তরুণের আহ্বান/স্বাধীনতার অখণ্ডরূপ

উইকিসংকলন থেকে

স্বাধীনতার অখণ্ডরূপ

অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মহাশর ও সমবেত বন্ধুবর্গ:

আজকাল দেশ-বিদেশে এত প্রতিষ্ঠান ও আন্দোলন থাকিতে—যুব-আন্দোলন আবার আরম্ভ হইল কেন? ইহার কারণ নির্দেশ করা খবেই সহজ। সব দেশে তরুণ সমাজ অসন্তুষ্ট ও অসহিষ্ণু হইয়া পড়িয়াছে। তাহারা যাহা চায়, তাহা পায় না, যে আদর্শকে ভালোবাসে সে আদর্শকে বাস্তবের মধ্যে মূর্ত করিয়া তুলিতে পারে না। তাই তাহারা বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছে এবং যে মানুষ বা যে ব্যবস্থা তাহাদের কর্ম পথে অন্তরায় হইয়াছে তাহা অপসারিত করিবার জন্য তাহারা বদ্ধপরিকর হইয়াছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপ, বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দের উপর বীতশ্রদ্ধ ভাব এবং নূতন কর্মের ও নূতন সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা —এই-সব কারণের সংমিশ্রণের ফলে যুব-আন্দোলনের উৎপত্তি।

 যুব-সমিতি গঠনের কাজে আজকাল অনেকে নিরত। কিন্তু যুব-আন্দোলনের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি বোঝেন কয় জন? যুব-সমিতিকে সেবা-সমিতির নামান্তর বলিয়া মনে করিলে চলিবে না। কংগ্রেস কমিটির নাম ও label বদলাইয়া যুব সমিতি গঠন করিলেও চলিবে না। প্রকৃতপক্ষে যুব-আন্দোলন একটা স্বতন্ত্র আন্দোলন, ইহার বিশিষ্ট আদর্শ আছে—বিশিষ্ট কর্মপ্রণালী আছে। সুতরাং কংগ্রেসের মধ্যে নেতৃত্ব বা মোড়লী করিবার আশা না থাকার দরুন যাঁহারা অনন্যোপায় হইয়া যুব-আন্দোলনের পাণ্ডা সাজেন তাঁহাদের দ্বারা যুব-আন্দোলনের কোনো সেবা বা উন্নতি হইবে না এবং চোখের সম্মুখে নূতন একটা আন্দোলন গড়িয়া উঠিতেছে দেখিয়া যাঁহারা স্থির থাকিতে না পারার দরুন যুব-আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক হইয়া পড়েন তাঁহাদের দ্বারাও কোনো বড়ো কাজ হইবে না।

 আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করিতেছি—বাংলার একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলুন, এই আন্দোলনে কয়জন খাঁটি কর্মী আছেন— যাঁহারা প্রকৃতপক্ষে যুব-আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও সার্থকতা উপলব্ধি করিয়া নিষ্কামভাবে এই কর্মে যোগদান করিয়াছেন, অবশ্য যুব-আন্দোলনের উদ্দেশ্য, অর্থ ও কর্মপ্রণালী যতই প্রচারিত হইতেছে ততই আন্দোলন ক্রমশ প্রসার লাভ করিতেছে। কিন্তু গোড়ায় একটি কথা বার বার বলা প্রয়োজন—সেটা এই যে, যুব-সমিতি কংগ্রেসের বা সেবা-সমিতির শাখাবিশেষ নয়। যুব-আন্দোলনের উদ্দেশ্য—নূতনের সন্ধান আনা, নূতন সমাজ, নূতন রাষ্ট্র, নূতন অর্থনীতির প্রবর্তন করা, মানুষের মধ্যে নূতন ও উচ্চতর আদর্শ উদ্বুদ্ধ করিয়া তাহাকে মনুষ্যত্বের উচ্চতর সোপানে লইয়া যাওয়া, এই আকাঙ্ক্ষা যাহার মধ্যে জাগিয়াছে, সে ব্যক্তি নূতনের জন্য, মহত্তর জীবনের জন্য পাগল হইয়াছে— সে বর্তমান ও বাস্তবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী না হইয়া পারে না। এই অশান্ত, অসন্তুষ্ট, বিদ্রোহী মন যার আছে—যে ব্যক্তি বর্তমান ও বাস্তবের অবগুণ্ঠন সবাইয়া মহত্তর জীবনের দৃষ্টি ও আস্বাদ পাইয়াছে— সেই ব্যক্তি যুব-আন্দোলনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে এবং যুব-সমিতি গঠনের অধিকারী হইয়াছে।

 পূর্বেকার সব আন্দোলনের দ্বারা যদি আমাদের অন্তরের ক্ষুধা মিটিত এবং জাতীয় জীবনের সব প্রয়োজন সিদ্ধ হইত তাহা হইলে যুব-আন্দোলন কোনোদিন জন্মিত না। কিন্তু দৃষ্টির সংকীর্ণতার দরুনই হউক অথবা প্রচেষ্টার অভাবের দরুনই হউক—তাহা হয় নাই। তরুণ প্রাণ বহুদিন যাবৎ অপরের স্কন্ধে আপনার ও আপনার জাতির সব দায়িত্ব চাপাইয়া যখন শেষে দেখিল যে তাহার আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দেশ্য পূর্ণ হইল না, তখন সে আর নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিল না। সব ক্লৈব্য ত্যাগ করিয়া সে তখন স্থির করিল, একবার সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে লইয়া দেখিবে ফলাফল কী হয়। এ বিশ্বাস তাহার হইল যে কল্যাণকৃৎ কখনো দুর্গতি-প্রাপ্ত হইবে না (“নহি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দংগতিং তাত গচ্ছতি”) এবং সঙ্গে সঙ্গে এ বিশ্বাসও তাহার হইল যে ভরসা করিয়া এই ভার গ্রহণ করিলে পরিণাম কখনো অশউভ হইবে না; জয়লাভ করিলে সে বসুন্ধরা ভোগ করিতে পারিবে এবং জয়ের পূর্বে মৃত্যুমুখে পতিত হইলে স্বর্গরাজ্যে স্থান পাইবে— (হতো বা প্রাপ্‌সাসি স্বর্গং, জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীং)।

 যুব-আন্দোলন—যুবক-যুবতীদেরই আন্দোলন। এ আন্দোলন মানুষকে, মনুষ্য সমাজকে ও মনুষ্য সভ্যতাকে জরা ও বার্ধক্যের হাত থেকে রক্ষা করিতে চায় এবং মানষের তারুণ্যকে অমর করিয়া রাখিতে চায়, প্রকৃতির বুকে যেরূপ ever green পাদপ পাওয়া যায় মানুষের প্রাণকেও তদ্রূপ নিত্য সবুজ করিয়া রাখা একান্ত প্রয়োজন। তাই যুগে যুগে তরুণের প্রাণ বার্ধক্যের বিরুদ্ধে, অনুকরণেচ্ছার বিরুদ্ধে, ভীরুতার বিরুদ্ধে, ক্লৈব্যের বিরুদ্ধে, বিজ্ঞতার বিরুদ্ধে এবং সর্বপ্রকার বন্ধনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া আসিতেছে। আমি গত বৎসর নাগপুরে তরুণদের একটি সভায় বলিয়াছিলাম—The voice of Krishna was the voice of immortal youth—গীতার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের যে বাণীর ঝঙ্কার আমরা শুনিতে পাই, তাহা অমর তরুণাত্মারই বাণী।

 যাঁহারা মনে করেন যে যুব আন্দোলন সাগরপারের সামগ্রী—তার জন্ম ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে এবং তার জন্মদাতা জার্মানীর Karl Fisher (কার্ল ফিসার) তাঁহারা কিছুই জানেন না এই পৃথিবীতে জরা বার্ধক্য যতদিন আছে— যুব-আন্দোলনও ততদিন আছে। তবে বর্তমান যুগে যুব-আন্দোলন বিরাট ও বিশিষ্ট রূপ ধারণ করিয়াছে এ বিষয় কোনো সন্দেহ নাই। যুব-আন্দোলনের পশ্চাতে একটা মহান আদর্শবাদ আছে। এ আদর্শবাদ নূতন হইলেও বহু পুরাতন, যুগে যুগে এই আদর্শ বাদই মানুষের প্রাণকে সঞ্জীবনী সুধায় ভরপুর করিয়া নূতন জীবন ও নূতন শক্তি দান করিয়াছে। অতি প্রাচীনকালে আমাদের এই দেশে মানুষ “ধর্ম-রাজ্যের” স্বপ্ন দেখিত। মানুষে তখন চাহিত—তখনকার সমাজ ও রাষ্ট্র ভাঙিয়া “ধর্ম-রাজ্য” স্থাপন করিতে। প্রাচীনকালে গ্রীস দেশে সেখানকার ঋষিরা স্বপ্ন দেখিত— Ideal Republic-এর—আদর্শ প্রজাতন্ত্রমূলক সমাজের। তার পর যুগের পর যুগ কত দেশে কত মনীষী কত utopia-র স্বপ্ন দেখিয়া আসিতেছেন। কেহ লিখিতেছেন New age-এর (নূতন যুগের) কথা— কেহ লিখিতেছেন great society-র (বৃহত্তর সমাজের) কথা—কেহ লিখিতেছেন millenium এর কথা— কেহ লিখিতেছেন অনাগত সত্য যুগের কথা—কেহ লিখিতেছেন Socialist State (সাম্যবাদমূলক রাষ্ট্রের) কথা। নানা দিক দিয়া, নানা ভাবে, নানা রূপের মধ্যে তরুণের প্রাণ যুগের পর যুগ একটা আদর্শ সমাজের এবং আদর্শ-মানুষের স্বপ্ন দেখিয়া আসিতেছে এবং সাধ্যমত তাহা বর্ণনা করিবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছে। বর্তমান যুগে কী প্রাচ্যে, কী পাশ্চাত্যে আমরা Superman (অতিমানুষ)-এর কথা শুনিতে পাই। Superman-এর মতবাদ অনেকে উপহাস করিয়া উড়াইয়া দেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা উপহাস করিবার বিষয় নয় কারণ ইহার মধ্যে একটা মহান সতা নিহিত আছে। Superman-এর যে রূপ জার্মান দার্শনিক Nietzsche (নীট্‌শে) দিয়াছেন অথবা ভারতের কোনো মনীষী দিবার চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা আপনারা অখণ্ড সত্য বলিয়া গ্রহণ না করিতে পারেন—কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য যে সাধু ও মনুষ্যজাতির পক্ষে কল্যাণকর এবং তাঁদের প্রচেষ্টা যে প্রশংসনীয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। যে জাতির শ্রেষ্ঠ মনীষীগণ Superman-এর (অতিমানুষের) স্বপ্ন দেখেন না—সে জাতির কি idcalism বা আদর্শবাদ আছে? এবং যে জাতির আদর্শবাদ নাই সে জাতি কি জীবন্ত—সে জাতি কি মহত্তর সৃষ্টির অধিকারী হইতে পারে?

 মানুষের সমস্ত প্রাণ যদি উদ্বুদ্ধ করিতে হয়— তাহার প্রত্যেক রক্তবিন্দুর মধ্যে যদি মৃতসঞ্জীবনী সুধা ঢালিতে হয়—তাহার অন্তর্নিহিত সমস্ত শক্তির স্ফুরণ যদি ঘটাইতে হয়— তাহা হইলে একটা মহত্তর আদর্শের আস্বাদ তাহাকে দেওয়া চাই। খ্রীষ্টীয়দের ‘বাইবেল’-এ (Bible) একটা কথা আছে— man does not live by bread alone—শুধু উদর পূরণের দ্বারা মানুষ বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। তার জীবন ধারণের জন্য অন্যরকম খোরাকেরও প্রয়োজন আছে। মানুষ জানিতে চায় তার জীবনের উদ্দেশ্য কি—সে কেন বাঁচিয়া আছে তার জীবন ধারণের সার্থকতা কিসে। এ প্রশ্নের উত্তর সে যদি ঠিকমতো না পায়, তাহা হইলে সে জীবনে শান্তি পায় না—নিজের জীবন ব্যর্থ বলিয়া মনে করে এবং অন্তরের সব শক্তির উন্মেষ সাধন করিতে পারে না। কিন্তু এ আদর্শের অনুভূতি ও আস্বাদ জোর করিয়া কেহ দিতে পারে না। অনভূতি ও আস্বাদ নিজে যে পায় নাই—সে অপরকে তাহা কি করিয়া দিবে?

 স্বপ্ন অনেকের ছিল, অনেকের আছে, আমাদের স্বর্গীয় নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয়েরও একটা স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন ছিল তাঁর শক্তির উৎস, তাঁর আনন্দের নির্ঝর। তাঁর স্বপ্নের উত্তরাধিকারী আজ আমরা হইয়াছি। আমাদেরও তাই একটা স্বপ্ন আছে এবং এই স্বপ্নের প্রেরণায় আমরা উঠি, বসি, চলাফেরা করি, লিখি ও বলি এবং কাজকর্ম করি। সে স্বপ্ন বা আদর্শ কি? আমি চাই একটা নূতন সর্বাঙ্গীণ মুক্তি-সম্পন্ন সমাজ এবং তার উপরে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। যে সমাজে ব্যক্তি সর্বভাবে মুক্ত হইবে এবং সমাজের চাপে আর নিষ্পিষ্ট হইবে না—যে সমাজে জাতিভেদের অচলায়তন আর থাকিবে না—যে সমাজে নারী মুক্ত হইয়া, সমাজে এবং রাষ্ট্রে, পুরুষের সহিত সমান অধিকার ভোগ করিবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সেবায় সমানভাবে আত্মনিয়োগ করিবে, যে সমাজে অর্থের বৈষম্য থাকিবে না, যে সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তি শিক্ষা ও উন্নতির সমান সুযোগ পাইবে, যে সমাজে প্রমের এবং কর্মের পূর্ণ মর্যাদা থাকিবে এবং অলসের ও নিষ্কর্মার কোনো স্থান থাকিবে না, যে রাষ্ট্র বিজাতীয় প্রভাব ও প্রতিপত্তির হস্ত হইতে সর্ব-বিষয়ে মুক্ত হইবে, যে রাষ্ট্র আমাদের স্বদেশী সমাজের যন্ত্রস্বরূপ হইয়া কাজ করিবে, সর্বোপরি যে সমাজ ও রাষ্ট্র ভারতবাসীর অভাব মোচন করিয়া বা ভারতবাসীর আদর্শ সার্থক করিয়া ক্ষান্ত হইবে না পরন্তু বিশ্বমানবের নিকট আদর্শ সমাজ, আদর্শ রাষ্ট্র বলিয়া প্রতিভাত হইবে— আমি সেই সমাজ ও সেই রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়া থাকি। এই দ্বপ্ন আমার নিকট একটা অখণ্ড সত্য, এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব-কিছু করা যায়, সর্বপ্রকার ত্যাগ বরণ করা যায়, সর্বপ্রকারের কষ্ট স্বীকার করা যায় এবং এই স্বপ্ন সার্থক করিবার চেষ্টায় প্রাণবিসর্জন করিলেও “সে মরণ স্বরগ-সমান।” হে তরুণ ভ্রাতৃমণ্ডলী! তোমাদের দিবার মতো সম্পদ আমার কিছু নাই—আছে শুধু এই প্রশ্ন— যাহা আমাকে অসীম শক্তি ও অপার আনন্দ দিয়াছে যাহা আমার ক্ষুদ্র জীবনকেও সার্থক করিয়াছে। এই স্বপ্ন আমি তোমাদের ঊপহার স্বরূপ দিতেছি— গ্রহণ করো।

 আজকাল রাজনীতি ক্ষেত্রে আমরা অনেক প্রকার গালাগালি ও অনেক মজার সমালোচনা শুনিতে পাই—তার মধ্যে একটা অভিযোগ এই যে, আমরা নাকি “যুব-সমিতি”গুলি Capture বা দখল করিবার চেষ্টা করিতেছি। এ অভিযোগ শুনিয়া হাসি পায়। যাহারা কোনো প্রতিষ্ঠান বা আন্দোলনের সহায়তা করিয়া আসিতেছে তাহাদের বিরুদ্ধে Capture-এর অভিযোগ হাস্যাস্পদ বটে; আমি জিজ্ঞাসা করি, যুব সমিতির ও ছাত্র আন্দোলনের এই নবাগত বন্ধুরা এতদিন কোথায় ছিলেন? যাহারা গোড়া থেকে এই আন্দোলনের সৃষ্টির ও ক্রমোন্নতির সহায়তা করিয়া আসিতেছে তাহারা আজ Capture অপরাধে অপরাধী এবং যাঁহারা প্রারম্ভ হইতে আজ পর্যন্ত কিছুই করেন নাই এবং এখন Capture করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়াছেন—তাঁহারা হইলেন নিঃস্বার্থ হিতৈষী। গত কলিকাতা-কংগ্রেসের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্র সমিতির সাধারণ সভার আমি এই বৎসরের জন্য আমাদের কর্মপদ্ধতি নির্দেশ করি। সেই বিস্তৃত কর্মপদ্ধতির মধ্যে একটি বিষয়ের উল্লেখ ছিল- “To assist students movement, youth movement and Physical Culture movement” অর্থাৎ ছাত্র আন্দোলন, যুবআন্দোলন ও ব্যায়াম সমিতি প্রতিষ্ঠার সহায়তা করিতে হইবে। এই কর্মপদ্ধতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল এবং প্রত্যেক জেলা কংগ্রেস কমিটির নিকট পাঠানো হইয়াছিল। তখন কোনো আপত্তি শোনা যায় নাই; বরং সকলে অনুমোদন করিয়াছিলেন। কিন্তু বৎসর শেষে যখন দলের স্বার্থপোষণের জন্য অপরকে গালাগালি দেওয়া দরকার হইল তখন এই অভিযোগ আবিষ্কৃত হইল যে, আমরা নাকি যুব-সমিতিগুলি অধিকার করিবার চেষ্টা করিতেছি। আমাদের যদি কোনো অপরাধ হইয়া থাকে তাহা এই যে আমরা যুব-আন্দোলনের যথেষ্ট সেবা ও সহায়তা করি নাই। ফলে নিখিল বঙ্গীয় যুব-সমিতি নামে যে প্রতিষ্ঠান আছে তাহা দিন দিন নিষ্কর্মা হইয়া পড়িতেছে। বাংলার অনেক জেলায় স্থানীয় যুব-সমিতিগুলি যথেষ্ট কাজ করিতেছে কিন্তু যাঁহারা এই যুব-আন্দোলনের কর্ণধার বলিয়া পরিচয় দেন—সেই নিখিল বঙ্গীয় যুব সমিতির কর্তৃপক্ষেরা—এ কয় বৎসর যাবৎ কি করিলেন? বঙ্গীয় যুব-সমিতির মধ্যে কেহ কেহ অবশ্য যুব-আন্দোলনের বিষয়ে অনেক প্রোপাগাণ্ডা (propaganda) করিয়াছেন এবং তাঁহাদের সম্বন্ধে আমার এই উক্তি প্রযোজ্য নয়। কিন্তু অধিকাংশ সভ্যেরা কি করিয়াছেন? কোনো কোনো প্রদেশে সেখানকার প্রাদেশিক যুব-সমিতি খুব কর্মঠ ও উৎসাহ-পরায়ণ, কন্তু বাংলা দেশে যুব-আন্দোলনের উৎসের মুখে যেন বাধা পড়িয়াছে। এবং এই উৎস হইতে মধ্যে মধ্যে যে বাণী নির্গত হয় তাহা অনেক সময়ে কংগ্রেসের অথবা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বিরোধী।

 আর-এক প্রকার সমালোচনা আমরা মধ্যে মধ্যে শুনিতে পাই— আমরা নাকি অপরকে কাজ করিবার সুযোগ দেই না। কাজ করিবার সুযোগ কে কাকে দেয়? আমাদেরই বা কাজ করিবার সুযোগ কে দিয়াছে? যার ভিতরে মনুষ্যত্ব আছে সে নিজ শক্তিবলে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করিয়া লয়, মাতা যেরূপ শিশুর মুখে অন্ন তুলিয়া দেন—তার জন্য সেরূপ কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করিয়া দিতে হয় না, কিন্তু আমরা সময়ে সময়ে রাজনৈতিক নাবালক সাজিয়া বলি যে আমরা কাজ করিবার সুযোগ পাইতেছি না— আমাদের কর্মক্ষেত্র কেহ আমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়া দিতেছে না। যে ব্যক্তি ক্রমাগত অভিযোগ করে যে, যে কাজ করিবার সুযোগ অথবা কর্মক্ষেত্র পাইতেছে না—সে কস্মিনকালেও তাহা পাইবে না। এবং যে ব্যক্তি অভিযোগ না করিয়া কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয় তাহার সুযোগ বা কর্মক্ষেত্রের অভাব কোনো দিন হয় না। বাংলার যুব-আন্দোলনের কর্ণধাররূপে যাঁহারা কয়েক বৎসর যাবৎ দায়িত্ব লইয়া বসিয়া আছেন তাঁহারাও কি কাজ করিবার সুযোগ-সুবিধা ও কর্মক্ষেত্র পান নাই?

 বাংলাদেশে আজকাল তুমলে বাদ-বিসম্বাদ, ভোটাভুটি ও ঝগড়া-বিবাদ লাগিয়া আছে। বর্তমানে দলাদলি যে নিতান্ত শোচনীয় ব্যাপার সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। এই দলাদলিতে সর্বাপেক্ষা অধিক ভুগিয়া থাকি আমরা, কারণ সহানুভূতির জন্য, অর্থসাহায্যের জন্য আমাদের বার বার জনসাধারণের দ্বারস্থ হইতে হয়। ঝগড়া-বিবাদ থাকিলে আমরা সাধারণের নিকট সহানুভূতি পাই না— অর্থ তো পাই-ই না—পাই শুধু অনাবিল গালাগালি। বিবাদ-কলহ যতদিন চলিবে ততদিন আমাদের কাজকর্ম একরকম বন্ধ থাকিবে—এ কথা অত্যুক্তি নয়। সুতরাং বিবাদ মেটাইবার আগ্রহ আমাদেরই সর্বাপেক্ষা অধিক অথচ কেহ কেহ মনে করিয়া থাকেন যে, আমাদে পেশা বুঝি ঝগড়া করা এবং আমরা কাজকর্ম ফেলিয়া ইচ্ছা করিয়াই কোমর বাঁধিয়াছি ঝগড়া করিতে। কংগ্রেস একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান—কংগ্রেস Social Service League-এর নামান্তর নহে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন আদর্শ থাকা স্বাভাবিক এবং কর্ম পদ্ধতি সম্বন্ধে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন মত থাকা অনিবার্য। মত ভিন্ন হইলে অনেক সময় পথও ভিন্ন হইয়া থাকে। অতএব ব্যক্তিগত ঝগড়া না থাকিলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মতানৈক্য প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। মতানৈক্য অনেক সময় মনান্তরে পরিণত হয় এবং তার উপরে যখন ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠে তখন দলাদলি আরো তিক্ত ও বিষাক্ত হইয়া উঠে। কিন্তু দলাদলির জন্য প্রকৃতপক্ষে কে দায়ী তাহা অনুসন্ধান না করিয়া কাহারো উপর দোষারোপ করা ঠিক নয়—ঝগড়া-বিবাদের জন্য যাহারা দায়ী তাহাদের অনর্থক বদনামের ভাগী করা কাহারো উচিত নয়। রাজনীতিক্ষেত্রে মধ্যে মধ্যে মতান্তর হওয়া অনিবার্য এবং মতান্তরের জন্য ঝগড়া-বিবাদ হওয়াও বোধ হয় তদ্রূপ অনিবার্য। কিছু মতান্তর যেন মনান্তরে পরিণত না হয় এবং ব্যক্তিগত নিন্দা ও গালাগালি যেন আমাদের অস্ত্র না হইয়া দাঁড়ায়—এ বিষয়ে আমাদের সাবধান ও সতর্ক হওয়া উচিত। তারপর ঐ আন্দোলনে যোগদান করিয়া আমরা যদি এতটা অসহিষ্ণু হইয়া পড়ি যে ভোটের পরিবর্তে লাঠি ও ছোরা ব্যবহার করিতে আমরা দ্বিধা বোধ না করি, তাহা হইলে দেশের দুর্দিন আসিয়াছে বুঝিতে হইবে। সেদিন কলিকাতার ছাত্রসভার কাজ পণ্ড করিবার জন্য বাহিরের লোক ও কতিপয় ছাত্র যেরূপভাবে আসিয়া আক্রমণ করিয়াছিল তাহা অতীব নিন্দনীয়। তার পূর্বে চট্টগ্রামে যে শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল, যার ফলে শ্রীমান সুখেন্দুবিকাশ দত্তের মতো চতুর্দশ বৎসর বয়সের আদর্শ বালককে নিজের জীবন দিতে হইল— তাহা ভুলিবার নয়। সব গুণ্ডামির জন্য দায়ী কে, তাহা আমাদের অনুসন্ধন করা উচিত এবং অনুসন্ধানের পর আমাদের কর্তব্য স্থির করা উচিত। যেখানে এরূপ পাশবিকতা দেখা দিয়েছে সেখানে একতার নামে এ-সব ব্যাপারে ধামাচাপা দিয়া কোনো লাভ নাই। সমাজের দেহে গলদ যাহা আছে তাহা শোধন করিয়া ফেলা উচিত।

 দুঃখের বিষয় এই যে, যাহারা ভণ্ডামিকে আশ্রয় দেয়— তাহারা একবার ভাবিযাও দেখে না যে ইহার পরিণাম কি। প্রথমত যে ব্যক্তি অপরের উপর গুণ্ডামি করে তার জানা উচিত যে একদিন তাহার উপরও গুণ্ডামি হইতে পারে কারণ সব মানুষ সমানভাবে সহিষ্ণু ও অহিংস নয়। তারপর আর একটী কথা তার মনে রাখা উচিত যে, দেশের জনসাধারণ গুণ্ডামির অনুমোদন করে না। সুতরাং গুণ্ডামি যে করিবে সে যে সাধারণের সহানুভূতি ও ভালোবাসা হারাইবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। সুতরাং গুণ্ডামি আপনাকেই ব্যর্থ করিয়া থাকে।

 আজকাল যুব-আন্দোলন সম্বন্ধে যত লেখা বাহির হয় তার মধ্যে কখনও কখনও কেবল সমালোচনাই পাওয়া যায়—পথ নির্দ্দেশ পাওয়া যায় না। ফলে, তরুণ-সমাজের মধ্যে একটা অর্থহীন বিশৃঙ্খলার ভাব যেন আসিয়া পড়িয়াছে। মানুষ সবের মধ্যে কেবল দোষ এবং খুঁত দেখিতে শেখে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট কোনও নির্দেশ পায় না—কোন্ পথে চলা উচিত বা কাহাকে অনুসরণ করা উচিত। এ সম্পর্কে ‘দাদা কোম্পানির’ খুব উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। আমি নিজে এই কোম্পানীর সভ্য কোনোদিন ছিলাম না— আশা করি কোনোদিন হইব না। কিন্তু আমি বুঝিতে পারি না যে, যাহারা একদিন এই কোম্পানীর সভ্য ছিলেন তাহারা কেন দাদা কোম্পানির প্রতি এত বিরূপ হইয়াছেন? তাঁহাদিগের নিজেদের কোম্পানি এখন liquidation-এ গিয়াছে অথবা তাঁহারা এখন promotion লাভ করিয়া ঠাকুর-দাদার সোপানে উঠিয়াছেন— ইহাই কি তাঁহাদিগের অসন্তোষের কারণ? তাহা যদি হয় তবে তার জন্য দায়ী কে?

 আজ বাংলার রাষ্ট্রীয় রঙ্গমঞ্চে দলাদলি ভীষণ আকারে দেখা দিয়াছে— ইহাতে দুঃখিত ও ব্যথিত হয় নাই এমন মানুষ বাংলা দেশে নাই। যদি কেহ থাকে তবে সে মনুষ্যপদবাচ্য নয়। কিন্তু ইহাতে হতাশ হইবাব কোনো কারণ আমি দেখি না। আমার গত ৮/৯ বৎসরের অভিজ্ঞতার ভিতরে তৃতীয়বার এই দলাদলি বাংলার রাষ্ট্রীয় গগন কালিমাময় করিয়া তুলিয়াছে। প্রথম ধাক্কা স্বয়ং দেশবন্ধুকে খাইতে হইয়াছিল, আমরা অবশ্য তাঁর পার্শ্বে ও পশ্চাতে ছিলাম এবং ধাক্কা খানিকটা আমাদের গায়ে লাগিয়াছিল। তখন শুনিতে হইয়াছিল দেশবন্ধুর শত্রুপক্ষের মুখে যে মাসিক ৫০,০০০ টাকার আয় পরিত্যাগ করিয়া তিনি পাঁচ হাজারি মন্ত্রীত্ব গ্রহণের জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন; এবং এ কথাও শুনিতে হইয়াছিল যে চিত্তরঞ্জনকে তাঁহারা দেশছাড়া কবিবেন। দেশছাড়া তাঁহারা চিত্তরঞ্জনকে করিয়াছেন এ বিষয়ে সন্দেহ নাই—কারণ দেশবাসীর সঙ্গে লড়াই করিতে করিতে তাঁহাকে অকালে ইহলোক ত্যাগ করিতে হইল।

 দ্বিতীয় ধাক্কা খাইয়াছিলেন শ্রীযুক্ত সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দ, তখন আমরা অনেকে কর্মক্ষেত্র হইতে বহু দূরে; কিন্তু প্রাচীরের অন্তরালে থাকিয়াও আমরা যে ফলাফলের জন্য অত্যন্ত উৎসুক্যের সহিত প্রতীক্ষা করিতেছিলাম এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। ফলে কংগ্রেসের জয় হইল। এবার তৃতীয় ধাক্কা আমরা নিজেরা সামনাসামনিভাবে খাইতেছি। ফল যে পূর্ববৎ হইবে এবং কংগ্রেসের জয় যে অবশ্যম্ভাবী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। তবে দুঃখের বিষয় এই যে বিরোধের মীমাংসা হইবার পূর্বে অনেক গালাগালি আমাদের খাইতে হইবে এবং অনেক কষ্ট আমাদের সহিতে হইবে। এই বিরোধের মূলে যদি তৃতীয় পক্ষের কোনো হাত না থাকিত তাহা হইলে আমরা এত কষ্ট পাইতাম না।

 আর একটা তীব্র সমালোচনা মধ্যে মধ্যে আমাদের কানে আসে সেটা এই যে কংগ্রেস এতদিন ঝগড়া-বিবাদ ছাড়া আর কি করিল? আমাদের দেশে যাঁহারা Political minded— যাঁহাদের রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি আছে তাঁহারা কিন্তু এ প্রশ্ন করেন না। এই প্রশ্ন করেন তাঁহারা, যাঁহারা মনে করেন যে দেশসেবার একমাত্র উদ্দেশ্য— হাসপাতাল নির্মাণ করা, সেবাসমিতি গঠন করা এবং বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময়ে আর্তের সেবা করা। তাঁহারা হাসপাতালের জন্য লক্ষ টাকা দিবেন কিন্তু স্বরাজ-লাভের জন্য ১৩০ টাকাও সানন্দে দিবেন না, তাঁহারা বলেন অমুক হাসপাতালে এতগুলি bill হইয়াছে, এতগুলি রোগীর চিকিৎসার আয়োজন হইয়াছে— কিন্তু তোমাদের কংগ্রেসে কি হইয়াছে? এরূপ প্রশ্ন শুনিলে কাহার ক্ষমতা আছে যে তাঁহাদের বুঝাইতে পারে যে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সকল রোগের মূলে যে মহাব্যাধি (যে মহাবাধির বিরাম না হইলে অন্য কোনো রোগ নির্মূল হইতে পারে না) সেই মহাব্যাধি নিরাকরণ করা। আমাদের যারতীয় দুর্দশার মূল কারণ যদি আমাদের পরাধীনতা হয় তাহা হইলে যে পর্যন্ত আমরা পরাধীনতা ঘোচাইতে না পারিব সে পর্যন্ত আমরা সুস্থ সবল ও কর্মঠ জাতি হইতে পারিব না। অতএব আমাদের সমস্ত শক্তি, উদ্যম, সম্পদ ও সময় স্বাধীনতা লাভের জন্য বায় করা উচিত। কিন্তু মুস্কিল এই যে আমরা শক্তি ও সম্পদ ব্যয় করিয়া স্বাধীনতার পথে কতদূর অগ্রসর হইতে পারিলাম তাহা বাহিরের কোনো মাপকাঠির দ্বারা অপরকে বুঝানো যায় না। হাসপাতালের বা বিদ্যালয়ের উন্নতি যত সহজে অপরকে বুঝানো যায় রাষ্ট্রীয় উন্নতি সেভাবে বুঝানো যায় না। তাই বিষয়াত্মিকা বুদ্ধি যাঁহাদের তাঁহারা মনে করেন যে আমরা স্বরাজ বা কেবল অর্থের অপব্যয় করি এবং বাজে কাজে সময় নষ্ট করিয়া থাকি। জাতির মধ্যে আদর্শবাদ আরো সঞ্চারিত না হইলে রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি জাগিবে না— রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি না জাগিলে রাষ্ট্রীয় সংগ্রামের অর্থ তাঁহারা বুঝিবেন না— রাষ্ট্রীয় সংগ্রামের সার্থকতা উপলব্ধি না করিলে তাঁহারা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য অকাতরে অর্থ ও সময় ব্যয় করিবেন না এবং সর্বস্বপণ করিতে না পারিলে জাতি কোনোদিন স্বাধীন হইবে না।

 তাই আমার অনেক সময়ে মনে হয় যে আমাদের দেশবাসীর মধ্যে Political-inentality-র বড়োই অভাব। এই রাষ্ট্রীয় মনোভাব বা রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি সৃষ্টি করাই কংগ্রেসের অন্যতম উদ্দেশ্য। জাতির মধো সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও সূক্ষ্ম বিচারশক্তি না আসিলে সে জাতি বহু বৎসর ধরিয়া সর্বস্ব বিলাইয়া আদর্শের পশ্চাতে ছুটিবার সামর্থ্য পাইবে না। এই বুদ্ধি ও বিচারশক্তি অনিবার একমাত্র উপায় সেই জাতির মধো আদর্শবাদ সঞ্চার করা। এই আদর্শবাদ সঞ্চার করিতে হইলে জাতির প্রাণের অন্তরতম প্রদেশে আঘাত করিতে হইবে—তাহার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা—আত্মবিকাশের স্পৃহা জাগাইতে হইবে। স্বাধীনতার জন্য তীব্র ক্ষুধা জাগিলে সে জাতি তখন জীবনপণ করিয়া সাধনায় প্রবৃত্ত হইবে। আপ্রাণ চেষ্টা ও ব্যাকুল সাধনা জাতি যেদিন করিতে পারিবে জাতি সেদিন মুক্ত হইবে।

 জনৈক বন্ধু আমাকে সেদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন— গত দুই বৎসর ধরিয়া আপনি কী করিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হইলে সঙ্গে সঙ্গে একটু তুলনা করা দরকার। গত দুই বৎসরের আগে দুই বৎসর কী হইয়াছিল এবং গত দুই বৎসর অন্য প্রদেশেই বা কী কাজ হইয়াছে এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে রোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। গত দুই বৎসর বেশি কাজ হউক আর নাই হউক— এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রীয় সংগ্রাম বলিতে যাহা বুঝা যায় তাহা যদি ভারতবর্ষে কোথাও থাকে তবে আছে বাংলায় ও পাঞ্জাবে এবং গত দুই বৎসর বাংলা দেশে জোরের সঙ্গে একটা আন্দোলন যদি না চলিয়া থাকিত তাহা হইলে আজ বাঙালী সরকার বাহাদুরের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করিত না।

 তথাপি এ কথা কৈফিয়ৎ স্বরূপ আমি বলিতে চাই না যে আমরা গত দুই বৎসর যাহা করিয়াছি তার জন্য আমরা খুব প্রশংসার্হ। আমি শুধু বলিতে চাই এ কথা যে, যে অবস্থায় আমরা কংগ্রেস হাতে লইয়াছিলাম তাহা বিবেচনা করিলে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করিলে স্বীকার করিতেই হইবে যে আমরা সাধ্যমত কর্তব্য সম্পাদন করিবার প্রয়াস পাইয়াছি। ১৯২৭ সালে বাংলার কংগ্রেস কমিটির অবস্থা ভাঙা হাটের মতো। একে সমগ্র ভারতবর্ষে তখন অসহযোগের স্রোতে ভাঁটা পড়িয়াছে— তার উপর আবার বাংলা দেশে ভীষণ দলাদলির ফলে তখন কংগ্রেস কমিটি নির্জীব হইয়া পড়িয়াছে। দেশের বহু কর্মী তখনো কারারদ্ধে। এই দুর্যোগের মধ্যে আমরা অবতীর্ণ হই এবং ধীরে ধীরে আবার উৎসাহ ও শক্তি সঞ্চার করিবার চেষ্টা করি।

 আমরা আজ যে যুগসন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আছি সে অবস্থায় যদি কাহাকেও কংগ্রেসের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হয় তবে একদিকে তাহাকে জোড়াতালি দিয়া পুরানো প্রোগ্রাম অনুসারে কাজ করিয়া যাইতে হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য এবং ভবিষ্যতের সংগ্রামের জন্য দেশকে প্রস্তুত করিয়া যাইতে হইবে। যে প্রোগ্রাম লইয়া ১৯২১ সাল হইতে এতদিন আমরা চলিয়াছি সে প্রোগ্রাম যথেষ্ট নয়। আমরা এ কয় বৎসরের চেষ্টার ফলে যত লোকের অন্তরে জাতীয় ভাব উদ্বুদ্ধ করিতে পারিয়াছি তাহাও যথেষ্ট নয়। এখন আমরা নূতন প্রোগ্রামে চাই— কিন্তু নূতন প্রোগ্রাম চাইবার পূর্বে, চাই নূতন মানুষ- যাহারা নূতন প্রোগ্রামে গ্রহণ করিতে পারিবে। এখনকার কংগ্রেসে আপনি নূতন প্রোগ্রাম লইয়া যান— কেহ তাহা গ্রহণ করিবে না—গ্রহণ করিলেও তাহা কাজে লাগাইবে না—অর্থাৎ অন্তরের সহিত করিবে না। আমাদের মধ্যে একদল লোক আছেন যাঁহারা “প্রোগ্রাম প্রোগ্রাম” বলিয়া কেবল চীৎকার করেন কিন্তু তাঁহারা তলাইয়া দেখেন না যে নূতন মানুষ তৈয়ারি না করিলে সে প্রোগ্রামের মূল্য বুঝিবে কে?

 ১৯২৭ সাল হইতে এই প্রশ্নই আমার চিত্তকে আলোড়িত করিয়া আসিতেছে। নূতন প্রোগ্রাম আমারও একটা আছে—কিন্তু সে প্রোগ্রাম দিবার সময় এখনো আসে নাই—আসিবে সেইদিন, যেদিন নূতন মানুষ প্রস্তুত হইবে যাহারা সেই কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করিয়া তাহা কাজে লাগাইতে পারিবে। নূতন মানুষ তৈয়ারি করিবার চেষ্টায় আমি এখন নিরত। তাই গত দুই বৎসর ধরিয়া আমি ছাত্র আন্দোলন, যুব-আন্দোলন, নারী-আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়ে এত জোর দিয়া বলিয়া আসিতেছি। এই-সব আন্দোলনের সাহায্যে যদি নূতন মানুষ পুরুষ ও নারী প্রস্তুত হয় তখন নূতন প্রোগ্রাম দিলে তার সার্থকতা হইবে।

 এই-সব আন্দোলনের ভিতর প্রাণসঞ্চার করিতে হইলে নূতন আদর্শ চাই। আমার আদর্শ—দেশের ও সমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি। সর্বাঙ্গীণ মুক্তির বাণী গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, ঘরে ঘরে প্রচার করিতে হইবে। স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ কী তাহা সকলকে বুঝাইয়া দিতে হইবে। স্বাধীনতার অখণ্ড রূপ আমরা অনেকেই আজও উপলব্ধি করি নাই। অখণ্ড রূপের উপলব্ধি জাতির মানসক্ষেত্রে একদিনে আসে না। বহু দিনের সাধনার ফলে, এবং বহু বৎসর খণ্ড খণ্ড রূপ দেখিবার পর আমরা আজ অখণ্ড রূপের উপলব্ধি পাইতেছি। সমগ্র জাতিকে এখন বুঝাইয়া দিতে হইবে স্বাধীনতার অখণ্ড রূপ কী। যেদিন জাতি এই অখণ্ড রূপের উপলব্ধি লাভ করিবে সেইদিন জাতি পূর্ণভাবে মুক্ত হইবার জন্য পাগল হইয়া উঠিবে।

 পূর্ণ সাম্যবাদের উপর নূতন সমাজকে গড়িয়া তুলিতে হইবে। জাতিভেদের অচলায়তনকে একেবারে ধূলিসাৎ করিতে হইবে। নারীকে সর্বভাবে মুক্ত করিয়া সমাজে ও রাষ্ট্রে পুরুষের সহিত সমান অধিকার ও দায়িত্ব প্রদান করিতে হইবে; অর্থের বৈষম্য দূর করিতে হইবে এবং বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে প্রত্যেকে (কী পুরুষ কী নারী) যাহাতে শিক্ষার ও উন্নতির সমান সুযোগ ও সুবিধা পায় তার ব্যবস্থা করিতে হইবে। সমাজতন্ত্রমমূলক সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র যাহাতে স্থায়ী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তার জন্য সচেষ্ট হইতে হইবে।

এক কথায় আমরা চাই ভারতের পূর্ণ ও সবার্ঙ্গীণ স্বাধীনতা। এই নূতন স্বাধীন ভারতে যাহারা জন্মিবে তাহারা মানুষ বলিয়া জগৎসভায় পরিগণিত হইবে। ভারত আবার জ্ঞানে, বিজ্ঞানে— ধর্মেকর্মে— শিক্ষায় দীক্ষায় শৌর্যে বীর্যে জগৎবরেণ্য হইবে।

 আমাদের কর্তব্য কী তাহা আর খুলিয়া বলার প্রয়োজন নাই। আমরাই তো নূতন ভারতের স্রষ্টা। অতএব এসো আমরা সকলে মিলিয়া এই পবিত্র মাতৃযজ্ঞে যোগদান করি। মা আমাদের আবার রাজরাজেশ্বরীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা হইবেন। এখনকার কাঙালিনী মাকে ষড়ৈশ্বর্যসম্পন্না দশভুজারূপে দেখিয়া আমাদের চক্ষু সার্থক হইবে। অতএব এসো ভ্রাতৃবৃন্দ, আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া সর্বস্ব বলিদানের জন্য মাতৃচরণে সমবেত হই।

 ডিসেম্বর ১৯২৯