ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 পরীক্ষার দিন নিকট হইল, মনে মনে কত ভাবনা হইল। যদি পরীক্ষা না দিতে পারি, তাহা হইলে বৃত্তির টাকা বন্ধ হইবে, গোলাপকে আর কিছুই দিতে পারিব না। পরীক্ষার কেবলমাত্র দুইদিন বাকী আছে, তখন আর কোনও উপায় না দেখিয়া দুষ্কর্মের আর এক সোপানে পদার্পণ করিলাম। সেইদিন অলক্ষিতভাবে কলেজের পুস্তকাগারে প্রবেশ করিলাম। সেই সময়ে কেহই সেইস্থানে ছিল না, সেইস্থান হইতে দুইখানি পুস্তক (যাহা অন্য স্থানে হঠাৎ পাওয়া সুকঠিন ও যাহা হইতে প্রশ্ন করিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল,) চুরি করিয়া গোলাপের বাটীতে লইয়া আসিলাম। পুস্তক দুইখানি আগাগোড়া একবার পড়িলাম ও বাছিয়া বাছিয়া তাহার ভিতর হইতে কতকগুলি পাতা কাটিয়া লইলাম। পরদিন কলেজে যাইয়া শুনিতে পাইলাম, পুস্তকালয় হইতে দুইখানি পুস্তক চুরি হওয়ায় অতিশয় গোলযোগ হইতেছে। পুস্তকাগারাধ্যক্ষ, পেয়াদা, দপ্তরি, প্রভৃতি পুস্তকাগারের সমস্ত কর্ম্মচারীগণ অতিশয় লাঞ্ছনাভোগ করিতেছে। কলেজের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী সাহেব নিজে ঐ পুস্তকের অনুসন্ধান করিতেছেন।

 যাহা হউক, পরদিবস পরীক্ষা হইল। সকলে যেরূপ নিয়মিত সময়ে পরীক্ষার স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল, আমিও সেইরূপ আসিলাম। অপহৃত পুস্তকের পাতাগুলি আপনার পিরাণের পকেটে করিয়া আনিলাম। পরীক্ষা আরম্ভ হইল, প্রশ্নের কাগজ দেওয়া হইলে দেখিলাম, তাহার অধিকাংশের উত্তর আমার পকেটের ভিতর আছে। মনে অতিশয় আশা হইল, সাহস হইল। আস্তে আস্তে অন্যের অলক্ষিতভাবে পকেট হইতে কাগজগুলি বাহির করিলাম এবং দেখিয়া দেখিয়া প্রশ্নের উত্তর লিখিতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু পাপের রেখা কতক্ষণ অঙ্কিত থাকে? দুষ্কর্ম্ম কত দিবস লুক্কায়িত থাকে? অদ্য আমার সকল গুপ্ত পাপ প্রকাশ হইয়া গেল, আমি ধরা পড়িলাম। একজন শিক্ষক, যিনি সেইস্থানে ছাত্রগণের উপর পাহারায় নিযুক্ত ছিলেন, তিনি আমাকে সেই সময় সমস্ত কাগজ পত্র সহিত ধরিয়া কলেজের প্রধান কর্ত্তার নিকট লইয়া গেলেন। আমি তাঁহার মেজাজ জানিতাম, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করায় আমি তাঁহার নিকট এই ঘটনার সমস্ত ব্যাপার স্বীকার করিলাম এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া গোলাপের বাটী হইতে পুস্তক দুইখানি বাহির করিয়া দিয়া তাঁহার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করিলাম। উক্ত সাহেব মহোদয় অতিশয় দয়ালু ছিলেন। তিনি আমাকে পুলিসের হস্তে অর্পণ না করিয়া কেবলমাত্র কলেজ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। আমি সে যাত্রা দণ্ডবিধি আইনের কঠিন দণ্ড হইতে পরিত্রাণ পাইলাম।

 পুস্তকাগারের অধ্যক্ষ প্রভৃতি যাহারা দুই দিবসের নিমিত্ত বিশেষরূপ লাঞ্ছনাভোগ করিয়াছিল, তাহারা এ সুযোগ পরিত্যাগ করিল না; আমার বিপক্ষে অনুসন্ধান করিয়া সমস্ত দোষ বাহির করিল ও আমার পিতাকে বলিয়া দিল।

 বৃদ্ধ পিতা মর্ম্মান্তিক দুঃখিত হইয়া আমাকে কেবলমাত্র এই বলিলেন, “আমি তোমাকে যে প্রকার বিশ্বাস করিতাম, তাহার উপযুক্ত ফলই পাইয়াছি। কিন্তু ইহাও তুমি নিশ্চয় মনে রাখিও, ইহজীবনে তুমি কখনও সুখী হইতে সমর্থ হইবে না।” পিতা সেই দিবস হইতে আর আমার সহিত ব্যাক্যালাপ পর্য্যন্ত করিলেন না। আমি পূর্ব্বে দিবাভাগে ও সন্ধ্যার সময় গোলাপের বাটীতে যাইতাম; কিন্তু এখন আমার আরও সুযোগ বাড়িল, রাত্রিদিন তাহার বাটীতেই থাকিতে লাগিলাম। কিন্তু এখন আর এক পয়সাও দিয়া তাহার সাহায্য করিতে পারিলাম না।

 গোলাপের উপর আমার মন এত আকৃষ্ট হইয়াছে যে, তাহাকে তিলার্দ্ধ দেখিতে না পাইলে চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখি। গোলাপও তাহা বুঝিল। সে এত দিবস হইতে যে মায়াজাল বিস্তার করিয়া আমাকে প্রলোভিত করিতেছিল, এখন যে তাহার ফল ফলিয়াছে, তাহা সে বুঝিতে পারিল। সে এখন জানিল যে, তাহাকে ছাড়িয়া আর আমি মুহূর্ত্তও থাকিতে পারিব না। তখন সে নিজের স্বভাব ক্রমে ক্রমে প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল। “খরচের টাকা নাই” “একটীমাত্র পয়সা নাই,” “হরি বাবু তারাকে যেরূপ একটী হীরার আংটি দিয়াছে, আমি সেইরূপ একটী আংটি লইব”, “কামিনীর মতন বারাণসী শাটী একখানিও আমার নাই”, “বসন্ত তাহার কাশ্মিরী শাল যোড়াটী বিক্রয় করিবে, উহা আমাকে খরিদ করিয়া দেও”, প্রভৃতি একটী একটী নূতন কথা নিত্য নিত্য আমার কাণে তুলিতে লাগিল। আমিও যাহাতে তাহার এই সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারি, তাহার উপায় মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম। একদিবস সে আমার উপর অতিশয় বিরক্তি-ভাব দেখাইয়া বলিল, “ডাক্তার! যদি তুমি কল্য আমাকে এক সেট সোণার গহনা আনিয়া দেও, ভালই, নচেৎ তুমি আমার বাটীতে আসিও না।” এই কথায় আমার অতিশয় ক্রোধ ও দুঃখ হইল। তাহাকে বলিলাম, “যদি আমি তোমার নিমিত্ত সোণার গহনা আনিতে পারি ভালই, নচেৎ তোমার বাটীতে আর আসিব না।” এই বলিয়া ক্রোধভরে গোলাপের বাটী হইতে বহির্গত হইলাম। গোলাপ পশ্চাৎ হইতে বার বার ডাকিল, আমি শুনিয়াও শুনিলামনা, চলিয়া আসিলাম। অতঃপর দুষ্কর্ম্মের আর এক সোপান ঊর্দ্ধে উত্থিত হইলাম।