তরুণের আহ্বান/তোমরা ওঠো জাগো

উইকিসংকলন থেকে

তোমরা ওঠো জাগো

মাননীয় অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মহাশয় ও সমবেত ছাত্রমণ্ডলী:

 আপনারা আজ কিসের জন্য এই ছাত্রসভায় আমায় আহ্বান করিয়াছেন তাহা আপনারাই জানেন। তবে এই সভায় আসিবার প্রবৃত্তি বা সাহস যে আমার হইয়াছে তাহার একমাত্র কারণ এই যে আমি মনে করি আমি আপনাদের মতোই একজন ছাত্র; “জীবনবেদ” আমি অধ্যয়ন করিয়া থাকি এবং বাস্তব জীবনের কঠিন আঘাতে যে জ্ঞানের উম্মেষ হয় সেই জ্ঞান আহরণে আমি এখন রত।

জাতির আদর্শ

প্রত্যেক ব্যক্তির বা জাতির একটা ধর্ম বা আদর্শ (ideal) আছে। সেই ideal বা আদর্শকে অবলম্বন ও আশ্রয় করিয়া সে গড়িয়া উঠে। সেই ideaকে সার্থক করাই তাহার জীবনের উদ্দেশ্য, সেই ideal বা আদর্শকে বাদ দিলে তাহার জীবন অর্থহীন নিষ্প্রয়োজন হইয়া পড়ে। দেশ ও কালের গণ্ডীর মধ্যে আদর্শের ক্রমবিকাশ বা অভিব্যক্তি একদিনে বা এক বৎসরে হয় না। ব্যক্তির জীবনে সাধনা যেরূপ বহুবৎসরব্যাপী হইয়া থাকে, জাতির জীবনেও সেইরূপ সাধনার ধারা পরুষানুক্রমে চলিয়া আসে। তাই মনীষীরা বলিয়া থাকেন যে আদর্শ একটা প্রাণহীন গতিহীন বস্তু নয়। তার বেগ আছে, গতি আছে, প্রাণ-সঞ্চারিণী শক্তি আছে।

আমাদের যুগধর্ম

যে আদর্শ আমাদের সমাজে গত একশত বৎসর ধরিয়া আত্মবিকাশের চেষ্টা করিতেছে আমরা তার পরিচয় সবসময়ে না পাইতে পারি। যে চিন্তাশীল, যাহার অন্তদৃষ্টি আছে শুধু সে ব্যক্তি বাহ্যঘটনা-পরম্পরার অন্তরালে অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীরূপা এই আদর্শের ধারাকে ধরিতে পারে। এই আদর্শই আমাদের যুগধর্ম— the idea of the age. ইহা উপলব্ধি সব সময়ে হয় না বলিয়া আমরা প্রায়শ ভ্রান্ত পথের দিকে আকৃষ্ট হই— ভ্রান্ত গুরুর অনুবর্তী হই। হে ছাত্রমণ্ডলী, যদি জীবন গঠন করিতে চাও—তবে ভ্রান্ত গুরু ও ভ্রান্ত পথের প্রভাব হইতে আত্মরক্ষা করো। নিজে আত্মস্থ হইয়া জীবনের প্রকৃত আদর্শ চিনিয়া লও।

 ১৫ বৎসর পূর্বে যে আদর্শ বাংলার ছাত্রসমাজকে অনুপ্রাণিত করিত তাহা স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। সে আদর্শের প্রভাবে তরুণ বাঙালী ষড়রিপু জয় করিয়া স্বার্থপরতা ও সকল প্রকার মলিনতা হইতে মুক্ত হইয়া আধ্যাত্মিক শক্তির বলে শুধু বুদ্ধ-জীবন লাভর জন্য বদ্ধপরিকর হইতে। সমাজ ও জাতি গঠনের মূল— ব্যক্তিত্ব বিকাশ। তাই স্বামী বিবেকানন্দ সর্বদা বলিতেন “man making is my mission”—খাঁটি মানুষ তৈয়ারি করাই আমার জীবনের উদ্দেশ্য।

 কিন্তু ব্যক্তিত্ব বিকাশের দিকে এত জোর দিলেও স্বামী বিবেকানন্দ জাতির কথা একেবারে ভুলিয়া যান নাই। কর্মবিহীন সন্ন্যাসে অথবা পরুষকারহীন অদৃষ্টবাদে তিনি বিশ্বাস করিতেন না। রামকৃষ্ণ পরমহংস নিজের জীবনের সাধনার ভিতর দিয়া সর্বধর্মের যে সমন্বয় করিতে পারিয়াছিলেন তাহাই স্বামীজির জীবনের মূলমন্ত্র ছিল এবং তাহাই ভবিষ্যৎ ভারতের জাতীয়তার মূলভিত্তি। এই সর্বধর্ম—সমন্বয় ও সকল-মত-সহিষ্ণুতার প্রতিষ্ঠা না হইলে আমাদের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে জাতীয়তার সৌধ নির্মিত হইতে পারিত না।

রাজা রামমোহনের যুগ

বিবেকানন্দ-যুগের পূর্বে যখন আমাদের দেশে নবযুগ প্রথম আরম্ভ হয় তখন আমাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ধর্মের নামে যে-সব অধর্ম চলিতেছিল, যে-সব আবর্জনা ও কুসংস্কার ধর্মের নামে সমাজ-দেহকে আচ্ছাদন করিয়াছিল এবং হিন্দু সমাজকে শতধা বিভক্ত করিয়াছিল, তাহা ধ্বংস করিবার জন্য রাজা রামমোহন কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন। বেদান্তের সত্য প্রচারিত হইলে হিন্দু সমাজ ধর্মের বহিরাববণ বর্জন করিয়া সত্য ধর্ম আশ্রয় করিতে পারিবে এবং ভেদজ্ঞান ভুলিয়া আবার একতা সূত্রে আবদ্ধ হইতে পারিবে এ বিশ্বাস তাঁহার ছিল। এবং ধর্মজগতে বিপ্লব আনিতে হইলে, আগে চিন্তাজগতে আলোড়ন সূচনা করা দরকার—তাই ভারতের চিন্তাশক্তিকে জাগাইবার জন্য তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়াছিলেন।

কেশবচন্দ্রের যুগ

ভারতকে জাগাইবার জন্য মনোরাজ্যে যে বিপ্লব রামমোহন প্রবর্তিত করিলেন, পরবর্তী যুগে সে বিপ্লব সমাজের মধ্যে আসিয়া পড়িল। কেশবচন্দ্রের যুগে সমাজ-সংস্কারের কাজ দ্রুত গতিতে চলিতে লাগিল। ব্রাহ্মসমাজের নূতন বাণীর প্রভাবে সমগ্র দেশে নবজাগরণ আরম্ভ হইল। কিছুকাল পরে যখন ব্রাহ্মসমাজ হিন্দু সমাজ হইতে পৃথক হইয়া পড়িল এবং হিন্দু সমাজের মধ্যেও জাগরণের সূচনা হইল তখন ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাইতে লাগিল।

স্বামীজির বাণী

রামমোহনের যুগ হইতে বিভিন্ন আন্দোলনের ভিতর দিয়া ভারতের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ প্রকটিত হইয়া আসিতেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই আকাঙ্ক্ষা চিন্তারাজ্যে ও সমাজের মধ্যে দেখা দিয়াছিল কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তখনো দেখা দেয় নাই কারণ তখনো ভারতবাসী পরাধীনতার মোহনিদ্রায় নিমগ্ন থাকিয়া মনে করিতেছে যে ইংরেজের ভারত-বিজয় একটা দৈব ঘটনা বা divine dispensation। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে স্বাধীনতার অখণ্ড রূপের আভাস রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের মধ্যে পাওয়া যায়। “Freedom, Freedom is the song of the Soul।” এই বাণী যখন স্বামীজির অন্তরের রুদ্ধ দুয়ার ভেদ করিয়া নির্গত হয় তখন তাহা সমগ্র দেশবাসীকে মুগ্ধ ও উন্মত্তপ্রায় করিয়া তোলে। তাঁহার সাধনার ভিতর দিয়া, আচরণের ভিতর দিয়া, কথা ও বক্তৃতার ভিতর দিয়া—এই সত্যই বাহির হইয়াছিল।

 স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে যাবতীয় বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া খাঁটি মানুষ হইতে বলেন, অপরদিকে সর্বধর্ম সমন্বয় প্রচার ভারতের জাতীয়তার ভিত্তিরূপে সংস্থাপন করেন। রামমোহন রায় মনে করিয়াছিলেন যে সাকারবাদ খণ্ডন কবিয়া, বেদান্তের নিরাকারবাদ প্রতিষ্ঠা করিয়া তিনি জাতিকে একটা সার্বভৌমিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাইতে পারিবেন। ব্রাহ্মসমাজও সেই পথে চলিয়াছিল কিন্তু ফলে হিন্দু সমাজ যেন আরো দূরে সরিয়া গেল। তারপর বিশিষ্টাদ্বৈতবাদমূলক বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদমূলক সত্য প্রচারের দ্বারা এবং সকল-মত-সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়া রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ জাতিকে একতাসূত্রে গাঁথিবার চেষ্টা করিলেন।

অরবিন্দের বাণী

 যে স্বাধীনতার অখণ্ড রূপ বিবেকানন্দের মধ্যে আমরা দেখিতে পাই তাহা বিবেকানন্দের যুগে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে প্রবেশ করে নাই। অরবিন্দের মুখে আমরা সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার বাণী শুনিতে পাই। অরবিন্দ যখন বন্দেমাতরম্ পত্রিকায় লিখিলেন “We want complete autonomy, free from British control”—তখন স্বাধীনতাকামী তরুণ বাঙালী বুঝিল যে এতদিন পরে সে মনের মতো মানুষ পাইয়াছে। ভাবপ্রবণ বাঙালী স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখিয়া বিভোর হইল। এখনো কানে বাজে সেই বাণী যাহা অরবিন্দ কলিকাতার মুক্ত প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া একদিন বলিয়াছিলেন—

 “I should like to see some of you becoming great; great, not for you own sake, but to make India great—so that she may stand up with head erect among the free nations of the world.”

 পরিপূর্ণ স্বাধীনতার প্রেরণা পাইয়া বাঙালী জাতি ঝড়তুফান অগ্রাহ্য করিয়া, বিপ্লবের ঝঞ্ঝার ভিতর দিয়া ছুটিয়া আসিয়াছে।

মহাত্মাজীর নূতন বাণী

১৯২১ খ্রীস্টাব্দে আমরা যখন আসিয়া পৌঁছিলাম তখন অসহযোগের বাণীর সঙ্গে সঙ্গে আমরা আর-একটা কথা শুনিলাম মহাত্মা গান্ধীর মুখে—“জনসাধারণকে বাদ দিলে এবং তাহাদের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা না জাগাইতে পারিলে, স্বরাজ লাভ হইতে পারে না।” অসহযোগের পন্থা ভারতে বা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। সেদিনও যশোহর জেলাবাসী এই পন্থা অবলম্বন করিয়া নীলকরের অত্যাচার হইতে আত্মরক্ষা করিয়াছিল। কিন্তু যে “গণবাণী” মহাত্মা গান্ধীর মুখে শোনা যায় তাহা ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নূতন কথা।

দেশবন্ধুর আদর্শ

এই বাণী আরো পরিস্ফুট হইয়াছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জীবনে। তিনি তাঁহার লাহোরের বক্তৃতায় অতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে যে-স্বরাজ তিনি লাভ করিতে চান— তাহা মুষ্টিমেয় লোকের জন্য নহে—তাহা সকলের জন্য, জনসাধারণের জন্য। “Swaraj for the masses”—এই আদর্শ তিনি নিখিল ভারতীয় শ্রমিক সভায় দেশবাসীর সম্মুখে উপস্থাপিত করেন।

 আর-একটা বাণী আমরা দেশবন্ধুর জীবনে পাই। এই যে মানুষের জীবন—জাতির এবং ব্যক্তির জীবন— ইহা একটি অখণ্ড সত্য। এই জীবনকে দ্বিধা বা বহুধা বিভক্ত করা যায় না। মানুষের প্রাণ যখন জাগে তখন তাহা সব দিক দিয়া জাগে, সর্বক্ষেত্রে তাহার নবজীবনের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বজগৎ তথা মনুষ্যজীবন— বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই বৈচিত্র্যের লোপ করিলে জীবনের বিকাশ হইবে না—বরং আমরা মরণের বা ধ্বংসের দিকে চলিব। তাই বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়া, “বহুর” মধ্য দিয়া ব্যক্তির এবং জাতির বিকাশ সাধন করিতে হইবে।

 বর্তমান যুগে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ আধ্যাত্মিক জগতে “এক” এবং “বহুর” মধ্যে যে সমন্বয় স্থাপন করিয়াছিলেন— সে সমন্বয় দেশবন্ধু জাতির জীবনে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সাধন করিয়াছিলেন বা করিতে প্রয়াস পাইয়া ছিলেন। দেশবন্ধু “শিক্ষার মিলনে” যেরূপ বিশ্বাস করিতেন “শিক্ষার বিরোধে”ও তদ্রূপ বিশ্বাস করিতেন—এক কথায় তিনি Federation of cultures-এ বিশ্বাস করিতেন এবং ভারতের মৌলিক একতায় প্রগাঢ় বিশ্বাসী হইলেও বাংলার বৈশিষ্ট্যেও বিশ্বাসবান ছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি ভারতবর্ষের centralised State অপেক্ষা federal State বেশি পছন্দ করিতেন।

স্বাধীনতার অখণ্ড রূপ

যে সর্বাঙ্গীণ বিকাশে দেশবন্ধু এত বিশ্বাসী ছিলেন তাহাই এই যুগের সাধনা। এই সাধনা সার্থক করিতে হইলে স্বাধীনতার অখণ্ডরূপ আগে দর্শন করা চাই। আদর্শের পরিপূর্ণ উপলব্ধি না হইলে মানুষ কর্মক্ষেত্রে কখনো জয়যুক্ত হইতে পারে না। তাই আজ সারা ভারতকে এবং বিশেষ করিয়া ভারতের তরুণ সমাজকে বলিয়া দিতে হইবে যে, যে-স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন আমরা দেখি সে রাজ্যে সকলে মুক্ত— ব্যক্তি মুক্ত, সমাজও মুক্ত, সেখানে মানুষ রাষ্ট্রীয় বন্ধন হইতে মুক্ত, সামাজিক বন্ধন হইতে মুক্ত এবং অর্থের বন্ধন হইতে মুক্ত। রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতি—এই ত্রিতাপ হইতে আমরা মানবজাতিকে, দেশবাসীকে মুক্ত করিতে চাই।

পরিপূর্ণ ও সর্বাঙ্গীণ মুক্তিলাভ

যাহারা মনে করে রাষ্ট্রীয় বন্ধন হইতে তাহারা দেশকে মুক্ত করিবে কিন্তু সমাজের পূর্বাবস্থা বজায় রাখিবে—অথবা যাহারা মনে করে যে সামাজিক বন্ধন সব চূর্ণ করিবে কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কোনো বিপ্লব আনিবে না—তাহারা সকলেই ভ্রান্ত। বস্তুত শরীরে স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিলে প্রত্যেক অঙ্গে যেরূপ পূর্বশ্রী ফিরিয়া আসে—মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যখন জাতির অন্তরে জাগিয়া উঠে তখন তাহা সব দিক দিয়া ফুটিয়া বাহির হয়। জাতি যখন সমস্ত বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে চায় তখন কেহ বলিতে পারে না— thus far and no further.

 আমাদের এই শতছিদ্রযুক্ত, পূতিগন্ধময় সমাজের দ্বারা পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ কোনোদিন হইবে না। পূর্ণ স্বাধীনতা (complete independence) লাভ করিতে হইলে সমস্ত জাতিকে মুক্তিলাভের জন্য ক্ষিপ্তপ্রায় হইতে হইবে। কিন্তু যে ব্যক্তি সামাজিক অত্যাচারে নিষ্পিষ্ট অথবা অর্থনৈতিক বৈষম্যে ভারাক্রান্ত, সে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য পাগল হইবে কেন? যার কাছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচারই সবচেয়ে বড়ো সত্য— সে ব্যক্তি এই সব অত্যাচার হইতে মুক্ত হইতে না পারিলে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা লাভের জন্য উদগ্রীব হইবে কেন?

 আজ এই কথাটি আমি খুব বড়ো করিয়া এখানকার ছাত্রসমাজের মধ্যে বলিতে আসিয়াছি—যে যুগে আপনারা জন্মিয়াছেন সে যুগের ধর্ম—পরিপূর্ণ ও সর্বাঙ্গীণ মুক্তি লাভ। স্বাধীন দেশে স্বাধীন আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের জাতি জন্মিতে চায়—বর্ধিত হইতে চায় এবং মরিতে চায়। ‘পুরুষ অবরুদ্ধ আপন দেশে, নারী অবরুদ্ধ নিজ নিবাসে’—এ অবস্থা আর কতদিন চলিবে। আমাদের নারীসমাজের বর্ণনা করিবার সময়ে আমরা আর কতদিন বলিব—

‘অচল হয়েও সচল সে যে
বস্তার চেয়েও ভারী।
মানুষ হয়েও সঙের পতুল
বঙ্গদেশের নারী।’

 স্বাধীনতার নামে অনেকের আতঙ্ক উপস্থিত হয়। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার কথা ভাবিলে অনেকে স্বপ্ন দেখেন রক্ত-গঙ্গার এবং ফাঁসিকাষ্ঠের। সামাজিক স্বাধীনতার কথা ভাবিলে অনেকে দেখিতে পান উচ্ছৃঙ্খলতার বিভীষিকা। কিন্তু আমি উচ্ছৃঙ্খলতার ভয়ে ভীত নহি। মানুষের মধ্যে যদি ভগবান বিরাজ করেন, অথবা মানুষের মধ্যে যদি মানবতা থাকে; যদি ভগবান সতা হন—যদি মানুষ সত্য হয়—তবে মানুষ চিরকাল পথভ্রষ্ট বা ভ্রান্ত হইতে পারে না। স্বাধীনতার মদিরা পান করিয়া যদি আমরা কিছু সময়ের জনা অপ্রকৃতিস্থ হই তাহা হইলেও অচিরে আমরা আত্মস্থ হইব। আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির যে দাবি— তাহা ভুলভ্রান্তি করিবার অধিকারের দাবি বৈ আর-কিছু নয় (the right to make mistakes), অতএব উচ্ছৃঙ্খলতার বিভীষিকা না দেখিয়া মুক্তিপথে আগুয়ান হও; নিজের মানবতায় বিশ্বাসী হইয়া মনুষ্যত্ব লাভের চেষ্টায় সর্বদা নিরত হও।

 আজ দেশের মধ্যে তিনটি বড়ো সম্প্রদায় একপ্রকার নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িয়া আছে—নারী সমাজ, উপেক্ষিত তথাকথিত অনুন্নত সমাজ এবং কৃষক ও শ্রমিক সমাজ। ইহাদের নিকট গিয়া বলো- তোমরাও মানুষ; মনুষ্যত্বের পূর্ণ অধিকার তোমরাও পাইবে। অতএব ওঠো, জাগো, নিশ্চেষ্টতা পরিহার করিয়া নিজের প্রাপ্য অধিকার করিয়া লও।

অখণ্ড মুক্তির উপাসক হও

হে বাংলার ছাত্র ও তরুণ সমাজ। তোমরা পরিপূর্ণ ও অখণ্ড মুক্তির উপাসক হও। তোমরাই ভবিষ্যৎ ভারতের উত্তরাধিকারী; অতএব তোমরাই সমস্ত জাতিকে জাগাইবার ভার গ্রহণ করো। তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে— অনন্ত, অপরিসীম শক্তি। এই শক্তির উদ্বোধন করো এবং এই নবশক্তি অপরের মধ্যে সঞ্চার করো; তোমাদের নিকট নূতন স্বাধীনতামন্ত্রে দীক্ষিত সমস্ত জাতি আবার বাঁচিয়া উঠুক!

 যেদিন ভারত পরাধীন হইয়াছে—সেই দিন হইতে ভারত সমষ্টিগত সাধনা (Collective Sadhana) ভুলিয়া ব্যক্তিত্বের বিকাশের দিকে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিয়াছে! ফলে কত শত মহাপুরুষ এই দেশে আবিভর্ভূত হইয়াছেন অথচ তাঁহাদের আবির্ভাব সত্ত্বেও জাতি আজ কিরূপ শোচনীয় অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে। জাতিকে আবার বাঁচাইতে হইলে সাধনার ধারা আবার অন্য দিকে পরিচালিত করিতে হইবে। জাতিকে বাদ দিয়া ব্যক্তিত্বের সার্থকতা নাই—এ কথা আজ সকলকে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে।

 আমাদের জাতির বহু লোক—পুরুষানুক্রমে বহু জ্ঞান ও সম্পদ আহরণ করিয়া আসিতেছে। এতদিন পর্যন্ত সমস্ত জাতি সে জ্ঞান ও সে সম্পদের অধিকারী হইতে পারে নাই। আজ হইতে তাহাকে অধিকারী করিয়া দিতে হইবে। সকলকে বুঝাইয়া দিতে হইবে, যে-ভারতের প্রতিষ্ঠা আমরা করিতে চাই— সেখানে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার, সমান দাবি, সমান সুযোগ। যেদিন সমস্ত দেশ এ কথা বুঝিবে সেদিন সমস্ত সমাজ মুক্ত হইবার জন্য অধীর, উম্মত্ত হইবে।

অসবর্ণ বিবাহের প্রয়োজনীয়তা

আর একটি কথা বলিয়া আমার বক্তব্য শেষ করিব। জাতির রক্তস্রোত যেন ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে। এখন চাই নূতন রক্ত। ভারতের ইতিহাস পড়িয়া দেখ— বহুবার রক্ত-সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। এই রক্ত-সংমিশ্রণের ফলে ভারতীয় জাতি বার বার মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া পুনর্জীবন লাভ করিয়াছে। যাঁহারা বর্ণসঙ্করে ভয় করেন তাঁহারা আমাদের জাতির ইতিহাস জানেন না এবং তাঁহারা মানব-বিজ্ঞান (anthropology) সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। আজ অসবর্ণ বিবাহ প্রবর্তনের দ্বারা যথেষ্ট রক্ত-সংমিশ্রণ ঘটিবে এবং এই রক্তসংমিশ্রণের ফলে জীবনীশক্তি আমরা ফিরিয়া পাইব।

সকলকে জাগাও

ভ্রাতৃমণ্ডলী। আজ আমার বক্তব্য এইখানে শেষ করিব। সাম্যবাদ ও স্বাধীনতামন্ত্র প্রচার করিবার জন্য তোমরা গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ো। স্বাধীন ভারতের যে দৃশ্য তোমাদের সম্মুখে ধরিলাম তাহা সমগ্র দেশবাসীর সম্মুখে ধরো। স্বাধীনতার পূর্ব স্বাদ নিজের অন্তরে পাইলে সকলেই পাগল হইয়া উঠিবে। এই স্বাদ— এই অনুভূতি নিজের অন্তরে আগে অবশ্য পাওয়া চাই। নিজে অন্তরে এই আলোক জ্বালো— সেই দীপ হস্তে লইয়া দেশবাসীর দ্বারবর্তী হও। যাও চীনা ছাত্রদের মতো—রুশ তরুণদের মতো— চাষীর পর্ণ কুটীরে, মজুরদের আবর্জনাপূর্ণ ভগ্নগৃহে। তাহাদের জাগাও। আর যাও—মাতৃজাতির সমীপে। যাঁহারা শক্তিরূপিণী অথচ সমাজের চাপে আজ হইয়াছেন ‘অবলা’—তাঁদেরও জাগাও—বলো—

‘আপনার মান রাখিতে জননী
আপনি কৃপাণ ধরো।’

সর্বোপরি যাও দলে দলে বাংলার উপেক্ষিত সমাজের কাছে। বলো—‘ভাই, এতদিন পরে এসেছি তোমাদের কাছে নূতন মন্ত্র নিয়ে তোমাদের মুক্ত করতে —মনুষ্যত্বের পূর্ণ অধিকার তোমাদেরও প্রাপ্য, এই কথা তোমাদের বলতে। তোমরা ওঠো, জাগো—এ বীরভোগ্যা বসসুন্ধরা তোমাদেরও ভোগ্যা।’

 জিজ্ঞাসা করি—এ কাজ করতে পারবে? হ্যাঁ পারবে, অবশ্য পারবে। তোমরা পারবে এ কাজ করতে—এ কথা আমি আজ বলতে এসেছি। এগিয়ে চলো— জয় তোমাদের অবশ্যম্ভাবী। তোমাদের সাধনা সিদ্ধ হউক— ভারত আবাব মুক্ত হউক— তোমাদের জীবনও সার্থক হউক।

বন্দেমাতরম্।

 জুলাই ১৯২৯