দেওয়ানা/দশম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দশম পরিচ্ছেদ।

 এ জগতে দুইজন লতিফের আপনার জন ছিলেন। এক আনারের পিতা, জামালখাঁ ও দ্বিতীয় ব্যক্তি জুম্মাশা ফকির।

 এই জুম্মাশা, তখন দিল্লী আগরার সর্ব্বজন জানিত ব্যক্তি। সম্রাট শাহজাহান, তাঁহাকে বড়ই ভক্তি শ্রদ্ধা করিতেন। সাধারণ লোকে, তাঁহাকে সিদ্ধ পুরুষ বলিয়া জানিত। পুর্ব্বোক্ত পীর-মহরমের আস্তানার অতি নিকটে, এক নির্জ্জন মস‍্জিদের মধ্যে এই মহাত্মা ফকির জুম্মাশা, তাঁহার ধর্ম্মময় জীবন যাপন করিতেন।

 তাঁহার বয়স কত, তাহা কেউ ঠিক বলিতে পারে না। তাঁহার শুভ্র কেশ, সুদীর্ঘ শ্বেত শ্মশ্রুরাজি, গলদেশে নীল বর্ণের তবলকির মালা এবং পরিধানে সুনীল বসন। মুখে যেন তখনও যৌবনের লাবণ্য তেজ ও প্রতিভা পূর্ণমাত্রায় বর্ত্তমান। অতি প্রাচীনেরা অনুমান করেন, তাঁহার বয়স, আশী বৎসরের উপর হইবে।

 সংসার বিরাগী—এই জুম্মাশার, সকল জীবের উপর সমান দয়া। সকল ধর্ম্মের লোককেই তিনি শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন। হিন্দুও মুসলমান সবই তাঁহার চক্ষে এক। আর্ত্তের উপকার, পীড়িতের সেবা, অনাথকে আশ্রয় দান, অনাহারীকে আহার প্রদান, তাঁহার নিত্য কর্তব্য। তাঁহার অতিথিশালার উন্মুক্ত ভাণ্ডার, এই “পীর মহরমের” সীমার মধ্যেই ছিল। তিনি নিজে অবশ্য সকল সময়ে এই সমস্ত দরিদ্র লোকের সেবাব্রতে নিযুক্ত থাকিতে পারিতেন না। তাঁহার অনুগত শিষ্যবর্গের মধ্যে এক একজনের উপর তিনি এক একটী নির্দ্দিষ্ট কর্ত্তব্য ভার দিয়া রাখিয়াছিলেন। আর নিজে প্রতিদিন প্রভাতে ও সন্ধ্যার সময় একবার করিয়া পীরমহরমে উপস্থিত হইতেন। এই সময়েই লোকে তাঁহার দর্শন পাইত।

 এই সন্ন্যাসী জুম্মাশার একজন অনুগৃহীত ও কৃপাপ্রার্থী শিষ্য আনারউন্নিসার পিতা জামাল খাঁ। এই জন্য তিনি আনারউন্নিসা ও মীর লতিফের নিকট সম্পূর্ণ পরিচিত।

 যে সকল ধনী ও অভিজাতবর্গ, তাঁহার সদাব্রতের ও লোক সেবার কার্য্যে অর্থসাহায্য করিতেন— তাঁহাদের মধ্যে এই জামাল খাঁও অবশ্য একজন। যখন জামাল খাঁ রত্ন ব্যবসায়ে দুই পয়সা উপায় করিতেন, তখন সাধ্যমত তিনি জুম্মাশাকে বেশী ভাবে অর্থসাহায্য করিতেন। অথচ জামাল খাঁর অপেক্ষা যাঁহাদের অবস্থা আরও উন্নত, তাঁহারা সেরূপভাবে প্রাণ খুলিয়া সৎকার্য্যে দান করিতে পারিতেন না।

 এদানীং জামালখাঁর অবস্থা ক্রমশঃ মন্দের দিকে যাইতেছিল। তাহাহইলেও তিনি পীর-মহরমে জুম্মাশার সদাব্রতের বৃত্তিটা, তখনকার অবস্থানুরূপ ভাবেই দিয়া আসিতেছিলেন।

 একবার আনারের ভাগ্য গণনা করাইতে গিয়া, জামালখাঁ এই জুম্মাশার নিকট হইতে জানিতে পারেন, তাঁহার কন্যার অর্থ ভাগ্য খুব বেশী। সম্ভবতঃ নিশ্চয়ই সে কোন বড়লোকের ঘরে পড়িবে।

 এই কথা শুনিবার পর হইতেই, জামালখাঁ একটা দুরাশার ছলনায় মুগ্ধ হইয়া পড়েন। তৎপরে যখন, নবাব সুজা বেগের সহিত আনারের বিবাহ প্রস্তাব আসিল, তখন জামালখাঁ জুম্মাশা ফকিরের ভবিষ্যৎ বাণীর উপর খুবই আস্থাবান হইয়া পড়িলেন।

 এই জুম্মাশা সম্বন্ধে যে আমরা এত কথা বলিলাম, তাহার একটু কারণ আছে। এই উপন্যাসের সহিত পাঠক যতই অগ্রসর হইবেন, ততই আমাদের কথার সারবত্তা বুঝিতে পারিবেন।

 যেদিন মীর লতিফের নিকট, জামাল খাঁ আনারের বিবাহ সম্বন্ধে সমস্ত কথা খুলিয়া বলেন, তাহার দুই এক দিন পরে মীর লতিফ, পীর মহরমে আসিয়া জুম্মাশার সহিত সাক্ষাৎ করিল।

 মীর লতিফের সৌভাগ্য, যে সে দিন অন্য কোন দর্শনার্থী ফকির-সাহেবের কক্ষে ছিল না। সুতরাং নির্জ্জনে পাইয়া সে আনারের সহিত তাহার বিবাহভঙ্গ সম্বন্ধে সমস্ত কথাই জুম্মাশাকে জানাইল।

 এই সুন্দরদর্শন মিষ্টভাষী সুচরিত্র যুবক মীরলতিফ‍্কে জুম্মাশা একটু স্নেহের চক্ষে দেখিতেন। লতিফের মুখে সমস্ত কথা শুনিয়া, তিনি গম্ভীর ভাব ধারণ করিলেন। তারপর মিষ্ট স্বরে মীর লতিফকে বলিলেন—“আনার যে কোন ধনবানের গৃহিণী হইবে, বহু পূর্ব্বে আমি তাহা জামালখাঁকে আভাস দিয়াছিলাম। বিধিলিপি— চিরদিনই অথণ্ডনীয়! এখন তোমার মনের সংকল্প কি-লতিফ্?”

 মীর লতিফ, জুম্মাশার মুখের দিকে বারেক মাত্র চাহিয়া আবার মুখ নত করিল। তাঁহার সে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, সে যেন সহ্য করিতে পারিল না। মুখ নীচু করিয়া সে মৃদুস্বরে বলিল—“আমি এখন আগরা ত্যাগ করিয়া দূর দেশে যাইতে চাই।”

 জুম্মাশা প্রসন্নবদনে বলিলেন—“তোমার এ সংকল্প শুভ,কেন না প্রলোভনের মুখ হইতে দূরে থাকাই ভাল। ত্যাগে মহত্ত্ব—ভোগে নয়। নিবৃত্তিই—শ্রেষ্ঠ মার্গ। প্রবৃত্তিই সকল কষ্টের মূল। তুমি একজন বীর সেনানী। সংকট যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার অসীম-সাহসিকতার কথা আমি শুনিয়াছি। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি আত্মত্যাগ করিয়া নিবৃত্তি মার্গের অনুসরণ করিতে পার, তাহা হইলেই তুমি প্রকৃতই বীর আখ্যা পাইবার যোগ্য।”

 মীর লতিফ বিমর্ষ মুখে বলিল—“তাহা হইলে কি আমাকে এ ব্যাপারে সকল আশাই ত্যাগ করিতে আপনি পরামর্শ দেন?”

 জুম্মাশা। নিশ্চয়ই তাই। যাহা প্রাক্তনে নাই, তাহার সম্বন্ধে চেষ্টা করা যেন ঈশ্বরের ক্ষমতার উপর অতি ব্যর্থ হস্তক্ষেপ!

 মীর লতিফ। সত্যই তাই বটে! কিন্তু—

 জুম্মাশা। তোমার ‘কিন্তুর’ মানে হইতেছে অতীতের স্মৃতি! কিন্তু মানে—এতদিনের মায়া। কিন্তু মানে-আবাল্য সাহচর্য্যজনিত এই মায়ার আকর্ষণের বিলোপ জন্য—একটা কষ্ট। কিন্তু বৎস! চিত্তবল প্রবল হইলে এ সব মোহ ত সহজেই কাটানো যায়। চেষ্টা করিলে অবাধ্য ও দুর্ব্বল চিত্তবৃত্তিকেও সবল করা যায়। তুমি চেষ্টা কর। নিশ্চয়ই সফলকাম হইবে। খোদা তোমার প্রাণে শক্তি আনিয়া দিবেন। সেই শক্তি তোমায় সবই ভুলাইয়া দিবে। অতীতের স্মৃতি জন্মের মত নষ্ট হইবে।

 মীর লতিফ কিয়ৎক্ষণ কি ভাবিয়া, বিমর্ষমুখে বলিল—“ভাল! আপনার আদেশই আমি পালন করিব। কিন্তু— এই এই আগরা সহর ত্যাগ করিবার পূর্ব্বে, আনারউন্নিসার সহিত একবার গোপনে সাক্ষাৎ করায় কি কোন পাপ আছে। প্রভু?”

 জুম্মাশা। তুমি আগরা ত্যাগ করিয়াই বা যাইবে কেন? অসংখ্য প্রলোভনের সম্মুখে থাকিয়া প্রবৃত্তি দমন করার অপেক্ষা, বোধ হয় বেশী গৌরবজনক কিছুই ত নয় মীর লতিফ!”

 মীর লতিফ মনে মনে বিচার করিয়া বুঝিল, ফকির জুম্মাশা যাহা বলিতেছেন,—তাহাই ঠিক। কিন্তু সে তাহার নিজের চিত্তের উপর ততটা বিশ্বাস করিতে পারিল না।

 সুতরাং সে বলিল— “প্রবৃত্তির সহিত সংগ্রাম করিয়া যাহাতে জয়লাভ করিতে পারি, প্রথমে তাহার চেষ্টা করিব। যদি না পারি, অগত্যা আমায় বাধ্য হইয়া এই আগরা হইতে চির বিদায় লইতে হইবে।”

 এই কথা বলিয়া মীর লতিফ, জুম্মাশার চরণ বন্দনা করিয়া তাঁহার নিকট হইতে বিদায় লইল বটে, কিন্তু আগরা ত্যাগের সংকল্পটা সে তাহার মন হইতে মুছিল না। কেন না! —চিত্ত তাহার বড়ই অবাধ্য।

 ভালবাসা এই জিনিষটা, বিরহের প্রথম সূচনায় যেন দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়া, তাহার পরিমাণটা যেন তাহার ভালবাসার পাত্রকে একটু বেশী করিয়া জানাইয়া দিয়া চলিয়া যায়। এই হতভাগ্য ও নিরাশচিত্ত মীর লতিফের তাহাই হইল।

 সে তাহার আবাস স্থানে ফিরিয়া আসিল বটে, কিন্তু সেখান হইতে যেন সকল সৌন্দর্য্য ঝরিয়া গিয়াছে। যেখানে থাকিয়া, ভাবী মিলনের সুখস্বপ্নে বিভোর হইয়া, সে ধরাকে খুবই সুষমাময় দেখিত, সেদিন সেইখানে থাকিয়াই বুঝিল, জ্যোৎস্নালোকে হাস্যময়ী মেদিনীর বুক হইতে, যেন সকল শোভাই বিলুপ্ত হইয়াছে। তাহার চারিপাশে উষ্ণ নিশ্বাস বহিতেছে।

 লতিফ, সে দিন দেখিল, জ্যোৎস্নার সে শুভ্রজ্যোতিঃ নাই— ধীরে প্রবাহিত নৈশবায়ুতে সে স্নিগ্ধতা নাই। নৈশ সমীরণবাহিত পুষ্পবাসে সে সুগন্ধ নাই। সেনানিবাসের পার্শ্ববাহিনী যমুনার কল সঙ্গীতে যেন সে মধুর মিলনের সুরনিক্কণ নাই! হায়! কেন এমন হইল?

 সে বিষণ্ণ প্রকৃতির উপর বিরক্ত হইয়া, শয্যায় শুইল। হায়! সে শয্যাও যেন সুতীক্ষ্ণ কণ্টকময়। সে শয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া, বাতায়ন পার্শ্বে আসিল। বোধ হইল, যেন তাহার পায়ের নীচের মেঝেটা ধীরে কাঁপিতেছে। সে সেই চন্দ্রালোকিত প্রকৃতির দিকে চাহিয়া, এক মর্ম্মভেদী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিল। কিন্তু তাহাতে তাহার প্রাণের যন্ত্রণা না কমিয়া যেন আরও বাড়িয়া উঠিল। সে কিছুতেই বুঝিতে পারিল না—কিসে এ জ্বালা হইতে সে শান্তি পাইবে! সে বুঝিল এই অভিশপ্ত আগরায় থাকিলে শান্তির আশা যে অতি দুষ্কর।

 গভীর মর্ম্মবেদনায় অধীর হইয়া, সেই গভীর রাত্রে নিজের কক্ষ ত্যাগ করিয়া, সেনানিবাসের পার্শ্ববাহিনী যমুনার তীরে সে আসিল। নদীতীরে একটী প্রস্তরমণ্ডিত ক্ষুদ্র ঘাট। সে সেই ঘাটের সোপানের উপর বসিয়া —একটী মর্ম্মভেদী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—“হায়! কেন এমন হয়?”

 চঞ্চল তরঙ্গময়ী যমুনা, কল কল-ছল-ছল শব্দে—উজান তুলিয়া চলিয়াছে। নীল জলের উপর, গলিত রৌপ্যের মত চন্দ্রকিরণ ধারা। স্নিগ্ধ মলয়—যমুনার শীকরকণা অপহরণ করিয়া আনিয়া, তাহাকে মৃতব্যজন করিতে লাগিল। কিন্তু কই তাহাতেও ত তাহার হৃদয়ের উষ্মা যাইতেছে না।

 সে যেন শুনিল—যমুনার কলকল ছলছল শব্দ তাহাকে বলিতেছে, “ছিঃ— ছিঃ—এত লঘু তুমি?” সেই নৈশসমীরণ মৃদু গর্জ্জনে বলিতেছে—“ছিঃ―ছিঃ এত অসার তুমি!” সেই শুভ্র জ্যোৎস্না যেন বিদ্রূপ করিয়া বলিতেছে —“নিজের স্বার্থই কি তোমার এত বেশী! যাহাকে তুমি ভালবাস—তাহার স্বার্থ দেখিতে কি তুমি একাবারে অন্ধ। চলিয়া যাও লতিফ্! সুদুর প্রবাসে। আর এখানে থাকিও না। যাহাকে ভালবাস, তাহার সুখের পথ কণ্টকিত করিও না।”

 নীরবভাষায় জড় প্রকৃতির এই শ্লেষময় তীব্র তিরষ্কার, যেন তাহার প্রাণের মধ্যে একটা অতি শোচনীয় লজ্জাআনিয়। দিল। মীর লতিফ অস্ফুট স্বরে বলিল—এই ভাষাহীনা প্রকৃতি দেবী ঈঙ্গিতে আমাকে যে সঙ্কেত করিতেছেন, তাহাই ত ঠিক। জুম্মাশা ত আমাকে আভাসে ঈঙ্গিতে এই কথাই বলিয়াছিলেন।

 তারপর সে মনে মনে নিম্নলিখিত ভাবে, প্রশ্নোত্তর ছলে এই যন্ত্রণাময় ব্যাপারটা লইয়া একটু আলোচনা আরম্ভ করিল।

 প্রথমে সে প্রশ্ন করিল,—“এই আনারউন্নিসা আমার কে?”

 উত্তর আসিল,—“সম্ভ্রান্ত কুলমহিলা সে। এতদিন সে সোদর জ্ঞানে, তোমায় ভাল বাসিয়া আসিয়াছে। বাল্য ও কিশোরের চঞ্চল প্রেমের কথা তুমি ভুলিয়া যাও। জ়ান তো—আনারের সহিত এক সম্ভ্রান্ত ওমরাহের বিবাহের কথা হইতেছে। তাহার সৌভাগ্যের পথে দাঁড়াইও না। তাহার ভবিষ্যতের উজ্জ্বল ভাগ্যকে, তোমার মর্ম্মভেদী নিরাশার মলিন নিশ্বাসে কলুষিত করিও না। ভালবাসা—ঈশ্বরের দান। সেই প্রেমময়ের পবিত্র প্রেমই, বিভিন্ন পাত্র বিশেষে, বিভিন্ন প্রকারের প্রেম মাধুরীর বিকাশ করে। এ দুনিয়ায় মাতা, পিতা, সুহৃৎ ভগ্নী, পত্নী, সবাইকেই ত লোকে ভালবাসে। যাহারা নিস্বার্থভাবে ভালবাসে, তাহারাই ত ভালবাসিতে জানে। ভালবাসার জন্য যাহারা ভালবাসে, তাহারাই ভালবাসার মহত্ত্বের মর্য্যাদা রাখিতে পারে। যাহা অসম্ভব, তাহার জন্য আশাপূর্ণ হইও না, আশাভঙ্গে ব্যাকুল হইও না। এই না জুম্মাশা তোমায় বুঝাইয়া দিলেন—ত্যাগেই প্রকৃত মহত্ত্ব। আসক্তিতে নয়। অতবড় সাধু যিনি তাঁহার কথা তুমি কি সাহসে অগ্রাহ্য করিতে চাও? হায়! অতি অসার অপদার্থ তুমি!”

 “এ বিশ্ব ত চিরদিনই এক মহা সুরে গাঁথা। চিরদিনই ত শুনিয়া আসিতেছ, যেখানে সুখ— সেইখানেই দুঃখ। যেখানে হাসি—সেইখানেই—অশ্রু। যেখানে ভ্রান্তি—সেইখানে সত্য। যেখানে আলোক—সেই খানেই আঁধার।”

 “তবে কেন ভ্রমে পড়িয়া কষ্ট পাও? একটু ত্যাগ স্বীকার করিয়া দেখ দেখি, তাহাতে তুমি কত আনন্দ পাইবে। একটু স্বার্থ ভুলিয়া পরার্থের জন্য প্রাণটাকে সমর্পণ করিয়া দেখ দেখি, তাহাতে কি পবিত্র সুখ। কি অনাবিল তৃপ্তি!”

 “ছার! তোমার এ রূপমোহ! এই দুনিয়ায় এই আনার উন্নিসাই কি শ্রেষ্ঠ রূপসী ও গুণবতী? এই ধরার বুকে এমন আর কি কেহ নাই, যে আনারের অপেক্ষা তোমায় বেশী ভালবাসিতে পারে?”

 “ভুলিয়া যাও—মীর লতিফ! তুমি এই আনারউন্নিসাকে। মনে ভাবিও, যেন কোন সুখনিশায় তুমি একটা সুখস্বপ্ন দেখিয়া অধীর হইয়াছিলে। ভালবাসার জন্য— ভালবাসিতে শিক্ষা কর! আনারের অদৃষ্টে বিধাতা যাহা লিখিয়াছেন, তাহার ভবিষ্যৎ জীবনের সুখশান্তি আনয়নের জন্য যে বিধান করিয়া দিতেছেন, তুমি তাহার সহায়তা কর। তাহার অতি নিকটে সমাগত সৌভাগ্য সন্মুখে, প্রলোভনের মত না থাকিয়া তাহার নেত্রপথ হইতে সুদূর বিস্মৃতির রাজ্যে চলিয়া যাও। এই আত্মত্যাগের মহত্ত্বে আনার যখন জীবনে চিরসুখী হইবে, তখন তুমিই যে আনারকে লাভ করার চেয়েও বেশী আনন্দ পাইবে!”

 এতক্ষণের পর অন্তরস্থ জাগ্রত বাণীর এই সংকেতময় উপদেশে মীর লতিফ্ একটা সোজা পথ দেখিতে পাইল। এতক্ষণ সে এক অন্ধকারময় বন্ধুর পথে বিচরণ করিয়া, প্রতি পদক্ষেপেই যাতনা ভোগ করিতেছিল—কিন্তু এখন সে যেন দেখিল, তাহার সেই অন্ধকারময় পথ খুব উজ্জ্বল। তাহার কর্ত্তব্য অতি পরিস্ফুট। তাহার আত্মসুখাভিলাষী সংঙ্কীর্ণ হৃদয়, যেন মহত্ত্বের জ্যোতি কণায় পরিপূর্ণ। সে এই দীর্ঘ চিন্তার পর বুঝিল—“এই সিদ্ধ ফকির সাধু পুরুষ জুম্মাশা যাহা বলিয়াছেন, তাহাই ঠিক। ত্যাগেই মহত্ত্ব! স্বার্থ পরিহারেই দেবত্ব!

 তখন তাঁহার হৃদয়—মহাঝটিকার পরে বিশাল বারিধির মত অতি শান্ত। তাহা যেন উন্মাদ তরঙ্গের তাণ্ডবলীলা বিহীন। তখন সে হৃদয়ে জ্বালার পরিবর্ত্তে শান্তি, আসঙ্গলিপ্সার পরিবর্ত্তে স্বার্থহীন উদার আনুরক্তি, সংকীর্ণতার পরিবর্ত্তে পরার্থপরতা, আসিয়া দেখা দিয়াছে।

 চিন্তাশূনা, বিপ্লববিহীন শান্তহৃদয়ে, মীর লতিফ, পুনরায় তাহার কক্ষে ফিরিয়া আসিল। যে শয্যা একটু আগে তাহার পক্ষে কণ্টকাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইয়াছিল, তাহা যেন এখন খুব শীতল ও আরামপ্রদ। কেননা—সে তাহার ভবিষ্যতের কর্ত্তব্যটি যে, কি, তাহা স্থির করিয়া লইয়াছিল।

 কিন্তু সে সুখ নিদ্রাতেও তাহার নিস্তার নাই। সে স্বপ্নে দেখিল, যেন আনারউন্নিসা তাহার শয্যা পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বলিতেছে— “ছার আমি! এ জগতে আমার চেয়ে আরও কত সুন্দরী আছে! স্নেহে, মায়ায়, ভালবাসায়, সহানুভূতিতে, অতি নগণ্যা আমি। আমার চেয়ে আরও কত আছে—যাহারা তোমার জন্য জীবন সমর্পণ করিতে পারে। এ রূপ, এ দেহ, ত চিরদিনের জন্য নয়। বাসিফুলের মত একদিন না একদিন ধরণীর বুকে ঝরিয়া পড়িবে। তখন কোথায় থাকিবে এ তীব্র আকর্ষণ! এ ছলনাময়ী মোহ! এ প্রাণস্পর্শী ব্যাকুলতা! তবে কেন এত চঞ্চল হইতেছ তুমি মীর-লতিফ্?

 যেখানে তোমার মন যাইতে চায়, যাও—তুমি সেখানে। যেথানে গিয়া তুমি প্রাণে শান্তি পাইবে, যাও—তুমি সেই দেশে। যেখানে গেলে আমার এ ছার স্মৃতি ভুলিতে পারিবে, যাও—তুমি সেই সুখস্বপ্নময় রাজ্যে! অতি তৃচ্ছ! অতি হীনা আমি! রাত্রে নিদ্রিত অবস্থায় মানুষ যে কত স্বপ্ন দেখে। কেউ সুখের সাগরে ভাসে, কেউ বিরহে কাঁদে, কেউ বা ভয়ে আতঙ্কে শিহরিয়া উঠে। মনে ভাবিও, আমাদের প্রথম জীবনের ব্যাপারটাও যেন একটা বিচিত্র কুহেলিমাখা মধুর স্বপ্ন! আর তার শেষে বিরহের প্রচণ্ড অনলজালা।

 তবে একটী অনুরোধ তোমাকে লতিফ! তোমার হৃদয় হইতে আমায় একাবারে মুছিয়া ফেলিও না। স্মৃতি সুখেরও হয়, দুঃখেরও হয়। কিন্তু এই স্মৃতি জিনিষটা ত এক। তুমি তোমার স্মৃতিকে চিরদিনের জন্য সুখময় করিয়া লইও। ভ্রাতৃভাবে—আমার কল্যাণ কামনা করিও। যদি কখনও কোন বিপদে পড়িয়া তোমার সাহায্যপ্রার্থিনী হই, তখন একবার দেখা দিও। মৃত্যু যখন তাহার চিরতুষারময় হস্তখানি আমার দেহে বুলাইয়া দিয়া চিরজন্মের মত অসাড় করিয়া দিবে, তখন একবার আসিয়া চরণধূলি দিও। তুমি যে আমার চক্ষে চির মহত্ত্বময় মীরলতিফ্?

 বিধাতার ব্যবস্থায় আর পিতার বিধানে, এখন আমি নষাব সুজাখাঁর বাগদত্তা পত্নী। তুমি আমার স্নেহময় ভ্রাতারূপে সেই মঙ্গলময় বিধাতার নিকট প্রার্থনা কর, যেন আমি প্রেমময়ী পত্নীরূপে, নূতন জীবনে স্বামীর প্রতি আমার মহাকর্ত্তব্যগুলি পালন করিতে পারি। আর আমার এই স্মৃতি হইতে অতীতের সমস্ত কথাই চিরজন্মের মত মুছিয়া ফেলিতে পারি।” এই কথা বলিয়া স্বপ্নদৃষ্টা সেই আনারউন্নিসা, যেন দর্পভরে তাহার শয্যা পার্শ্ব ত্যাগ করিতে উদ্যত হইল।

 মীরলতিফ্ স্বপ্নঘোরে যেন আনারকে ধরিতে গেল। কিন্তু পারিল না। সেই কক্ষমধ্যে কোথায় যে তাহার সেই তীব্র জ্যোতির্ম্ময়মূর্ত্তি সহসা বিলয় হইল, তাহাও সে বুঝিতে পারিল না!

 সহসা তাহার নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। সে নেত্রমার্জ্জনা করিয়া, নিদ্রার ঘোর কাটাইয়া লইয়া দেখিল—তখনও সূর্য্যোদয় হয় নাই। তবে প্রভাতকুসুমের সুগন্ধি পরাগ মাথিয়া, উষার স্নিগ্ধবায়ু তাহার ললাটে, সেই স্বপ্নজনিত উত্তেজনা সঞ্জাত ঘর্ম্মবিন্দুকে সযত্নে মুছাইয়া দিতেছে।

 লতিফ ভাবিল—“একি বিচিত্র স্বপ্ন! সত্যই কি আনারউন্নিসা আমার শয্যাশার্শ্বে আসিয়া আমায় মৃদু তিরস্কার করিয়া গেল! না—না—সবই মিথ্যা! সবই আমার অনুশোচনাময় উষ্ণ মস্তিষ্কের বিকৃত ক্রিয়া।

 তাহা হইলেও, সে আনারকে একখানি পত্র লিখিয়া ফেলিল। সে পত্রে কোন ক্ষোভ নাই—আক্ষেপ নাই, অনুরোধ নাই, তীব্র তিরষ্কার বা বিদ্রূপের লেশ পর্যন্ত নাই।

 সে পত্রে লেখা ছিল—“স্নেহময়ী আনার! তোমার দাম্পত্যজীবন চিরসুখময় হউক,এই আমার কামনা। আমি মহিমাময় বিধাতার কাছে এই প্রার্থনাই করিতেছি। সম্রাট-পুত্র দারা শেকোর নূতন আদেশে, কালই সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমাকে আগরা ত্যাগ করিতে হইবে। আজ সন্ধ্যার পর তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার কথা ছিল,—কিন্তু বাদশাহের ভৃত্য আমি। সরকারের আদেশ লঙ্ঘন করার সাধ্য আমার নাই। এজন্য রাজ হুকুমে বাধ্য হইয়া সুদূর প্রবাসে চলিলাম।”

 রাজকুমার দারাশেফের আদেশ ছিল, “যত শীঘ্র পার আগরা ত্যাগ করিয়া আমার লাহোরের শিবিরে পৌঁছিবে।” মীর লতিফ্ ইচ্ছা করিলে আরও দুই চারি দিন বিলম্ব করিতে পারিত। কিন্তু সে তাহা করিল না। কেন না জড় প্রকৃতির সেই জ্বালাময় বিদ্রূপ বাণী তখনও সে ভুলে নাই।

 আর তাহার বিশ্বস্ত ভৃত্য, ঠিক সময়েই, আনারউন্নিসার নিকট তাহার পত্র থানি পৌঁছাইয়া দিল। বলা বাহুল্য, মীর লতিফের পত্রখানি আনারউন্নিসা জুমেলার কাছে পাইল। পত্রখানি পড়িয়া, তাহার মুখ শুকাইল। সে দেখিল, সে পত্রমধ্যে আগাগোড়া একটা অস্ফূট মর্ম্ম-বেদনা, অতি করুণ কাহিনী ফুটিয়া উঠিয়াছে। আনার মুখ তুলিয়া দেখিল জুমেলা সে কক্ষে নাই।

 সে মীর লতিফের আগমন প্রত্যাশায় উৎসুক চিত্তে অপেক্ষা করিতেছিল। আর তার পরিবর্ত্তে সে পাইল কিনা, তাহার স্বহস্ত লিখিত এক প্রাণহীন, করুণাহীন, সমবেদনা বিহীন, সেই পত্র।

 আনারউন্নিসা, চিরদিনই অভিমানিনী। সে মনে মনে ভাবিল, এ পত্র মীর লতিফের মনের ভিতরের কথাই বহন করিতে আনিয়াছে।

 তাহার পিতা সে দিন বলিয়াছিলেন,—“নবাবের সহিত তোমার বিবাহের কথা শুনিয়া মীরলতিফ হাঁ কি না ভালমন্দ কিছুই বলিল না। বরঞ্চ তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বোধ হইল, সে যেন ইহাতে তিলমাত্র দুঃখবোধ করে নাই।”

 মীর লতিফ সংযমের ও সহিষ্ণুতার বলে তাহার মূখে যে উদ্বেগহীন ভাবটী আনিয়াছিল, জামাল খাঁ ভ্রান্তিবশে সেটিকে উপেক্ষার ভাব বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলেন। আর এই জন্যই তাহার নিজের মনগড়া একটা অভিমতই, তাঁহার কন্যার নিকট ব্যক্ত করিয়াছিলেন।

 আনার উন্নিসার মনে এখন পিতৃকথিত সেই উপেক্ষার কথাটাই খুব জাঁকিয়া বসিল। স্থিরভাবে বিবেচনার শক্তি তাহার ছিল না।

 সে বুঝিল,—যে মীর লতিফ এক মুহূর্ত্তের অদর্শনে ব্যাকুল হইয়া পড়িত, আজ সে একবার আমার সহিত দেখা করিবার অবকাশ পাইল না। আমি তাহার নিকট বিদায় লইবার পূর্ব্বেই সে নিষ্ঠুরের মত চলিয়া গেল। আমার মনের দুটো দুঃখের কথা না শুনিয়াই, সে সমবেদনার দেনা-পাওনার ব্যাপারটা এই ভাবেই কি রোক শোধ করিয়া দিল? হায়! অকৃতজ্ঞ মীর লতিফ!

 মীর লতিফের এই অকৃতজ্ঞতা, তাহার চক্ষে খুবই অসহনীয় বলিয়া বোধ হইল। এজন্য লতিফের উপর তাহার খুব রাগ হইল। তাহার সুন্দর মুখখানি মীর লতিফের ইচ্ছা সাধিত এই অপমানে লাল হইয়া উঠিল। তাহার প্রাণের মধ্যে একটা অনুশোচনার ঝড় উঠিল। সে ঝড়ের বেগ সে সহিতে পারিল না।

 সে দিন রাত্রে, আনার একটুকুও ঘুমাইতে পারিল না। সমস্ত রাত্রিটা শয্যায় শুইয়া সে খুব কাঁদিল। কান্নাতে তাহার প্রাণের তার যেন অনেকটা কমিয়া গেল। বুকের ভিতর যে ঝড়টা শক্তি সঞ্চয় করিতেছিল— তাহা যেন অন্যদিকে চলিয়া গেল।

 অবশ্য এ কান্নাটা অভিমানের ফল। অভিমানের উদ্ভবক্ষেত্র হইতেছে—ক্রোধ। ক্রোধের মাত্রাটা কমিয়া গেলে,অভিমানটাও সেই সঙ্গে সঙ্গে যেন একটু কমিয়া আসে।

 আনারউন্নিসা মীর লতিফের সেই পত্রখানির কথাগুলি ধীর ভাবে আলোচনা করিয়া, আর নানাদিক দিয়া ভাবিবার পর বুঝিল, মীর লতিফ যাহা বলিয়াছে, তাহাই ঠিক। সে যাহা সংকল্প করিয়াছে, সত্যই তাহা আত্মত্যাগের জ্বলন্ত পরিচয়। পাছে সে আমার ভবিষ্যৎ সুখের পথে অন্তরায় হইয়া পড়ে, এই জন্যই সে দূরে যাইতে চায়। স্মৃতির মৃত্যু ঘটাইতে চায় বলিয়াই সে আমার দৃষ্টির সম্মুখ হইতে সরিয়া গিয়া, তাহার হৃদয়ের সহিত মহাসংগ্রামে প্রস্তুত হইতে উদ্যত।

 যে মীর লতিফকে একটু আগে সে অকৃতজ্ঞ ভাবিয়া মনে মনে খুবই তিরস্কার করিয়াছিল, এখন এইরূপ আলোচনার ফলে, নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিয়া, সে নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে করিল। সে কেবলমাত্র বলিল— “লতিফ! এত মহৎ তুমি!”

 তারপর ব্যাকুল হৃদয়ে একটী মর্ম্মভেদী দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে পুনরায় বলিল—“লতিফ্! লতিফ্! আমায় মার্জ্জনা কর তুমি। তোমার হৃদয়ে যে দেবতার মহত্ত্ব। তোমার প্রাণ যে আত্মত্যাগের সজীব মন্ত্রে উদ্দীপিত। তোমার হৃদয় যে আমার সুখের জন্যই কাতর। আমার হিতের জন্যই যে তুমি অতি ব্যাকুল। তাই তুমি প্রাণের মহত্ত্ব দেখাইয়া নিজের আশাভরসা,তৃপ্তি আকাঙ্ক্ষা,সুখের বাসনা বিসর্জ্জন দিয়া, আমার সন্মুখ হইতে চলিয়া গেলে! যেখানে থাক না তুমি - সুখে থাকিও। আর আমায় আশীর্ব্বাদ কর তুমি, আমি যেন জীবনের এই পরিবর্ত্তনে, এই পরীক্ষাময় সংসারের কঠোর কর্ত্তব্য— স্বামীর প্রতি কর্ত্তব্যগুলি করিতে পারি। দেবতুল্য তুমি! আমার মনের কথা বুঝিতে ত তোমার বাকী নাই। একদিন নিজের দেহের বহুমূল্য শোণিত দিয়া, তুমিই যে আমার জীবন রক্ষা করিয়াছিলে। যদি কখনও তোমার এরূপ কোন বিপদ উপস্থিত হয়, খোদার নিকট প্রার্থনা করি, আমি যেন তোমার হিতের জন্য, আমার হৃদয়ের শোণিত সেইরূপে ঢালিয়া দিতে পারি।”

 সেই দিনের প্রভাত হইতেই আনারউন্নিসার জীবনে নূতন পরিবর্ত্তন আরম্ভ হইল। এই মীর লতিফকে ভুলিবার জন্য জন্য সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিল।

 পুরূষের অপেক্ষা নারীর হৃদয়ের শক্তি যেন একটু বেশী। আর সহিষ্ণুতা থুবই বেশী। আনারউন্নিসা এই চেষ্টা ও সহিষ্ণুতার বলে, হৃদয়ের সহিত মহাসংগ্রাম আরম্ভ করিয়া দিল।