দেওয়ানা/একাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

একাদশ পরিচ্ছেদ।

 ভাগ্য মানুষকে যে পথে লইয়া যায়, ভবিতব্য তাহার নিজের ঘোর কৃষ্ণবর্ণের বহিতে, যে ভাবে মানুষের জীবনের ভবিষ্যৎ দিন গুলির জমা খরচ মিলাইয়া, খতিয়ান করিয়া লুকাইয়া রাখে, তাহা মহাশক্তিবান মানবেরও জানিবার সাধ্য নাই। আনার-উন্নিসা ত তাহাদের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। সুতরাং ভবিতব্যের অব্যর্থ লেখনী তাহার ভবিষ্যৎকে সে পথে চালিত করিল, সে সেই পথেরই পথিক হইল।

 আর বেশী ভূমিকা না করিয়া, আমরা সোজাসুজি বলিয়া ফেলিব, এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে, জামাল খাঁ তাহার রূপসী কন্যা আনারউন্নিসাকে নবাব সুজাবেগের হস্তে সমর্পণ করিয়া তৃপ্তিলাভ করিলেন।

 অতবড় একজন ধনী ওমরাহের বিবাহে, যেভাবে জাঁক-জমক হওয়া প্রয়োজন বা সঙ্গত, তাহার কিছুই হইল না। তাহার গূহ্য কারণ—নবাব সুজাবেগই জানেন। তবে এটুকু বলা যায়, এই উদ্বাহ ব্যাপারে মাঝামাঝি রকমের একটা আনন্দও উৎসবানুষ্ঠান হইয়াছিল বটে। তাহাতে কেবল জামাল খাঁ ও সুজাবেগের অতি অন্তরঙ্গ মিত্র ও আত্মীয়বর্গই নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, সেই বিবাহান্তে জামাল খাঁর ঋণের সেই তমলুক খানি, ছিন্ন করিয়া ফেলিয়া দিয়া তাঁহার জামাতা তাঁহাকে ঋণ মুক্ত করিলেন।

 নবাবের ইচ্ছানুসারে, বিবাহের দুই সপ্তাহ পরেই আনার উন্নিসা পিতৃভবন ত্যাগ করিয়া তাহার স্বামীর প্রাসাদতুল্য, বহুমূল্য সজ্জাপূর্ণ বিচিত্র ভবনে আসিয়াছে। ইতিপূর্ব্বে এক দিন এই বাড়ীতেই সে আমন্ত্রিতা রূপে নবাব সুজাখাঁর নিকট হইতে সেই বহুমূল্য রত্নহার লাভ করিয়াছিল। সুতরাং সে দিন সে যে গৃহের অতিথি ছিল, আজ সে ঘটনাচক্র আবর্ত্তনে তাহার একাধিশ্বরী।

 আনার বড়ই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী। কিশোর অতিক্রম করিয়া সে যৌবন সীমায় পদার্পণ করিয়াছে। বর্ষার ভরা নদী যেন কূলে কূলে পুরিয়া উঠিয়াছে। ঢলঢল লাবণ্য, আর ওষ্ঠাধরে মধুর হাসি, মধুর অপাঙ্গে উজ্জল কটাক্ষ, হৃদয়ে স্বামীর প্রতি অনুরাগ। ভাগ্যের নূতন পরিবর্ত্তনে সে এখন এক প্রাসাদ তুল্য অট্টালিকার অভিষিক্ত রাজরাণী।

 স্পর্শমণির স্পর্শে, লৌহও সুবর্ণ হইয়া থাকে। আনার উন্নিসার আগমনে নবাব সুজা খাঁর প্রাসাদ তুল্য অট্টালিকা যেন সুখ সৌভাগ্যে উজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। তাহার চারিদিকে একটা নূতন শ্রী সম্পদ ফুটিয়া উঠিল।

 যেখানে যেটি রাখিলে সুন্দর দেখায়, যেটি করিলে ভাল হয়, আনারউন্নিসা সেইভাবেই তাহার নিজের ও স্বামীর ব্যবহৃত কক্ষগুলি সাজাইল। আগে যে সমস্ত কক্ষের প্রত্যেক সজ্জায়, রুচির অভাব আর একটা বিশৃঙ্খল ভাব দেখা যাইত, তাহা যেন শৃঙ্খলার মোহকরী স্পর্শে অতি সুন্দর অবস্থায় দাঁড়াইল।

 দাসী বাঁদী যারা, তারা আনারের মিষ্টকথা আর সুন্দর ব্যবহারে, সত্য সত্যই তাঁহার গোলাম হইয়া পড়িল। সকলের যুখেই একটা সন্তোষের ভাব। সকলেরই সংসারের কর্ত্তব্য কর্ম্মে উৎসাহ ও নিষ্ঠা। কাজকর্ম্ম সমস্ত যেন মন্ত্রবলে চলিতে লাগিল। আর নবাব সুজা বেগ এতদিন পরে বুঝিতে পারিলেন—নারীর মোহকরী শক্তি কতদূর। সুগুণা সুরুপসী পত্নী লাভ কত ভাগ্যের কথা। জ্বালার জীবনে স্নেহময়ী পত্নী যে শান্তির প্রস্রবণ! সুবুদ্ধিমতী কর্ত্তব্য পরায়ণা রূপসীর আদর কত মূল্যবান। শূন্য প্রাণের পূর্ণতা কোথায়? জ্বালাময় মর্ত্তে-স্বর্গের সুখ কেমন করিয়া মিলে?

 সেই প্রাসাদতুল্য অট্টালিকার দক্ষিণে একটী বহুদূর ব্যাপী পুষ্পোদ্যান। যত্নের অভাবে, তাহা যেন দিনে দিনে হীনশ্রী হইয়া পড়িতেছিল। কিন্তু আনারের সুন্দর ব্যবস্থায়, আর যত্নময় তত্ত্বাবধানে, তাহাতে একটা যেন নুতন শ্রী ফুটিয়া উঠিল। পুষ্পোদ্যানের নানাস্থলে সুন্দর মর্ম্মরবেদী, নব-প্রতিষ্ঠিত কুঞ্জবীথি। কোথায় বা কৃত্রিম প্রস্রবণ। সেই হীনশ্রী শ্মশানতুল্য উদ্যানভূমি মধ্যে যেন বসন্তের মাধুরী ফুটিয়া উঠিল।

 দুইটী মাস মাত্র সে এই গৃহের অধীশ্বরী হইয়াছে। আর ইহার মধ্যেই গৃহস্থালীর সকল দিকেই এত পরিবর্ত্তন। সত্যই সে যেন রাজরাণীর গৌরবে, নিজের অধিকৃত মহলে একাধিপত্য করিতে লাগিল। মায়াবিনীর মত কি যেন এক কুহেলী মাথা মন্ত্রশক্তিতে, সকল দিকেই সৌন্দর্য্য ফুটাইয়া তুলিল।

 নবাব ― সুজা খাঁও এতদিন পরে বুঝিলেন, সাতরাজার ধন এক উজ্জ্বল মাণিক, বিধাতা তাঁহাকে দিয়াছেন। সেই মাণিকের স্নিগ্ধোজ্জ্বল জ্যোতিতে, আজ তাঁহার গৃহের প্রত্যেক কেন্দ্র উজ্জ্বলিত। এতদিন তিনি আনারের সৌন্দর্য্যের উপাসক ছিলেন, এখন তাহার গুণের যেন খুবই পক্ষপাতী হইয়া পড়িলেন।

 আনার তাঁহার গৃহলক্ষ্মী হইবার পর হইতে, নবাব সাহেব সেই শয়তানী বাহারবানুর স্মৃতি, তাঁহার মনের ভিতর হইতে ক্রমশঃ মুছিয়া ফেলিতে ছিলেন। খুবই সৌভ্যাগের কথা, যে বাহারবানু ঘটনাচক্রে পড়িয়া প্রায় দুই মাস হইল, আজমীরে চলিয়া গিয়াছে। কেন―তা সেই বলিতে পারে। যাইবার পূর্ব্বে, সে নবাব সুজাখাঁকে কোন সংবাদই দিয়া যায় নাই।

 নবাবের সাধের “আরাম-মঞ্জিলে, সুতরাং চাবি পড়িয়াছে। তিনি আর বড় একটা সেখানে যান না। এখন সেখানকার কক্ষগুলি শূন্য ও পরিত্যক্ত। যাহার জনয একদিন এই গুপ্ত আরামকক্ষের প্রয়োজন হইয়াছিল, সে ত আর আগরায় নাই।

 দেখিতে দেখিতে আরও একটা নাস কাটিয়া গেল। তবু বাহারের কোন সংবাদই নাই। কিন্তু তাহার জন্য নবাব সুজা খাঁ তিলমাত্র দুঃখিত নহেন। আর যেন ভবিষ্যতে তাহার কোন সংবাদ পাইতে না হয়, সে পাপ আর না আসিয়া জুটে, ইহাই যেন তাঁহার মনের কথা।

 প্রমারায় নেশায় আর এই বাহারবানুর প্রবল অর্থ তৃষ্ণা মিটাইবার জন্য, নবাব সুজা খাঁ এ পর্য্যন্ত খুবই অপব্যয় করিয়া আসিয়াছেন। এখন জমা ও খরচের রেওয়া মিলাইয়া, তিনি বুঝিলেন―তাঁহার অপব্যয়ের মাত্রাটা খুবই অতিরিক্ত হইয়া গিয়াছে। যে অর্থ তিনি জীবনে উপায় করেন নাই, বাহারবানুর শোষণ নীতির ফলে, তাহার বেশী তিনি খরচ করিয়া ফেলিয়াছেন।

 কিন্তু এরূপ ভাবে-যদি আর কিছুদিন চলিত, তাহা হইলে তাঁহার সমূহ সর্ব্বনাশ ঘটিত। তাঁহার পরলোকগতা জননী, রুকিনা বিবি, বিষয় ব্যাপার সম্বন্ধে কোন খপরই রাখিতেন না। তবে এটা অবশ্য তিনি কানাষুষায় শুনিয়াছিলেন, তাঁহার পুত্র এদানীং বড়ই উচ্ছৃঙ্খলভাবে অপব্যয় করিতেছেন। এজন্য তিনি পুত্রকে বহুবার তিরস্কার করিয়াছিলেন, সাবাধান করিয়াও দিয়াছিলেন। কিন্তু এ অপব্যয়ের পরিমাণ যে কত বেশী, তাহা তিনি জানিবার চেষ্টা কখনও করেন নাই।

 সুতরাং এতদিনের পর নবাব সুজা বেগ তাঁহার জমা খরচের রেওয়া মিলাইয়া যখন বুঝিলেন, যে তাঁহার সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ অপব্যয়ে উড়িয়া গিয়াছে, আর এই অপব্যয়ের পরিবর্তে তিনি পাইয়াছেন―কেবল, বিশ্বাসঘাতকতা, সুতীব্র শ্লেষ আগাগোড়া একটা প্রতারণাময় ভালবাসা, তখন তাঁহার মনে বড়ই একটা কঠোর অনুতাপ জন্মিল। তিনি আবার পৈতৃক ব্যবসায়ে মন দিলেন।

 আর একটা ঘটনা,যাহা এখানে উল্লেখ করা থুবই প্রয়োজন। সেটা আর কিছুই নয়। এই শাস্তিরূপিনী আনারের সহিত বিবাহের পর হইতে আর বাহারবানুর তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেরাজির মায়া একেবারে ত্যাগ করিয়াছেন।

 এখন এই আনার উন্নিসার অঙ্গুলি হেলনে তাঁহাকে চলিতে হইতেছে। অবশ্য এ শাসনের মধ্যে কঠোরতা নাই, শ্লেষ নাই, কাতর অনুযোগ নাই—আছে কেবল মিষ্ট কথা, প্রাণভরা আদর, গালভরা হাসি, হৃদয়ভরা স্নেহ,আর যত্ন মাখানো সোহাগ। এই প্রকার একটা বৈচিত্রময় ভালবাসার মধ্যে ফেলিয়া, এই রূপসী শ্রেষ্ঠা আনারউন্নিসা, নবাব সুজা বেগকে দিনে দিনে তাহার গোলাম করিয়া তুলিতেছিল।

 বিলাসিনীর ছলনাময় প্রেমপ্রতারিত কলঙ্কিত চরিত্র নবাব সুজা বেগ, এখন আনারউন্নিসার ক্ষণিক বিরহে বড়ই ব্যাকুল হইয়া উঠেন। এই আনারকে দুদণ্ডের জন্য চোখের আড়াল করিতেও যেন তাঁহার কষ্টবোধ হয়। এই আনারউন্নিসার মুখখানি কোন কারণে মলিন দেখিলে, তাঁহার বুকের ভিতর যেন কেমন করিয়া উঠে। তিনি মিষ্ট কথায়, অপরিমিত সোহাগে, পত্নীর চিত্তবিনোদনের চেষ্টা করেন। তাহার মলিন মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিতে দেখিলে, তাঁহার হৃদয়ের মধ্য হইতে যেন একটা ভারী বোঝা কোথায় সরিয়া যায়।

 একদিনের একটা ঘটনা বলি। কোন একটা সরকারী কার্য্য উপলক্ষে, নবাব সুজাখাঁকে একটু দূরে যাইতে হইয়াছিল। যে সময়ের মধ্যে তাঁহার ফিরিবার কথা ছিল, সে সময়টা উত্তীর্ণ হইয়া গেল।

 রাত্রি প্রথম প্রহর উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। বিমল জ্যোৎস্নালোকে শ্যামবর্ণা ধরণী হাস্যমুখরিতা। আনার উন্নিসার শয়ন কক্ষ পূর্ণভাবে উজ্জলিত। শয়নের সময় উত্তীর্ণ হইয়া গেলেও সে শষ্যা আশ্রয় করিতে পারিল না।

 আনারউন্নিসা, মুক্তবাতায়ন পথ দিয়া জ্যোৎস্নালোকিত প্রকৃতির দিকে অনেকক্ষণ ধরিয়া চাহিয়া থাকিয়া, একটী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল— “এত নিষ্ঠুর তুমি! আজ এত বিলম্ব করিতেছ কেন? এত দেরী ত কখনও কর না?

 এই সময়ে কে যেন পশ্চাৎ হইতে অতি সন্তর্পণে পা টিপিয়া আসিয়া, তাহার চোখ দুটী চাপিয়া ধরিল। আনার, আগন্তুকের হাত দুটী ছাড়াইয়া লইয়া দেখিল, নবাব সুজা বেগ তাহার সম্মুখে।

 সুজা বেগ সহাস্যমুখে বলিলেন—“আজ হাতে হাতে তুমি ধরা পড়িয়াছ। মেরে—জান্ পেয়ারে্! আমাকে অকারণে দোষ দিতেছ কেন? তোমায় ছাড়িয়া কি আমি নিশ্চিন্ত চিত্তে বহুক্ষণ কোথাও থাকিতে পারি।”

 আনার। তবে আজ এত দেরী করিলে কেন?

 সুজা। তুমি কি কর দেখিবার জন্য, পাশের কক্ষে একটু আত্মগোপন করিয়াছিলাম! ঠিক সন্ধ্যার পরই আজ আমি বাটীতে ফিরিয়াছি।

 আনার। তাহা হইলে তুমি নিষ্ঠুর নও ত কি?

 সুজা। কিসে?

 আনার। আমায় এত অনর্থক ভাবাও কেন?

 সুজা। আমার অপরাধ হইয়াছে। মার্জনা কর—আনারবেগম!

 আনার। একটী করারে আমি তোমায় মার্জনা করিতে প্রস্তুত।

 সুজা। কি করার তোমার—শুনিতে পাই কি?

 আনার। সাতদিন তোমাকে এই বাড়ীর মধ্যে নজরবন্দী হইয়া থাকিতে হইবে।

 সুজা। গোলামের গোলাম আমি। হুকুম তামিল করিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমাকে চৌকি দিবার জন্য কাহাকে বাহাল করিবে।

 আনার এই দুটী চক্ষুকে!

 সুজা। ভাল-তাহাই স্বীকার করিলাম। কিন্তু আমার একটী অনুরোধ রাখিতে হইবে।

 আনার। কি?

 সুজা। তোমার বীণ‍্টা একবার তুলিয়া লও। তোমার সেই গানটী একবার আমাকে শুনাও।

 আনার। না—তা আমি পারিব না। আমার বড় লজ্জা করে।

 সুজা। আমি নবাব সুজা বেগ, মুকিম—বাদশাহী, মোগল সরকারের দৌলতখানার হেপাজতকার। আমার হুকুম তোমাকে তামিল করিতেই হইবে!

 আনার। আর আমি খোদ নবাব—বেগম—আনারউন্নিসা। নবাব সুজা খাঁর মালেক্— আমার খুস্ মেজাজের হুকুম, আমি গাহিতে পারিব না।

 এই কথা বলিয়া আনারউন্নিসা একটী তীব্র কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল। আর নবাব সুজা বেগ, এই কটাক্ষ-বিশিখ-বিষে জর্জ্জরিত হইয়া পরাজয় স্বীকার করিয়া, আনারকে স্নেহভরে বুকে জড়াইয়া ধরিলেন।

 বারান্দার বাহিরে একটা হীরামন তাহার দাঁড়ের উপর বসিয়া দুলিতেছিল। সে সহসা কি একটা খেয়ালবশে, শিশ্ দিয়া উঠিল—“শিঃ—শিঃ—শিঃ।”

 আনারউন্নিসা, সজোরে নবাবের আলিঙ্গন পাশ মুক্ত হইয়া সহাস্যমুখে বলিল—“ছিঃ ছিঃ নবাবসাহেব কর কি? পাখীটাও যে আমাদের অবস্থা দেখিয়া বিদ্রূপ করিতেছে।”

 নবাব সুজা বেগ আনারের আরক্ত গণ্ড দুঢ়ী মৃদুভাবে টিপিয়া দিয়া বলিলেন—“অই—ছি—ছি আমার না তোমার, আনার উন্নিসা? পাখীটা বলিতেছে কি জান আনার? ছিঃ—ছিঃ প্রিয়তমের এক দণ্ডের অদর্শনে যে একটু আগে এতটা ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছিল, সে এখন তাহার প্রাণের জিনিসকে কাছে পাইয়া উপেক্ষা করিতেছে। তাই বলিতেছে— ছি! ছি!

 আনারউন্নিসা কথাটা উড়াইয়া দিবার জন্য বলিল—“আজ তুমি বড় শ্রান্ত হইয়াছ! একটু সেরাজি দিব কি?”

 সুজা বেগ কৃত্রিম বিরক্তির সহিত বলিলেন—“ছিঃ! ওকথা কি আর বলিতে আছে? যে নেশায় আজ আমাকে তোমার গোলাম করিয়া রাখিয়াছে সেরাজির নেশা কি তার চেয়েও বেশী জমাট? সেরাজির নেশা শীঘ্রই ছুটিয়া যায়! কিন্তু তোমার অই অফুরন্ত প্রেম মদিরায় উন্মত্ত হইয়া দুনিয়ায় সব ভুলিয়া, আমি যে মাতিয়া আছি, তাহা যে ছুটিবার নয় আনারউন্নিসা!

 আনার সহাস্যমুখে বলিল—“সত্যি নাকি? আমি যদি কাল কবরে যাই। তাহা হইলে নেশা ছুটিয়া যাইবে না তো?”

 সুজা বেগ মুখখানা গম্ভীর করিয়া বলিলেন—“ছি! ও কথা বলিতে নাই।

 এই কথা বলিয়া আবেগভরে আনারকে বুকে জড়াইয়া লইয়া, নবাব সুজাবেগ তাঁহার এই নিষ্ঠুরতার প্রতিশোধ লইলেন।

 এই সময়ে পাখীটা আবার চীৎকার করিয়া শীশ্ দিয়া উঠিল—“শি—শি” অর্থাৎ “ছিঃ—ছিঃ।”