ত্রিপুরার স্মৃতি/সুজামস্‌জিদ্‌

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

সুজামস্‌জিদ্‌

 কুমিল্লা নগরীর অন্তঃপাতী সুজাগঞ্জ নামক পল্লীতে অবস্থিত উক্ত সুপ্রসিদ্ধ মসজিদটী ঘটনা বিশেষের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ত্রিপুরাধিপতি গোবিন্দ মাণিক্য-কর্ত্তৃক খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্ম্মিত হইয়াছিল। যে ঘটনামূলে তিনি ইহা নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, এই বিষয় যথাসম্ভব সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণিত হইল।

 মোগল সম্রাট শাহজাহানকে তদীয় পুত্র ঔরঙ্গজেব কারারুদ্ধ করিয়া ভারত সাম্রাজ্য অধিকার করিতে প্রয়াস প্রাপ্ত হইলে, রাজ্যাধিকারের জন্য শাহজাহানের পুত্রগণ-মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। সেই সংগ্রামে সুবে-বাঙ্গলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসন কর্ত্তা শাহজাদা সুলতান মহম্মদ সুজা ঔরঙ্গজেবের কর্ত্তৃক পরাজিত হইলে তদীয় ভ্রাতা দারামুরাদ্‌ বখ্‌শের ন্যায় নিহত হওয়ার আশঙ্কায় তদানীন্তন ত্রিপুরাধিপতির আশ্রয় গ্রহণ পূর্ব্বক জীবনরক্ষার উদ্দেশে ত্রিপুরাতে আগমণ করেন।

 হতভাগ্য সুজা তথায় উপস্থিত হইয়া পরম্পরায় লোকমুখে জ্ঞাত হন যে, তাঁহাকে ধৃত করিবার জন্য ঔরঙ্গজেব্‌ গোবিন্দ মাণিক্যকে সানুনয়ে এক লিপি প্রেরণ করিয়াছেন, এবং সেই লিপি তৎকালের ত্রিপুর-রাজ্যাধিকারী ছত্র মাণিক্যের হস্তগত হইয়াছে। তখন প্রাণ ভয়ে তিনি ত্রিপুরা হইতে পলায়ণ পূর্ব্বক রাজ্যচ্যূত গোবিন্দ মাণিক্যের সমীপে উপস্থিত হইয়া তদীয় আশ্রয় প্রার্থী হন। যে সুজা একদা গোবিন্দ মাণিক্যের বিরুদ্ধাচরণ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই, কালের কুটিলচক্রে সেই সুজাই আজ জীবনরক্ষার্থে গোবিন্দ মাণিক্যের শরণাপন্ন হইতে বাধ্য হইয়াছিল—ইহাকেই বলে বিধিবিড়ম্বনা।

 বর্ণিত ঘটনার সময় (১৭৭০ ত্রিপুরাব্দ) গোবিন্দ মাণিক্য তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ছত্র মাণিক্যের চক্রান্তে রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া চট্টগ্রামের পার্ব্বত্য প্রদেশে বাস করিতেছিলেন। তথায় তিনি সুজাকে আশ্রয় প্রদান পূর্ব্বক “রসাঙ্গ” বা আরাকান প্রদেশে গমন করেন। ইহার কিয়দ্দিবস পর সুজাও গোবিন্দ মানিক্যের অনুবর্ত্তী হন।

 একদা রসাঙ্গের অধীশ্বর ও গোবিন্দ মাণিক্য একত্রে উপবেশন পূর্ব্বক বাক্যালাপ করিতেছেন—এমন সময়ে সুজা তথায় উপস্থিত হইলে, পূর্ব্বপরিচয় থাকা বশতঃ গোবিন্দ মাণিক্য তাহাকে সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা করেন। তাহা পর্য্যবেক্ষণ করিয়া—জনৈক ম্লেচ্ছ যবনকে এবংবিধ সম্মান প্রদর্শন করিবার কারণ কি—এই কথা রসাঙ্গের অধিপতি গোবিন্দ মাণিক্যকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি তৎসমীপে মুজার কুলমর্য্যাদার পরিচয় প্রদানপূর্বক তাহার সমস্ত অবস্থা জ্ঞাপন করেন।

 এই বিষয় বঙ্গ ভাষায় রচিত ত্রিপুররাজ-বংশ চরিত রাজমালায় নিম্নরূপ লিপিবদ্ধ আছে।

আউরঙ্গজেব বাদসা তখনে হৈল।
রাজ্য ভ্রষ্ট হৈয়া সুজা রসাঙ্গেতে গেল।
গোবিন্দ মাণিক্য রাজা সেই স্থানে ছিল।
হেন কালে সুজা বাদসা উপস্থিত হৈল॥
ত্রিপুর রসাঙ্গ রাজা বৈসে সিংহাসনে।
বাদসা দেখিয়া ত্রিপুর উঠিল তখনে॥
সিংহাসন হৈতে লামে ত্রিপুর-রাজন।
সুজা বাদসা সিংহাসনে করিল স্থাপন॥
রসাঙ্গের মহারাজা বলিল আপন।
কি কারণে ম্লেচ্ছ রাজা দিছ সিংহাসন॥
রাজা বলে নরেশ্বর করি নিবেদন।
এহিত সুজা বাদসা বিখ্যাত ভুবন॥

   রাজমালা—গোবিন্দ মাণিক্য খণ্ড

 আরাকান অধিপতি সুজার প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া তাঁহাকে সাদরে সম্ভাষণ করেন এবং এতদ্ব্যতীত গোবিন্দ মাণিক্যের সকরুণ অনুরোধে বশীভূত হইয়া তিনি সুজাকে আশ্রয় প্রদান করিতে প্রতিশ্রুত হন।

 গোবিন্দ মাণিক্যের এবম্ভূত সৌজন্যের বিনিময়ে সুজা তদীয় কটী-বন্ধ সংলগ্ন দুষ্প্রাপ্য পারস্য দেশীয় তরবারি এবং মূল্যবান হীরকাঙ্গুরী উন্মোচন পূর্ব্বক এই কথা বলিয়া সবিনয়ে গোবিন্দ মাণিক্যকে প্রদান করেন—“ভারত সম্রাটের পুত্র হইয়াও অদৃষ্ট দোষে আজ আমি পথের ভিখারী, এই দুইটী ব্যতিরেকে আপনাকে প্রদান করিতে পারি এমন কোন দ্রব্য এক্ষণে আমার নিকট নাই, অতএব আপনার অনুপযুক্ত হইলেও কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ ইহাই আমি আপনাকে উপঢৌকন প্রদান করিতেছি, অনুগ্রহ পুর্ব্বক এই যৎসামান্য দ্রব্যদ্বয় গ্রহণ করিয়া বাধিত করিবেন।”

 যে অসিটী সুজা-কর্ত্তৃক গোবিন্দ মাণিক্যকে প্রদত্ত হইয়াছিল, তাহা অদ্যাপি ত্রিপুরাধিপতিগণের নিকট বর্ত্তমান আছে।

 শাহজাদা সুজা ও গোবিন্দ মাণিক্য উভয়েই এক সময়ে এবং এক-ই বিষয়ে জন্মভূমি হইতে বিতাড়িত হন। সুজার পক্ষে দিল্লীর সিংহাসন লাভ করা দূরের কথা—তাঁহার আর স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করা ভাগ্যে ঘটে নাই; আরাকানেই তিনি নিহত হন। কিন্তু ধর্ম্মপরায়ণ হিন্দু নৃপতি গোবিন্দ মাণিক্য পুণ্যবলে পুনরায় রাজ্যপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

 ত্রিপুরাধিপতি গোবিন্দ মাণিক্য ১০৭৬ ত্রিপুরাব্দে (১৬৬৬ খৃষ্টাব্দ) পুনরায় রাজদণ্ড ধারণ করিলে বিবৃত ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন-স্বরূপ কুমিল্লা নগরীর উত্তর প্রান্তে প্রবাহিত গোমতী নদীর তীববর্ত্তী “সুজামস্‌জিদ্‌” নামক শাহজাদা সুলতান মহম্মদ সুজার নামসমন্বিত মুসলমানগণেব সুপ্রসিদ্ধ ভজনালয়টী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। এবং যে ভূমিখণ্ডের উপর বর্ণিয়মান মস্‌জিদটী নির্ম্মিত, তৎ-কর্ত্তৃক তাহাতে সুজার নামানুসারে একটী গঞ্জ স্থাপিত হইয়া সুজাগঞ্জ অ্যাখ্যা প্রদত্ত হইয়াছিল।

“গোমতী নদীর কুলে মজিদ স্থাপিয়া।
সুজা বাদসার নামে মজিদ করিয়া॥
সুজা নামে এক গঞ্জ রাজা বসাইল।
সুজাগঞ্জ নাম বলি তাহার রাখিল॥”

রাজমালা—গোবিন্দ মাণিক্য খণ্ড

 ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িত যে সমুদয় কীর্ত্তিমালা এতদঞ্চলে অবস্থিত তন্মধ্যে ইহা অন্যতম। বর্ণিত মসজিদ নির্ম্মিত হওয়ার পব অবধি এযাবৎ ইহার রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি সমস্ত কার্য্যই ত্রিপুররাজ্য হইতে সম্পাদিত হইতেছে।

 সুজাকে ধৃত করিবার জন্য ঔরঙ্গজেব কর্ত্তৃক গোবিন্দ মাণিক্যের নিকট যে এক লিপি প্রেরিত হইয়াছিল বলিয়া পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে, সেই পত্রের প্রতিলিপি এবং তাহার বঙ্গানুবাদ এই পুস্তকের পরিশিষ্টে প্রদত্ত হইল।


[১০০] [১০১]

ঔরঙ্গজেব কর্ত্তৃক গোবিন্দ মাণিক্যের
নিকট লিখিত পত্রের প্রতিলিপি

بفضله تعالی



 عديم‌المثال جوهر ذاتی اقبال و سلطنت پناهی بیشم سمرو بیجي مها مهودي پنج سري جُکت مهاراجه گوبِند مانِک بہادر سلام‌الله تعالی

 ما بدولت را به تحقیق رسیده است که دشمن مورثیم شجاع بصورت پنهاني بدارالسلطنت آن مملکت پناهي سکونت می‌ورزد چونکه بزرگان قدیم ایشان از سر صدق حوصله با بزرگوارانم الفت تمام و محبت ما لا کلام داشته به یگانگی و یکجهتي دارالسلطنت و فرمان روائي میداده‌اند چنانچه بسابق ایام نیز قوم افاغنه که از ضرب شمشیر بزرگانم گریخته در آنسو هنگامه آرا بردند بزرگان آن سلطنت پناه از وفور اتحاد و کمال ارتباط آن شوربختان را از جانب شرق بنگاله باز بآنسو گریزانیدند و تفرقه تمام بحال‌شان افگندند پس درینولا مترصدم که مطابق نوشته ما بدولت دشمن مذکورم را گرفتار نموده فوراً باین جانب روانه فرمایند و اگر اقتضائی رضاي آرم سلطنت پناه باشد ما سپهسالارم بمقام مونگیر مقیم و منتظر دارم بعد گرفتارش ما به سپهسالارم بهزم و هوشیاري تمام رسانیده ما بدولت را ممنون سازند که سلسله محبت بضابطه قدیم مستحکم ماند وگرنه یقین کلی است که در صورت بودن آن ناعاقبت اندیش بانسو خرخشه و تفرقهٔ بمملکت ایشان راه یابد ما بدولت را یقین کمال است که بموجب نوشته سابق بکار مذکوره کار فرمان شده باشند



ঔরঙ্গজেব কর্ত্তৃক গোবিন্দ মাণিক্যের নিকট
লিখিত পত্রের বঙ্গানুবাদ


 অতুলনীয় উচ্চকুলোদ্ভব সৌভাগ্যবান্‌ রাজ্যেশ্বর বিষম সমর-বিজয়ী মহামহোদয় পঞ্চ শ্রীযুক্ত মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য বাহাদুর—আল্লাতালা আপনার রাজ্য সুমঙ্গলে রক্ষা করুন।

 আমি সুনিশ্চিতরূপে অবগত হইয়াছি যে, আমার চিরশত্রু সুজা ভবদীয় রাজ্যে গোপনে অবস্থান করিতেছে। মদীয় পূর্ব্বপুরুষের সম্মানিত মহোদয়গণের সহিত আপনার গৌরবান্বিত পূর্ব্বপুরুষগণের পরস্পর আত্মীয়তা ও প্রণয় থাকা বশতঃ আমাদিগের সহিত বিবাদে লিপ্ত দুর্ভাগ্য আফ্‌গানেরা ভবদীয় রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলে আপনার মহামান্য পূর্ব্বপুরুষগণ অসিপ্রহারে যেরূপ সেই দুষ্ট আফগানদিগকে বঙ্গদেশে বিতাড়িত করিতেন, বর্ত্তমানে আমিও তদ্রূপ আশা করি—আমার লিখানুসারে আপনি উক্ত শত্রু (সুজা) কে ধৃত করিয়া সত্বর আমার নিকট প্রেরণ করেন। যদি আপনার অভিমত হয়, তবে আমার সেনাপতিকে মুঙ্গেরে অপেক্ষা করাইব। তাঁহাকে ধৃত করিবার পর আপনার সেনাপতির রক্ষণাবেক্ষণে সাবধানে প্রেরণ করিয়া বাধিত করিবেন—যেন প্রাচীন বন্ধুতা স্থায়ী বহে। নতুবা ইহা নিশ্চয় জানিবেন—আপনার রাজ্যে উক্ত অপরিনামদৰ্শির অবস্থান করার জন্য ভবিষ্যতে আমাদিগের পরস্পর-মধ্যে বিবাদ ও মনোমালিন্য সংঘটিত হইবে। আমার লিপি অনুসারে কার্য্য হইবে বলিয়া আমি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি।