তীর্থ-সলিল/চাতকের প্রতি

উইকিসংকলন থেকে

চাতকের প্রতি।

বন্দি তোমা’ আনন্দ-মূরতি!
পাখী তুমি কখনত’ নহ,
স্বর্গে কিবা তা’রি কাছে অতি
ভরা-প্রাণে ঢাল স্বপ্ন-মোহ;
না শিখিয়া, না ভাবিয়া আহা, অজস্র গাহিছ অহরহ!
ঊর্দ্ধে দূরে,—দূর দূরান্তরে
ধরা হ’তে উড়েছ উধাও,
গূঢ় নীল গগণ-সাগরে
পুঞ্জ তেজ সম ছুটে যাও,
গাহিয়া উড়িয়া চল কত,—উড়িয়া কতই গান গাও।

শ্রান্তিভরে সূর্য্য পড়ে ঢলি’,
তাহারি সে সুবর্ণ-আলোকে
নেঘ-মালা উঠিছে উজলি’,
তুমি তাহে সাঁতারিছ সুখে,
অশরীরী আনন্দ যেন গো ছাড়া পেয়ে ছুটেছে দ্যুলোকে৷

গলিয়া পাণ্ডুর সন্ধ্যা মিশে
তোমারি প্রয়াণ-পথ ‘পরে;
পাইনা তোমার আর দিশে,
তারা যেন তীব্র রবিকরে;
উচ্ছ্বাসের উচ্চ স্বপ্ন তব, আহা তবু শুনি প্রাণ ভ’রে৷

শুভ্রকায়, রজত-গোলক,
শশাঙ্কের রশ্মির সমান,—
ক্ষীণ যা’র প্রদীপ্ত আলোক
ঊষার কিরণে ম্রিয়মাণ;
নয়নে যায়না দেখা, শেষে, আছে শুধু হয় অনুমান৷

মুখরিত ধরণী, সমীর,
হয়েছে তোমারি সুরে হায়,
নির্ম্মেঘ আকাশ যবে স্থির
নগ্ন-কায়া যামিনী ঘুমায়,
জ্যোৎস্না যেন বৃষ্টি করে চাঁদ, গগনের কূল ভেসে যায়৷

তুমি যে কি আমরা জানিনা,
জানিনা কি তুলনা তোমার,
ইন্দ্রধনু হ’তেও ঝরেনা
তেমন উজল বারিধার,—
তুমি যেথা সেথাই যেমন কলতান,—সঙ্গীত বিধার।

ভাবাবেশে উন্মাদ পরাণ,
অচেনা সে কবির মতন,—
অযাচিত গেয়ে যাও গান
মুগ্ধ ধর। নহে যতক্ষণ,—
অভিনব আশা-আশঙ্কায় যতক্ষণ নাহি ডুবে মন।

অবরিতা নৃপবালা হেন,
প্রাসাদের নিভৃত শিখরে,
ভালবাসা-ভারে উনমন
ক্লান্ত হিয়া জুড়াবার তরে
প্রেমেরি মতন মধুগান গাহ কুঞ্জ প্লাবিয়া সুস্বরে।

সোনালি সে জোনাকীর মত,—
হিমজলে পাপ্‌ড়ির স্তরে
ঢাল গো তরল আলো কত,
নিশীথে, অজ্ঞাতে, অগোচরে;
ঝরা ফুল আর তৃণদল রাখে যা’রে ঘিরিয়া আদরে।

পুঞ্জ-পত্র কুঞ্জের ভিতরে
গোলাপের মত নিমগন;
যতক্ষণ গন্ধ না বিতরে,—
তপ্ত বায়ু করে আলিঙ্গন;
শেষে সেই সৌরভেরি ভারে ক্লান্ত পক্ষ মন্থর পবন৷

বসন্তের বর্ষণের রব
কম্পন-চঞ্চল তৃণ‘পরে—
বর্ষণ-জাগ্রত ফুলে সব;—
যত সুর নিখিলে বিহরে,—
ক্লেদহীন, উচ্ছ্বাসে নবীন—তব সুর জিনে সকলেরে।

পাখী কিবা কিন্নর! শিখাও,
পূর্ণ প্রাণ কি ভাব-সৌরভে;
এমন ত’ শুনিনি কোথাও
মদিরা কি প্রণয়ের স্তবে,
স্বরগের সুধার প্লাবন আবেগে ঢালিতে মর ভবে৷

পরিণয়-নিশির সাহানা,
বিজয়ীর বিজয়ের তান,
ও গানের নহে সে তুলনা,
মিথ্যা তার মাধুরীর ভাণ;
কি যেন অভাব সে সকলে,—লুক্কায়িত—তবু বর্ত্তমান৷

বল, পাখী, কোথা সে নির্ঝর,—
উৎসারিত যাহে তব গান?
কোন্ গিরি, সাগর, প্রান্তর?
কোন্ মেঘ সোনার সমান?
সে কোন্ পাখীর ভালবাসা? সে কোন্ ব্যথার অবসান?

তব গান বরিষে অমিয়া,
নাহি তাহে অবসাদ-লেশ,
কভু বুঝি বিরক্তির ছায়া
আসে নাই দিতে তোমা’ ক্লেশ;
প্রেম জান; জান না প্রেমের তৃপ্ত সুখে দুঃখ কি অশেষ৷

জাগিয়া কি স্বপনে ঘুমায়ে
জান কি বারতা মরণের?
মর নর আমাদের চেয়ে
গভীর প্রকৃত কথা ঢের?
নহে তব গীতি স্রোতম্বিনী কেন চির সৌন্দর্য্যের ফের?

আগে পিছে চাহি চারিভিতে,
কামনা—কোথাও যাহা নাই;
আমাদের প্রাণের হাসিতে
মিশে আছে বেদনা সদাই;
সব চেয়ে সুমধুর গান—সব চেয়ে দুখের কথাই।

তবু মোরা পারিতাম যদি
ঘৃণা, ভয়, গর্ব্ব তেয়াগিতে;
জনমি’ যদি গো নিরবধি
নাহি হ’ত অশ্রু বরষিতে,
জানি না শকতি হ’ত কিনা তোমার ও আনন্দে মিশিতে৷

আনন্দের ছন্দ আছে যত,
যত আছে সুর, লয়, তান,—
রত্ন সম কাব্য শত শত
গ্রন্থের ভাণ্ডারে শোভমান,—
কবি বলে, ধরণী-বিরাগী, সকলের শ্রেষ্ঠ তব গান৷

আনন্দের জান যে বারতা
শিখাও হে তাহার সন্ধান,
ওই তব সংহত মত্ততা
কণ্ঠে মোর দিক্ আসি তান,
বিশ্ব বাহে শোনে গো বিস্ময়ে—মুগ্ধপ্রাণ আমারি সমান!

শেলি।