়া আদায় করিয়া কিছু পাওয়া যায় না, প্রাণপণে নিষ্ঠার সহিত ত্যাগস্বীকারেই প্রকৃত কার্যসিদ্ধি।”

 এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেস ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সের কয়েকটি অধিবেশনে যোগ দিয়াছিলেন, কিন্তু সর্বত্রই তিনি ‘আবেদন-নিবেদনের নীতি’র প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করিতেন এবং আত্মশক্তির সাধনার উপরেই জোর দিতেন। ১৮৮৬ সালে কলিকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ যোগদান করেন এবং নিজের রচিত “আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে” এই গানটি করেন। তারপর ১৮৯৬ সালে কলিকাতায় যে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়, তাহাতেও তিনি যোগ দেন। লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। এই অধিবেশনেই রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত জাতীয় সংগীত “বন্দে মাতরম্” নিজে সুরসংযোগ করিয়া গান করেন। সেই হইতে “বন্দে মাতরম্” গান রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত সুরেই প্রতি বৎসর কংগ্রেসে গীত হইয়া আসিতেছে। জনসাধারণের মধ্যেও এই সুর প্রচলিত হইয়াছে। সুতরাং জাতীয় আন্দোলনে ইহা রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ দান বলা যাইতে পারে। ১৮৯৭ সালে নাটোরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্স বা রাষ্ট্রসম্মিলনীর যে অধিবেশন হয়, তাহাতে রবীন্দ্রনাথ যোগ দিয়াছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ঐ অধিবেশনের সভাপতি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীযুত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ ‘তরুণের দল’ ছিলেন। ঐ সময়ে এই সব রাজনৈতিক সম্মিলনীতে বক্তৃতা, প্রস্তাব প্রভৃতি ইংরেজী ভাষাতেই হইত। নাটোরের সম্মিলনে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ‘তরুণের দল’ দাবী করিলেন যে, বাঙলা ভাষাতেই সমস্ত কার্য পরিচালিত হইবে। ইংরেজীনবিস প্রবীণেরা প্রমাদ গণিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলে ভারী তরুণদের দাবীই তাঁহাদের মানিয়া লইতে হইল। অবনীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘ঘরোয়া’ নামক গ্রন্থে এ বিষয়ে যে সরস বর্ণনা করিয়াছেন, তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না।—

 “আগে থেকেই ঠিক ছিল, রবিকাকা প্রস্তাব করেন, প্রোভিন্সিয়াল কনফারেন্স বাঙলা ভাষায় হবে। আমরা ছোক্‌রারা সবাই রবিকাকার দলে। আমরা বললুম, নিশ্চয়ই, প্রোভিন্সিয়াল কনফারেন্সে বাঙলা ভাষার স্থান হওয়া চাই। ররিকাকাকে বললুম, ছেড়ো না, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব এজন্যে। সেই নিয়ে আমাদের বাধল চাঁইদের সঙ্গে। তাঁরা আর ঘাড় পাতেন না। ছোকরার দলের কথায় আমলই দেন না। তাঁরা বললেন, যেমন কংগ্রেসে হয়, তেমনি এখানেও হবে—সব কিছু ইংরেজিতে। অনেক তক্কাতক্কির পর দুটো দল হয়ে গেল। একদল বলবে বাঙলাতে আর একদল বলবে ইংরেজিতে। সবাই মিলে গেলুম প্যাণ্ডেলে। বসেছি সব, কনফারেন্স আরম্ভ হবে। রবিকাকার গান ছিল, গান তো আর ইংরেজীতে হতে পারে না, বাঙলা গানই হলো। ‘সোনার বাঙলা’ গানটা বোধ হয় সেই সময়ে গাওয়া হয়েছিল।

 “এখন প্রেসিডেণ্ট উঠেছেন স্পীচ দিতে,—ইংরেজীতে যেই না মুখ খোলা, আমরা ছোকরারা যারা ছিলুম, বাঙলা ভাষার দলে, সবাই এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম—বাঙলা, বাঙলা। মুখ আর খুলতেই দিই না কাউকে। ইংরেজীতে কথা আরম্ভ করলেই আমরা চেঁচাতে থাকি, বাঙলা, বাঙলা। মহা মুশকিল, কেউ আর কিছু বলতে পারেন না। তবুও ঐ চেঁচামেচির মধ্যেই দু-একজন দু’একটা কথা বলতে চেষ্টা করেছিলেন। লালমোহন ঘোষ ছিলেন ইংরেজিদুরস্ত, তাঁর মত ইংরেজীতে কেউ বলতে পারত না, তিনি ছিলেন পার্লামেণ্টারী বক্তা,— তিনি শেষটায় উঠে বাঙলায় করলেন বক্তৃতা। কী সুন্দর তিনি বলেছিলেন,—যেমন পারতেন তিনি ইংরেজীতে বলতে, তেমনি চমৎকার তিনি বাঙলাতেও বক্তৃতা করলেন! আমাদের উল্লাস দেখে কে, আমাদের তো জয়জয়কার। কনফারেন্সে বাঙলা ভাষা চলিত হোলো। সেই প্রথম আমরা পাবলিক্‌লি বাঙলা ভাষার জন্য লড়লুম।” (‘ঘরোয়া’—৭৫-৭৬ পৃঃ)।

 ১৮৯৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রসম্মিলনের ঢাকা অধিবেশনেও রবীন্দ্রনাথ যোগ দেন। সম্মিলনে দেশীয় ভাষা, দেশীয় ভাব, জাতীয় পোষাক-পরিচ্ছদের সমর্থন করিয়া তিনি বক্তৃতা করেন। এই সময়েই বিজাতীয় অনুকরণ ও সাহেবীয়ানার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ ও ব্যঙ্গ বিদ্রূপের কশাঘাত করিয়া তিনি বহু প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, ব্যঙ্গ নাট্য প্রভৃতি রচনা করেন।

 ১৮৯৮ সালেই রাজদ্রোহের অভিযোগে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক গ্রেপ্তার হন। রবীন্দ্রনাথ গভর্মেণ্টের এই কার্যের তীব্র সমালোচনা করিয়া প্রবন্ধ লেখেন এবং তিলকের মকদ্দমার ব্যয় চালাইবার জন্য অর্থ সংগ্রহেরও সহায়তা করেন। রাজদ্রোহ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার জন্য কলিকাতা টাউন হলে যে বিরাট সভা হয়, রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় “কণ্ঠরোধ” নামক তাঁহার বিখ্যাত প্রবন্ধ পাঠ করেন। উহার এক স্থানে তিনি বলেন,—

 “একদিকে পুরাতন আইন-শৃঙ্খলের মরিচা সাফ হইল, আবার অন্যদিকে রাজকারখানায় নূতন লৌহশৃঙ্খল নির্মাণের ভীষণ হাতুড়ী-ধ্বনিতে সমস্ত ভারতবর্ষ কম্পান্বিত হইয়া উঠিয়াছে! একটা ভয়ানক ধূম পড়িয়া গিয়াছে! আমরা এতই ভয়ঙ্কর!

 “মূল কথাটা এই, তাঁহারা আমাদিগকে জানেন না। আমরা পূর্বদেশী, তাঁহারা পশ্চিমদেশী, আমাদের মধ্যে যে কী হইতে কী হয়, কোথায় আঘাত লাগিলে কোন্‌খানে ধোঁয়াইয়া উঠে, তাহা তাঁহারা ঠিক করিয়া বুঝিতে পারেন না। সেইজন্যই তাঁহাদের ভয়। আমাদের মধ্যে ভয়ঙ্করত্বের আর কোন লক্ষণ নাই, কেবল একটি আছে—আমরা অজ্ঞাত।

 “সত্যই যদি তাহাই হইবে, তবে হে রাজন, আমাদিগকে আর কেন অজ্ঞেয় করিয়া তুলিতেছ? যদি রজ্জুতে সর্পভ্রম ঘটিয়া থাকে, তবে তাড়াতাড়ি ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া ভয়কে আরও পরিব্যাপ্ত করিয়া তুলিতেছ কেন? যে একমাত্র উপায়ে আমরা আত্মরক্ষা করিতে পারি, তাহা রোধ করিয়া ফল কি?

 “......সংবাদপত্র যতই অধিক এবং যতই অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না। রুদ্ধবাক, সংবাদপত্রের মাঝখানে রহস্যান্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া থাকা আমাদের পক্ষে বড়ই ভয়ঙ্কর অবস্থা।”

 ৪৪ বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ যে “ভয়ঙ্কর অবস্থা”র কথা লিখিয়াছিলেন, এখনও তাহার পরিবর্তন হয় নাই, বরং নানাদিক দিয়া পূর্বাপেক্ষা উহা আরও বাড়িয়াছে।

 এক সময়ে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর লোকের ধারণা ছিল যে, রবীন্দ্রনাথ ধনীর সন্তান, কল্পনা-বিলাসী কবি, বাস্তব জগতের সঙ্গে, সাধারণ লোকের সুখদুঃখের সঙ্গে তাঁহার কোন পরিচয় নাই, দেশের জাতীয় আন্দোলন বা স্বাধীনতা-আন্দোলনের সঙ্গে তাঁহার প্রাণের যোগ নাই। এই ধারণা যে কিরূপ ভ্রান্ত, উত্তরকালে নিজের কার্যের দ্বারা রবীন্দ্রনাথ তাহা প্রমাণ করিয়াছিলেন। তাঁহার জীবনের যে সময়ের কথা আমরা এখন বলিতেছি, সেই সময়ে তিনি দেশের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে পরিচয় লাভের জন্য কঠোর সাধনা করিতেছিলেন। জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে কেবল বুদ্ধির যোগ নয়, হৃদয়ের যোগও স্থাপন করিতেছিলেন। কিন্তু তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল বিভিন্ন, আবেদন-নিবেদনের পথ তিনি ঘৃণা করিতেন, বঙ্কিমের যোগ্য শিষ্যরূপে আত্মশক্তির সাধনাতেই তিনি দেশের মুক্তির সন্ধান লাভ করিয়াছিলেন। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করিয়া রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় লিখিয়াছিলেন,—

 “রাজদ্বারে নিবেদনের থালা লইয়া বৎসরের পর বৎসর কেবল মাত্র কাঁদুনীর সুরে ‘কিছু দাও কিছু দাও’ করিয়া প্রার্থনা করিলে কিছু পাইব না। গুরুতর দুঃখকে শিরে বহন করিয়া কারাদণ্ডে অবিচল থাকিয়া, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। স্বাধীনতা সম্ভোগ করিবার পূর্বে বাহুবলে উহা আমাদের অর্জন করিতে হইবে।”

 উত্তরকালে স্বদেশী আন্দোলন তথা নবজাতীয়তা-আন্দোলনের উপর রবীন্দ্রনাথের এই অভিমত কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, পরে তাহা আমরা দেখিতে পাইব।