বিষয়বস্তুতে চলুন

দায়ে খুন/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 চারিদিবসকাল অনবরত ভাবিয়া-চিন্তিয়া এবং অপর ফারমের আমার পরিচিত অপরাপর কর্মচারীগণের সহিত পরামর্শ করিয়া বঙ্গদেশের যতগুলি প্রধান প্রধান নগরের নাম সংগৃহীত হইবার সম্ভাবনা, তাহা সংগ্রহ করিয়া, তাহার একটা তালিকা প্রস্তুত করিলাম। চারিদিবস পরে, অর্থাৎ পঞ্চমদিবসে আমি সেই তালিকা সহ পুনরায় রাজার কাটরায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে ইতিপূর্ব্বে মাণিকচাঁদকে আমি যেরূপ অবস্থায় দেখিতে পাইয়াছিলাম, আজও দেখিলাম, তিনি সেই স্থানে সেইরূপ অবস্থায় বসিয়া কার্য্য করিতেছেন। তাঁহার দ্বারবানও সেইরূপে ঘরের বাহিরে বসিয়া রহিয়াছে।

 আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই তিনি আমাকে সেই স্থানে বসিতে বলিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, তিনি কহিলেন, “আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আমার হাতের কার্যটী শেষ করিয়া, আপনার সহিত কথোপকথনে নিযুক্ত হইতেছি।” এই বলিয়া তিনি আপনার কার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন, আমি সেই স্থানে স্থিরভাবে বসিয়া রহিলাম। এইরূপে প্রায় একঘণ্টাকাল অতিবাহিত হইলে পর, তিনি আপনার হস্তস্থিত কলম সেই স্থানে রাখিয়া আমার দিকে চাহিলেন ও কহিলেন, “এখন আমি আপনার কথায় মনোনিবেশ করিতে প্রস্তুত; বলুন, এখন আমাকে কি করিতে হইবে?”

 আমি। আপনাকে এখন কিছুই করিতে হইবে না। আপনি আমাকে একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আনিতে বলিয়াছিলেন, তাই আমি অদ্য আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।

 মাণিক। বঙ্গদেশের মধ্যে কোন্ কোন্ স্থানে আমাদিগের শাখা-কার্য্যালয় খুলিতে হইবে, তাহারই তালিকা?

 আমি। হ্যঁ।

 মাণিক। প্রস্তুত হইয়াছে?

 আমি। একরূপ প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি।

 মাণিক। এত অল্প সময়ের মধ্যে এরূপ একটী কার্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন? অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া না দেখিলে, এরূপ তালিকা সহজে কোনরূপে প্রস্তুত হইতে পারে। সেই তালিকা প্রস্তুত করিতে আমি আপনাকে দশদিবস সময় প্রদান করিয়াছিলাম না?

 আমি। না মহাশয়! আপনি আমাকে চারিদিবসমাত্র সময় প্রদান করিয়াছিলেন। তাহারই মধ্যে যতদূর সম্ভব, আমি একটী তালিকা প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি। আপনি একবার দেখিলেই জানিতে পারিবেন যে, সেই তালিকা প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইতে পারিয়াছি কি না?

 এই বলিয়া আমার আনীত তালিকাখানি মাণিকাচাঁদের হস্তে প্রদান করিলাম।

 মাণিকচাঁদ সেই তালিকাখানি একবার আদ্যোপান্ত দেখিয়া কহিলেন, “এই তালিকায় আপনি অনেকগুলি নাম লিখিয়াছেন সত্য; কিন্তু আমার বিশ্বাস, বঙ্গদেশের মধ্যে ইহা অপেক্ষাও কারবারের অনেক ভাল ভাল স্থান আছে, সেই স্থানগুলিও আপনি যদি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারেন, তাহা হইলেই ভাল হয়। আমি আপনাকে আরও দশদিবসের সময় প্রদান করিতেছি, একটু সবিশেষ চেষ্টা করিয়া সেই দশদিবসের মধ্যে যাহাতে আপনি এই কার্যটী সম্পন্ন করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা করিবেন। আর অদ্য হইতে একাদশ দিবসের দিন আপনি পুনরায় আমার নিকট আগমন করিয়া, আপনার প্রস্তুত করা তালিকাখানি আমাকে প্রদান করিবেন। সেইদিবস হইতেই সেই সকল স্থানে শাখা-কার্য্যালয় সকল স্থাপন করিতে যেরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে, তাহা আমি করিব। কোন্ কোন্ স্থানে শাখা কার্য্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, তাহা স্থির করিবার নিমিত্ত আর যেন অধিক সময় ব্যয় না হয়। এই দশদিবসের মধ্যেই যেন সমস্ত কার্য্য শেষ হয়।”

 আমি। কোন্ কোন্ স্থানে শাখা-কার্য্যালয় স্থাপন করিলে চলিতে পারে, অনেক ভাবিয়া এবং অনেক অনুসন্ধান কধিয়া, তাহা ত আমি একরূপ স্থিরই করিয়াছি। তদ্ব্যতীত আর যে সকল কারবার-উপযোগী স্থান আছে, তাহা জানিয়া লইতে দশদিবসের প্রয়োজনু হইবে না, দুই চারিদিবসের মধ্যেই আমি উহা স্থির করিয়া লইতে পারিব।

 মাণিক। সে উত্তম কথা। যে কার্য্য আপনি আর চারিদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করিতে পারিবেন বলিয়া আপনার বিশ্বাস, সেই কার্য্য দশদিবসের মধ্যে যে সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিবেন, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি এত কার্য্যে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি যে, দশদিবসের মধ্যে আমি কোনরূপেই অপর কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে সমর্থ হইব না। একাদশ দিবসে ঠিক এই সময় আপনি এখানে আগমন করিবেন, সেইদিবস আমি সমস্ত স্থির করিয়া লইব।

 যেরূপ আদেশ পাইলাম, কার্য্যেও আমি সেইরূপ করিলাম। দেখিয়া শুনিয়া আরও কতকগুলি ভাল ভাল স্থানের নাম বাহির করিয়া দুই তিনদিবসের মধ্যে একটী তালিকা প্রস্তুত করিলাম। তালিকাখানি সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেলে, আমি ভাবিলাম, একবার রাজার কাটরায় গিয়া মাণিকচাঁদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসি। দেখি, তিনি সেই তালিকা সম্বন্ধে আর কোনরূপ নূতন কথা বলেন কি না?

 এই ভাবিয়া আমি পঞ্চমদিবসের দিন পুনরায় সেই রাজার কাটরায় গমন করিলাম; কিন্তু সে দিবস মাণিকচাঁদ বা তাঁহার দ্বারবানকে দেখিতে পাইলাম না। দেখিলাম, ঘর তালাবদ্ধ। পুনরায় তাহার পরদিবস গমন করিলাম, সে দিবসেও সেইরূপ তালাবন্ধ দেখিলাম। এইরূপে দশমদিবস পর্য্যন্ত প্রত্যহ একবার করিয়া সেই স্থানে গমন করিতে লাগিলাম; কিন্তু একদিবসের নিমিত্তও মাণিকাচাঁদ বা তাঁহার দ্বারবানের সহিত সাক্ষাৎ হইল না। এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া মনে করিলাম, কোন কার্য্যবশতঃ হয় ত মাণিকচাঁদ স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন, অথবা তাঁহার কোনরূপ শারীরিক অসুস্থতা উপস্থিত হইয়াছে।

 একাদশ দিবসের দিন পুনরায় সেই স্থানে গমন করিলাম। পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে মাণিকচাঁদ এবং তাঁহার দ্বারবানকে দেখিতে পাইয়াছিলাম, আজ উভয়কেই সেইরূপ ভাবে দেখিলাম। দেখিলাম, দ্বারবান্ সেই ঘরের দরজায় বসিয়া আছে, আর মাণিকচাঁদ ঘরের ভিতর বসিয়া লেখাপড়ায় নিযুক্ত আছেন।

 আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই মাণিকাচাঁদ পূর্ব্বে র ন্যায় আমাকে বসিবার স্থান প্রদান করিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন মহাশয়! আপনার উপর আমি যে কার্যের ভার অর্পণ করিয়াছিলাম, তাহা শেষ করিতে পারিয়াছেন কি?”

 উত্তরে আমি কহিলাম, “সে কার্য্য আমার অনেকদিবস শেষ হইয়া গিয়াছে। আমি তাহার একটা সম্পূর্ণ তালিকাও প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি।” এই বলিয়া আমি যে তালিকাখানি প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহা তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি উহা আপন হন্তে গ্রহণ করিয়া একবার আদ্যোপান্ত উত্তমরূপে দেখিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, “আমার বোধ হইতেছে, আপনি যে তালিকা প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহাতেই আপাততঃ আমাদিগের কার্য্য চলিতে পারিবে। অদ্য এই তালিকাখানি আমার নিকট থাকুক, সময়মত আমি উহা একবার আদ্যোপান্ত দেখিয়া রাখিব। আপনি কল্য পুনরায় আগমন করিবেন, সেই সময় উভয়ে পরামর্শ করিয়া, যে যে স্থানে শাখা-কার্য্যালয় স্থাপন করা বিবেচনা-সিদ্ধ হয়, সেই সেই স্থানে কার্য্যালয় স্থাপন করিবার বন্দোবস্ত করা যাইবে।” এই বলিয়া, সেই তালিকাখানি মাণিকচাঁদ আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন। আমিও আপন স্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম।

 পরদিবস পুনরায় রাজার কাটরায় গমন করিয়া দেখিলাম, মাণিকচাঁদ পূর্ব্বের ন্যায় আপন আফিসে বসিয়া কর্ম্ম-কার্য্য করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া তিনি নিতান্ত দুঃখভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “আমি বড়ই দুঃখের সহিত আপনাকে বলিতেছি যে, আপনি এত পরিশ্রম ও এত সময় নষ্ট করিয়া যে তালিকাখানি প্রস্তুত করিয়াছেন, এবং যাহা গত কল্য আমার নিকট রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা যে আমি কোথায় ফেলিয়াছি, আমি তাহার কিছুই সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হইতেছে, আপনাকে পুনরায় সেইরূপ আর একখানি তালিকা প্রস্তুত করিতে হইবে।”

 মাণিকচাঁদের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “তালিকাখানি দৈবাৎ হারাইয়া গিয়াছে বলিয়া আপনাকে সবিশেষ চিন্তিত হইতে হইবে না। আমি যে তালিকাখানি আপনাকে প্রদান করিয়াছিলাম, তাহার একখানি নকল আমার নিকট আছে; যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে এখনই আনিয়া আমি উহা আপনাকে প্রদান করিতে পারি।”

 আমার কথার উত্তরে মাণিকাচাঁদ কহিলেন, “আপনি যে সেই তালিকার একটী নকল রাখিয়াছেন, ইহা শুনিয়া আমি সবিশেষ রূপে সন্তুষ্ট হইলাম। আপনাকে পরিশ্রম করিয়া উহা এখনই আনিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, কল্য আপনি উহা লইয়া আমার নিকট এই সময় আসিবেন।” এই বলিয়া মাণিকচাঁদ, সেই দিবসও আমাকে সেই স্থান হইতে বিদায় করিলেন।

 আমার নিকটে যে তালিকাখানি ছিল, তাহার একটী নকল প্রস্তুত করিয়া মাণিকচাঁদের আদেশ-অনুযায়ী সেই তালিকাখানি সঙ্গে লইয়া পরদিবস পুনরায় তাঁহার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই দিবস তিনি আমার সহিত উত্তমরূপে কোন কথা কহিলেন না, কেবলমাত্র আমার নিকট হইতে তালিকাখানি গ্রহণ করিলেন, এবং এইমাত্র কহিলেন, “অদ্য আমার শরীর একটু অসুস্থ বোধ হইতেছে। তালিকাখানি এখন আমার নিকট থাকিল, আমি সময়মত উহা দেখিয়া রাখিব। আপনি চারিদিবস পরে পুনরায় আসিবেন, সেই দিবস সমস্ত কার্য্যের বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিব।”

 আমি তাঁহারই আদেশ-অনুযায়ী চারিদিবস পরে, অর্থাৎ গত কল্য তাঁহার নিকট পুনরায় গমন করিয়াছিলাম। কল্যও তিনি আমাকে এই বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছেন, “আমি সেই তালিকাখানি এখন পর্যন্তও উত্তমরূপে দেখিয়া উঠিতে পারি নাই। আপনি পরশ্ব তারিখে পুনরায় আগমন করিবেন, সেই দিবস উল্লিখিত কার্য্যের সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া ফেলিব।”

 মহাশয়! আমি আমার এই চাকরীর অবস্থা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমি প্রতিদিন মাণিকচাঁদ কর্ত্তৃক কার্য্যে নিযুক্ত হইতেছি, বা কোনরূপ জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইয়া কোনরূপ বিপদ‍্গ্রস্ত হইবার পথ প্রসারিত করিতেছি; তাহার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এই নিমিত্ত আমি আপনার পরামর্শ লইবার মানসে আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, এবং এ পর্যন্ত যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা যতদুর সম্ভব আমি মনে করিতে পারিয়াছি, তাহা আপনার নিকট আমি বিবৃত করিলাম। এখন মাণিকচাঁদের আদেশ আমাকে প্রতিপালন করিতে হইবে, অর্থাৎ আগামী কল্য পুনরায় আমাকে সেই স্থানে যাইতে হইবে। এরূপ অবস্থায় আপনি আমাকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিবেন, সেই উপদেশই আমি শিরোধার্য্য করিয়া, আপনার আদেশমত কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইব।