বিষয়বস্তুতে চলুন

দ্বিতীয় চরিতাষ্টক/মদনমোহন তর্কালঙ্কার

উইকিসংকলন থেকে

কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার।

 ইনি, ১২২২ সালে (১৮১৫ খৃঃ) নদীয়া জিলার অন্তর্গত বিল্লগ্রামে ব্রাহ্মণ কুলে জন্ম গ্রহণ করেন। ইঁহার পিতার নাম রামধন চট্টোপাধ্যায়। পুত্র কন্যায় তাঁহার পাঁচ সন্তান, তন্মধ্যে মদনমোহন জ্যেষ্ঠ। রামধন সংস্কৃত কলেজের গ্রন্থ লেখকের কার্য্য করিতেন। রামধনের পর তাঁহার কনিষ্ঠ রামরত্ন ঐ কার্য্য প্রাপ্ত হন। তিনি মদনকে কলিকাতা লইয়া গিয়া সংস্কৃত কলেজে পাঠার্থ নিযুক্ত করিয়া দেন। তখন তাঁহার বয়ঃক্রম আট বৎসর। মদন ইহার পূর্ব্বে স্বগ্রামস্থ কোন পাঠশালায় কিছু দিন পড়িয়া টোলে সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিলেন।

 কিছু দিন কলিকাতায় থাকিয়া তাঁহার উদরাময় হইল। বাড়ী চলিয়া গেলেন। প্রায় তিন চারি বৎসর দেশীয় অধ্যাপকগণের টোলে সংস্কৃত ব্যকরণ ও সাহিত্য পড়িলেন। পরে ১২৩৬ সালে পুনরায় সংস্কৃত কালেজে প্রবিষ্ট হইলেন। ঐ বৎলর সুবিখ্যাত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলেজে প্রথম প্রবিষ্ট হন। তখন তাঁহার বয়স দশ বৎসর। মদনের সঙ্গে এক শ্রেণীতে ব্যাকরণ পড়িতে লাগিলেন। ক্রমশঃ উভয়ের অত্যন্ত প্রণয় হইল। বুদ্ধি বিষয়ে কেহই কম ছিলেম না। পরীক্ষায় দুই জনেই উত্তমরূপে উত্তীর্ণ হইতেন। সে শ্রেণীতে পারিতোষিক হইলে তাঁহারা ভিন্ন আর কেহ পাইতেন না। তিনবৎসরে ব্যাকরণ পাঠ সম্পন্ন করিয়া উভয়েই সাহিত্য শ্রেণীতে উঠেন। এই শ্রেণীতে কিছু দিন পড়িতে পড়িতেই মদনমোহন সংস্কৃত ও বাঙ্গালা কবিতা রচনা করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার কবিতা গুলি সরল ও মিষ্ট হইত এবং তিনি পাঠ্য পুস্তক সকল উত্তমরূপে বুঝিতেন। এই জন্য তৎকালীন সাহিত্যাধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার তাঁহাকে ভাল বাসিতে লাগিলেন। দুই বৎসর সাহিত্য শ্রেণীতে পড়িয়া অলঙ্কার শাস্ত্রের শ্রেণীতে উঠিলেন। তখন তাঁহার বয়স ১৭ বৎসর। তিনি অতি সত্বরই অলঙ্কারে ব্যুৎপত্তিলাভ করেন। বিশেষতঃ পদ্য গ্রন্থনে ক্রমেই তাঁহার ইচ্ছা ও শক্তি বাড়িতে লাগিল। এই সময়ে প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ এই শ্রেণীর অপ্যাপক ছিলেন। তিনিও মদনমোহনের শিক্ষানৈপুণ্য দেখিয়া সন্তুষ্ট হন। মদনমোহন, এই শ্রেণীতে পড়িবার সময় সংস্কৃত “রসতরঙ্গিনী” গ্রন্থের বাঙ্গলা পদ্যে অনুবাদ করেন। তাঁহার ঐ বাঙ্গালা কবিতা গুলি বেশ মিষ্ট ও সুললিত; কিন্তু পলকগণের পাঠ্য পুস্তকে তুলিয়া দিবার যোগ্য নহে। কাব্য শাস্ত্রে অনুরাগ দেখিয়া এই সময়ে তাঁহার অধ্যাপকেরা তাঁহাকে “কাব্যরত্নাকর” এই উপাধি দেন। কিন্তু কোন্ সময়ে কি কারণে তাঁহার “তর্কালঙ্কার” উপাধি হয়, জানা যায় না।

 দুই বৎসর অলঙ্কার পড়িয়া কিছু কাল জ্যোতিষ ও দর্শনশাস্ত্রের আলোচনা করেন। ইহার পর স্মৃতির শ্রেণীতে পাঠারম্ভ করেন। তিন বৎসর কাল এই শ্রেণীতে পড়িয়া স্মৃতির পরীক্ষা দেন। ঐ পরীক্ষায় এক শত একুশ প্রশ্ন প্রদত্ত হয়, তন্মধ্যে মদনমোহন আটচল্লিশটা প্রশ্নের সুন্দর উত্তর দিয়াছিলেন। তদপেক্ষা অধিক আর কেহই লিখিতে পারেন নাই। ঐ পরীক্ষায় তিনি এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উত্তীর্ণ হইয়া প্রশংসা পত্র লাভ করেন। মদনমোহন স্মৃতির শ্রেণীতে পড়িবার সময় “বাসবদত্তা” নামক এক খানি বাঙ্গালা কাব্য পদ্যে প্রণয়ন করেন। এই সময়ে তাঁহার বয়ঃক্রম একুশ বৎসর মাত্র। ইহা সংস্কৃত “বাসবদত্তার” গল্প লইয়া লিখিত হয়। যশোহর জিলার অন্তর্গত নওয়া পাড়ার জমিদার কালীকান্ত রায়ের প্রবর্ত্তনায় ১২৪৪ সালে উহা রচনা করেন। কেহ কেহ বলেন, “রসতরঙ্গিনী” ইহার পরের রচিত। কথিত আছে, বাঙ্গালা কবিতা রচনা বিষয়ে ভারতচন্দ্রকে পরাজিত করিবার বাসনায় তিনি “বাসবদত্তা” রচনা করেন। কিন্তু পরিশেষে উভয় রচনার তুলনা করিয়া দেখিলেন যে, ভারতকে হারাইতে পারেন নাই। তদবধি বাঙ্গালা কবিতা লেখা প্রায় ছাড়িয়া দেন। বোধ হয়, এরূপ ক্ষণিক ইচ্ছার বশবর্ত্তী হইয়া কবিতা গ্রন্থনে নিবৃত্ত না হইলে, তিনি ভবিষ্যতে উহাতে কৃতকার্য্য হইতে পারিতেন। যেহেতু বাল্যকালেই তাঁহার ঐ শক্তির স্ফ‌ুর্ত্তি হইয়াছিল। যাহা হউক, ১২৫০ সালে (১৮৪২ খৃঃ) তিনি পাঠ সাঙ্গ করিয়া কলেজ ছাড়িলেন।

 কালেজ ছাড়িয়া প্রথমে তিনি কলিকাতার বাঙ্গালা পাঠশালায় ১৫৲ টাকা বেতনে পণ্ডিত হয়েন। পরে বারাসতের গবর্ণমেণ্ট ট্রেবর বিদ্যালয়ের প্রধান পণ্ডিতের পদে ২৫৲ টাকা বেতনে নিযুক্ত হন। তথায় এক বৎসর মাত্র কাজ করিয়া ফোর্ট উইলিয়ম্ কালেজের অধ্যাপকের পদ পাইলেন। এই পদের বেতন ৪০৲ টাকা ছিল। তথায় দুই বৎসর প্রশংসার সহিত কর্ম্ম করিয়াছিলেন। তাঁহার সাহেবছাত্রেরা তাঁহাকে যথেষ্ট ভক্তি করিতেন। যে সকল সিবিলিয়ান্ সাহেব এদেশে কর্ম্ম করিতে আসেন, তাঁহারা ঐ কালেজে বাঙ্গালা শিক্ষা করেন। এই সময়ে কৃষ্ণনগর কলেজ স্থাপিত হয়। তর্কালঙ্কার ৫০৲ টাকা বেতনে তাহার প্রধান পণ্ডিতের পদ পান। ঐ পদে এক বৎসর মাত্র কর্ম করিয়া সংস্কৃত কলেজের সাহিত্য শাস্ত্রাধ্যপিকের পদে ৯০৲ টাকা বেতনে নিযুক্ত হইলেন। এত দিনে তাঁহার গুণের গৌরব ও পরিশ্রমের কতক পুরস্কার হইল। তিনি উৎসাহ ও আনন্দের সহিত অধ্যাপনা কার্য্য করিতে লাগলেন। ছাত্র ও উপরিতন কর্ম্মচারীরা তাঁহার কাজে সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি তিন বৎসর সংস্কৃত কলেজের কর্ম্ম করেন।

 এই সময়ে মহামান্য ড্রিঙ্ক‌‍্ওয়াটার বেথুন সাহেব এ দেশীয় স্ত্রীগণকে শিক্ষাদিবার জন্য এ দেশীয় প্রধান প্রধান সুশিক্ষিতগণের সহযোগিতা গ্রহণ করিতে ছিলেন। মদনমোহনও তাঁহার সহিত মিলিত হইয়া অনেক পরিশ্রম করেন। মদনমোহনের চরিতাখ্যায়ক বলেন, যেদিন বেথুনবালিকা বিদ্যালয়ের ভিত্তি সংস্থাপিত হয় সেই দিন মদনমোহন তথায় উপস্থিত থাকিয়া ভূমিতে নবরত্ন নিহিত করেন। এবং তখন বিদ্যালয়ে কেহ বালিকা প্রেরণে সম্মত হন নাই, কিন্তু তর্কালঙ্কার সব প্রথমে আপনার দুই কন্যা পাঠাইয়া পথ প্রদর্শক হইয়াছিলেন। তারানাথ তর্ক বাচস্পতি এবং জজ্ শম্ভনাথ পণ্ডিত পরে আপন আপন কন্যা বিদ্যালয়ে পাঠান। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষা দিবার ভার তাঁহার উপরই অর্পিত হইয়াছিল। তিনি প্রতিদিন প্রাতে বালিকাদিগকে শিক্ষা দিতেন। তখন নীতিকথা ও শিশুবোধকাদি কয়খানি পুস্তকই বালিকাদিগের পাঠ্যপুস্তক ছিল। মদনমোহন বালিকাদিগের পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূরীকরণার্থ ১২৫৭ সালে (১৮৪৯ খৃঃ) তিন খণ্ড শিশু শিক্ষা রচনা করেন। অনেকেই স্বীকার করেন যে, শিশুশিক্ষার পূর্ব্বে বালক বালিকার পাঠোপযোগী তাদৃশ সরল বাঙ্গালা আর লিখিত হয় নাই। প্রথমভাগ শিশুশিক্ষা তিনি বেথুন্ সাহেবের নামে উৎসর্গ করেন। এই সময়ে কলিকাতার সংস্কৃত মুদ্রাযন্ত্র তাঁহারই যত্নে স্থাপিত হয়। তাহাতে বাঙ্গালা ও সংস্কৃতের অনেক প্রাচীন গ্রন্থ মুদ্রিত হয়। “সর্ব্ব শুভকরী” নাম্নী এক খানি বাঙ্গলা সম্বাদ পত্রিকা তাঁহার যত্নে প্রচারিত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। তিনি নিয়মিতরূপে উহাতে প্রস্তাব সকল লিখিতেন। স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী স্বাধীনতা বিষয়ে তিনি অনেক প্রস্তাব লিখিয়াছিলেন। তৎকালে সকলেই তাঁহার ঐ সকল লেখার প্রশংসা করিতেন। তিনি “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ।” মহা নির্ব্বাণ তন্ত্রের এই বচন উদ্ধত করিয়া লোকদিগকে স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে উৎলাহিত করিতেন। কিন্তু বন্ধ সমাজের অবস্থা পর্য্যা লোচনা করিতে ও “নস্ত্রেীস্বাতন্ত্র্যমর্হতি” এই রচন উদ্ধৃত করিতে বিস্মৃত হইয়াছিলেন।

 স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে অন্তরের সহিত যত্ন ও পরিশ্রম করিতেন বলিয়া বেথুন সাহেব তাঁহার পুরস্কার করিতে ইচ্ছা করিলেন। মদনমোহনের নিকট এই ভাব প্রকাশ করায় তিনি এই অভিপ্রায়ে উত্তর করিয়াছিলেন, “আপনি অপার সমুদ্র পার হইতে আসিয়া বঙ্গবালাগণের দুরবস্থা মোচনের চেষ্টা করিতেছেন, আমি বাঙ্গালী হইয়া সেই চেষ্টার কিঞ্চিম্মাত্র সহায়তা করিয়া কোন ক্রমেই পুরস্কারের যোগ্য নহি।” বেথুন ইহাতে অধিকতর সন্তুষ্ট হন। সাহেব প্রথমে তর্কালঙ্করকে বিদ্যালয়ে শিক্ষা দান নিবন্ধন বেতন লইতে অনুরোধ করেন, মদন তাহা অস্বীকার করিয়া ঐ পদে গিরীশ বিদ্যারত্নকে নিযুক্ত করিয়া দেন। এই সময়ে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ শূন্য হয়। বেথুন তর্কালঙ্কারকে ঐ পদ দিতে চাহেন। তর্কালঙ্কার, আপনাপেক্ষা বিদ্যাসাগরকে ঐ পদের অধিক যোগ্য স্বীকার করিয়া তাঁহাকে ঐ পদ দিতে অনুরোধ করেন। তর্কালঙ্কারের চরিতাখ্যায়ক এই কথার সত্যতায় সংশয় করেন। তিনি বলেন “ইহা সত্য হইলে তর্কালঙ্কার বন্ধুত্ব ও ঔদার্যের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া গিয়াছেন।”

 কলিকাতার জল বায়ু তর্কালঙ্কারের সহ্য হইত না। তিনি যত কাল কলিকাতায় ছিলেন, বরাবর অস্বাস্থ্য ভোগ করিতেন। ক্রমে তাঁহার অস্বাস্থ্য বদ্ধ-মূল হইতে লাগিল। এই সময়ে মুরসিদাবাদের জজ্ পণ্ডিতের পদ শূন্য হওয়ায় তিনি ঐ পদে নিযুক্ত হইবার জন্য বেথুন সাহেবকে বলেন। বেথুন তর্কালঙ্কারের কুশলার্থী ছিলেন। তিনি বাঙ্গালা গবর্ণমেণ্টকে এজন্য বিশেষ রূপে অনুরোধ করায় তর্কালঙ্কার ঐ পদ প্রাপ্ত হইলেন। ঐ পদের বেতন মাসে ১৫০ টাকা ছিল। গ্রন্থ ও সম্বাদপত্র প্রচার, স্ত্রী শিক্ষার সহায়তা এবং উৎকৃষ্ট স্বভাব প্রযুক্ত ইহার পূর্ধ্ব হইতে দেশমধ্যে তাঁহার সুখ্যাতি প্রচারিত হইয়াছিল। মুরসিদাবাদে গিয়া তত্রত্য ব্যক্তিগণ দ্বারা তিনি সমাদরে ও পরিচিত বন্ধুর ন্যায় পরিগৃহীত হইলেন। ছয় বৎসর জজ্ পণ্ডিতের কাজ করিয়া ঐ স্থানেই ডেপুটী মাজিষ্টরের পদ পান। বিদ্যা, বুদ্ধি ও সরল ব্যবহারে তত্রত্য সকলেই তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। জজ্ পণ্ডিতের কর্ম্ম করিবার সময় তাঁহার যথেষ্ট অবসর ছিল। এইজন্য মুরসিদাবাদের হিতের জন্য অনেক সদনুষ্ঠানে মনোযোগ করিতে পারিয়া ছিলেন। মধ্যে মধ্যে সভাস্থাপন ও তাহাতে বক্তৃতা করিয়া লোকদিগকে সৎকার্য্যে প্রবৃত্ত দিতেন। বিধবা ও অনাথ বালক বালিকাদিগের সাহায্য জন্য একটি দাতব্য সমাজ স্থাপন করিয়াছিলেন। তদ্ব্যতীত মুরসিদাবাদে একটি অতিথিশালা স্থাপন করেন। মদনমোহনের যাইবার পূর্ব্বে মুরসিদাবাদে এতাদৃশ সাধারণ হিতকর কাজের অনুষ্ঠান প্রায় ছিল না।

 মদনমোহন জজ্ পণ্ডিতের পদ ত্যাগ করিলে শ্রীযুক্ত শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ঐ পদে নিযুক্ত হন। ১২৬২ সালে (১৮৫৫খৃঃ) শ্রীযুক্ত বিদ্যাসাগরের “বিধবা বিবাহ বিষয়ক’ প্রথম পুস্তক প্রকাশিত হয়। দেশীয় পণ্ডিত গণ, হিন্দু আঢ্যগণের সাহায্যে ঐ পুস্তকের উপর অনেক আপত্তি উত্থাপিত করিয়া কতকগুলি পুস্তক বাহির করিলেন। বিদ্যাসাগরও প্রচুর পরিমাণে শাস্ত্রীয় প্রমাণ, যুক্তি ও বিচারশক্তি দ্বারা ঐ সকল আপত্তির খণ্ডন করিয়া তিন চারশত পৃষ্ঠা পরিমিত “বিধবা বিবাহ বিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তক” এই নামে এক বৃহৎ গ্রন্থ প্রচার করিলেন। উহার উত্তর দানে কেহ সমর্থ হইলেন না। সুতরাং প্রায় সকলকেই বিশ্বাস করিতে হইল যে, বিধবা বিবাহ অশাস্ত্রীয় নহে। প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ প্রভৃতির উদ্যোগে বিদ্যাসাগর কলিকাতার ব্যবস্থাপক সভা হইতে পর বৎসর এক আইন্ পাস করাইলেন। উহার মর্ম্ম এই বিধবা বিবাহে জাত পুত্রগণ পৈতৃকধনের অধিকারী হইবে। ঐ আইনকে ১৮৫৬ সালের ১৫ আইন কহে। উপরি উক্ত জজ‍্পণ্ডিত শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এই নূতন নিয়মানুসারে ১২৬৩ সালের ২৩এ অগ্রহায়ণ সব প্রথম বিধবা বিবাহ করেন। মদনমোহন তর্কালঙ্কারই এই বিবাহের ঘটক ছিলেন। দেশাচার বিরুদ্ধ স্ত্রীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহে সহায়তা করায় মদনমোহনের উপর গ্রামস্থ লোকরা খড়্গ-হস্ত হইয়াছিলেন। তিনি এই অপরাধে গ্রাম মধ্যে আট নয় বৎসর সমাজচ্যুত হয়। ছিলেন। এছাড়া, এজন্য তাঁহাকে অনেক নিগ্রহ ভোগ করিতে হইয়াছিল। তাঁহার বিপক্ষেরা যাহাই বলুন, এস্থলে মোটের উপর আমরা এই কথা বলিতে পারি, কোনরূপ অনিষ্টকর প্রথার নিরাকরণ বা নুতন বিধ মঙ্গলানুষ্ঠান করিতে গিয়া বিড়ম্বনা ভোগ করিলে—সে বিড়ম্বনায় মনুষ্য জীবনের গৌরব বৃদ্ধি হয়।

 মুরসিদাবাদে অবস্থিতি কালে তর্কালঙ্কার বেথুন্ সাহেবের মৃত্যু সম্বাদ পান। এই সম্বাদে তিনি শোকার্ত্ত হইয়াছিলেন। কারণ বেথুনের সহিত তাঁহার একটু আন্তরিক সম্বন্ধ ছিল। সাহেব ও বাঙ্গালীর মধ্যে প্রায় সেরূপ থাকে না। তর্কালঙ্কারের কন্যাদ্বয়কে বালিকাকালে বেথুন্ কোলে করিয়া আপনার বাড়ী লইয়া যাইতেন। ইহার পর তিনি কান্দীর সব্ ডিবিসন্ প্রাপ্ত হন। কথিত আছে, তাঁহার ইচ্ছানুসারে তাঁহার জন্যই ঐ সব ডিবিসন্ স্থাপিত হয়। তিনি কান্দীর অনেক উন্নতি করিয়া গিয়াছেন। বালক বালিকার বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, অতিথিশালা, পথ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বিস্তর শ্রম ও যত্ন করিয়াছিলেন। তিনি ডেপুটি মাজিষ্টর ভাবে এসকল করিতে বাধ্য ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু তিনি কার্য্যের দ্বারা দেখাইয়া গিয়াছেন যে, লোকের ভাল করিবার ইচ্ছা তাঁহার অন্তরে ছিল। কিছু দিনের পর শুনিলেন, তাঁহার মহকুমার মধ্যে “মাকালতোড়” নামক স্থানে কোন বিশেষ পর্ব্বাহোপলক্ষে দুইজন দুর্দ্দান্ত মুসলমান জমিদারের মধ্যে বৎসর বৎসর ভয়ানক দাঙ্গা হয়। ঐ দাঙ্গায় অনেক লোক হতাহত হইয়া থাকে। ইহাও শুনিলেন, একবার একজন সাহেব মাজিষ্টর দাঙ্গা নিবারণ করিতে গিয়া হত হইয়াছিলেন। তিনি শান্তিরক্ষক,—নিজ মহুকুমার শান্তি রক্ষা করা তাঁহার কর্ত্তব্য ইহা তর্কলঙ্কারের মনে সতত জাগরূক থাকিত। এই কর্ত্তব্য বুদ্ধির উত্তেজনায় তিনি একবার ঐ দাঙ্গা নিবারণার্থ অশ্বারোহণে মাকালতোড়ে স্বয়ং উপস্থিত হন। বিবাদকারিগণ তাঁহাকে আক্রমণ করে। অশ্ব আহত হইয়া ভূপতিত হয়। তিনিও সেই সঙ্গে ভূমিতলে নিপতিত হইয়া মুর্চ্ছা প্রাপ্ত হন। একজন প্রভু পরায়ণ ভৃত্য সে যাত্রায় তাঁহার প্রাণ রক্ষা করে। কয়েক জন পুলিস্ সৈন্য সঙ্গে যায়; কিন্তু তাহারা প্রচুর পরিমাণে সাবধানতা অবলম্বন করিয়া “তফাৎ” ছিল।

 কিছুদিন পরে পুনর্ব্বার মাকালতোড়ে গিয়া কয়েক জন অপরাধী ধরিয়া আনেন এবং তাহাদের যথাযোগ্য। শাস্তি দেন। কিন্তু তাহারা জমিদার, সকল লোকই তাহাদের বশীভূত, এইজন্য উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাহারা উচ্চ আদালত হইতে নিষ্কৃতি পায়। এই ঘটনায় মদনমোহন নিতান্ত ভগ্ন-হৃদয় হইয়া পড়েন এবং দুর্ব্বৃত্ত জমিদারগণকে শত্রু করিয়া তাঁহার অত্যন্ত ভয়ও হইয়াছিল। সর্ব্বদা প্রাণভয়ে শঙ্কিত থাকিতেন। যে দিন তাহাদের নিষ্কৃতির সম্বাদ পান, সেই দিন বলিয়াছিলেন,—“আজ আমার অর্ধমৃত্যু হইল।” তিনি এই সময় হইতে কর্ম্ম ছাড়িয়া দিবার সঙ্কল্প করেন। নানা কারণে প্রকৃতরূপে শান্তিরক্ষা করিবার যো নাই, তাঁহার মনে এই ভাবের উদয় হইয়াছিল। এই জন্য তিনি কর্ম্ম ছাড়িয়া কবিতা রচনা করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিবার সংকল্প করেন। কিন্তু এ সকল সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত হইবার পূর্ব্বেই তাঁহার মৃত্যু হয়। ঐ সময়ে কান্দীতে বিসুচিকা রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তিনি ঐ রোগে ১২৬৪ সালের (১৮৩৭ খৃঃ) ২৭ ফাল‍্গুন প্রাণত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি বিধবা পত্নী ও অনেক গুলি পুত্রকন্যা রাখিয়া যান। তাঁহার অভাগিনী জননী এতাদৃশ পুত্র যমের মুখে দিয়া আজও জীবিতা আছেন। তাঁহার পাঁচ কন্যা বর্ত্তমান। কন্যাগণের মধ্যে কেহ কেহ লেখাপড়া জানেন ও কবিতা লিখিতে পারেন।

 মদনমোহন তর্কালঙ্কার মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁহার পত্নীকে সম্বোধন করিয়া এই কয়টা কথা বলিয়াছিলেন,—“তুমি কেঁদোনা, তোমার চিরসহচর তোমায় ফেলিয়া পলায়ন করিতেছে বটে, কিন্তু তাহার প্রাণসখা ঈশ্বর[] তোমায় নিরাশ্রয় অবস্থায় আশ্রয় দিবে। তাহার জীবদ্দশায় তুমি ও আমার প্রাণসমা কন্যাগণ কোন কষ্ট পাইবে না। ** আমি তোমাদের নিকট এই ভিক্ষা চাই, যেন প্রশান্তভাবে মরিতে পাই,—মৃত্যুর পূর্ব্বে যেন আমায় শয্যা হইতে নামান না হয়।”

 মদনমোহন অনেক গুলি সংস্কৃত গ্রন্থের সংশোধন ও মুদ্রাঙ্কন করিয়াছিলেন। যখন এ দেশে বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষার ভত প্রচলন ছিল না, তখন তিনি গদ্য ও পদ্যে উৎকৃষ্ট রচনা শক্তির পরিচয় দিয়াছিলেম। তিনি সংস্কৃত ভাষাতেও অনেক সুমধুর ও সুললিত কবিতা লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সংস্কৃত কবিতার অনেক পদ, জয়দেবের “মধুর-কোমল-কান্তপদাবলীর” সদৃশ। কি সংস্কৃত কি বাঙ্গলা উভয়বিধ কবিতার অনেক ছন্দ, রাগরাগিণী ও তালের সহিত সুসঙ্গত করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন। তিনি এত অধিক ছন্দের সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন, বোধ হয়, বাঙ্গলা কবির মধ্যে কেহই তদ্বিষয়ে তাহার সমকক্ষ নহে। অথচ ঐ সকল ছন্দই বিশুদ্ধ ও সুমিষ্ট। সুললিত পদ-বিন্যাস ও ছন্দবন্ধ বিষয়ে তাঁহার যাদৃশী ক্ষমতা ছিল, প্রকৃত কবিত্ব প্রকাশে সেরূপ ছিল না। শুনা যায়, তিনি আর একখানি বৃহৎ পুস্তক লিখিয়াছিলেন, মৃত্যুকালে তাহার পাণ্ড‌ুলিপি অপঅপহৃত হয়। তিনি বঙ্গকামিনীগণের জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। এখনকার বাঙ্গালা রচনার মধ্যে কথায় কথায় “উন্নতিসোপানে পদবিক্ষেপ’” এইরূপ শব্দ বিন্যাস দেখিতে পাওয়া যায়। মদনমোহনের জীবন চরিত পড়িলে ঐ কথার অর্থ বুঝা যায়। তিনি বাঙ্গালা স্কুলের পাণ্ডিত্যরূপ নীচের ধাপ হইতে প্রতি ধাপ স্পর্শ পূর্ব্বক উঠিয়াছিলেন। তাঁহার চরিত্রে উৎসাহ, হিতৈষা, সরলতা কর্তব্যনিষ্ঠা, তেজস্বিতা, ইত্যাদি গুণ গুলি স্পষ্ট দৃষ্ট হইত।


  1. শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে লক্ষ্য করিয়া।