দুর্নীতির পথে/মন

উইকিসংকলন থেকে

৫। মন

দেহের উচ্চতর ক্রিয়াসকল বিশেষ করিয়া মনের ক্রিয়া, যে সকল অঙ্গের সাহায্যে হইয়া থাকে, তাহাদের পর্য্যবেক্ষণ করিলে জনন এবং অন্তর্জননের মধ্যে কতখানি নিশ্চল বিরোধ তাহা বুঝা যায়। দেহের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় ইচ্ছাপেক্ষক্রিয়াবান্ (মস্তিষ্ক-মেরুদণ্ডমূলক) এবং ইচ্ছানিরপেক্ষক্রিয়াবান্ এই উভয় প্রকার স্নায়ুমণ্ডলী যে সকল কোষের দ্বারা গঠিত, মূলে সেগুলিও বীজকোষ এবং নিগূঢ় প্রাণকেন্দ্র হইতে আহৃত। এই সকল কোষ অনবরত ভাগে ভাগে বিভিন্ন ক্রিয়ার জন্য স্নায়ুমণ্ডলীর বিভিন্ন গ্রন্থিপুটে যাইতেছে। বলা বাহুল্য বহুসংখ্যক কোষ সর্ব্বদা মস্তিষ্কেও যাইতেছে। এই সকল বীজকোষের অন্তর্জনন ক্রিয়া এবং উর্দ্ধমুখী গতিরোধ করিয়া তাহাদের জনন অথবা কেবল সম্ভোগের কার্য্যে নিযুক্ত করিলে অঙ্গ সকল তাহাদের ক্ষয়নিবারক প্রাণশক্তি হইতে বঞ্চিত হয় এবং ধীরে ধীরে শেষ পর্য্যন্ত নিস্তেজ হইয়া যায়। এই সকল শারীরিক তত্ত্ব হইতে যে যৌননীতি পাওয়া যায় তাহার বিধি—পূর্ণ সংযম, অন্তত পক্ষে পরিমিত সন্তোগ। যাহা হউক সংযম নীতির মূল কোথায় তাহা দেখা গেল।

 একটি উদাহরণ করুন। ভারতীয় দার্শনিকগণ বলিতেন সংযম মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করে। হিন্দুধর্ম ও সমাজের সহিত যাহারা সামান্য পরিচিত, তাহারা জানেন হিন্দুরা পূর্ব্বে তপস্যা করিত এবং এখনও কেহ কেহ করে। এই তপস্যার উদ্দেশ্য দুটি—শরীরের শক্তিরক্ষা ও বৃদ্ধি করা এবং অলৌকিক মানসিক শক্তি অর্থাৎ সিদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া। প্রথমটির নাম হঠযোগ। হঠযোগীরা কেবল দৈহিক পূর্ণতাকে লক্ষ্য করিয়া অসাধারণ শারীরিক শক্তিসকল লাভ করিয়া থাকেন। অপটির নাম রাজঘোগ; ইহার লক্ষ্য মানসিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধন। তথাপি এই দুই প্রকার যোগের ভিতর একই শারীর-নীতি আছে। প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ মানবতত্ত্ববিদ পতঞ্জলির যোগদর্শনে এবং তৎপ্রভাবান্বিত অন্যান্য গ্রন্থে ইহা উক্ত হইয়াছে।

 যোগসাধনের যে সব বাধা আছে, রাগ তাহাদের মধ্যে তৃতীয় (২,৭)। পতঞ্জলি বলেন, সুখ অথবা সুখলাভের উপায় সম্বন্ধে আকাঙ্খা, তৃষ্ণা অথবা ইচ্ছাকে রাগ বলে। সুখের সহিত দুঃখ ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে বলিয়া যোগীর সুখ ত্যাগ করা উচিত (২,১৫)। এ পর্য্যন্ত যোগদর্শনে মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কামবাসনার আলোচনা হইয়াছে; পরের সূত্রসকলে শরীর-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইহা আলোচিত হইয়াছে।

 যমের সাধনা যোগাভ্যাসের প্রথম ধাপ। যম পাঁচ প্রকার—অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য্য ও অপরিগ্রহ। দেখিয়া আশ্চর্য্য হইতে হয় যে, যাহারা যোগী বলিয়া নিজেদের পরিচয় দেয় তাহারা হয় চতুর্থ যম কি তাহা জানে না অথবা তাহার কথা বলে না। ব্রহ্মচর্য্যই চতুর্থ যম।

 পতঞ্জলি মুনির মতে ব্রহ্মচর্য্য পালন করিলে যথেষ্ট লাভ হয়। তিনি বলেন, যিনি ব্রহ্মচর্য্যে প্রতিষ্ঠিত তাঁহার বীর্য্য বা শক্তিলাভ হয়; বিভিন্ন প্রকার সিদ্ধি তাঁহার হস্তগত হয়। তিনি শ্রোতাদের অন্তরে তাঁহার নিজের চিন্তা অনুপ্রবেশ করাইতে পারেন। এরূপ দুর্লভ সিদ্ধি যাঁহার লাভ হয় তাঁহার মত সৌভাগ্য কাহার?

 শ্রীযুক্ত মণিলাল দ্বিবেদী নামক বর্ত্তমান ভারতের জনৈক পণ্ডিত বলেন, “শরীরবিজ্ঞানের সুপরিচিত নিয়ম এই যে, বুদ্ধির সহিত শুক্রের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। আমরা বলিতে পারি যে, আধ্যাত্মিকতার সহিতও শুক্রের এইরূপ সম্বন্ধ আছে। একরূপ অমূল্য বস্তুর অপব্যয় না করিলে মানুষ শারীরিক শক্তি ও ঈপ্সিত আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করে। কোনো যোগ সফল করিতে হইলে প্রথমেই ব্রহ্মচর্য্য পালন করিতে হইবে।

 যোগ সাধনের উদ্দেশ্য ও উপায় ভাষ্যকারগণ রূপকের ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন। যেমন উক্ত হইয়াছে, শক্তি সাপের মত নিঃশব্দে সর্ব্বাপেক্ষা নীচের চক্র (অণ্ডকোষ) হইতে উঠিয়া সর্বাপেক্ষা উপরের চক্রে (মস্তিষ্কে) যায়।