দ্বিতীয় চরিতাষ্টক/দ্বারকানাথ ঠাকুর

উইকিসংকলন থেকে

দ্বারকানাথ ঠাকুর।

 ১২০১ সালে (১৭৯৪ খুঃব্দে) ইঁহার জন্ম হয়। তিনি তাঁহার পিতৃব্য রামলোচনের পোষ্য পুত্র। ঠাকুরদিগের বংশাবলীর বিষয় কিছু বলা আবশ্যক। কিছুকাল পূর্ব্বে এই বংশীয় এক ব্যক্তি একখানি পুস্তিকা বাহির করেন। উহাতে ভট্রনারায়ণকে, এই বংশের আদি পুরুষ বলা হইয়াছে। পুস্তিকাকার আপনাকে ভট্রনারায়ণ হইতে ত্রিংশত্তম পুরুষ বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার প্রকাশিত বেণীসংহার নামক নাটকের ভূমিকাতে, আদিশূরের রাজত্ব কালে বঙ্গদেশে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণ আসিয়াছিলেন তাঁহাদিগ হইতে তিনি দ্বাত্রিংশত্তম পুরুষ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। ঠাকুর গোষ্ঠীর শাণ্ডিল্য গোত্র। অতএব মুখোপাধ্যায় দিগের শ্রীহর্ষকে পূর্ব্ব পুরুষ বলিবার যেরূপ অধিকার, ভট্টনারায়ণকে পূর্ব্ব পুরুষ বলিবার ইঁহাদিগেরও সেইরূপ অধিকার। আদিশূরের চেষ্টায় আনুমানিক ৮৭০ বৎসর পূর্বে ভট্রনারায়ণ এদেশে আগমন করেন। এমত স্থলে বর্তমান ঠাকুর দিগের, ভট্রনারায়ণ হইতে ত্রয়স্ত্রিংশত্তম অথবা চতুস্ত্রিংশত্তম পুরুষ হওয়া সংশয়ের বিষয়। কুলীন কায়স্থ দিগের বংশ বিবরণ দ্বারাও পুস্তিকাকারের অনুমান সপ্রমাণ হয় না। অল্পকাল পূর্ব্বে রাজা রাধাকান্তদেব বাহাদুর কর্ত্ত‌ৃক কায়স্থদিগের যে একজাই হয়, ঐ উপলক্ষে কায়স্থ দিগের বংশ বিবরণ গ্রন্থে দৃষ্ট হয় যে, ঘোষ, বসু এবং মিত্র দিগের অষ্টবিংশতি পুরুষ হইয়াছে। এই সময়ের মধ্যে ঠাকুর দিগের বংশ এত বৃদ্ধি হওয়া সম্ভাবিত বোধ হয় না। ঘটকদিগের গ্রন্থে ভট্টনারায়ণ হইতে ষোড়শ পুরুষ হলধর নামক কোন ব্যক্তির উল্লেখ দেখা যায়। বর্ণিত আছে, ইনি একজন উৎকৃষ্ট আইনজ্ঞ এবং বঙ্গরাজের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। ইহাও বর্ণিত আছে। যে তিনিই গৌড়নগরের নির্ম্মাতা ও কৌলীন্যের সংস্থাপয়িতা। কিন্তু এসকল কথা, প্রমাণ সিদ্ধ ও ঘটনা-সঙ্গত নহে। পুনশ্চ জগন্নাথ নামক আর এক ব্যক্তির কথা শুনা যায়, ইনি ভট্রনারায়ণ হইতে চতুর্ব্বিংশ পুরুষ। ইনি পূর্ব্ব পুরুষের দৃষ্টান্তানুসারে কনোজ হইতে যশোহরে আসিয়া আবাস স্থাপন করেন এবং ইসবপুরের শূদ্ররাজা সুধারাষের রূপগুণ সম্পন্না কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। কথিত আছে, ঠাকুর গোষ্ঠী এই শঙ্কর বিবাহ নিবন্ধন জাতিচ্যুত ও পিরালী বলিয়া আখ্যাত হন। কিন্তু এ গুলি অনুমানমূলক কল্পনা, প্রকৃত ইতিহাসে দেখা যায় পঞ্চারামের পুত্র জয়রাম নামক কোন ব্যক্তি ঠাকুর পরিবারের স্থাপন কর্ত্তা। জয় রাম ২৪ পরগণার আমিন ছিলেন। জিলায় রাজস্ব আদায় করা তাঁহার কার্য্য ছিল। ঐ সময়ে গবর্ণমেণ্টের “ফোর্ট উইলিয়ম” নামক দুর্গ নির্মিত হইতেছিল। ঐ নির্মাণ কার্যের ভার যে বিভাগে অর্পিত ছিল, জয়রাম কোন গতিকে তাহতে যোগ দিয়াছিলেন। এ বিভাগ বর্ত্তমান পবলিক ওয়ার্ক বিভাগের অনুরূপ। বর্ত্তমান পরলিক ওয়ার্কে কিরূপ কার্য্য হয় এবং অর্থের কিরূপ সদ্ব্যবহার হয়, তাহা সকলেই অবগত আছেন। যাহা হউক, উক্ত দুর্গ নির্ম্মাণে প্রচুর অর্থ ও সময় লাগিয়াছিল। সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী হইতে সরদার মিস্ত্রী পর্যন্ত প্রত্যেকেই রাশীকৃত অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিল। যখন কার্য্যের উপযুক্তরূপ নিয়মাদি ছিল না, কর্ত্তৃপক্ষের তাদৃশ পর্য্যবেক্ষণ ছিল না, যে যত পারিত লুঠপাট করিত, তখন জয়রামও যদি অর্থোপার্জ্জনের প্রলোভন পরিত্যাগে সমর্থ না হইয়া থাকেন তাহা বিস্ময়ের বিষয় নহে। ষে রূপেই হউক, তিনি বিলক্ষণ সঙ্গতি ও পাঁচটা পুত্র রাখিয়া মরিয়াছিলেন, তন্মধ্যে দর্প নারায়ণ ও নীলমণি নামক দুইটী পুত্র, দুইটা পৃথক্ পরিবার স্থাপন করিয়া গিয়াছেন।

 জ্যেষ্ঠ দর্পনারায়ণ গৃহে থাকিয়া পৈতৃক বিষয়ের রক্ষা। ও সমধিক উন্নতি করিয়াছিলেন। নীলমণি আপন ভাগ্য পরীক্ষার্থ বিদেশে বহির্গত হইলেন। তিনি প্রথমে জিলা আদালতের কোন অধীন কর্ম্মচারীর পদ পান; কিন্তু, ক্রমে, অতি সত্বরই জিলার সেরেস্তাদারী পদ লাড করিয়াছিলেন। এই সেরেস্তাদারী পদ, তৎকালে অতিশয় দুর্লভ এবং বাঙ্গালীদিগের প্রাপ্য সর্ব্বপ্রধান পদের মধ্যে পরিগণিত ছিল। নীলমণি কলিকাতা স্থিত বাটীতে ভ্রাতার নিকট অর্থ পাঠাইতে লাগিলেন। কিছু কাল পরে যখন তিনি একেবারে কর্মত্যাগ করিয়া গৃহে আসিলেন, তখন তাঁহার গৃহপ্ররিত অর্থের হিসাবাদি লইয়া জ্যেষ্ঠের সহিত বিবাদ হইতে লাগিল। পরিশেষে তাঁহার পৈতৃক ও স্বোপার্জ্জিত অর্থের অংশ স্বরূপ ভ্রাতার নিকট হইতে আপোষ মীমাংসায় এক লক্ষ টাকা পাইলেন। এই টাকা লইয়া তিনি পৈতৃক গৃহ পরিত্যাগপূর্ব্বক যোড়াসাঁকোয় গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া বাস করিতে লাগিলেন। এই নীলমণির তিন পুত্র, রামলোচন, রামমণি এবং রামবল্লভ। রামমণির দুই স্ত্রী, প্রথমার গর্ভে দ্বারকানাথ ও রাধানাথ এবং দ্বিতীয়ার গর্ভে রমানাথের জন্ম হয়। রামলোচন নিঃসন্তান এই জন্য আপনার উত্তরাধিকারী রূপে দ্বারকানাথকে যখাশাস্ত্র পোয্যপুত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 দ্বারকানাথ প্রথমে গুরুমহাশয়ের পাঠশালে বাঙ্গালা শিখিয়াছিলেন। পরে চিৎপুর স্থিত সিরবোরন্ সাহেবের স্কুলে ইংরাজীর প্রথম শিক্ষা সম্পাদন করেন। এই স্কুলে অতি সামান্য সামান্য কয়েকখানি ইংরাজী পুস্তক পাঠ করিয়াছিলেন। তিনি স্কুলে যাহা শিখিয়াছিলেন তাহা যৎসামান্য। স্বাধীন চিন্তাশক্তি দ্বারা এবং মানবচরিত্র ও প্রকৃতি পুস্তক পর্য্যালোচনায় প্রচুর জ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন।

 তাঁহার বিদ্যালয়-শিক্ষার যে ন্যূনতা ছিল, বড় ২ সাহেবদের সংসর্গ ও উপদেশে তাহার পূরণ করেন। এই সংসর্গে বালক কাল হইতেই তাঁহার মন উন্নত হইয়াছিল। এবং এই সময়ে রাজা রামমোহন রায়ের[১] সহিত পরিচয় হওয়াতে ধর্ম ভাবেরও বিলক্ষণ স্ফুর্ত্তি হয়। দ্বারকানাথ প্রথমে পিতামহের ন্যায় খাটী হিন্দু ছিলেন; হোম ও পূজায় তাঁহার খুব শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু রামমোহন রায়ের শিক্ষায়, হিন্দুধর্ম্মের পৌত্তলিকতা ও আড়ম্বর বৃথা বলিয়া বুঝিলেন; এবং পরিশেষে সত্য ও আত্ম-ভাবে একেস্বরের উপাসনা করিতে শিখিয়াছিলেন।

 রামমোহন রায় সদৃশ হিন্দু দার্শনিকের সহিত নিরন্তর অধ্যয়ন, ধর্ম্ম চিন্তা ও তর্কবিতর্ক করতে এবং ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাপনাদি ধর্ম্ম-কার্য্যে তাঁহার সহযোগিতা ও সহায়তা করতে তাঁহার মন ধর্ম্মান্ধতা ও কুসংস্কার হইতে মুক্ত হইল। তাঁহার মন এইরূপে উন্নত হওয়াতে তিনি সমস্ত জীবন কার্য্যে দেখাইয়া গিয়াছেন যে, জাতি বিচার, ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের প্রতিকুল হওয়া উচিত নহে। দ্বারকানাথ তাঁহার প্রাচীন শিক্ষক সিরবোরন্ সাহেবকে কখনই বিস্মৃত হন নাই। সাহেব যতদিন জীবিত ছিলেন, দ্বারকানাথ তাহাকে নিয়মিত রূপে বৃত্তি প্রদান করিতেন। দ্বারকানাথ নিজ যত্নে উৎকৃষ্ট রূপে পারসী ও আরবী ভাষা অভ্যাস করিয়াছিলেন। তিনি আরবী ও পারসীতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন হইয়াও ঐ দুই ভাষায় সুচারুরূপে লিখিতে ও কহিতে পারিতেন।

 দ্বারকানাথের পালক পিতা যদিও অতিশয় ঐশ্বর্য্যশালী জমিদার ছিলেন না, তথাপি তাঁহার চাল চলন বড় মানুষী ধরণের ছিল। দ্বারকানাথ যে পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী হন, তাহা তৎকালীন হিন্দু পরিবারের অভাবপূরণে সমর্থ হইত; কিন্তু দ্বারকানাথ ঠাকুর সদৃশ ব্যক্তির পক্ষে তাহা সামান্য ছিল। সুতরাং তাঁহাকে নিজ যত্নেও পরিশ্রমে অনেক অর্থ উপার্জ্জন করিতে হইয়াছিল। একজন লেখক বলিয়া গিয়াছেন যে দারিদ্র্য ও অপরিমিত সম্পদশালিতার মধ্যবর্ত্তী অবস্থাতেই সুন্দররূপে মানসিক উন্নতি হইয়া থাকে। দ্বারকানাথ ইহার স্পষ্ট নিদর্শন।

 বালক কালেই তাঁহার পিতার মৃত্যু হয়। সুতরাং পৈতৃক বিষয়াদির ভার, তাঁহার উপরেই পতিত হইল। যে সকল জমিদারীর ভার তাঁহার গ্রহণ করিতে হয়, তন্মধ্যে পাবনার অন্তর্গত বহরমপুর নামক একটী জমিদারী ছিল। এই ভার গ্রহণে তাঁহার একটা বিশেষ উপকার এই হইল, অচির কাল মধ্যে তিনি জমিদারী কার্য্যে বিলক্ষণ দক্ষ হইয়া উঠিলেন। এই দক্ষতা উত্তর কালে তাঁহার অনেক কাজে লাগিয়াছিল। যেহেতু দেশের ব্যবহারিক ও রাজস্ব সম্বন্ধীয় অবস্থা ঐ জ্ঞানের উপর নির্ভর করিতেছিল। জমিদারী ও রাজস্ব পর্য্যালোচনা করিতে করিতে তাঁহার আইন শিক্ষার অভিলাষ হইল। আইন শিক্ষা বিষয়ে কট্লার ফরগুসন্ সাহেবের দ্বারা অনেক সাহায্য পাইয়াছিলেন। এই সাহেব সেই সময়ের এক জন প্রধান ব্যারিষ্টার ছিলেন। প্রথমাবস্থায় দ্বারকানাথের বুদ্ধির উন্নতি সাধন বিষয়ে রাজা রামমোহন রায় এবং ব্যবস্থাধ্যাপন বিষয়ে উপরি উক্ত সাহেবই প্রধান ছিলেন। তিনি যে কেবল দেওয়ানী আইনের মূল সূত্রগুলি শিখিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন তাহা নহে; আইন ব্যবসায়ীকে যেমন রীতিমত শিখিতে হয়, সর্ব্বপ্রকার আইন, তিনিও সেই রূপে শিখিয়াছিলেন। এইরূপে ব্যবস্থাজ্ঞ হইয়া ওকালতী আরম্ভ করিলেন। তৎকালীন অনেক গুরুতর মোকর্দ্দমার নিষ্পত্তি, তাঁহার হাত দিয়া হইয়াছিল।

 তিনি ওকালতী করিতে আরম্ভ করিয়া বড়২ রাজা ও জমিদারের বিশ্বাস ভাজন হইয়াছিলেন। কতকগুলি শক্র-হস্তু-গত প্রায় বিষয় বাঁচাইয়া দেওয়াতে তাঁহার ওকালতী কার্য্যের অত্যন্ত গৌরব বৃদ্ধি হইয়াছিল। সর্ব্বপ্রধান উকিল বলিয়া দেশ বিদেশে সুখ্যাতি হইল। বঙ্গদেশের এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান ২ ভূম্যধিকারিগণের বিশ্বাস্য উপদেশক ও ব্যবস্থা প্রতিনিধি হইলেন। বঙ্গদেশে রাণী কাত্যায়নী, রাজা বরদাকান্ত রায় প্রভৃতি তাঁহার মক্কেল ছিলেন। যে সময়ে দেশীয় ভিন্ন ২ শ্রেণীস্থ লোকদিগের মধ্যে কিছুমাত্র ঐক্য ছিল না; সদ্বিচার প্রাপ্তি সুরতি খেলার মত ছিল; রাজনীতি, কেবল প্রজাবর্গের অভাব ও ইচ্ছা বাড়াইতে ছিল; ঐ সময়ে ওকালতী কার্য্যে কৃতকার্য্য হওয়া অসাধারণ শক্তির পরিচয়।

 উপরি উক্ত কার্যের সঙ্গে ২ তিনি ইংরাজ বণিকগণের কলিকতাস্থ বাণিজ্য প্রতিনিধি হইলেন। নীল, রেশম প্রভৃতি এদেশীয় বাণিজ্য দ্রব্য ক্রয় করিয়া ইউরোপে পাঠাইবার জন্য জাহাজ বোঝাই করিয়া দিতেন। কেবল রাইতগণের নিকট হইতে খাজনা আদায় করা এবং বৃথা কার্য্যে সময় ক্ষেপণ করাই যে, জমিদারের কার্য্য নহে, দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বসমকালীন অকর্ম্মণ্য জমিদার দিগকে তাহার শিক্ষা দিয়াছিলেন। এইরূপে তিনি কি দেশীয় কি বিদেশীয় উভয় জাতির মধ্যেই আপনার পদ স্থাপন ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করিয়াছিলেন।

 এই সময়ে ২৪ পরগণার নিমকি কালেকটরের আফিসে সেরেস্তাদারের পদ খালি হয়। দ্বারকানাথ ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন। খুব সুখ্যাতির সহিত কাজ করিতে লাগিলেন। এই কার্য্য করিতে ২ ক্রমে সদর যোর্ডের দেওয়ান হইলেন। বহুবৎসর অত্যন্ত কার্য-দক্ষতা ও প্রশংসার সহিত ঐ কার্য করিয়া নিজের কার্য্য বাহুল্য প্রযুক্ত ইচ্ছাপূর্ব্বক ঐ পদ পরিত্যাগ করিলেন। তাঁহার এস্তোবা পাইয়া বোর্ডের সেকরেটারি পারকার্ সাহেব যারপর নাই দুঃখিত হন এবং যথেষ্ট সুখ্যাতি ও তাঁহার কার্য্য নৈপুণ্যের বিচার করিয়া তাঁহাকে দুইখানি পুত্র লেখেন। ঐ পত্র দুই খানি এস্থলে উদ্ধৃত করা যাইতে পরিত; কিন্তু সংক্ষিপ্ততা এই গ্রন্থের একটা উদ্দেশ্য বলিয়া তাহা হইল না। বোর্ডের কাজ ছাড়িয়া দিয়া তিনি ইউরোপীয় প্রণালীতে কারবার আরম্ভ করিলেন। সব প্রথমে দ্বারকানাথ ঠাকুর এদেশে ইউরোপীয় প্রণালীর বাণিজ্যালয় স্থাপন করলেন বলিয়া তৎকালের গবর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিক্ বাহাদুর তাঁহাকে একখানি অভিনন্দন পত্র প্রদান করেন। যেহেতু তৎকালে কেহই এরূপ স্বাধীন ব্যবসায় অবলম্বন করিতে সাহসী হন নাই। সকলেই বিলাতী কুঠির মুছদ্দিগিরি করিয়া এবং দস্তুরির লাভে সন্তুষ্ট হইয়া কালযাপন করিতেন। সুতরাং এতাদৃশ সময়ে এরূপ সদনুষ্ঠান দর্শনে গবর্ণর বাহাদুর সন্তুষ্ট হইয়া পত্র দ্বারা দ্বারকানাথকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন। ইহা-একজন বাঙ্গালীর পক্ষে সামান্য গৌরবের বিষয় নহে।

 দ্বারকানাথ ঠাকর ইহার পর আর কয়েক জন বড় ২ সাহেব ও বাঙ্গালীর সহিত মিলিত হইয়া একটা ব্যাঙ্ক‌্, স্থাপিত করেন। ক্রমে নীল, রেশম ও চিনির কুটী করিয়া ছিলেন। রাণীগঞ্জে কয়লার কাজ চালাইতেও আরম্ভ করিয়াছিলেন। দ্বারকানাথ ওকালতী, স্বাধীন বাণিজ্য, কুঠির কাজ প্রভৃতিতে যেমন কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন, জমিদারী কার্য্যেও সেইরূপ। পৈতৃক জমিদারী ব্যতীত তিনি নিজে অনেক ভূসম্পত্তি ক্রয় করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে রাজসাহীর অন্তর্গত কালীগ্রাম, পাবনার অন্তর্গত সাহাজাদপুর, রংপুরের মধ্যে স্বরূপপুর, মণ্ডলঘাটের তের আনা অংশ, দ্বারবাসিনী, জগদীশপুর, যশোহরের অন্তর্গত মহম্মদসাহী প্রভৃতি প্রধান। এতদ্ব্যতীত আরও অনেক জমিদারী তিনি স্বয়ং ক্রয় করেন। কিন্তু এই সময়ে তাঁহার পৈতৃক জমিদারী পাবনার অন্তর্গত বহরমপুর, তাঁহার পক্ষে বড় বিরক্তিকর হইয়া উঠিয়াছিল। তত্রত্য প্রজারা ঐকমত্য অবলম্বনপূর্ব্বক খাজনা দেওয়া রহিত করে এবং নায়েব গোমস্তার পীড়ন হইতে নিস্কৃতি পাইবার প্রার্থনায় মাজিষ্টরের কাছে দরখাস্ত দেয়। মাজিষ্টর স্বয়ং তত্ত্বানুসন্ধান করিবার জন্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইলেন এবং প্রজাগণকে জমিদারের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার আশা দিলেন। প্রজারা হুজুরের প্রশ্রয়ে আরও উদ্ধত হইয়া উঠিল। দ্বারকানাথ এই সম্বাদ পাইয়া মাজিষ্টরকে শিক্ষা দিবার উপায় অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। মাজিষ্টরের কতকগুলি পূর্ব্বকৃত অপরাধ সন্ধান করিয়া তিনি নিজে বহরমপুরে গমন করিলেন এবং একদিন রাত্রে সাহেবের তাম্বুতে গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিলেন। প্রথমে সাহেবকে কহিলেন যে, একপক্ষের কথা শুনিয়া বিশ্বাস করা তাঁহার অন্যায় হইতেছে এবং প্রজারা যে সকল অত্যাচারের কথা সাহেবকে জানাইয়াছে, তাঁহার কর্ম্মচারিগণের দ্বারা সেরূপ অত্যাচার হয় না। অতএব সাহেব প্রজাদিগের পক্ষতা পরিত্যাগ করুন। সাহেব একথায় সন্তুষ্ট না হইয়া ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। তখন দ্বারকানাথ, সাহেবকে পূর্ব্বাপরাধ গুলি স্মরণ করাইয়া তাঁহাকে পুলিসে অর্পণ করিবার ভয় প্রদর্শন করিলেন। সাহেব তখন সুপথে আসিয়া সকল গোল মিটাইয়া দিলেন। একে সাহেব, তাহে জিলার হর্ত্তাকর্ত্তা, তাঁহার সঙ্গে এমন অসম সাহসের কার্য্য, বোধ হয়, দ্বারকানাথের পুর্ব্বে বা পরে কোন বাঙ্গালীই, করিতে পারেন নাই।

 দ্বারকানাথ আপনার স্বার্থ রক্ষার্থ যেমন উদ্যোগী ও তৎপর ছিলেন; পরার্থ রক্ষা ও পরের অভাব দর্শনেও ঠিক সেইরূপ ছিলেন। ইহার একটি উদাহরণ পূর্ব্বে দেওয়া গেল। আর একটা নিম্নে প্রকটিত হইতেছে।

 কোন সময়ে একজন জিলা জজ্ পীড়িত হইয়া বিলাত গমনার্থ বিদায় লইয়াছিলেন। তাঁহার একলক্ষ টাকা ঋণ ছিল। ঋণ পরিশোধের কোন উপায় ছিল না। তিনি স্বদেশে যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন শুনিয়া উত্তমর্ণেরা তাঁহাকে কারাগারে দিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সাহেব এই বিপদের সম্বাদ পাইয়া চিন্তা সাগরে মগ্ন হইলেন এবং তাদৃশ অসুস্থাবস্থায় কারাযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইলে নিশ্চয়ই তাঁহার মৃত্যু হইবে, এইরূপ স্থির করিলেন। অনেক ভারিয়া চিন্তিয়া সাহেবের দ্বারকানাথ ঠাকুরকে মনে পড়িল। কারণ তৎকালে বড়২ সাহেবেরা দ্বারকানাথ ঠাকুরকেই উদার ও বদান্য বলিয়া জানিতেন। কিন্তু তাঁহার সহিত সাহেবের কোন কালে চাক্ষুষ পরিচয় ছিল না। জজ্ আপনার বিপদ বিজ্ঞাপন করিয়া দ্বারকানাথকে পত্র লিখিলেন। দ্বারকানাথ অবিলম্বে সবিশেষ অনুসন্ধান করিয়া সাহেবের উত্তমর্ণগণকে একলক্ষ টাকা দিলেন। তাহাদিগের নিকট সাহেবের যে সকল খৎ ও রসিদ্ ছিল তাহা গ্রহণ করিলেন। এই সকল কাগজের সহিত দ্বারকানাথ জজের নিকট গমন করিলেন এবং আপনি আপনার পরিচয় দিলেন। সাহেব মহাসন্তুষ্ট হইয়া আপনার বিপদের কথা সবিস্তারে বলিতে আরম্ভ করিলেন। সাহেবের কথা শেষ না হইতেই উল্লিখিত খৎ ও রসিদ সকল তাঁহার সম্মুখে অর্পণ করিলেন। সাহেব তদ্দর্শনে বিস্মিত হইয়া অশ্রুপূর্ণ লোচনে দ্বারকানাথের নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন এবং তাঁহাকে শত২ ধন্যবাদ দিলেন। পরিশেষে জজ্ দ্বারকানাথকে ঐ টাকার জন্য একখানি খত্ লিখিয়া দিতে চাহিলেন। কিন্ত‌ু দ্বারকানাথ এই বলিয়া তাহা লইতে অস্বীকার করিলেন যে, সাহেব উপস্থিত পীড়া হইতে অব্যাহতি না পাইলে খৎ লওয়া বৃথা; পক্ষান্তরে তিনি আরোগ্য লাভ করিয়া ভারতবর্যে প্রত্যাগত হইলে অবশ্যই টাকা দিবেন। এস্থলে ইহাও বলা আবশ্যক যে, সাহেব সুস্থ হইয়া এদেশে আসিয়া দ্বারকানাথের ঋণ পরিশোধ করিয়াছিলেন।

 এইরূপ দয়া ও বদান্যতার কার্য্য তাঁহার অনেক ছিল। সময়ে ২ নগদ টাকা দিয়া অনেকের সাহায্য করিতেন। অনুরোধ পত্র দ্বারা সওদাগরি অফিসে ও গবর্ণমেণ্ট আফিসে অনেক বাঙ্গালী ও সাহেবের চাকরী করিয়া দিয়াছিলেন। কোন সময়ে তাঁহার একজন সহাধ্যায়ী দুরবস্থায় পড়িয়া সাহায্য প্রার্থনায় তাঁহাকে একপত্র লেখেন। দ্বারকানাথ পত্র পাইবামাত্র এক কালে তাঁহাকে পাঁচশত টাকা পাঠাইয়া দেন এবং তাঁহাকে এই সঙ্গে পত্র লিখিলেন যে, তিনি কলিকাতা আইলে, চিরকালের জন্য তাঁহার ভরণপোষণের উপায় করিয়া দিবেন।

 উপরি উক্ত জজ্ সাহেবকে এককালে লক্ষ টাকা দিয়া সাহায্য করিয়াছিলেন। দিবার সময়ে, টাকা পুনঃপ্রাপ্ত না হইবারই সম্ভাবনা ছিল। এমন স্থলে, তাহার সহিত তুলনা করিলে সহাধ্যায়ীকে পাঁচশত টাকা দান করা সামান্য কার্য্য বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু এই শেষোক্ত কার্য্য দ্বারা তাঁহার চরিত্রের প্রকৃতভাব অবগত হওয়া যাইতেছে। দ্বারকানাথ স্বার্থ ও পরার্থ সমদৃষ্টিতে দেখিতেন। লোক চরিত্রের মন্দাংশ গ্রহণ করাই, লোকের প্রকৃতি। এইজন্য অবিশেষজ্ঞ লোকের মধ্যে তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে একটী কুসংস্কার আছে। ঐ সকল লোকে তাঁহাকে স্বার্থ ও বঞ্চনা পরায়ণ বলিয়া জানেন। তাঁহারা এমন মনে করিতে পারেন যে, বিপন্ন জজ্কে লক্ষ টাকা দিয়া সাহায্য করায় হয়ত দ্বারকানাথের কোনরূপ স্বার্থ সাধনের মতলব ছিল। কিন্তু একজন সহধ্যায়ী সামান্য বাঙ্গালীকে এককালে পাঁচশত টাকা দিয়া সাহায্য করায় সেরূপ মতলবের সম্ভাবনা ছিল না। এইজন্যই আমরা বলিয়াছি, এ কার্য্যটিতে তাঁহার অন্তরের প্রকৃত ভাব প্রকাশ পাইয়াছে। প্রকৃত সত্য কোনরূপেই আচ্ছন্ন থাকে না। তাঁহার এতাদৃশ অনেক কার্য্য লক্ষিত হইবে।

 দ্বারকানাথের পূর্ব্বতন প্রভু ও পরম বন্ধু প্লাউডেন্ সাহেব, দ্বারকানাথের অনুরোধে, ২৪ পরগণধর কালেকটারের কাছারীতে অনেক লোকের কর্ম্ম করিয়া দেন। সাহেব তখন ২৪ পরগনার কালেক‍্টার ছিলেন। কোন সময়ে ঐ সকল কর্ম্মচারীর মধ্যে একজন কতকগুলি টাকা চুরি করে। গবর্নমেণ্ট তজ্জন্য প্লাউডেন্ সাহেবকে ঐ ক্ষতিপূরণ করিতে আদেশ করেন। দ্বারকানাথ ইহা জানিতে পারিয়া সাহেবকে এই মর্ম্মে পত্র লিখিলেন যে, “আমি ঐ ক্ষতিপূরণ করিতে বাধ্য, যেহেতু আমার অনুরোধেই ঐ ব্যক্তিকে কর্ম্ম দেওয়া হইয়াছিল।” প্লউডেন্ সাহেব যারপর নাই সন্তোষ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া ঐ পত্রের উত্তর দেন।

 দ্বারকানাথ ২৪ পরগনার দাতব্য চিকিৎসালয়ে এক লক্ষ টাকা দান করিয়াছিলেন। নিরাশ্রয় অন্ধগণের সাহায্য নিমিত্ত ঐ টাকায় একটী ফণ্ড হইয়াছিল। ঐ ফণ্ডের জন্য কয়েক জন প্রধান সাহেব ট্রষ্টি নিযুক্ত হন। ট্রষ্টিগণের অন্যতম পার্কার সাহেব দ্বারকানাথকে এক পত্র লেখেন। ঐ পত্রের একাংশে এইরূপ লেখা আছে। “আমি বহু কাল হইতে আপনার অন্তরের পবিত্রতা, নিঃস্বার্থতা এবং অতুল্য দয়ার বিষয় এত অধিক পরিমাণে অবগত আছি যে, আপনার এই অসামান্য দান দেখিয়া, অন্যে বিস্মিত হইতে পারে, কিন্তু, আমি বিস্মিত হইলাম না।” তাঁহার সময়ে কি শিক্ষা সম্বন্ধে কি অন্যবিধ দয়ার কার্য্যে, যেখানে যে কোন ঘটনা উপস্থিত হইত, তিনি সর্ব্বত্রই অজস্র দান করিতেন। যাবতীয় সাধারণ কার্য্যের চাঁদার পুস্তকে তাঁহার নাম লিখিত হইত। সৎকার্য্যে দান করিবার জন্য তাঁহার মুদ্রাধার সর্ব্বদা মুক্ত থাকিত।

 এদেশীয় দিগকে বিদ্যা শিক্ষা দিবার জন্য গবর্ণমেণ্টের যে শিক্ষা-সভা ছিল, দ্বারকানাথ তাহার একজন সুযোগ্য এবং পরমোদ্যোগী সভ্য ছিলেন। তিনি হিন্দু কলেজকে ভারতবর্ষের সর্ব্বপ্রকার উন্নতির দ্বার মনে করিতেন। এইজন্য তাহার উন্নতি ও স্থায়িত্ব পক্ষে সবিশেষ চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। ১২৪৩ সালে কলিকাতার মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। তিনি স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া উহার ছাত্রগণের উৎসাহ বর্দ্ধনার্থ তিন বৎসর অন্তর দুই হাজার টাকা পারিতোষিক দিতেন। তিনি এই দান করিবার সময় কলেজের অধ্যক্ষগণকে যে পত্র লেখেন, তাহাতে এই অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, তাঁহার যে সকল স্বদেশীয় ছাত্র কলেজে অধ্যয়ন করে, কেবল মাত্র তাহাদিগেরই উৎসাহ বর্দ্ধনার্থ ঐ টাকা ব্যয় করা হইবে। মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হইবার সময়ে শারীর-বিজ্ঞান শিক্ষার একটা বিষম ব্যাঘাত উপস্থিত হইয়াছিল। শবব্যবচ্ছেদে হিন্দু ছাত্রগণ আপত্তি উপস্থিত করেন। দ্বারকানাথ ইহা জানিতে পারিয়া কলেজের ব্যবচ্ছেদ গৃহে প্রতিদিন স্বয়ং উপস্থিত হইতেন। এবং ছাত্রগণকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিতেন যে, ইহাতে তাহাদের জাতিপাত বা অধর্ম্ম হইবে না, বরং তদ্বারা শরীর-বিজ্ঞান শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া উৎকৃষ্ট চিকিৎসক হইবেন। তিনি কিছুকাল এইরূপ চেষ্টা করায়, হিন্দু ছাত্রগণের কুসংস্কার ও অমূলক আপত্তি অন্তরিত হইল।

 আমরা প্রথম চরিতাষ্টকে রাজা রামমোহন রায়ের জীবন-চরিতে সতীদাহ ও সতীদাহ-নিবারণ বিষয়ক বিবরণ সংক্ষেপে সংগ্রহ করিয়াছি। এস্থলে কেবল এইমাত্র বক্তব্য যে, দ্বারকানাথ ঠাকুরও ঐ বিষয়ে এক জন প্রধান উদোগী ছিলেন। তজ্জন্য লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক বাহাদুরের স্ত্রী লেডি বেণ্টিঙ্ক বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে একখানি পত্র লেখেন।

 এদেশীয় জমিদার গণের কিরূপ ক্ষমতা, উত্তমরূপে সেই ক্ষমতার পরিচালন করিতে পারিলে দেশের কিরূপ উন্নতি হইতে পারে এবং তাহা গবর্ণমেণ্টের সুশাসন পক্ষে কতদূর পোষকতা করিতে পারে, দ্বারকানাথই প্রথমে তাহা অনুভব করিয়াছিলেন। এইজন্য তিনি গবর্নমেণ্ট ও জমিদারের মধ্যে “জমিদারের সভা” নাম দিয়া একটা সভা স্থাপন করেন। ১২৪৫ সালে উহা স্থাপিত হয়। এই সভার দ্বারা উভয়ের পত্রাদি সম্বন্ধ হইত। এই সভা স্থাপন বিষয়ে গবর্নমেণ্টের অনুমোদন প্রার্থনা করিয়া এক আবেদন করা হয়। গবর্নমেণ্ট সে আবেদন গ্রাহ্য করেন। তৎকালীন “ইংলিসম্যান্” সম্পাদক হারি সাহেব এবং বাবু প্রসন্ন কুমার ঠাকুর এই দুই ব্যক্তি অভিনর সভার সম্পাদক হইয়াছিলেন। কিন্তু দ্বারকানাথই ইহার জীবন স্বরূপ ছিলেন। ঐ সভার নাম এক্ষণে “ব্রিটিস্ ইণ্ডিয়ান্ এছোছিয়েসন্” হইয়াছে এবং উহার ক্ষমতাও, পূর্ব্বাপেক্ষা অনেক বর্দ্ধিত দেখা যাইতেছে। এক্ষণে উহা, কেবলমাত্র জমিদারের প্রতি নিধি না থাকিয়া, উচ্চশ্রেণীস্থ প্রায় যাবতীয় লোকের প্রতিনিধি হইয়াছে। উহার দ্বারা দেশের যে কিছু হিত সাধিত হইতেছে, দ্বারকানাথই তাহার মূল।

 লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক‍্ বাহাদুরের রাজ্যশাসনে এদেশীয় প্রজাগণ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। এইজন্য দ্বারকানাথ সংস্কৃত কলেজ গৃহে তৎকালীন প্রধান প্রধান দেশীয় ব্যক্তিগণকে আহ্বান করিয়া বেণ্টিঙ্ক বাহাদুরকে এক অভিনন্দন পত্র প্রদান করেন। সেই অভিনন্দন পত্রিকার প্রত্যুত্তরে গবর্ণর বাহাদুর যে পত্র লেখেন, তাহার মর্ম্ম এইরূপ—“ভারতবর্ষে ইংরাজরাজ শাসনের ফলাফল কেবল একমাত্র তুমিই বিশেষ রূপে বিচার করিতেছ।”

 ১২৪২ সালে দ্বারকানাথ উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ভ্রমণে যাত্রা করেন। তখন রেলওয়ে হয় নাই। তিনি ডাকের গাড়ীতে তদ্দেশীয় যাবতীয় প্রধান প্রধান নগর, দেবায়তন, ও তীর্থ ভ্রমণ করিয়াছিলেন। বৃন্দাবনে দশ হাজার টাকা ব্যয় করিয়া তত্রত্য উচ্চশ্রেণীস্থ চৌবে উপাধিধারী ব্রাহ্মণগণকে ভোজ দিয়া ছিলেন। তিনি যখন আগরার দুর্গ দর্শনে যান, তখন কতকগুলি খৃষ্টিয়ান্ সৈনিক তাঁহাকে আপনাদের উপাসনা গৃহের দুরবস্থা দেখাইয়া সাহায্য প্রার্থনা করে। দ্বারকানাথ সবিশেষ অনুসন্ধান। করিয়া তাহাদিগকে পাঁচশত টাকা দান করেন।

 বিলাতের সহিত ভারতবর্যের সংস্রব, এদেশের জ্ঞান, সভ্যতা ও উন্নতি পক্ষে বিশেষ সহায়তা করিয়াছে তাহার সন্দেহ নাই। বাষ্পীয় পোতই ঐ সংস্রব বন্ধনের প্রধান হেতু। যেমন স্থলপথে রেলওয়ে কোম্পানি, তেমনি সমুদ্র পথে কলের জাহাজ চালাইবার কোম্পানি আছে। ভারতবর্ষ ও ইংলণ্ডের মধ্যে ঐ কোম্পানির কার্য্য আরম্ভ করাইবার জন্য দ্বারকানাথ সবিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম করিয়াছিলেন। তিনি দুরদর্শনের দ্বারা বুঝিয়া ছিলেন যে, এই সম্বন্ধে এদেশের বিশেষ উন্নতি হইবে। দ্বারকানাথ, ইংরাজী, বাঙ্গালা ও দ্বিভাষী সম্বাদ পত্র সকলের বিশেষ উৎসাহ দাতা ছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করিতেন যে, সম্বাদ পত্রই, দেশের উন্নতি সাধনের প্রধান যন্ত্র। এইজন্য তৎকালীন প্রধান ইংরাজী সম্বাদ পত্রের উন্নতি সাধনে তিনি প্রধান সহায় ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের “প্রভাকরকে” তিনি ভাল বাসিতেন। টাকা দিয়া সাহায্য করিতেন এবং কাগজে উৎকৃষ্ট প্রস্তাব সকল প্রকাশ করিবার জন্য সম্পাদককে পরামর্শ দিতেন। শত্রুকে কিরূপে নিরস্ত্র করিতে হয়, অন্যাপেক্ষা দ্বারকানাথ তাহা উত্তমরূপে বুঝিতেন। তাঁহার সময়ে “জ্ঞানান্বেষণ” নামক একখানি সম্বাদপত্র প্রচারিত হইত। হেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক রসিককৃষ্ণ মল্লিক তাহার সম্পাদক ছিলেন। তিনি একদা, আপনার কাগজে দ্বারকানাথের নিন্দা প্রচার করেন। এই অপরাধে, সম্পাদককে প্রহার করিবার জন্য দ্বারকানাথ অনেক বন্ধুর কাছে পরামর্শ পাইয়া ছিলেন। কিন্তু দ্বারকানাথ এই সকল পরামর্শ অগ্রাহ্য করিয়া রসিক বাবুকে ভোজে নিমন্ত্রণ করেন এবং তাঁহাকে নম্রভাবে বুঝাইয়া দেন যে, সম্পাদক তাঁহার নিন্দা প্রচার বিষয়ে ভ্রমে পতিত হইয়াছেন। তদবধি দ্বারকানাথের চরিত্র বিষয়ে, সম্পাদকের মত ফিরিয়া যায়।

 ভারতবর্য পরাধীন হইয়াও একটি উৎকৃষ্ট সৌভাগ্য ভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছেন, যাহা সভ্যতম ইউরোেপ খণ্ডের অনেক লোকে অদ্যাপি প্রাপ্ত হন নাই। তাহার নাম মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা। পূর্ব্বে ইহা এদেশে ছিল; পত্রিকা সম্পাদকেরা রাজকার্যের ফলাফল স্বাধীন ভাবে বিচার করিতে পারিতেন না। ১২৪৫ সালে সর্ চারলস্ মেট্ কাফ্ বাহাদুরের শাসনকালে যন্ত্রের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ঐ স্বাধীনতা প্রাপ্তি বিষয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুর কত যত্ন, কত চেষ্টা, কত পরিশ্রম ও কত উৎসাহ প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহা সবিস্তরে লিখিবার অবসর নাই। নিম্নে তৎকালীন এক খানি পত্র এবং পার্কার সাহেবের বক্তৃতার মর্ম্ম সঙ্কলন করিলাম; বোধ হয়, পাঠক, তদ্বারাই তদ্বিষয়ক জ্ঞান লাভে সমর্থ হইবেন। এদেশের হিতৈষী প্রধান প্রধান ইংরাজ ও বাঙ্গালী, মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা দান নিবন্ধন গবর্ণর বাহাদুরকে অভিনন্দন দিবার মানসে একত্র সমবেত হন। দ্বারকানাথ ঐ সভাস্থলে উপস্থিত হইতে না পারিয়া সভাপতিকে এইরূপ পত্র লিখিয়াছিলেন। “দেশীয় জমিদার ভাবেই হউক, বণিক ভাবেই হউক, কিম্বা অন্যাপেক্ষা গবর্ণমেণ্টের নিকট বিশেষ পরিচিত এই জন্যই হউক, এতাদৃশ মহৎ বিষয় উপলক্ষে কিছু বলা, আমি আমার কর্ত্তব্য জ্ঞান করি। এ পর্যন্ত গবর্ণমেণ্ট যত প্রকার হিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছেন, যন্ত্রের স্বাধীনতা দান তন্মধ্যে প্রধান। যেহেতু এই স্বাধীনতা, ভারতরাজ্য শাসন বিষয়ে ইংলিস গবর্ণমেণ্টের বিশেষ সাহায্য করিবে। এই স্বাধীনতা দ্বারা, শাসন-কর্ত্তৃগণের ন্যায়পরতায়, ভারতবাসিগণের সহজেই বিশ্বাস হইবে, কারণ ইহা দ্বারা প্রজাগণকে রাজকার্য্যের ফলাফল বিচারের ক্ষমতা দেওয়া হইতেছে।” ঐ সভায়, সহকারী সভাপতি পার্কার সাহেব দ্বারকানাথকে লক্ষ্য করিয়া এইরূপ বক্তৃতা করেন। “আমি যে নামের সম্মান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম তাহা এ দেশের মধ্যে প্রধান; তাঁহার দ্বারা রক্ষিত বা তাঁহার সৎপরামর্শ ও বদান্যতার ফলভোগী এতাদৃশ শত শত ব্যক্তি সেই নাম সতত স্মরণ করে; যাহারা তাঁহার অসীম দয়া ও দাতৃত্বের ফল ভোগ করিয়াছে, এতাদৃশ সহস্র সহস্র ব্যক্তির চিত্ত-ক্ষেত্রে সেই নাম অঙ্কিত আছে; কি বিদ্যালয়ে, কি চিকিৎসালয়ে, কি বিজ্ঞান ও সাহিত্য সমাজে যে নাম অহোরহ প্রতিধ্বনিত হইতেছে; আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায়, দয়া, দাক্ষিণ্য ও ঔদার্য্য বিষয়ে যে নামের উপমা দিতে পারে না; আমরা আজ যে বিষয়ের জন্য সমাগত হইয়াছি, তাহার সহিত যে নাম অনপনেয়রূপে সম্বদ্ধ, আমি আমার পরম বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সেই নাম সকলের সমক্ষে গ্রহণ করিতেছি।—”

 কলিকাতায় পটোলডাঙ্গাস্থিত “ফিবার হস‍্পিটাল” স্থাপন সময়ে যে কমিটি নিযুক্ত হয়, দ্বারকানাথ সেই কমিটীর এক জন প্রধান সভ্য ছিলেন। অন্তরের সহিত ঐ কমিটীর কার্য্য করিয়াছিলেন। মৃত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ ঐ কার্য্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা এবং বাবু মতিলাল শীল ভূমি দান করেন। তিনি দেশীয়গণের মধ্যে যেরূপ সম্ভ্রম ও প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, সাহেবদিগের মধ্যেও সেইরূপ। বড় বড় সাহেবের চরিত্র শোধনের জন্য তাহাদের সমক্ষে দোষের কথার উল্লেখ করিতে সঙ্কুচিত হইতেন না। এইরূপে ক্রমে ক্রমে তিনি দেশের মধ্যে সর্ব প্রধান হইয়া উঠিলেন। লর্ড অক‍্লণ্ড বাহাদুর এদেশের হিতানুষ্ঠান সম্বন্ধে সর্ব্বদা তাঁহার সহিত পরামর্শ করিতেন। জমিদারের সহিত গবর্নমেণ্টের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্বন্ধীয় প্রস্তাব লইয়া সর্ব্বদাই কথোপকথন হইত। প্রতি বৃহস্পতিবারে দ্বারকানাথের সহিত লর্ড বাহাদুরের সাক্ষাৎ হইত। বারাকপুরে, দ্বারকানাথকে প্রায়ই নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যাইতেন। দ্বারকানাথ বলিতেন, এবং তাঁহারি কার্য্যের দ্বারা বুঝা যাইত যে, এদেশের হিতসাধন করাই তাঁহার লক্ষ্য। তাঁহার সকলই অদ্ভত! বাবুগিরি, সাহেবি চাল চলনেরও চুড়ান্ত করিয়া গিয়াছেন। বেলগাছিয়ায় একটা উদ্যান করিয়াছিলেন। তেমন উদ্যান এ দেশের কোন বড়মানুষের ছিল না। উহা এ দেশের যাবতীয় জ্ঞানী, ধনী, ধার্ম্মিক ও রাজনীতিজ্ঞের আরামস্থল ছিল। গবর্ণর জেনেরল পর্য্যন্ত ঐ বাগানে নিমন্ত্রণে যাইতেন।

 অতঃপর দ্বারকানাথ ঠাকুর ১২৪৮ খৃঃ অব্দে ইউরোপ যাত্রার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁহার ঐ অভিপ্রায়, পরবৎসর জানুয়ারি মাসে কার্য্যে পরিণত হয়। বিলাত যাত্রা কালে, তিনি এ দেশের অনেক প্রধান প্রধান কমিটী হইতে অনেক অভিনন্দন পত্র পাইয়াছিলেন এবং সেই সকল পঞ্জের উত্তর দিয়াছিলেন। তিনি ১২৪৯ সালে (১৮৪২ খৃঃ অব্দের ৯ই জানুয়ারি) “ইণ্ডিয়া” নামক পোতারোহণে বিলাত যাত্রা করেন। তাঁহার ভ্রাতা রমানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাপ্রসাদ রায় এবং অন্যান্য ইউরোপীয় বন্ধুগণ তাঁহার সমভিব্যাহারে গমন করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁহার বিলাত যাত্রার এক খানি দৈনিক বিবরণ লিখিয়াছিলেন। ভাহাতে, কোথায় কোথায় গিয়াছিলেন, কোথায় কি করিয়াছিলেন, সমুদায় চিত্রিত করা আছে। কলিকাতা হইতে লণ্ডন্ যাবার পথে যেখানে যে কিছু দর্শনীয় আছে, দ্বারকানাথ তাহার সকলই দেখিয়াছিলেন, প্রধান প্রধান স্থানে দুই এক দিন ছিলেন;—সর্ব্বত্রই রাজার হালে ছিলেন। তিনি, লণ্ডনে পেঁছিবার অব্যবহিত পরেই চিমুইকে একটা বাগান দেখিতে যান, ঐ বাগানে তিনি মনোহর পরিচ্ছদধারী আঠার শত ব্যক্তিকে একা কালে দেখিতে পান। তাঁহার নিকট যে পরিচয়-পত্রিকা ছিল, তৎপ্রদর্শনে বিলাতের প্রধান প্রধান লোক দিগের দ্বারা মহা সমাদরে পরিগৃহীত হন। রাজমন্ত্রী সর্ রবর্ট পিল্ বোর্ড অফ্ কণ্ট্রোলের সভাপতি লর্ড ফিটজারলণ্ড, লর্ড ব্রাইহেম্ প্রভৃতি মহামান্য ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণ করস্পর্শ করিয়া অন্তরের সহিত তাঁহার সমাদর করেন।

 ২২শে জুন তারিখে কোর্ট অফ ডাইরেক‍্টারের মেম্বারেরা লণ্ডনের কোন প্রসিদ্ধ স্থানে একটী সভা করিয়া দ্বারকানাথের অভ্যর্থনা করেন। ভারতবর্ষের শাসন কর্ত্তারা এক জন বাঙ্গালী প্রজাকে এইরূপে সম্মানিত করিলেন, ইহা অবগত হওয়া বঙ্গবাসিগণের বিশেষ অনিন্দের বিষয়। ক্রমে ক্রমে তিনি মহারাণী, রাজপরিবারস্থ সমস্ত লোক এবং ইংলণ্ডের যাবতীয় প্রধান প্রধান লোকের নিকট পরিচিত হইয়াছিলেন; সর্ব্বত্রই সম্মানের সহিত পরিচিত হইয়াছিলেন। তিনি লণ্ডন হইতে তাঁহার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এক পত্র লিখেন। ঐ পত্র হইতে কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করিলাম। “আমি আসিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের অনেক বস্তু দেখিয়া এরূপ প্রত্যাশা করি নাই যে, ইংলণ্ড সদৃশ ক্ষুদ্র দ্বীপে আর কিছু নুতন দেখিব। লণ্ডন বাস্তবিকই বিস্ময়কর রাজধানী। লণ্ডনস্থ ব্যক্তিগণের কার্য্যপরতা, জনতা, গাড়ী, ঘোড়া, দোকান ইত্যাদিতে আমাকে বিস্মিত করিয়াছে। পূর্ব্বাহ্ন ৮টা হইতে রজনী ১২টা পর্য্যন্ত আমি কেবল লোক জনের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিতে ব্যস্ত থাকি। লণ্ডনে পৌছিবার দুই দিন পরেই মহারাণী কর্ত্তৃক মহা সমাদরে পরিগৃহীত হইয়াছি। যাহার ধন আছে, সে লণ্ডনে আসিয়া জীবনের সুখসম্ভোগ করুক। আমি এখানকার কতকগুলি বড় লোকের উদ্যান পরিদর্শন করিয়াছি, তাহার ফল এই হইয়াছে যে, আমার বেলগাছিয়ার বাগানের প্রতি আর কিছুমাত্র আস্থা নাই। আমি লণ্ডনের বিষয় আজ কিছুই লিখিতে পারিলাম না; ভরসা করি পরপত্রে কিছু লিখিতে পারিব।”

 এক দিন মহারাণী ভিক্টোরিয়া তাঁহার স্বামী, খুল্পতাত প্রভৃতি প্রধান ব্যক্তিগণের সহিত, অশ্বারোহী সৈন্যগণের রণাভিনয় পরিদর্শন করিতেছিলেন। মহারাণী কর্ত্তৃক নিমন্ত্রিত হইয়া দ্বারকানাথ তদ্দর্শনে গমন করেন এবং মহারাণী স্বয়ং তাঁহাকে সেই রণকৌশল বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। আর এক দিন মহারাণী দ্বারকানাথকে ভোজে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। ঐ ভোজে মহারাণী স্বয়ং, তাঁহার স্বামী প্রিন‍্স আলবার্ট এবং রাজপরিবারস্থ অন্যান্য অনেক লোক উপস্থিত ছিলেন। মহারাণী ঐ স্থানে দ্বারকানাথকে তিনটি স্বর্ণমুদ্রা উপহার। দেন, ঐ মুদ্রা তিনটি সেই দিনই মুদ্রিত হইয়াছিল।

 দ্বারকানাথ ঠাকুর সদৃশ সুসামাজিক লোক প্রায় দেখা যায় না। সমাজের সর্ব্বশ্রেণীস্থ লোকের সহিত মিশিতে এবং তাহাদের সন্তুষ্ট করিতে, তাঁহার বিলক্ষণ ক্ষমতা ছিল। ইংলণ্ডের বড় বড় লোকের সহিত কিরূপ মিশিয়াছিলেন, পূর্ব্বে তাহার কতকগুলি নিদর্শন প্রদর্শিত হইয়াছে। এক্ষণে আর একটীর উল্লেখ না করিয়াও ক্ষান্ত হওয়া গেল না। মহারাণী এক দিন নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহাকে আপন অন্তঃপুরে লইয়া যান এবং জ্যেষ্ঠপুত্র ও পুত্রবধূর নিকট দ্বারকানাথের পরিচয় দিয়া দেন। কেবলমাত্র পরিচয় নহে, তাঁহারা দ্বারকানাথের করস্পর্শ করিয়া প্রিয় সম্ভাষণ করিয়াছিলেন। ইংলণ্ড, সদ্গুণের ও স্বদেশহিতৈষীর কতদূর সমাদর করেন, এই রাজব্যবহার দ্বারা এস্থলে তাহারও পরিচয় পাওয়া যাইতেছে।

 ইহার পর দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিলাতের ছাপাখানা, পোষ্ট অফিস, পশুশালা, দ্রব্যাদি প্রস্তুত করিবার কারখানা প্রভৃতি দর্শন করেন। তন্মধ্যে কয়েকটা কথামাত্র, এই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থে উদ্ধৃত হইবার যোগ্য। তিনি টাইম্‌স নামক সম্বাদ পত্রের যন্ত্রালয়ে গিয়া দেখিলেন, দুই ঘণ্টায় ২০,০০০ জাহার কাগজ মুদ্রিত হইতেছে। পোষ্ট অফিসে গিয়া দেখিলেন, পত্রে ও সম্বাদপত্রে দুই লক্ষ, দুই ঘণ্টার মধ্যে নির্ব্বচিত ও যথাস্থানে প্রেরিত হুইতেছে। কোন সময়ে তত্রত্য পশুশালায় গিয়া দেখিয়াছিলেন, সেখানকার যাবতীয় পশুই, প্রায় ভারতবর্ষ ও অন্যান্য পূর্ব্ব দেশ হইতে সংগৃহীত হইয়াছে। ঐ পশুগণের রক্ষা প্রণালী দেখিয়া তিনি অতিশয় প্রীত হইয়াছিলেন এবং এই প্রণালী, ভারতবর্ষীয় পশুশালাধ্যক্ষগণের অনুকরণীয় বলিয়া বোধ করিয়াছিলেন। ইংলণ্ডের সকলই অদ্ভুত!

 দ্বারকানাথের পরম বন্ধু ও উপদেষ্টা রাজা রামমোহন রায় বিলাতে দেহত্যাগ করিয়াছিলেন এবং ব্রিষ্টলের নিকটে তাঁহার শব সমাহিত হয়, ইহা প্রথম চরিতাষ্টকে বর্ণিত হইয়াছে। দ্বারকানাথ সেই সমাধি দর্শনার্থ ব্রিষ্টলে গিয়াছিলেন।

 ইহার পর তিনি ফরাসী দেশ দর্শনার্থ যাত্রা করেন। যাত্রাকালে ইংলণ্ডস্থ সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ ও তাঁহার গমনে দুঃখ প্রকাশ করেন। ভারতবর্ষীয় গবর্ণর জেনেরল্ মধ্যে মধ্যে এ দেশের রাজা ও বড় বড় জমিদারগণকে দর্শন দেন। উহাকে “লেভি” বলে। দ্বারকানাথের বিদায় কালে, ঐ “লেভির” মত সমারোহ হইয়াছিল। ইংলণ্ডের ন্যায় পারিসেও যথাযোগ্য সমাদরে পরিগৃহীত হন। রাজা, রাণী, রাজমন্ত্রী প্রভৃতি সর্ব্বোচ্চশ্রেণীস্থ ব্যক্তিগণ, এবং অন্যান্য যাবতীয় প্রধান প্রধান লোকের নিকটই তিনি সম্মান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এইরূপেই, মহতের পুরস্কার হইয়া থাকে। তিনি জগদ্বিখ্যাত পারিস নগরীতে প্রবেশ করিয়াই তাহার মনোহারিণী শোভায় মোহিত হইয়াছিলেন। কোন বিশেষ রাজকীয় উৎসবের সমর নগরকে আলোকমালায় মণ্ডিত করার প্রথা আছে। অনেকেই দেখিয়া থাকিবেন, (১৮৬৯ খৃঃ অব্দে) ১২৭৬ সালে মহারাণীর মধ্যম পুত্র ডিউক অফ এডিন‍্বরা এদেশে আগমন করিলে কলিকাতা রাজধানীতে কিরূপ আলোকোৎসব হইয়াছিল। পারিসে প্রবেশ করিয়াই দ্বারকানাথের বোধ হইয়াছিল, কোন বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে পারিসে বুঝি ঐরূপ আলোকোৎসব হইতেছে। ইহাতে বোধ হইতেছে, পারিস ঐরূপ শোভায় নিত্য-শোভিত।

 দ্বারকানাথ ঠাকুর যখন পারিসে অবস্থিতি করিতে ছিলেন, সেই সময়ে ইংলণ্ডের ডাইরেক্টার সভা হইতে এক খনি অভিনন্দন পত্র এবং একটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। তিনি স্বদেশের জন্য যত সাধু কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, ঐ পদক, তাহার পুরস্কার স্বরূপ। তাঁহার প্রধান প্রধান কার্য্যের স্মরণ-সূচক শব্দ সকল, ঐ পদকে খোদিত হইয়াছিল। গৃহে প্রত্যাগত হইয়াও, মহারাণীর নিকট হইতে আর এক খানি পত্র পান। মহারাণী, দ্বারকানাথকে তাঁহার নিজ গৃহে রাখিবার জন্য আপনার সম্পূর্ণ প্রতিচিত্র প্রদান করিবেন, ঐ পত্রে সেই কথা লিখিত হইয়াছিল। জন-সমাজে এত প্রাধান্য লাভ করা, রাজ-দ্বারে এতাদৃশ সম্মান প্রাপ্ত হওয়া, কেহবা “কপালের কথা” বলিয়া মনকে প্রবোধ দেন; কেহবা “দ্বারকানাথ বড় ঘরের লোক, তাঁহার এরূপ হইবার অনেক যোগ্যড় ছিল” এইরূপ বলিয়া নিশ্চেষ্ট হয়েন। এই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থে “কপালের কথায়” আমরা কোন কথা কহিতে সাহসী হইলাম না। কিন্তু পক্ষান্তরে বক্তব্য এই যে, বংশমর্য্যাদা, সম্পত্তি প্রভৃতি উচ্চ পদলাভে সহায়তা করে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এস্থলে ইহাও বুঝিতে হইবে, ঐ গুলি সজীব পদার্থ নহে। বংশমর্য্যাদাদি ত অনেকের আছে! তাঁহারা সকলেই দ্বারকানাথ ঠাকুরের সদৃশ হন না কেন?

 এক বৎসরের মধ্যেই দ্বারকানাথ দেশে প্রত্যাগত হয়েন। তিনি স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া, স্বজাতির পরিত্রাণের অনেক উপায় অনুসন্ধান করিয়া, বুদ্ধি ও উদ্যোগিতার জয়পতাকা উড‍্ডীন করিয়া দেশে আইলেন, এ দিকে বাবুদিগের বৈটকখানায় এবং ভট্টাচার্য্য মহাশয়দিগের টোলে, দ্বারকানাথ ঠাকুরের জাতি গিয়াছে বলিয়া গোল উঠিল। অধিক, আশ্চর্য্যের বিষয় এই, দ্বারকানাথ যে পিরালি বংশের আভরণ স্বরূপ, সেই পিরালি ঠাকুরগণের মধ্যেও কেহ কেহ তাঁহার বিপক্ষ হইয়াছিলেন। পরিশেষে, দেশীয় সমাজে স্থির হইল, যদি দ্বারকানাথ জাতিচ্যুতি নিবন্ধন প্রায়শ্চিত্ত করেন, তবে তিনি সমাজভুক্ত হইতে পারিবেন। দ্বারকানথ তাদৃশ প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন না দেখিয়া, ঐ গোলযোগে ভ্রক্ষেপ করেন নাই।

 এদেশীয় স্ত্রীশিক্ষার আবশ্যকতা, দ্বারকানাথের মনে প্রথম উদিত হয়। তিনি তদনুসারে গবর্ণমেণ্টে প্রস্তাব করিয়া তাহার আয়োজনে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু আমরা বলিতে পারি না, তিনি কি জন্য তাহাতে কৃতকার্য্য হতে পারেন নাই।

 তিনি (১৮৪৫ খৃঃ) ১২৫১ সালের ৮ মাচ্চ পুনর্ব্বার ইংলণ্ডে গমন করেন। নিজ ব্যয়ে বিলাত হইতে উত্তম রূপে সুশিক্ষিত করিয়া আনিবার জন্য মেডিকেল্ কলেজের দুই জন উৎকৃষ্ট ছাত্রকে সমভিব্যাহারে লইলেন। ছাত্র দুই জনের নাম ভোলানাথ বসু এবং সূর্যকুমার চক্রবর্ত্তী। এই সুর্য্যকুমার চক্রবর্ত্তীই “গুডিব্ চক্রবর্ত্তী” বলিয়া খ্যাত। ইনি অদ্যাপি বর্ত্তমান। গবর্ণমেণ্টও, দ্বারকানাথের অনুকরণে আর দুই জন ছাত্র বিলাত পাঠান এবং তাহাদের ব্যয় দিতে স্বীকার করেন। এদেশে ইংরাজী শিক্ষার প্রধান সহায় ডেবিড্ হেয়ারের ভ্রাতার নাম, জোজেফ্ হেয়ার। দ্বারকানাথ ডেবিড্ হেয়ারের জীবনচরিত লিখিবার জন্য তাঁহার ভ্রাতার নিকট বিবরণ সকল চালিয়াছিলেন। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, তাঁহার সে কার্য্যটী সম্পন্ন হয় নাই।

 প্রধান রাজমন্ত্রী গ্লাড্ষ্টোন্ সাহেব একদা দ্বারকানাথকে আপন গৃহে আহ্বান করেন। ভারতবর্ষের হিতসাধন বিষয়ক বিবিধ কথোপকথন হয়। দ্বারকানাথ মন্ত্রীবরকে জিজ্ঞাসা করেন, সুশিক্ষিত হিন্দুরা কেন মহা সভার সভ্য হইতে পারেন না? যে হেতু তদ্বিষয়ে কোন উপযুক্ত প্রতিবন্ধক দেখা যায় না। মন্ত্রীবর বলিলেন, হিন্দুধর্ম্মই সেই প্রতিবন্ধক; হিন্দুধর্ম্মাবলম্বী, পার্লিয়ামেণ্টের আসনে আসীন হইতে এবং সেখানকার নির্দ্দিষ্ট শফথ গ্রহণ করিতে পারেন না, খৃষ্টান ব্যতীত অন্যের তাহা অসাধ্য। দ্বারকানাথ অনেক সুযুক্তি দ্বারা দেখাইয়াছিলেন, হিন্দুরা তাহা অবশ্যই পারেন; কিন্তু রাজমন্ত্রীর বিবেচনায় তাঁহার সেই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া, বোধ হয় নাই।

 ৩০ জুন তারিখে তিনি একটা ভোজের নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন। ঐ স্থানে হঠাৎ অত্যন্ত শীতানুভব হইয়া কম্পজ্বর হয়। নিমন্ত্রিতা রমণীগণ তাঁহার আকস্মিক পীড়া উপস্থিত দেখিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন এবং আপনাদের গায়ের শাল সকল দ্বারকানাথের গায়ে দিয়াছিলেন। তিন চারি জন ডাক্তার চিকিৎসার্থ নিযুক্ত হইলেন। তাঁহারা বায়ু পরিবর্ত্তনের পরামর্শ দিলেন। এক মাস কাল ইতস্ততঃ বায়ু সেবন করিয়া বেড়াইলেন। কিন্তু সকলই বৃথা হইল! (১৮৪৬ খঃ) ১২৫৩ সালের ১ আগষ্ট সবিরাম জ্বরে বেলফাষ্ট্ নগরে তাঁহার মৃত্যু হইল। তখন বয়স বায়ান্ন বৎসর। যাঁহার পিতৃপিতামহ গণের শব অগ্নিতে দগ্ধ হইয়াছে, তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কিরূপ হইবে, এই বিষয় লইয়া মহা গোলযোগ আরম্ভ হইল। তাহার সঙ্গে, তাঁহার পুত্র এবং ভ্রাতৃপুত্র ছিলেন। তাঁহারা উভয়েই বালক, সুতরাং যাহাতে ভাল হয়, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বিষয়ে তাঁহারা সেইরূপ করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। পরিশেষে কেন‍্সালগ্রীন্ নামক রমণীয় স্থানে তাঁহার শব সমাহিত হইল; কিন্তু সমাধানক্রিয়ার সহিত কোনরূপ খৃষ্টীয় আড়ম্বর করা হয় নাই। সমাধিস্তম্ভে রজতফলকে কেবল এইমাত্র খােদিত হইয়াছিল, “১৮৪৬ খৃষ্টাব্দের ১ আগষ্ট কলিকাতার জমিদার দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যু হইল।”

 তাঁহার মৃত্যুতে কি স্বদেশ কি বিদেশস্থ যাবতীয় পরিচিত স্ত্রীপুৰুষের শােক হইয়াছিল। তাঁহার মৃত্যু, বঙ্গ দেশের পক্ষে নিদাৰুণ ক্ষতি জনক ঘটনা বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল। এতাদৃশ গৌরবপূর্ণ জীবন যত দীর্ঘ হয়, দেশের ততই মঙ্গল। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, দ্বারকানাথ তাদৃশ দীর্ঘ জীবন প্রাপ্ত হন নাই। দ্বারকানাথ জাতিতে হিন্দু, ধর্ম্মেও হিন্দু ছিলেন। প্রথম বয়সে পুজা হােমাদির, যথাবিধি অনুষ্ঠান করিতেন। রাজা রামমোহন রায়ের সহিত বন্ধুত্ব-বন্ধনের পর হইতে তাঁহার ধর্ম বিষয়ক মতের কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্ত হইয়াছিল। তিনি এক পরমেশ্বরে এবং মনুষ্যের অনন্ত উন্নতিতে বিশ্বাস করিতেন। নিয়মিতৰূপে স্নানের পর উপাসনা করিতেন। উপাসনার উগযােগিতায় তাঁহার বিশ্বাস ছিল। প্রাচীন আর্য্যগণের উদার ভাবের অনুকরণে তাঁহার অনেক ধর্ম্মকার্য্য অনুষ্ঠিত হইত। ইংলণ্ডের টাইম্‌স নামক সর্ব্ব প্রধান সম্বাদ-পত্র সম্পাদক, দ্বারকানাথের মৃত্যুতে আক্ষেপ করিয়াছিলেন। তিনি দ্বারকানাথের যাবতীয় সৎ ও মহৎ কার্য্যের সমালোচনা করিয়া সুদীর্ঘ প্রস্তাব লিখিয়াছিলেন। এদেশের যেখানে যত সম্বাদ-পত্র ছিল, দ্বারকানাথের মৃত্যুতে সকলেই হাহাকার করিয়াছিলেন। তাঁহার স্মরণার্থ ও তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থ, এ দেশে অনেক সভা, অনেক বক্তৃতা ও অনেক চাঁদা সংগ্রহ হইয়াছিল। সংক্ষিপ্ততার অনুরোধে, এস্থলে আমরা তাহার কিঞ্চিন্মাত্রেরও উল্লেখ করিতে পারিলাম না।

 এই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থে দ্বারকানাথ ঠাকুরের চরিত্র লিখিয়া উঠা একরূপ অসম্ভব ও অসাধ্য। যেহেতু, আমাকে চরিতাষ্টকের উদ্দেশ্যের অনুরোধে, কিয়ৎ পরিমাণে, স্বাধীনতা ত্যাগ করিতে হইয়াছে। কোন মহৎ ব্যক্তির জীবনের যে যে অংশ, বিদ্যালয়ের বালকের হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইবে, আমি তদ্ব্যতীত আর কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে পারিব না। সুতরাং মহৎ ব্যক্তির চরিতা লোচনায়, চরিতাষ্টকের ত্রুটি থাকিবার সম্ভাবনা। কিন্তু ভরসা করি, অন্যান্য পাঠকগণ এই ত্রুটির ক্ষমা করিবেন। দ্বারকানাথ কত বড় লোক ছিলেন, যাঁহারা ভাল করিয়া জানিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহাদিগকে কিশোরীচাঁদ মিত্র সঙ্কলিত ইংরাজী গ্রন্থ পাঠ করিতে হইবে।

 দ্বারকানাথের সময়ে বাঙ্গালীর মধ্যে তত্ত‌ুল্য ক্ষমতাশালী বোধ হয়, আর কেহই ছিলেন না। স্বার্থ বিস্তৃত হইয়া পরার্থে পরিণত হয়। একটি বালক আপনার বিষয় যেমন বুঝে, পরের বিষয় তেমন বুঝে না। যত বয়ঃপ্রাপ্ত হইতে থাকে, অপরের বিষয় ততই বুঝিতে আরম্ভ করে। আত্ম কার্য্য সাধনে, আপনার সুখসচ্ছলতা বর্দ্ধনে, আপনার অভাবপূরণে, এবং সর্ব বিষয়ে প্রাধান্য লাভে মানুষ যতই কৃতকার্য্য হইতে থাকেন, তাঁহার মন আপনার কার্য্য হইতে বিরত হইয়া ততই পরের কার্য্যে অভিনিবিষ্ট হইতে থাকে। তখন সেইরূপ অভিনিবেশেই অন্তরে সুখানুভব হয়। এইরূপে মানুষের মন, নিজ গৃহ, —নিজ পল্লী হইতে স্বগ্রামে,—অবশেষে স্বদেশে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে। ইহাকেই স্বদেশ-হিতৈষা কহে, ইহাকেই স্বার্থের বিস্তৃতি কহে। কার্য্যের দ্বারা সপ্রমাণ হইয়াছে যে, দ্বারকানাথ স্বদেশ-হিতৈষী ছিলেন। অতএব তিনি প্রাধান্যলাভে কত দূর কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন, ইহা দ্বারা তাহাও প্রতিপন্ন হইতেছে।

 তিনি জমিদারী, ওকালতী, চাকরী ও নানাবিষয়ক বাণিজ্য দ্বারা অপরিমিত অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। এক দিকে যেমন অপরিমিত উপার্জ্জন, অন্য দিকে তেমনি অপরিমিত সদ্ব্যয় করিয়াছিলেন। তাঁহার সদ্ব্যয়ে অর্থ, সার্থক হইয়াছিল। যাঁহাদের টাকা আছে, ব্যয় বিষয়ে তাঁহাদের দ্বারকানাথের অনুকরণ করা উচিত। তিনি অর্থ ব্যয় দ্বারা যত কার্য্য করিয়াছিলেন, অনেকে বলেন, সর্ব্ব বিষয়েই তাঁহার এক একটি স্বার্থসিদ্ধির মতলব ছিল। যিনি যে কাজই করুন, সূঙ্ক্ষ দর্শনে দেখিয়া গেলে, তাহার কোন না কোন অংশে ঐরূপ মতলব সকলেরই দেখা যায়। ঐরূপ মতলব লোকের থাকে বলিয়াই জগতের কাজ হয়। যাহার ঐরূপ কোন মতলব নাই, তিনি বাসনা বিহীন নিশ্চেষ্ট, —প্রকৃতির স্রোতে ভাসমান। তাঁহার মানসিক সুখের অপ্রতুল নাই বটে, কিন্তু তিনি কাহাকে সে সুখের ভাগ দেন না। সামাজিকের মতলব থাকা আবশ্যক, যিনি আপনার মতলব সিদ্ধির উদ্দেশে শরীর শুষ্ক করিয়া জ্ঞান উপার্জ্জন করেন, হৃদয়ের রক্ত জল করিয়া টাকা রোজকার করেন, যেখানে অভাব, সেই খানে অর্থবৃষ্টি করেন, নাম “কিনিবার” জন্য দেশ-হিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠান করেন, আমরা সেইরূপ লোকের সংখ্যা-বুদ্ধি দেখিতে ইচ্ছা করি। কাহার অতিশয় উচ্চ পদ দেখিলে, পার্শ্ববর্ত্তী লোকের মনে কিঞ্চিৎ দ্বেষভাবের সঞ্চার হওয়া প্রকৃতির নিয়ম। বোধ হয়, তাঁহার চরিত্রের বিরুদ্ধে যিনি যাহা বলিয়া থাকেন, ঐ দ্বেষভবই, তাহার মূল। দ্বারকানাথ বাঙ্গালী ছিলেন, এ কথা স্মরণ করা, বঙ্গবাসিগণের বিশেষ আনন্দের বিষয় তাহার সংশয় নাই।

  1. ইহাঁর জীবন-চরিত, প্রথম চরিতাষ্টকে লিখিত হইয়াছে।