দ্বিতীয় চরিতাষ্টক/গোবিন্দ চক্রবর্ত্তী (মুকুট রায়)

উইকিসংকলন থেকে

ক্রোরীয়ান্ গোবিন্দচন্দ্র চক্রবর্ত্তী।

 যখন মুসলমান সম্রাট আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে উপবিষ্ট হইয়া ভারতরাজ্য শাসন করিতে ছিলেন; যখন দাক্ষিণাত্যে হিন্দুচুড়ামণি মহারাজ শিবজি হিন্দু স্বাধীনতার পুনঃস্থাপন বাসনায় বিপুল অশ্ব সেনার অধিনায়ক হইয়া রায়গড়ে বদ্ধ-মূল হইতে ছিলেন; যখন সুদক্ষ নবাব সাইস্তাখাঁ বঙ্গদেশে রাজত্ব করিতেছিলেন; যখন ফরাসী, দিনেমার, ওলন্দাজ, ইংরাজ প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকেরা পরস্পর প্রতি যোগীতা পূর্ব্বক বাঙ্গালার। নানাস্থানে বাণিজ্য বিস্তার করিতেছিলেন; সেই সময়েই সুবিখ্যাত নবদ্বীপের অগ্নি কোণে কামারকুলি[১]নামক গ্রামে একজন প্রধান বাঙ্গালী প্রাদুর্ভূত হন। তাঁহারই নাম গোবিন্দচন্দ্র চক্রবর্ত্তী।

 বঙ্গদেশের বিষয় যতই আলোচনা করা যায়, ততই অবসন্ন হইতে হয়। অধুনাতন বঙ্গবাসি-গণ আপনাদিগকে চালাক ও কাজের লোক বলিয়া মনে২ কতই সন্তুষ্ট হন এবং লোকের নিকট অহঙ্কার প্রকাশ করিতেও ত্রুটি করেন না। কিন্তু দেখেন না যে, তাঁহাদের দেশের একখানা প্রকৃত ইতিহাস নাই। যে জাতির ইতিহাস নাই সে জাতির কিছুই নাই। সভ্য জাতিরা তাহাদিগকে মানুষ জ্ঞান করেন না। এইজন্যই বর্ত্তমান রাজপুরুষ গণের নিকট বাঙ্গালী জাতির তাদৃশ আদর নাই। যদি বঙ্গদেশের পূর্ব্বতন অবস্থার প্রকৃত ইতিহাস থাকিত, যদি আমাদের পূর্ব্বপুরুষ গণের জীবন-চরিত থাকিত, যদি পূর্ব্বতন সামাজিক আচার ব্যবহার বিষয়ক গ্রন্থাদি থাকিত তাহাহইলে আর আমাদিগকে পদ্মা ও ভাগীরথীর অন্তর্গত আধুনিক চরবাসী বা বনবাসী বলিয়া উপেক্ষিত হইতে হইত না। তাহা হইলে আমরা “বড় ঘরানা” বলিয়া আদর পাইতাম এবং সভ্য ও প্রবল জাতিগণের দয়ার পাত্র হইতে পারিতাম। উপরি উক্ত ব্যক্তির জীবন-চরিত সম্বন্ধে যেরূপ গল্প শুনা যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস গ্রন্থে তাহার গন্ধও নাই। ইহাকি অল্প আক্ষেপের বিষয়! অথচ তাদৃশ ব্যক্তির তাদৃশ কার্য্যই ইতিহাসের প্রধান বিষয়। নবাব মুর্সিদকুলী জাফর খাঁর সময়ে, নাজির আহম্মদ, সইয়দ্ রেজাখাঁ, সইয়দ্ ইফ রাম খাঁ প্রভৃতি মুসলমান রাজপুরুষের বাঙ্গলার রাজস্ব সম্বন্ধে যে কার্য করিতেন, একজন বাঙ্গালীও আপন পুত্রের সহিত সেই সময়ে বহুবৎসর তাদৃশ কোন কার্য্য করিয়াছিলেন, এবং তদ্দ্বারা আপন অবস্থা সমুন্নত করিয়া বিবিধ কীর্ত্তিকলাপ দ্বারা চিরস্মরণীয় হইয়া গিয়াছেন; ইতিহাসে পাঠ না করিলে ইহা কি রূপে বিশ্বাস করা যাইতে পারে? যেরূপ শুনা যায়, তাহাতে ঐ বাঙ্গালীর পদ, উপরি উক্ত মুসলমান রাজপুৰুষ গণের পদ অপেক্ষাও উচ্চতর ছিল বলিয়া বােধ হয়। হয়, গােবিন্দ চক্রবর্তীর জীবন-চরিত সম্বন্ধে বঙ্গদেশীয় জনশ্রুতি মিথ্যা বলিতে হয়, নয়, মুসলমান লেখক, ইতিহাস হইতে বাঙ্গালীর নাম পরিত্যাগ করিয়াছেন ইহাই স্বীকার করিতে হয়। এই উভয় তর্কের মধ্যবর্ত্তী হইয়া সিদ্ধান্ত করিলে বােধ হয়, যে, গােবিন্দ চক্রবর্ত্তীর যাদৃশ উচ্চ পদের গল্প শুনা যায়, বাস্তবিক তাদৃশ পদ তাঁহার হয় নাই। ফলতঃ যেমন শুনা যায় সেরূপ না হইলেও, যখন ডেঃ গবর্ণর রাজা রাজবল্লভ, পেস্কার দর্পনারায়ণ প্রভৃতি দেশীয় গণের নাম ইতিহাসে দষ্ট হয়; তখন বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার “ক্রোরীয়ান্” বলিয়া খ্যাত গােবিন্দ চক্রবর্তীর বিষয় বাঙ্গালার ইতিহাসে বিবৃত হওয়া নিতান্তই উচিত ছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। যাহা হউক, যখন ইতিহাসে কোন প্রমাণ নাই, তখন কেবল মাত্র জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়াই, গােবিন্দ চক্রবর্ত্তীর জীবন-চরিত-সম্বন্ধীয় আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতে হইল।

 নবাব সাইস্তাখাঁর সময়ে কামারকুলিতে এক ঘর দুঃখী বৈদিক ব্রাহ্মণের বাস ছিল। সাধ্বী স্ত্রী এবং ৭।৮ বৎসর বয়স্ক একটী পুত্র সন্তান লইয়া ব্রাহ্মণ অতি কষ্টে সংসার নির্ব্বাহ করিতেন। বালকটি অতি দুষ্ট স্বভাব। একদিন প্রতিবাদী বালক গণের সহিত খেলা করিতে করিতে কে কি দিয়া ভাত খাইয়াছে, সেই কথা উঠিল। সকলের কথা ফুরাইলে একটা বালক কহিল, “আমার মা যেরূপ লাউ চিঙড়ি রাঁধিয়াছিলেন, তোমরা কেহই সেরূপ খাও লাই।” আমাদের বালক গৃহে আসিয়া মাতার নিকট লাউ চিঙ্গড়ি খাইবার প্রস্তাব করিলেন। মাতার হাতে কপর্দ্দকমাত্র নাই যে, তদ্দ্বারা মাচ ক্রয় করেন। এদিকে বালকের ভয়ানক আবদার; এমন সময়ে হঠাৎ একজন মৎস্য বিক্রয়িণী গৃহে উপস্থিত হইল। জননী, উপায়ান্তর না দেখিয়া ধারে মাচ কিনিলেন। তাহাকে বলিয়া দিলেন “ফিরিয়া যাইবার কালে দাম লইয়া যাইও।”

 লাউ চিঙড়ির যোগাড় হইল দেখিয়া গোবিন্দের আনন্দের সীমা নাই। খেলিতে বাহির হইলেন। জননী পাক প্রস্তুত করিলেন। মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত হইল। মৎস্য বিক্রয়িণী পাড়ায় ২ মাচ বেচিয়া ফিরিয়া আইল। মাঠাকুরাণীর নিকট পয়সা চাহিল। তিনি বলিলেন,—“বাছা পয়সাত হাতে নাই,—আর একদিন লইও, —অজি এস।” ইহাতে মেছুনী অসন্তুষ্ট হইয়া যার পর নাই গালি গালাজ করিল। কেহ২ বলেন সে রন্ধন করা মাচ, তরকারী হইতে বাছিয়া লইয়া গিয়াছিল। ঠাকুর এই ব্যাপার অবগত হইয়া বড় বিরক্ত হইলেন। পুত্রের জন্য ছোট লোকের গালি খাইতে হইল বলিয়া স্ত্রীর সম্মুখে পুত্রোদ্দেশে অনেক তিরস্কার করিলেন। ইতিমধ্যে গোবিন্দ গৃহে আসিয়া আহার করিতে বলিলেন। গোবিন্দ মাছের তরকারীতে মাছ না পাইয়া জননীকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“মাছ কই?” জননী রোদন করিতে২ মেছুনীর বৃত্তান্ত বলিলেন। কেহ বলেন, কর্ত্তার আদেশে গোবিন্দকে ছাই খাইতে দেওয়া হইয়াছিল। ঘটনা যাহাই হউক, ফলে দারিদ্র নিবন্ধন এই ব্যাপার উপলক্ষে গোবিন্দের মনে একটি বিলক্ষণ আঘাত লাগিয়া ছিল। ভোজন হইতে বিরত হইয়া সেই আট বৎসর বয়স্ক বালক বলিলেন, “মা আমার নিমিত্ত ভাবিও না, যদি টাকা রোজগার করিতে পারি তবে আবার ঘরে ফিরে আসিব, নতুবা এই জন্মের শোধ বিদায় হইলাম।” এই কথা বলিয়া গোবিন্দ বাটী হইতে বাহির হইলেন।

 গোবিন্দ কোথা যাইবেন, কি করিবেন তদ্বিষয়ে লক্ষ্য স্থির নাই। ভ্রমণ করিতে২ গঙ্গাতীরে উপস্থিত ইইয়া দেখিলেন, একটী ভাল গাছে পাকীর ছা হইয়াছে। পক্ষি-শাবক গ্রহণে লোলুপ হইয়া বৃক্ষে আরোহণ করিলেন। কোটরে যেমন হস্ত প্রবেশ করাইবেন, একটী বিষধর সর্প তন্মধ্য হইতে অর্দ্ধ নিষ্ক্রান্ত হইয়া দংশনে উদ্যত হইল। এমন অবস্থায় ভয়ে অভিভূত হইয়া গাছ হইতে পড়িয়া যাওয়াই সম্ভব। কিন্তু গোবিন্দ তৎক্ষণাৎ এরূপে সাপের গলা টিপিয়া ধরিলেন, যে, সে আর দংশন করিতে পারিল না। কিন্তু লাঙ্গূল দ্বারা তাঁহার হস্ত জড়াইয়া ধরিল। গলা ছাডিয়া দিলে দংশন করে; এদিকে এক হস্তের আশ্রয়ে বৃক্ষ হইতে অবতরণ করাও সুকঠিন। প্রস্তুত-বুদ্ধি বালক আপনাকে এইরূপ বিপন্ন দেখিয়া তখনি একটী সদুপায় উদ্ভাবন ও অবলম্বন করিলেন। যে ক্ষমতা, নিরাশ্রয় দুঃখী বালককে ভবিষ্যতে সম্ভ্রম জনক ও গুরুভার-বহরাজকীয়পদে উন্নত করিয়াছিল, পাঠকগণ তালিতরুর শিখর দেশে নাগপাশ-বদ্ধ বালাকের নবীন জীবনে অদ্য তাহার অঙ্ক‌ুর দেখিতে পাইবেন। গোবিন্দ কোন রূপে অপর হস্ত দ্বারা লাঙ্গুলের অগ্রভাগ ধরিয়া একৎ বেড় খোলেন, আর তালীয় খড়গ[২] ছিন্ন করিয়া ভূতলে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে একজন পরিব্রাজক সন্ন্যাসী যদৃচ্ছাক্রমে ভ্রমণ করিতে২ এই স্থানে উপস্থিত হইলেন। কথিত আছে, তিনি তৎকালে নির্দ্দিষ্ট গুণ বিশিষ্ট একটা শিষ্যের অনুসন্ধান করিতেছিলেন। সহসা তাল বৃক্ষোপরি দৃষ্টি সংযোগ হওয়ায় এক অদ্ভ‌ুত নাট্যের অভিনয় দেখিতে পাইলেন। মনেৎ স্থির করেন সেই বালকই, তাঁহার উপযুক্ত শিষ্য হইবে। বালক আরব্ধ কর্ম্ম শেষ করিয়া গাছ হইতে নামিলেন। সন্ন্যাসী তাঁহাকে, ভাল হইবার আশা দিয়া, সঙ্গে যাইতে অনুরোধ করিলেন। গোবিন্দ বলিলেন, সন্ন্যাসী ঠাকুর যদি পাকীর ছা দিতে পারেন, তবে তিনি তাঁহার সঙ্গে যান। সন্ন্যাসী পক্ষিশাবকের প্রলোভন দেখাইয়া তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া প্রস্থান করিলেন। সন্ন্যাসী তাঁহাকে মন্ত্র গ্রহণ করাইয়া, মন্ত্র সিদ্ধির উপায় বলিয়া দিলেন এবং কহিলেন, গোবিন্দ, ভবিষ্যতে অতিশয় বড় লোক হইবেন; কিন্তু অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মৃত্যু হবে। পরিব্রাজকের এই সকল ভবিষ্যৎ বাণী সম্পূর্ণরূপে সফল হইয়াছিল। তিনি সন্ন্যাসীর সঙ্গে দিল্লী যান।

 কথিত আছে, সন্ন্যাসীর বরে বিনা যত্নে আরবী ও পারসী ভাষায় নানা বিদ্যা উপার্জ্জ্বন করিয়াছিলেন। গোবিন্দ, আরবী ও পারসী ভাষায় পণ্ডিত হইয়াছিলেন একথা যেমন সত্য; অন্যদিকে, বিনা যত্নে বিদ্যাভ্যাস না, এটাও সেইরূপ সত্য। অতএব এমন স্থলে উপরি উক্ত জনশ্রুতি, সহজেই মিথ্যা বলিয়া বোধ করা যাইতে পারে। অনুমানে ইহাই প্রতীত হয় যে, হয়, প্রোক্ত দুই ভাষায় সন্ন্যাসীর জ্ঞান ছিল, তিনি স্বয়ং গোবিন্দকে শিক্ষা দেন; না হয়, দিল্লীতে তাঁহার কাল প্রচলিত বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা করিয়া দেন। অল্প সময়ে ও অল্প শ্রমে তাদৃশ বিদ্যা উপার্জ্জনে সমর্থ হইয়ছিলেন বলিয়াই, লোকে বলে “বিনা যত্নে সন্ন্যাসীর বরে বিদ্বান্ হইয়াছিলেন।” ফলতঃ এতাদৃশ প্রতিভাসম্পন্ন বালকের শিক্ষা গ্রহণ বিষয়ে অনেক কৌতুক ও আমোদ জনক উপদেশ পাইবার আশা করা যাইতে পারে; কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য বশতঃ তাহার সবিশেষ বিবরণ কিছুই সংগ্রহ করা যায় না।

 গোবিন্দ, বাল্য স্বভাবের বশীভূত হইয়া আরবীর সুললিত কবিতা, মুখে২ আবৃত্তি করিতে২ দিল্লীর নগর পথে ভ্রমণ করিতেছিলেন। ভাহা, তৎকালীন সম্রাটের রায় রাঁইয়ার[৩] কর্ণে প্রবেশ করিল। তিনি অতিশয় সন্ত‌ুষ্ট হইয়া বালককে নিকটে আহ্বান করেন। দেওয়ান আকৃতি প্রকৃতি এবং বদন স্ত্রীতে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ দেখিয়া গোবিন্দকে বড় ভাল বাসিলেন। আশ্রয় দান করিয়া তাঁহার উন্নতি সাধন কল্পে সবিশেষ মনোযোগী হইলেন। তিনি দেওয়ানের অনুগ্রহে বহু দিন এই স্থানে থাকিয়া বহুবিধ বিষয় কার্য্য শিক্ষা ও কাজ কর্ম্ম করেন। শেযে, যে কার্য্য করিয়া প্রচুর সম্পত্তি ও দেশাবচ্ছিন্নে খ্যাতি লাভ করেন, এই স্থান হইতেই তাহার সূত্রপাত হয়।

 গোবিন্দ চক্রবর্তী, দেওয়ানের অনুগ্রহে ক্রমাণ্বয়ে অনেক রাজকর্ম্মে নিযুক্ত হন। দেওয়ান অপাত্রে অনুগ্রহ বিতরণ করেন নাই। তিনি, গোবিন্দের অসাধারণ গুণ ও কার্য্য-ক্ষমতা দর্শনে মোহিত ইইয়া তাহার প্রতি অনুগ্রহ করিতে বাধিত হন। নিজের একটু মনুষ্যত্ব না থাকিলে, কেবল মাত্র পুরানুকূল্যে, কেহ প্রকৃত বড় লোক হইতে পারেন না, অনেকে সহায় নাই বলিয়া আক্ষেপ করেন, কিন্তু অকারণ সহায় অতি অল্প লোকের থাকে। যাহা হউক, গোবিন্দ, ক্রমে সম্রাটের গোচর হইলেন। এই ঘটনাতেই তাহার গুণ ও ক্ষমতার, পর্যাপ্ত পুরস্কার হইল। কার্য্য ও কারণ উভয়ে এরূপ আশ্চর্য্য সম্বন্ধ-যুক্ত যে, তাহাদের মধ্যে কিঞ্চিন্মাত্র বৈষম্য থাকিবার যে নাই। আপাত দৃষ্টিতে বোধ হইতে পারে, গোবিন্দের যেরূপ যোগাযোগ হইল, যাহার সম্বন্ধে সেরূপ হইবে তাহারই তাদৃশী উন্নতি হইবার সম্ভাবনা। কিন্তু কার্য্য কারণের ভাব পর্য্যালোচনা করিলে, বোধ হইবে, যোগাযোগ আপনি হয় না। এ সংসারে কয় ব্যক্তি, অত্যুচ্চ তালিতরু-শিখরে তাদৃশ অবস্থাপন্ন হইয়াও তাদৃশী প্রস্তুত-বুদ্ধি প্রদর্শনে সমর্থ হয়?

 তৎকালীন সমাট একদা গোবিন্দকে দেখিতে চাহিলেন। দেওয়ান, সম্রাট সাক্ষাৎ করণোপ যোগী আয়োজন করিয়া দিলেন। গোবিন্দ, স্বকীয় বিদ্যা, বুদ্ধি ও কার্য্য-দক্ষতা প্রদর্শনে সম্রাটের এতাদৃশ স্নেহ ও সন্তোষ আকর্যণ করিলেন যে, তিনি তাঁহাকে প্রার্থনার অধিক পুরস্কার দানে বাধিত হইলেন। বাদসা, “বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা” এই তিনটি শব্দ উচ্চারণ পূর্ব্বক পদ সঞ্চালনে নিকটস্থ তিনটী তাকিয়া স্থান ভ্রষ্ট করিলেন। গোবিন্দ ইহার অর্থ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া একপ্রকার অসন্তুষ্ট হইয়াই রাজ সভা হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন। দেওয়ানজীকে কহিলেন, “মহাশয়, এমন বাতুলের নিকটও আমাকে পাঠাইয়াছিলেন।”

 গোবিন্দের প্রতি বাদ‍্সার বিশেষ অনুরাগ দেখিয়া দেওয়ানের কিঞ্চিৎ শঙ্কা হইয়াছিল, পাছে দেওয়ানী পদ গোবিন্দকে প্রদত্ত হয়। গোবিন্দের সহিত সম্রাটের সাক্ষাৎ ও “তিন তাকিয়ে ইলাম” হইয়া গেলে দেওয়ানজীর সে শঙ্কা অন্তরিত হইল।

 পূর্ব্বতন মুসলমান সম্রাটদিগের সভায়, সিংহাসনের সম্মুখে ও উভয় পার্শ্বে কতকগুলি “তাকিয়া” থাকিত। ঐ সকল “তাকিয়া” ভিন্ন২ সুবার নামে অভিহিত হইত। “তাকিয়া ইলামের” অর্থ এই, কোন ব্যক্তিকে ঐ পুরস্কার দেওয়া হইলে, সে তত্তৎসুবার কোন প্রধান রাজকর্ম্ম পাইবার অধিকারী হইত। তদনুসারে গোবিন্দ বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যা এই তিন বার “ক্রোরীয়ান” অর্থাৎ রাজস্ব সম্বন্ধীয় সর্ব্বপ্রধান পদে অভিষিক্ত হইলেন। বাঙ্গালার নবাবের অধীন থাকিয়া কাজ করিতে হইত বটে, কিন্তু সে অধীনতা নামমাত্র। বাঙ্গালা বলিলে তৎকালে উপরি উক্ত তিন প্রদেশ বুঝাইত। গোবিন্দ একরূপ স্বাধীন ভাবেই বাঙ্গালার রাজস্ব নির্ণয় ও আদায় করিতেন। মুসলমান অধিকারের পূর্ব্ব হইতেই, বঙ্গদেশ দ্বাদশটী ক্ষুদ্র রাজ্যে[৪] বিভক্ত ছিল। কথিত আছে, সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময়ে যশোহর রাজ প্রতাপাদিত্য ঐ বারটি রাজ্য স্বায়ও করেন। এ কথা সত্য বোধ হয় না। অথবা সত্য হইলেও, ঐ রাজ্যগুলি অধিক কাল আত্ম-বশে রাখিতে পারেন নাই। যেহেতু গোবিন্দ চক্রবর্ত্তীর সময়ে এবং তাঁহার মৃত্যুর পরও অনেক দিন পর্যন্ত পূর্ব্বস্থলীতে ঐ বার জনরাজার বারটী বাসা বাটী ছিল। ঐ বাসাবাড়িী সকল “বারভূম” বলিয়া খ্যাত ছিল। রাজস্ব সম্বন্ধীয় কার্যাদি করিবার জন্য বঙ্গরাজ গণের কর্মচারীরা উপরি উক্ত বাসা বাটী সকলে অবস্থান করিত। কখন২ প্রয়োজন মতে, গোবিন্দের সহিত বা পরবর্ত্তী তৎ পদাভিষিক্তের সহিত সাক্ষাৎ করিতে স্বয়ং রাজারাও তথায় আসিতেন।

 গোবিন্দ, শেষাবস্থায় কামার কুলির বাটী ত্যাগ করেন। কারণ তৎকালে এবাটি গঙ্গাগর্ভসাৎ হয়। ঐ বাটির তিনদিকে গড় কাটা হইয়াছিল, অপর দিকে গঙ্গা স্বয়ং গড়ের কার্য্য করিতে ছিলেন। বাসবাটি ব্যতীত গঙ্গাতীরে অট্টালিকাময় ঠাকুর বাটি ছিল। তথায় একশত আটটি শিব মন্দির ছিল। তদ্ব্যতীত রাধাকান্ত, রাধাবল্লভ, কৃষ্ণদেব এবং মদনগোপাল এই চারিটি দেব বিগ্রহ ছিলেন। গোবিন্দ পশ্চিম হইতে আগমন কালে তৎকালীন জয়পুর-পতির নিকট প্রথম বিগ্রহ প্রাপ্ত হন। দেবালয়ের সহিত সংযুক্ত অতিথিশালা। গোবিন্দ, ঐ সকল দেব সেবা এবং অতিথি সেবা, মহাসমারোহে সম্পন্ন করিতেন। শ্রুত আছে, তিনি অত্যন্ত বদান্য ছিলেন।

 বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে তিনটি শ্রেণী আছে। রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র এবং বৈদিক। এই শ্রেণীত্রয়ের মধ্যে জাতিগত ভিন্নতা কিছুই নাই। কিন্তু সকলেই আপন২ শ্রেণীকে অপেক্ষাকৃত পবিত্র মনে করেন। সেটি কেবল তাঁহাদের মনের ভ্রম মাত্র। কার্য্যে কাহারও অধিক প্রাধান্যের প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং সকলেই সমান এইরূপ অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকাশ্যরূপে এই শ্রেণীত্রয়ের মধ্যে আহার ব্যবহার বা বিবাহদি ম্বিন্ধ হইতে পারে না। অথচ কেহ কাহার অন্ন গ্রহণ করিলে, তাহাকে স্বশ্রেণী হইতে পতিত হইতে হয়; এবং ঐ শ্রেণী সকলের মধ্যে গুরু শিষ্য সম্বন্ধ প্রচলিত আছে। যাহা হউক, একজাতির মধ্যে এইরূপ অমূলক ভিন্নতা থাকায় অনেক অনিষ্ট হইতেছে। এই তিন শ্রেণীর মধ্যে বিবাহাদি সম্বন্ধ প্রচলিত হইলে ব্রাহ্মণ জাতির অনেক মঙ্গল হইতে পারে। এই তিন শ্রেণী একত্র হইলে কিরূপ মঙ্গল হইতে পারে এবং পৃথক্ থাকায় কি অনিষ্ট হইতেছে, তাহার সূক্ষম বিচার, এগ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। যাহা হউক, এই তিন শ্রেণীকে একত্রিত করিবার জন্য গোবিন্দ চক্রবর্ত্তী সবিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি নিজে তিন শ্রেণীতে বিবাহ করিয়াছিলেন। তাঁহার তিন পত্নীর সন্তান হইয়াছিল। কিন্তু বৈদিকীপত্নীর গর্ভজাত সন্ততিগণ ব্যতীত, আর কেই জীবিত ছিল না। তাঁহার অপর সন্তানেরা জীবিত থাকিলে এবং পরবংশীয়েরা এই নুতন প্রণালী প্রচলিত করিবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করিয়া আসিলে কোন ফল হইত না এ কথা বলা যায় না। ফলতঃ গোবিন্দের এই চেষ্টা ফলবতী হয় নাই। তিনি মৃত্যু কালে দুই পুত্র রাখিয়া যান। জ্যেষ্ঠের নাম রূপরাম, কনিষ্ঠের নাম মুকুটরাম। বোধ হয়, কর্ম্মসূত্রে, রাজসংসার হইতে রায় উপাধি পাইয়াছিলেন। এইজন্য তাঁহার পরবংশীয়েরা রায় উপাধিতেই খ্যাত হন।

 কথিত আছে, একদা আহ্নিক করিতে২ হঠাৎ গোবিন্দের মৃত্যু হয়। তিনি যোগাসনে উপবিষ্ট, তাঁহার ছিন্ন মস্তক গৃহ ভলে পতিত, শরীর রুধিরাভিষিক্ত হইতেছে; তৎকালীন পরিজনেরা, তাঁহার এইরূপ পরিণাম দেখিয়াছিলেন। যাঁহারা তাঁহার এইরূপ মৃত্যুতে বিশ্বাস করেন, তাঁহারা বলেন, গোবিন্দ চ্ছিন্নমস্তার মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন; এইজন্য তাহার ঐ রূপে মৃত্যু হইয়া ছিল। তন্ত্রের রহস্য উদ্ভেদ করা সহজ ব্যাপার নহে। পুরাণে প্রথিত আছে, মহারাজ লঙ্কাধিপতি আপনার ছিন্ন মস্তক দ্বারা ইষ্টদেবের প্রীতি সাধন করিয়াছিলেন। গোবিন্দের ইষ্টদেব পূজাও সেইরূপ কিনা, নিশ্চয় বলা যায় না। এরূপ মৃত্যুর বহুবিধ হেতু কল্পনা করা যাইতে পারে। কোন কারণ বশতঃ একজন মুসলমান - নবাবের সহিত তাঁহার বিবাদ হইয়াছিল, এরূপ শ্রুত আছে। সেই নিষ্ঠ‌ুর নবাবের ষড়যন্ত্রে গোবিন্দের তাদৃশী মৃত্যু ঘটিতে পারে। অথবা তাঁহার যে কার্য্য করিতে হইত, তাহাতে এতদ্দেশীয় তৎকালীন রাজগণের সহিত মনোবাদ হইবার সম্ভাবনা ছিল। কিম্বা যে গুরুর প্রসাদে তাঁহার তাদৃশী উন্নতি হইয়াছিল, সেই গুরুর বাক্য সার্থক করিবার জন্য আত্ম-ঘাতের প্রবৃত্তি হওয়াও নিতান্ত অসম্ভব নহে। সুজা উদ্দৌলার রাজ্য আরম্ভের কিছু পূর্ব্বে এই ঘটনা সংঘঠিত হয়।

 গোবিন্দ চক্রবর্ত্তী বঙ্গদেশে মুকুট রায় বলিয়া খ্যাত; নিম্নে তাঁহার এইরূপ খ্যাতির কারণ নির্দ্দেশ করা যাইতেছে। একথা পূর্ব্বে একবার বলা হইয়াছে;—তাঁহার দুইটিী পুত্র, রূপরাম রায় এবং মুকুটরাম রায়। কনিষ্ঠ মুকুটরাম রায়, অধিকতর বিদ্যাবান্, সদ‍্গুণশালী ও কার্যদক্ষ হইয়াছিলেন। পিতা বর্ত্তমানেই ক্রোরীয়ানের কার্য্য নিজ হস্তে গ্রহণ করেন। পিতাও তাঁহাকে সম্যক্ উপযুক্ত দেখিয়া, সকল কার্য্য তাঁহার নামে চালাইতেন। গোবিন্দের অপেক্ষা, মুকুট অধিক কাল ঐ কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন। বোধ হয়, রাজস্ব আদায় সম্বন্ধে মুকুট, রাজগণের সহিত অধিক রুক্ষ্ম ব্যবহার করিতেন। কারণ খাজনা আদায় সম্বন্ধীয় নানাপ্রকার পীড়াপীড়ির ঘটনা, পূর্ব্বস্থলীতেই ঘটিয়াছিল, এইরূপ শুনা যায়। গোবিন্ধ পূর্ব্বস্থলীর বাটীতে অধিককাল বাস করেন নাই। প্রায় তাঁহার পরলোক সময়েই, তত্রত্য বাটী নির্ম্মিত হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত গোবিন্দের পূর্ব্ব নিবাস কামারকুলিতে “বারভূমের” কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। মুকুট রায়ের কর্ত্তৃত্বে এবং তাঁহার অভিপ্রায় মতেই পূর্ব্বস্থলীর বসতবাটী, দেবায়তন, কাছারী বাড়ী, নহবতখানা, হাওয়াখানা, ইত্যাদি “আমিরী” ধরণের বাড়ী ঘর নির্ম্মিত হইয়াছিল। এই যাবতীয় অট্টালিকাময় গৃহাদি, এক অত্যুচ্চ দুরারোহ প্রাকারে বেষ্টিত ছিল। ইহাকে “চৌদালী” কহিত। দক্ষিণে পাঠানেরা তোরণ রক্ষা করিত এবং উত্তরে বাগদী জাতীয় তীরন্দাজ ও তলোয়ার বাজ চোয়াড়েরা খড়ককী দ্বার রক্ষা করিত। বাটীর পূর্ব্ব ও পশ্চিম দিকে অন্যান্য কর্ম্মকর কায়স্থাদি জাতির আবাস ছিল। কালক্রমে তাহারা তওৎ স্থানের অধিবাসী হইয়াছে। অদ্যাপি পূর্ব্বস্থলীতে ঐ সকল অধিবাসীর অবশেষ বর্তমান আছে। মুকুটরামের সময় ক্রিয়াকাণ্ডের কিছু বাহুল্য হইয়াছিল। তিনি অতি সমৃদ্ধির সহিত খিড়‍্কির পুষ্করিণী-প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। ঐ কার্য্যে মিথিলার অধ্যাপকগণও আগমন করেন। ঐ সময়ে অন্যরূপেও অনেক সদ্ব্যয় হইয়াছিল।

 বাবুগিরি করা, সদ্ব্যয়াদি দ্বারা দেশাবচ্ছিন্নে সুখ্যাতি লাভ করা, বাহ্যাড়ম্বর প্রদর্শন দ্বারা ছোট বড় সকলের কাছে সম্ভ্রম বৃদ্ধি করা; এগুলি কর্ত্তার ভাগ্যে প্রায় ঘটে না। পৃথিবীতে ইহার ভূরি উদাহরণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। কর্ত্তার ভাগ্যে ঘটে না, তাহার বিশেষ কারণই আছে। অর্থ উপার্জ্জ্বনের পথ আবিষ্কত করিতে এবং অর্থোপার্জ্জ্বন করিতেই তাঁহার জীবনের অধিকাংশ ও উৎকৃষ্টাংশ অতিবাহিত হইয়া যায়; পরবংশীয়েরাই ধন ভোগের অধিকারী। মুকুটরাম রায় বড় লোকের সন্তান হইয়াই উচ্চপদে আসীন ইইয়াছিলেন, তাঁহাকে গোবিন্দের ন্যায় মেছুনীর গালি খাইয়া, পিতা কর্ত্তৃক তিরস্কৃত হইয়া “টাকা রোজগার” করিবার জন্য গৃহত্যাগ করিতে হয় নাই। তাঁহাকে অযত্ন-রক্ষিত নিরভিভাবক বালকের ন্যায় তালগাছে উঠিয়া বিপদে পড়িতে হয় নাই; তাঁহাকে সন্ন্যাসীর শিষ্য হইয়া দেশে২ ভ্রমণ করিতে হয় নাই। তাঁহাকে পরান্নভোজী হইয়া স্বজন শূন্য দূরদেশে থাকিয়া লেখা পড়া শিখিতে হয় নাই। তাঁহাকে হঠাৎ উচ্চপদ লাভের, বিষম-সঙ্কট সকল অতিক্রম করিতে হয় নাই। তিনি একেবারেই নির্ব্বিঘ্নে বড়লোক হইয়া কার্য্য ক্ষেত্রে প্রবেশ করিবার অবসর পাইয়া ছিলেন। এইজন্যই তাঁহার অধিকতর যশঃ সর্ব্বত্র বিকীর্ণ হইয়াছিল। এইজন্যই তাঁহার আড়ম্ববানু গামিনী খ্যাতিতে, পিতৃ-কৃত্য পর্যন্ত বিলীন হইয়াছিল। এইজন্যই, গোবিন্দ চক্রবর্ত্তী, এদেশে মুকুটরাম রায়। বলিয়া খ্যাত হইয়াছিলেন।

 “নবদ্বীপ অঞ্চলের কে একজন, প্রতিজ্ঞা পূর্ব্বক সন্ন্যাসীর সঙ্গে বিদেশে গিয়া বড়লোক হইয়া আসিয়াছে।” ইত্যাদি সম্বাদ তাঁহার বাল্য বিবরণের সহিত প্রথমে সর্ব্বত্র প্রচারিত হয়। সেই ব্যক্তির অধ্যবসায়, আত্মবিলম্বন, সদাশয়তা প্রভৃতি ক্রমে প্রচারিত হওয়ায় “লোকটি কে?” জানিবার জন্য সকলেরই ইচ্ছা হইতে পারে; কিন্তু তৎকালে এদেশে মহৎ ব্যক্তির জীবন-চরিত অনুসন্ধানের প্রকৃত রীতি প্রচলিত না থাকায়, মুকুটরাম রায়ই, অনুসন্ধিৎসুগণের চক্ষে পতিত হইলেন। যেহেতু গোবিন্দ তাহার অনেক পুর্ব্বে অনধিক চারি পাঁচ বৎসর মাত্র রাজকার্য্য করিয়া পরলোক গত হইয়াছিলেন। অথচ অনুসন্ধান-কালে মুকুটরাম রায়ই, অধিকতর সমৃদ্ধির সহিত পিতৃপদে অভিষিক্ত ছিলেন। যখন লেখা পড়ার সাধারণ চর্চ্চা অধিক ছিল না, কোন বিষয়ের স্বরূপ নির্ণয়ে লোকের তত ইচ্ছা ছিল না, বঙ্গদেশের তাদৃশী অবস্থায় একজন, আর একজন বলিয়া খ্যাত হওয়া বড় অসম্ভব নহে।

 যে সকল গুণের প্রভাবে মানুষ সবিশেষ উন্নতি লাভ করেন; অধ্যবসায়, আত্মবলম্বন, সাহস দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি সেই সকলের মধ্যে প্রধান। গোবিন্দের জীবনে প্রথমাবধি ঐ গুণ গুলি ছিল বলিয়াই, তিনি তাদৃশী উন্নতি লাভে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি যখন সম্পূর্ণ বালক, পাখীর ছা পাইলে যেখানে সেখানে যাইতে পারিতেন, তখনই তাঁহাতে ঐ সকল গুণ স্ফ‌ুর্তি পাইয়াছিল। যে বয়সে অন্য বালক স্বগ্রাম মধ্যে একাকী বেড়াইতে সাহস করে না, সন্ধ্যার পর রুদ্ধ-দ্বার গৃহ মধ্যে থাকিয়াও “ভূত প্রেতনীর” ভয়ে চমকিয়া উঠে, গোবিন্দ সেই বয়সে অর্থোপার্জ্জন করিবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া গৃহ ত্যাগ করেন। কোথা যাইবেন, কি করিবেন, কে তাঁহার সহায় হইবে, তখন এসকলের স্থিরতা ছিল না। তিনি আপনি, আপনার অবলম্বন হইয়া গৃহ ত্যাগ করেন। গৃহ ত্যাগ করিয়াই, তালীয় তরুশিখরে অসামান্য প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও অসীম সাহসের পরিচয় দেন। পক্ষিশাবকের প্রত্যাশায় সন্ন্যাসীর সঙ্গে যথ তথা যাইতে সম্মত হওয়ায়, একদিকে যেমন বালকতা অন্যদিকে, তেমনি সাহস প্রকাশ পাইয়াছিল। তাঁহার বাল্য-জীবন পর্য্যালোচনা করিলে, কাহার না অন্তরে উৎসাহ-স্রোতঃ প্রবাহিত হয়? কাহার না, দুঃখের দশায় পড়িয়া অর্থোপার্জ্জ্বনের জন্য ঘর ছাড়িতে সাহস হয়? কাহার না পর প্রত্যাশী হইয়া মনুষ্য জীবনকে কলঙ্কিত করিতে ঘৃণা হয়? কাহারই বা আলস্যবশে বিবিধ বিড়ম্বনা ভোগ করিতে ইচ্ছা হয়?

 যে স্থলে পার্থক্য দ্বারা অনিষ্ট-সংঘটন হয়, অথবা ইষ্টোৎপত্তির ব্যাঘাত ঘটে, সেই স্থলে যিনি একীকরণের চেষ্টা করেন, তিনিই মহৎ। ইষ্টানিষ্টের লাঘব গৌরব অনুসারেই, মহত্ত্বের তারতম্য হইয়া থাকে। ধর্ম্ম, রাজ্য, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির মধ্যগত বিভিন্নতাকে লক্ষ্য করিয়াই লাঘব গৌরবের কথা উত্থাপিত হইতেছে। ধর্ম্ম যে সৎসারের প্রধান বস্তু এবং উহার পার্থক্যে বিষম অনর্থ সংঘটিত হইতে পারে একথা সকলেই স্বীকার করিবেন। এইজন্যই খ্রীষ্ট, মহম্মদ, নানক, চৈতন্য প্রভৃতি ধর্ম্মসংস্কারকগণ সর্ব্বজাতীয় লোককে এক ধর্ম্মে আহ্বান করিয়া জগদ্বিখ্যাত হইয়াগিয়াছেন। তাঁহাদের ন্যায় ভক্তি ও সম্মান লাভ করিতে আর কে পারিয়াছেন? এইজন্যই, প্রূসিয়ান্ রাজমন্ত্রী কাউণ্ট বিস‍্মার্ক জর্ম্মনির ক্ষুদ্ররাজ্য সকলকে একীভূত করিয়া তাদৃশ প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন। এইজন্যই বুদ্ধাবতার সকল জাতিকে একত্র একান্ন[৫] ভোজন করাইয়া এত মাহাত্ম্য লাভ করিয়াছেন। এবং এইজন্যই আমরা গোবিন্দ চক্রবর্ত্তীকে মহৎ ও সদাশয় বলিতে অধিকার লাভ করিয়াছি। এস্থলে কেহ যেন এমন মনে করিবেন না যে, গোবিন্দ উপরি উক্ত মহাত্ম-গণের সহিত সর্ব্বাংশে তুলিত হইলেন। কেবল কার্য্যগত আংশিক সাদৃশ্য হেতুই এস্থলে তাঁহার নাম গৃহীত হইতেছে।

 পূর্ব্বে বলা হইয়াছে, তিনি রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র ও বৈদিক এই তিন শ্রেণী-সন্নিবিষ্ট ব্রাহ্মণ বর্ণের একীকরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। ইহাই তাঁহার সদাশয়তা ও মাহাত্ম্যের পর্যাপ্ত প্রমাণ। সুনীতি শিক্ষা করা এবং উৎকৃষ্ট কার্য্যের “প্রস্তাব” করা, অপেক্ষাকৃত সহজ! আমরা কেবল তাহাতেই পণ্ডিত। বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহ রহিত করা, ধর্ম্মবিষয়ে স্বাধীন চিন্তা করা, ইচ্ছানুরূপ ব্যবসায়ে বুদ্ধি চালনা করা ইত্যাদি বিষয়ে কাহার অমত নাই; অন্যকে এই সকল কার্য্যে উপদেশ দান করিবার জন্য সভা, সমাজ, সম্বাদপত্র, গ্রন্থপ্রণয়নের ছড়াছড়ি হইতেছে। কিন্তু স্বয়ং কোন বিষয়ের প্রবর্ত্তক হইতে কাহারই সাহস হয় না। যিনি সভায় গিয়া তেজস্বিনী বক্তৃতা দ্বারা বাল্যবিবাহের প্রতিবাদ করিয়া আসেন, হয়ত তিনি আপনার দুই একটী বালিকা কন্যার বিবাহ দিয়া ফেলিয়াছেন, কিম্বা তাহাদিগের বিবাহ-সম্বন্ধ দেখিতেছেন। যিনি অপরের বিধবা ভগ্নী বা কন্যার পুনরুপর্যমে। সবিশেষ যত্নশীল, তিনি হয়ত, প্রাচীন গণের প্রশংসা প্রত্যাশায় বাড়ীর বিধবাদিগকে, একখানি পাইড়ওয়ালা কাপড় পরিতে দেখিলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আমরা যে২ বিষয়ে দুই একটা উদাহরণ প্রদর্শন করিলাম, দেশ-কাল-অবস্থানুসারে ইহার মধ্যে অনেক তর্ক চলিতে পারে। ফলতঃ অধুনাতন ব্যক্তিগণের নৈতিক সাহসের অভাব প্রতিপন্ন করাই আমাদের উদ্দেশ্য। বোধ হয়, গোবিন্দ চক্রবর্ত্তীর জীবন-চরিত পাঠ, আমাদের উক্ত বিধ চিত্ত-রোগ প্রতিকারের একটা ঔষধ হইতে পারে। তিনি স্বয়ং সাধু কার্য্যের প্রদর্শক হইয়াছিলেন। তাঁহার তিন পত্নীরই গর্ভজাত সন্তান-গণ জীবিত থাকিলে নিশ্চয়ই তাঁহার অভিপ্রায় সুসিদ্ধ হইত। মুকুটরাম রায়ই তাহার প্রমাণ। মুকুটের ন্যায় ক্ষমতাশালী তাঁহার রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ভ্রাতারা জীবিত থাকিলে কি তাঁহাদের বিবাহ হইত না? অবশ্যই হইত! সেই সঙ্গে সঙ্গেই তিন শ্রেণী মিলিত হইয়া আসিত।

 গোবিন্দের দুই পুত্র; রূপরাম ও মুকুটরাম। রূপরামের চারি পুত্র; —গোপাল রায়, চাঁদরায়, বেণীরায় এবং কেশব রায়। বেণীরায়ের বংশে সূর্য্যকুমার রায় নামক একটী মাত্র পুরুষ অদ্যাপি জীবিত আছেন। তিনিও প্রাচীন, তাঁহার স্ত্রী পুত্রাদি কিছুই নাই। ইনিই গোবিন্দ চক্রবর্ত্তীর শেষ বংশ ধর। গোবিন্দের পশ্চিম দেশস্থ কিঞ্চিৎ নষ্ট সম্পত্তি উদ্ধার করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিতেছেন। রূপরামের পুত্রেরা বর্গীর “হঙ্গামে” পূর্ব্বস্থলীর বাটী ত্যাগ করিয়া বাখরগঞ্জে গিয়া বাস করেন। বহুকাল পরে তাঁহার বংশীয়েরা পূর্ব্বস্থলীতে ফিরিয়া। আসেন। তখন তত্রত্য গৃহাদি জঙ্গলাকীর্ণ ও বন্য পশুর আবাস হইয়াছিল। কালক্রমে ঐ সকল অট্টালিকা গঙ্গার উদরসাৎ হইয়াছে। সূর্য্যকুমার উহার ভগ্নাবশেষ দ্বারা গঙ্গাতীর হইতে একটু দূরে সামান্য বাটী নির্ম্মাণ করিয়া বাস করিতেছেন। ঐ ভগ্নাবশেষ সকল অদ্যাপি, পূর্বস্থলীর গঙ্গাতীরে দৃষ্ট হয়। স্ত্রী পুত্র বিহীন জরাজীর্ণ সূর্য্যকুমারে এবং ভাগীরথীর স্রোতঃ-ধৌত ভগ্নাবশেষে অদ্যাপি গোবিন্দের চিহ্ন রহিয়াছে। কিন্তু যায়,—আর থাকে না।


  1. কামার কুলির কিঞ্চিৎ দক্ষিণে রামচন্দ্রপুর। এই রামচন্দ্রপুরে সুবিখ্যাত গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের মঠ আছে।
  2. তালের বাগুলা, দুই ধার করাতের ন্যায়। উহাকে তালীয় খড়্গ বলে।
  3. দেওয়ান।
  4. বর্দ্ধমান, যশোহর, পাটলি, কৃষ্ণনগর, সাতসইকে সমুদ্রগড়, আশাম, কিতব, যক্ষপুর ইত্যাদি।
  5. শ্রীক্ষেত্রের, সকল জাতির একত্রে অন্নগ্রহণ প্রণালী, বুদ্ধদেব প্রবর্ত্তিত।