দ্বিতীয় চরিতাষ্টক/জজ্‌ শম্ভুনাথ পণ্ডিত

উইকিসংকলন থেকে

জজ্ শম্ভ‌ুনাথপণ্ডিত।

 ইনি, কলিকাতা মহানগরীতে ১২২৬ সালে (১৮২০খৃঃ) ব্রাহ্মণ কুলে জন্মগ্রহণ করেন। ইহাঁর পিতার নাম শিবনাথ পণ্ডিত। ইহাঁদিগের পূর্ব্ব নিবাস কাশ্মীর দেশে। শিবনাথের তদশ সংগতি ও সম্ভ্রম ছিল না, কিন্তু তিনি অতি সৎস্বভাবের লোক ছিলেন। কলিকাতার অনেকের সহিত তাঁহার বাস্তবিক সদ্ভাব ছিল, তিনি কৌতুক জনক গল্পাদি দ্বারা বালক ও যুবগণের সহিত আমোদ করিতে বড় ভাল বাসিতেন। আলি পুরের দেওয়ানী আদালতে অতি সামান্য বেতনে মহাফেজের কর্ম্মে নিযুক্ত ছিলেন।

 শম্ভনাথ প্রথমে শিক্ষার্থ গৌরমোহন আঢ্যের ইংরাজী বিদ্যালয়ে প্রেরিত হন। তিনি পাঠাবস্থায় সহধ্যায়ীগণের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ছিলেন না; কিন্তু শিক্ষাবিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভের জন্য সর্ব্বাপেক্ষা অধিক চেষ্টা করিতেন। ভাল ভাল পুস্তক গৃহে বসিয়া অভিজ্ঞ লোকের সাহায্যে রীতিমত অধ্যয়ন করিতেন। সহধ্যায়ী ও ভিন্ন বিদ্যালয়স্থ উত্তম উত্তম ছাত্রদিগের সহিত বন্ধুত্ব করিয়া সভা স্থাপন করিতেন এবং যাহাতে মানসিক উন্নতি হয় তদনুরূপ নানাবিষয়ে তর্ক বিতর্ক করিতেন। পরম বন্ধু ভবানী প্রসাদ দত্তের সহিত একত্রে বেকনের বিখ্যাত প্রবন্ধ সকলের টীকা করিয়া প্রচার করেন। উহা দ্বারা এখনকার ছাত্রের অনেক সাহায্য পাইতেছেন। সরলতা প্রভৃতি কতকগুলি গুণ, তাঁহার চরিত্রে অধিক পরিমাণে দেখা যাইত। এইজন্য তিনি, সমপাঠী কি, ভিন্ন বিদ্যালয়স্থ বালকগণেরও প্রিয় পাত্র হইয়াছিলেন। কোন বালকের কোনরূপ বিপদ উপস্থিত হইলে, তাহার প্রতিবিধানর্থ সবিশেষ যত্ন করিতেন। এমন স্থলে ঐ বিপদাপন্ন বালকের পক্ষতা অবলম্বন করিয়া সময়ে সময়ে প্রচুর সাহস প্রকাশ করিতেন। ইহা যে, পশ্চিম দেশীয় ভাব তাহাতে আর সন্দেহ নাই।

 অল্পদিনের মধ্যেই বিদ্যালয়ের পড়া ছাড়িয়া দিয়া তাঁহাকে কর্ম্মের চেষ্টা দেখিতে হইল। তিনি প্রথমে মাসিক ২০৲ টাকা বেতনে মহা ফেজের সহকারী নিযুক্ত হন। পরে ১২৫১ খৃষ্টাব্দে তএত্য জজ সররবট্ বারলো সাহেব তাঁহার যোগ্যতায় সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে একটী অপেক্ষাকৃত উন্নত পদে অর্থাৎ ডিকরী জারির মোহরের নিযুক্ত করিলেন। তিনি ঐ পদে কার্য্য করিতে করিতে ডিক‍রি জারির আইন সম্বন্ধে এক খানি ক্ষুদ্র পুস্তিকা লিখিলেন। উহাতে ঐ আইনের কতকগুলি দোষের সুন্দর বিচার করা হয়। ঐ পুস্তক খানি কার্য্যোপযোগী ও উৎকৃষ্ট হওয়ায়, তিনি সুখ্যাতির সহিত গবর্ণমেণ্টে পরিচিত হইলেন। উহা দ্বারাই ভবিষ্যতে ঐ আইনের দোষ সংশোধিত হয়। বারলো সাহেব নিজে অত্যন্ত দুষ্ট ও নিষ্ঠ‌ুর ছিলেন। অনেককেই তাঁহার এই স্বভাব দোষের ফল ভোগ করিতে হইয়াছিল। কিন্তু তিনি শম্ভুনাথকে খুব ভাল বাসিতেন। শম্ভুনাথের ঐ উৎকৃষ্ট পুস্তকের বিশেষ গৌরব করিতেন এবং তাঁহারই নিকট শিক্ষিত তাঁহারই চেলার দ্বারা উহা প্রণীত হইয়াছিল বলিয়া তিনি আপনারও গৌরব জ্ঞান করিতেন।

 এই সময়ে ঐ আদালতে মিসিলখাঁর পদ শূন্য হওয়ায় শম্ভুনাথ উহা পাইবার জন্য প্রার্থনা করেন। এ কর্ম্ম অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ছিল, এইজন্য বারলো সাহেব তাঁহাকে উহার প্রার্থনা হইতে বিরত করেন; যেহেতু তিনি জানিতেন যে, শম্ভুনাথের শ্বাস রোগ হইবার। সম্ভাবনা ছিল। তদনুসারে তিনি ঐ প্রার্থনা হইতে ক্ষান্ত হইয়া কোন বন্ধুর পরামর্শে ওকালতী কর্ম্মারম্ভের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলেন। ১২৫৬ সালে ওকালতীর সমন প্রাপ্ত হইয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হন। উক্ত পদ প্রাপ্তি বিষয়ে নিরাশ হওয়াই, তাহার ভবিষ্যৎ উন্নতির নিদান।

 মোকর্দ্দমা পাইলে তিনি অত্যন্ত শ্রম ও অভিনিবেশ, সহকারে তাহার অবস্থানুসন্ধান করিতেন এবং সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি প্রভাবে তৎসম্বন্ধীয় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় সকল অতি সহজে বুঝিয়া তাহাতে আবশ্যকমত তর্ক বিতর্ক করিতে পারিতেন। জানিয়া শুনিয়া একবর্ণ মিথ্যা কহিতেন না, কাহার মোকর্দ্দমার কোন অংশে কিঞ্চিৎ মাত্র অন্যায় আছে জানিতে পারিলে উহা কদাচ গ্রহণ করিতেন না। অসঙ্গতি নিবন্ধন কাহাকে অত্যাচারের প্রতিকারে অসমর্থ দেখিলে তিনি বিনা অর্থ গ্রহণে তাহার মোকর্দ্দমা করিয়া দিতেন। এমন স্থলে কখন কখন ষ্ট্যাম্প প্রভৃতির ব্যয়ও স্বয়ং প্রদান করিতেন। মোকদ্দমা সকলের বাস্তবিক যেরূপ নিম্পত্তি হইবার সম্ভাবনা, অর্থী প্রত্যর্থীর অপ্রিয় হইলেও তাহাই বলিতেন, তাহাদিগকে সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত করিবার জন্য কখন তাহার অন্যথা করিতেন না। এই সকল কারণে তিনি অতি শীঘ্রই একজন সত্য ও ন্যায় পরায়ণ, কার্যদক্ষ এবং দয়াবান্ উকিল বলিয়া সর্ব্বত্র বিখ্যাত ও আদৃত হইয়া উঠিলেন। এইরূপ আচরণে যদিও তাঁহার আয়ের অল্পতা হইতে লাগিল, কিন্তু বিশুদ্ধ ব্যবহার গুণে সকল শ্রেণীস্থ লোকেরই বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার পাত্র হইয়া উঠিলেন এবং তজ্জন্য এত অধিক সম্মান লাভ করিয়াছিলেন যে, উকিল মোক্তারের ভাগ্যে সেরূপ প্রায় ঘটে না। তাঁহার ব্যবহারজ্ঞতা দর্শনে কখন কখন সাহেবরাও বিস্মিত হইতেন। যাহা হউক, বিচারপতি জে, আর ফলভীন সাহেব, তাঁহার কার্যদক্ষতা ও সুশীলতায় এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন যে, তাঁহার বিনা প্রার্থনায় তাঁহাকে গবর্ণমেণ্ট জুনিয়ার উকিলের পদ প্রদান করেন। ১২৬০ সালে ঐ পদ পান।

 যদিও এই পদটী অত্যন্ত সম্ভ্রমজনক বটে, কিন্তু। ইহাতে একটা কঠিন কার্য্য ছিল। যে সকল অপরাধী সেস‍্ন আদালত হইতে প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রাপ্ত হইয়া সদর নিজামতে আসিত, ঐ উকিলদিগকে গবর্ণমেণ্টের পক্ষ হইয়া অপরাধীর বিপক্ষে তর্ক করিতে হইত। গবর্ণমেণ্টের জুনিয়ার উকিলদিগের মনে তর্ক করিবার সময় কখন কখন এমন হেতুবাদ উপস্থিত হইয়া থাকে, যাহাতে কিয়ৎ পরিমাণে অপরাধীর পক্ষ সমর্থিত হইতে পারে। কিন্তু তাঁহারা গবর্ণমেণ্টের বেতন ভোগী সুতরাং গবর্ণমেণ্টের পক্ষ সমর্থন ব্যতীত আর কিছুই করিতে পারেন না। শম্ভ‌ুনাথের মনে একবার ঐরূপ হেতুবাদ উপস্থিত হওয়ায় তিনি তৎক্ষণাৎ গবর্ণমেণ্টের পদ ত্যাগ করিয়া অপরাধীর স্বপক্ষে বক্তৃতা করিতে ইচ্ছুক হইয়াছিলেন। ঐ সকল মোকর্দ্দমায় তিনি নিতান্ত অসুখী হইতেন। পরে এরূপ মোকর্দ্দমায় প্রায়ই উপস্থিত হইতেন না।

 ১২৬৯ সালে (১৮৬১ খৃঃ) তিনি গবর্ণমেণ্টের সিনিয়র অর্থাৎ প্রধান উকিলের পদ প্রাপ্ত হন। পূর্ব্বে এই পদে রমাপ্রসাদ রায় ছিলেন। শম্ভুনাথ আইনের কুটার্থ সম্বন্ধে বৃথা বাগাড়ম্বর করিয়া শ্রোতৃগণকে বিরক্ত করিতেন না। আইনের উদ্দেশ্য, সদ্বিচার ও সৎযুক্তির সাধারণ নিয়মের উপর সরল ও সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করিতেন। এই জন্য তাঁহার বক্ত‌ৃতার কোন অংশই কখন কাহার অপ্রীতি বা বিরক্তি কর হয় নাই। বিশেষতঃ ফৌজদারী আইনে তার অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল। ঐ আইনের সূক্ষ্মতকে তাঁহাকে কেহই পারিয়া উঠিতেননা। তাঁহার আইনের অভিজ্ঞতা গবর্ণমেণ্ট এমন উত্তম রূপে বুঝিয়াছিলেন যে, তাঁহাকে ১২৬৫ সালে কলিকাতাস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তিনি উত্তমরূপে দুই বৎসর কাল এই কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়াছিলেন। ১২৬৯ সালে যখন কলিকাতার সদর দেওয়ানী আদালত উঠিয়া গিয়া তৎপরিবর্ত্তে হাইকোর্ট নামক উচ্চতম আদালত স্থাপিত হয়, তখন ঐ আদালতে একজন এতদ্দেশীয় বিচারপতি নিযুক্ত করা গবর্ণমেণ্টের অভিপ্রেত হইলে বিখ্যাত রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায় ঐ পদে মনোনীত হন; কিন্তু বিচারাসনে উপবেশনের পূর্ব্বেই তাহার মৃত্যু হওয়ায় শম্ভ‌ুনাথই ঐ পদ প্রাপ্ত হইলেন। তিনি এই উন্নত পদে নিযুক্ত হওয়াতে দেশীয় বিদেশীয় সকলেই প্রীত হইয়াছিলেন।  যে কয়েক বৎসর তিনি এই কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন তন্মধ্যে কখনই তাঁহার সদ্বিচার ও পাণ্ডিত্যে সংশয় উপস্থিত হয় নাই। বরং অনেক সময়ে তিনি আত্মকার্য্যে বিলক্ষণ দক্ষতা প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন; বিশেশতঃ তাঁহার বুদ্ধির আশ্চর্য্য তীক্ষ্ণতায় মিথ্যা মোকর্দ্দমা মাত্রেরই কুটিলতা প্রকাশিত হইয়া পড়িত। কোন মিথ্যা মোকর্দ্দমা তাঁহার এজলাসে উপস্থিত হইলে তৎপক্ষীয় উকিল মোক্তারগণ বিপদ অশিক্ষা করিতেন। তিনি দেশীয় উকিলগণের মুরব্বী স্বরূপ ছিলেন। কেহ কোন বিপদে পড়িলে পদ-ক্ষমতায় সাহায্য করিয়া কিম্বা বন্ধুভাবে পরামর্শ দিয়া যে কোনরূপে তাঁহাকে উদ্ধার করিতেন। ঐ সময়ে বাঙ্গালী বারিষ্টারদিগকে ন্যায্য স্বত্ব দান সম্বন্ধে মহা গোলযোেগ উপস্থিত হয়। কেবল শম্ভুনাথ ও কয়েক জন ভদ্র জজের যত্নে সে গোল মিটিয়া যায়। ইউরোপীয় সহযোগী বিচারপতি ও কৌন্‌সিলগণের সহিত ও পরম সৌহৃদ্য ছিল। তিনি সদ্বিচার সম্পাদনেযেমন যত্নবান্ ছিলেন, লোকের সহিত শিষ্টাচার রক্ষায়ও তদনুরূপ মনোযোগী ছিলেন। তিনি হাইকোর্টের বিচারপতির পদে সম্পূর্ণ কৃতকার্য্যতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। ঐ কৃতকার্য্যতায় এ দেশের একটা মহৎ উপকার হইয়াছে। ইহার পূর্ব্বে শাসনকর্ত্তৃ গণের এইরূপ সংস্কার ছিল যে, এ দেশীয় লোকেরা উচ্চ পদে নিযুক্ত হইবার যোগ্য নহে। কিন্তু শম্ভুনাথ সে কুসংস্কার দূর করিয়াছেন। তিনি কেবল আপনার বুদ্ধিশক্তি ও উদ্যোগিতায় তাদৃশ সামান্য অবস্থা হইতে এত উন্নতিলাভ করিয়াছিলেন। সুশিক্ষালাভের চেষ্টা অনেকেই করেন; কিন্তু গভীর জ্ঞানার্জ্জনে এবং কাজের মানুষ হইবার জন্য শম্ভুনাথ যেরূপ যত্ন করিয়াছিলেন, তাই সকলেরই অনুকরণীয়। তিনি প্রথমাবস্থায় স্কুলের পড়া ছাড়া বাড়ীতে কত কাজ করিতেন, তাহার কতক পূর্ব্বে বলা হইয়াছে তদ্ব্যতিরেকে, আইনে প্রকৃত জ্ঞানলাভ করিবার জন্য বিখ্যাত হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের এক সভা ছিল, শম্ভুনাথ ঐ সভার একজন প্রধান মেম্বর ছিলেন। নিয়মিতরূপে তাহাতে বক্তৃতা, বিচার ও তর্ক বিতর্ক করিতেন। কোন বিষয় পড়িয়া যাওয়াপেক্ষা লিখিতে গেলে অধিক চিন্তার প্রয়োজন, লেখা দ্বারা সুন্দররূপে তদ্বিষয়ের আলোচনা হয়। বোধ হয়, শম্ভুনাথ এই জন্য আইনসংক্রান্তু অনেক প্রস্তাব লিখিয়া তৎকালীন হিন্দুপেট্রিয়ট্ প্রচার করিতেন। তাঁহার ঐ সকল প্রস্তাব-পাঠে উচ্চ আদালতের বিচারপতিগণ এবং অন্যান্য অভিজ্ঞ লোক প্রশংসা করিতেন। কোন বীজ আকাশে অঙ্কুরিত হয় না,—উপযুক্তউপকরণের অপেক্ষা করে। শম্ভুনাথ উপযুক্ত উপকরণে সজ্জিত হইয়াই হাইকোর্টের বিচারাসন অলংকৃত করিয়াছিলেন।  যাহা হউক, এইরূপ সম্ভ্রম, সুখ্যাতি ও সদ্বিবেচনা সহকারে এ দেশীয় অত্যুচ্চ আদালতে সদ্বিচার সম্পাদন দ্বারা দেশের মুখোজ্জল করিতেছিলেন এবং স্বদেশীয়গণের উন্নতি আশা বর্দ্ধিত করিতেছিলেন, এমন সময়ে তাঁহার সামান্য জ্বর ও একটী বিস্ফোটক হইল। ক্রমাগত তিন সপ্তাহ শয্যাগত থাকিয়া ১২৭৪ সালের (১৮৬৭ খৃঃ) ২৪ জ্যৈষ্ঠ প্রাতঃকালে ইহলোক পরিত্যাগ করেন। তাঁহার মৃত্যুতে দেশীয় ও বিদেশীয় জনগণ কিরূপ, অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহার অধিকাংশ, তৎকালীন কোন সম্বাদপত্র হইতে নিম্নে উদ্ধত করিলাম।

 “তাহার পীড়া সাংঘাতিক আকার ধারণ করা অবধি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত তাঁহার বাটীতে অষ্ট প্রহরই শোকার্ত্ত বন্ধুর মহাজনতা হইয়াছিল। মৃত্যুর কিছুকাল পরেই যখন পরিজন ও পরমাত্মীয়ের মৃত দেহের চতুষ্পার্শ্বে হাহাকার রবে বক্ষে করাঘাত করিতেছে অথবা ভূমিতে মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িতেছে, যখন শতশত আত্মীয় স্বজন বাটীর ভিতরে বাহিরে সর্ব্বত্র “কি হলো! কি! সর্ব্বনাশ!” এইমাত্র শব্দ উচ্চারণ করিতেছে এবং নয়নজলে সকলের বক্ষঃস্থল ভাসিতেছে, যখন ভবানীপুর ও কলিকাতার পল্লীতে পল্লীতে গলিতে গলিতে “কি দুঃখের বিষয়! কি দুরদুষ্ট! দেশের কি দুঃভাগ্য” এইরূপ শব্দ সকলের মুখ হইতে বিনির্গত হইতেছে, তখন বঙ্গ দেশের সর্বোচ্চ বিচারাসনদ্বয়ে বিচার পতিরাও আন্তরিক শোক ও আক্ষেপ প্রকাশ করিতেছিলেন। হাইকোর্টের অরিজিনাল সাইডে প্রধান বিচারপতি সরবার্ণসপিকক্ এডভোেকেট্ জেনেরলকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন,—“অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, এই বিচারালয়ের অন্যতম সুপণ্ডিত বিচার কর্ত্তা জষ্টিস্ শম্ভুনাথ পণ্ডিতের মৃত্যু-সম্বাদ উকীল কৌন্সলী এবং সাধারণকে অবগত করিতে হইল। এই শোচনীয় ঘটনা অদ্য প্রাতে ঘটিয়াছে। শ্রীশ্রীমহারাজ্ঞী কর্ত্ত‌ৃক হাইকোর্টের বিচার কর্ত্তার পদে এদেশীয়দিগের মধ্যে ইনি মাত্র অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। আমার নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করিতে হইলে, আমাকে যথার্থই বলিতে হইবে, এবং বোধ হয়, ইহাতে কেবল আমার নহে, আমার সুপণ্ডিত সহযোগদিগেরও মত ব্যক্ত করা হইতেছে যে, জষ্টিস্ শম্ভুনাথের মৃত্যুতে আমরা একজন বহুগুণ বিশিষ্ট এবং মহামান্য বন্ধু ও সহযোগী হারাইয়াছি, এবং জন সাধারণ ও এই বিচারালয় একজন অত্যন্ত ন্যায়বান, সুপণ্ডিত, ও স্বাধীন হৃদয় বিচারপতি হইতে বঞ্চিত হইয়াছেন, তাহার সন্দেহ নাই।”

 এ দিকে সদরদেওয়ানী আদালতে বিচারপতি জ্যাক্স‍্ন, শম্ভুনাথের মৃত্যু সম্বন্ধে অত্যন্ত শোকার্ত্ত হইয়া নিম্নলিখিত প্রকারে আদালতকে সম্বোধন করিয়াছিলেন;—

 “অদ্যকার কার্যে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে, যিনি এদেশীয়দিগের মধ্যে সর্ব্বপ্রথমে এই বিচারালয়ের বিচারপতির পদে, মহারাজ্ঞী কর্ত্তৃক নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাঁহার মৃত্যু-সম্বদের উল্লেখ করা আবশ্যক। আমাদিগের মৃত সহযোগী ও বন্ধুর সহিত এই আদালতের অনেক উকিল কৌনসলীর, আমার অপেক্ষা অধিককাল পর্যন্ত এবং অধিকতর আত্মীয়তা ছিল। সন্দেহ নাই, কিন্তু আমি নিশ্চয় বলিতেছি, তাঁহার মৃত্যুতে আমরা যে একজন বহুগুণ বিশিষ্ট ও মহামান্য সহযোগী এবং বন্ধু হইতে বঞ্চিত হইয়াছি, এবং সাধারণেও যে, একজন ন্যায়পর, সুপণ্ডিত, পারদর্শী ও সত্যনিষ্ঠ বিচারপতি হইতে বঞ্চিত হইয়াছে, একথা বলিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। আমার বিশ্বাস হইতেছে যে, এরূপ কথা, হাইকোর্টের উভয় সাইডে আমার সুপণ্ডিত বিচারপতিরা প্রয়োগ করিবেন। যখন এদেশীয়গণের মধ্যে একজনকে এই আদালতের বিচার কর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিবার প্রস্তাবের বিবেচনা করা হয়, তখন বাবু শম্ভুনাথ পণ্ডিতের যোগ্যতা, সাধুতা, বহুদর্শিতা প্রভৃতি গুণ সমূহে তাঁহাকেই ঐ পদের উপযুক্ত পাত্র বলিয়া নির্দ্দেশ করে। তাঁহার নিয়োগের পর, তাঁহার সারল্য, দয়া এবং সৌজন্যগুণে তিনি যেমন তাঁহার সহযোগিদিগের প্রণয় ভাজন হইয়াছিলেন, ঐ সকল গুণে সেইরূপ তাঁহার অন্যবিধ যোগ্যতার সৌন্দর্য্যও বৃদ্ধি হইয়াছিল।”

 অপরাপর এজ‍্লাসের বিচারপতিগণও উপরি উক্ত রূপ বক্ত‌ৃতা করিয়া, সকলেই সে দিবস আদালত বন্ধ করেন। জজ্ বেলি এরূপ শোকার্ত্ত হইয়াছিলেন যে, বাস্তবিক তাঁহার অশ্রুপাত হইয়াছিল। হাইকোর্ট বন্ধ হইলে গবর্ণমেণ্ট উকিল কৃষ্ণকিশোর ঘোষের পশ্চাৎ পশাৎ প্রায় দুইশত ভদ্রলোক মৃতদেহের সঙ্গে শবদাহের ঘাট পর্যন্ত গমন করেন। তাঁহার চরিত্র, কার্য্য ক্ষমতা ও সাধারণ গুণ সম্বন্ধে হাইকোর্টের বিচারপতিগণ যাহা বলিয়াছেন, তৎসম্বন্ধে তদতিরিক্ত আর কিছুই বলিবার প্রয়োজন নাই। তাঁহার যে সকল গুণ কার্য্যস্থলে প্রকাশ পাইবার সম্ভাবনা ছিল না, কেবল বন্ধুজন ও পরিজনের মধ্যেই প্রকাশ পাইত, এখন সেই সম্বন্ধে কিছু বলিবার প্রয়োজন আছে। কারণ বাহিরে অনেকেই সৎ হইতে পারেন; যিনি অন্তুরে সৎ, তিনিই অধিকতর সাধুবাদের যোগ্য।

 স্নেহ, সৌজন্য, প্রণয়তৃষ্ণা, অমায়িকতা সকল অবস্থাতে এবং সকল সময়েই তাঁহার চরিত্রে প্রকাশ পাইত। পুত্র কলত্রাদির ত কথাই নাই, কুটম্বমাত্রেই তাঁহার নিজ পরিজনের ন্যায় সযত্নে ও সস্নেহে প্রতিপালিত হইত। তিনি অনেক টাকা উপার্জ্জন করিয়া ছিলেন এবং নিজে সামান্য লোকের অবস্থায় থাকতেন বটে, কিন্তু আত্মীয় স্বজনের ভরণপোষণে এবং সদ্বিষয়ে দানাদিতে তাঁহার সকল টাকাই খরচ হইয়া যাইত। এই বিষয়ে মাসে তাঁহার দুই হাজার টাকা খরচ হইত। তিনি আপন সন্তানাদির জন্য যাহা রাখিয়া গিয়াছেন, কেবল তাহাতে, তাঁহাদের ভদ্র লোকের মত চলিবার সম্ভাবনা নাই। তিনি বন্ধুবর্গকে উত্তমরূপে আহারাদি করাইতে এবং অতিথি সেবায় অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। একবার কাহার সহিত বন্ধুত্ব হইলে তাহা চিরকাল। মনে রাখিতেন। প্রথমাবস্থা ও সামান্যাবস্থার পরিচিত বন্ধুগণকে দেখিলে যত সন্তুষ্ট ও তাঁহাদের সমাদর করিতে যত ব্যস্ত হইতেন, সম্ভ্রান্ত মিত্রগণের দর্শনে। তত হইতেন না। ডিকরিজারির মোহরেরের অবস্থা হইতে হাইকোর্টের বিচারপতির পদ পর্যন্ত তাঁহার স্বভাব সমান বিনীত ছিল। তিনি এত শিষ্টাচারী ছিলেন ভৃত্যদিগকেও ভাই বলিয়া সম্বোধন করিতেন। নিতান্ত ব্যগ্রতার সময়েও কোন দ্রব্য চাহিতে হইলে, “দেও ভাই” “দেও জি” ভিন্ন কখন “দে” বলিতে কেহ শুনে নাই। তিনি যাবজ্জীবন কাহার সহিত অপ্রীতিকর বা কষ্টকর ব্যবহার করেন নাই। সকলের নিকট নিরপরাধী থাকাই তাহার জীবনের ব্রত ছিল। মৃত্যুর পূর্ব্ব দিন কোন বন্ধু, চিকিৎসকপরিবর্ত্তনের প্রস্তাব করিলে বন্ধুর হস্ত ধরিয়া কাতরস্বরে কহিলেন,—“প্রাণ যাউক, তথাপি যেন মান রক্ষা হয়। মরিবার সময় যেন কাহার মনে কষ্ট দেওয়া না হয়।” নিয়োজিত চিকিৎসকের জবাব দিয়া গিয়াছেন জানিতে পারিলে তবে অন্য চিকিৎসক ডাকিতে অনুমতি করেন। তথাপি পুনঃ পুনঃ বলিয়া ছিলেন,—“কেই যেন আমার উপর কষ্ট না হন।”

 পাঠকগণ দেখুন! তাহার কয়েকটী গুণ পাশাপাশি করিয়া দেখুন! শম্ভুনাথের চরিত্র কেমন অদ্ভুত! এক দিকে শিশুর সারল্য,—অন্যদিকে বৃদ্ধের গাম্ভীর্য্য; এক দিকে অসাধারণ ক্ষমতা,—অন্যদিকে অকপট নম্রতা; একদিকে ঐশ্বর্য্য,—অন্যদিকে দীনভাব; একদিকে বহুলোকের সহিত আলাপ,—অন্যদিকে সকলেরই প্রণয় লাভ; একদিকে অসামান্য পাণ্ডিত্য, —অন্য দিকে চিত্তরঞ্জক সুসামাজিকতা। এতাদৃশ বিসদৃশ গুণগ্রামের একাধার প্রায় দেখা যায় না।

 তিনি একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ছিলেন। ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজের সভাপতিত্ব, তিনিই করিতেন। ধর্ম্ম বিষয়িনী চিন্তা ও আলোচনায় তাঁহার বিশেষ অনুরাগ ছিল। ধর্ম্ম বিষয়ে কথা কহিতেন, অন্যত্র প্রায়ই নীরব থাকিতেন। তিনি ব্রিটীস্ ইণ্ডিয়ান সভায় সভ্যভাবে উপস্থিত হইতেন, কিন্তু সে স্থলে কেহ তাঁহাকে প্রায়ই কথা কহিতে দেখিতেন না। তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম শ্রীযুক্ত বাবু প্রাণনাথ পণ্ডিত। তিনিও ইংরাজী ও সংস্কৃত শাস্ত্রে অভিজ্ঞ হইয়াছেন। এইবার সংস্কৃত সাহিত্যে (M. A.) পরীক্ষা দিবেন। আমরা ভরসা করি, তিনি “পিতার” উপযুক্ত পুত্র হইবেন।


সম্পূর্ণ।