নারী-চরিত/লোক হিতৈষিণী এলিজাবেথ ফ্রাই

উইকিসংকলন থেকে

লোক হিতৈষিণী এলিজাবেথ ফ্রাই।

 ১৭৮০ খৃষ্টাব্দের ২১এ মে, ইংলণ্ডের অন্তঃপাতি নরউইচ্‌ নগরে এলিজাবেথ ফ্রাই জন্ম পরিগ্রহ করেন। তাঁহার পিতার নাম যোহন গর্ণি; তিনি লণ্ডন নগরের এক জন সুপ্রসিদ্ধ ধনবান্ বণিক। এলিজাবেথ শৈশবকালে অত্যন্ত ভীরু, বলহীনা ও মৌনপরায়ণা ছিলেন। তিনি কোন রূপ শব্দ শুনিলেই ভয়ে কম্পিত হইতেন, এবং কেহ তাঁহার প্রতি একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিলেই ক্রন্দন করিয়া উঠিতেন। তাঁহার শরীর এরূপ শীর্ণ ও রুগ্ন ছিল, যে লোকে প্রতি দিন তাঁহার মৃত্যু শঙ্কা করিত। তাঁহার মৃদুভাব দর্শনে সকলেই অনুমান করিয়াছিল, যে তিনি নিতান্ত নির্ব্বুদ্ধি, অলস ও অকর্ম্মণ্য হইবেন এবং বুদ্ধির জড়তা বশতঃ রীতিমত অধ্যয়ন করিতেও পারিবেন না।

 এলিজাবেথ, জননীকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন, পাছে তাঁহার অজ্ঞাতসারে কোন দৈব ঘটনায় মাতার মৃত্যু হয়, এই ভয়ে তিনি সমস্ত রজনী জাগ্রত থাকিয়া অনবরত রোদন করিতেন। তাঁহার পিতা মাতা, তাঁহাকে নিতান্ত দুর্ব্বল ও একান্ত বুদ্ধিহীন জানিয়া শ্রমসাধ্য অধ্যয়নেও নিযুক্ত করেন নাই। এলিজাবেথের একাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম না হইতেই তাঁহার মাতার মৃত্যু হয়। মাতৃশোকে তিনি অত্যন্ত কাতর হন। তাঁহার পিতা অতিশয় বুদ্ধিমান ও সরল স্বভাব ছিলেন; প্রিয়তম বনিতাবিয়োগের পর, তিনি আপন সন্তানগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণ, যথানিয়মে বিদ্যাশিক্ষা ও সমুচিত প্রযত্নে প্রতিপালন করিতেলাগিলেন।

 বয়োবৃদ্ধি সহকারে এলিজাবেথের শরীর ক্রমে ক্রমে যে রূপ সবল হইতে লাগিল, তদ্রুপ তদীয় স্বভাবেরও সম্যক্‌ পরিবর্ত্তন লক্ষিত হইল। তিনি পূর্ব্বতন অলস ভাবি পরিত্যাগ করিয়া পরিশ্রম সহকারে লেখা পড়া শিখিতে যত্নবতী হইলেন। শরীরের দুর্ব্বলতা হেতু শৈশব কালে যে সকল বিদ্যা অধ্যয়ন করিতে পারেন নাই, অধুনা অল্পকাল মধ্যেই তাহাতে বিলক্ষণ ব্যুৎপত্তি লাভ করিলেন। বিশেষতঃ শিল্প ও সঙ্গীত বিদ্যায় তাঁহার অসামান্য নৈপুণ্য জন্মিয়াছিল। তিনি যেমন গুণবতী তেমনই রূপবতী ছিলেন। তদীয় মনোহর রূপ মাধুরীর কথা ও বিশিষ্ট বিদ্যাজ্যোতিঃ সর্ব্বত্র প্রকাশিত হইলে আপামর সাধারণ সমীপে তিনি সবিশেষ গৌরবান্বিত হইলেন।

 এলিজাবেথ, লণ্ডন নগরে থাকিয়া স্বীয় ভগিনী ও অপরাপর বয়স্যাগণের সহিত নানা প্রকার সমাজে ভ্রমণ করিতেন; বিলাসিনী বয়স্যাদিগের সহবাসে যৌবন সুলভ অসার আমোদ প্রমোদে তাঁহার মন একান্ত অনুরক্ত হইল। কিন্তু এই অলীক আহ্লাদ আমোদ, তাঁহার হৃদয় ক্ষেত্রে অধিক কাল স্থায়ী হয় নাই। অনতিকাল বিলম্বেই তিনি সাংসারিক ভোগ বিলাস হইতে নিরস্ত হইবার নিমিত্ত প্রতিজ্ঞা করিলেন। ভাবিলেন অকিঞ্চিৎকর বিষয় সুখে অনুরক্ত হওয়া মনুষ্য মাত্রেরই অনুচিত। কেবল ঈশ্বরের প্রিয় কার্য্য সাধন করা ও লোক সমাজের হিতচেষ্টা করাই একান্ত কর্ত্তব্য। এই রূপে তিনি কখন সংসার ও কখন ঈশ্বরের দিকে ধাবমান হইতেন।

 এই প্রকার অবস্থায় তাঁহার কিছুকাল গত হইল। পরে একদা আপন ভগিনীগণের সহিত উপাসনালয়ে গমন করেন। তথায় ধর্ম্মপ্রচারকের শান্তিরস পুর্ণ সুমধুর উপদেশ বাক্য শ্রবণে, তাঁহার অন্তঃকরণ এককালে ভক্তি রসে অভিষিক্ত হয়। তখন অশ্রুপাত কবিতে করিতে নিজালয়ে প্রত্যাগতা হন, সেই অবধি তিনি সাংসারিক সুখে জলাঞ্জলি দিয়া নিয়ত ধর্ম্ম চিন্তায় কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এলিজাবেথ বহুকষ্টে সংসারের মোহ জাল হইতে মুক্তি পাইয়া প্রথমতঃ ভোগবিলাসিনা বয়স্যাগণের সঙ্গ ও লণ্ডন নগর পরিত্যাগ করেন। পরে পিত্রালয়ে অবস্থিতি করিয়া অহর্নিশি পরোপকার ব্রত পালন পূর্ব্বক সাধ্যানুসাৱে দীন দরিদ্রদিগের দুঃখ মোচন এবং রোগিদিগের আরোগ্য চেষ্টা ও অধার্ম্মিক দিগকে জ্ঞানদান করা তাঁহার প্রধান কার্য্য হইয়া উলে।

 পাছে সদনুষ্ঠানে ব্যাঘাত জন্মে; এজন্য এতকাল পর্য্যন্ত এলিজাবেথ বিবাহ করেন নাই। এক্ষণে লণ্ডন নগরবাসি যুষফ ফ্রাই নামক এক সদ্‌গুণসম্পন্ন ধনবান ব্যক্তির সহিত তিনি উদ্বাহ সূত্রে বদ্ধ হইলেন। এলিজাবেথ, যে ভাবনায় বিবাহ বিষয়ে পরাঙ্‌মুখ ছিলেন অতঃপর তাঁহার তাহাই ঘটিল তিনি পিতৃগৃহের সহিত নিজ স্থাপিত বিদ্যালয় ত্যাগ করিয়া লণ্ডন নগরে বাস করিতে বাধ্য হইলেন। কিন্তু স্বকীয় একান্ত ধর্ম্মশীলতাগুণে তথায় দিবানিশি ধর্ম্মচর্চ্চা, নিয়ত পরহিত সাধন, ও গার্হস্থ্য ধর্ম্মের উন্নতি চেষ্টা করত, সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। বিবি ফ্রাই, অত্যন্ত দয়াবতী ছিলেন। স্বীয় দান গ্রহণের উপযুক্ত পাত্রাম্বেষণে সর্ব্বদা তৎপর থাকিতেন, তিনি আপন গ্রন্থে লিখিয়াছেন, যে ‘‘করুণাময় পরমেশ্বর আমাকে সংসার যাত্রা নির্ব্বাহের প্রয়োজনাধিক দ্রব্য প্রদান করিয়াছেন, অতএব তদ্দ্বারা দীন দুঃখীর উপকারসাধন করা আমার অতীব কর্ত্তব্য”। বিবি ফ্রাই, স্বামীর অত্যন্ত প্রণয়িনী ছিলেন, তাঁহারা একাদিক্রমে নয় বৎসর কাল সম্প্রীতিতে লণ্ডনে বাস করেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁহার পাঁচটী সন্তান জন্মিয়াছিল।

 অনন্তর ফ্রাই, লণ্ডন নগর পরিত্যাগ করিয়া পালসেট্‌ নামক পল্লিগ্রামে বাস করিলেন। পিতৃগৃহে বাসকালের ন্যায় পল্লিগ্রামের স্বাভাবিক শোভা সন্দর্শনে তিনি অতিশয় উৎসুক ছিলেন; এক্ষণে পালসেট্‌ গ্রামে অবস্থিতি করিয়া তাঁহার সেই অভিলাষ সফল হইল। তিনি সময়ে সময়ে আপন সন্তানগুলিকে সমভিব্যাহারে লইয়া উদ্যান মধ্যে গমন করিতেন; ইতস্ততঃ পাদ চারণ কালে তাহাদিগকে পদার্থ বিদ্যা বিষয়ক নানাবিধ উপদেশ দিতেন। তদীয় যত্নে ও পরিশ্রমে পালসেট্‌ গ্রামে একটা বালিকাবিদ্যালয় সংস্থাপিত হয়। এলিজাবেথ স্বয়ং বালিকাদিগকে শিক্ষা দান করিয়া অতি অল্পকাল মধ্যে বিদ্যালয়ের বিলক্ষণ শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেন। এই রূপে তথায় কিছুকাল বাসের পর, কোন বিখ্যাত চিকিৎসকের সহিত তাঁহার আলাপ হয়। তিনি তাঁহার নিকট চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া তাহাতে বিলক্ষণ বুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁহার সমধিক যত্নে ও সুচিকিৎসায় পালসেট্‌ গ্রামের পার্শ্ববর্ত্তি গ্রাম সমূহ হইতে বসন্ত রোগ প্রায় তিরোহিত হইয়াছিল। তিনি শীতাতুর দরিদ্রকে রোমজাত বস্ত্র ও রোগিদিগের প্রয়োজনীয় নানাবিধ ঔষধ বিতরণ করিয়া যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেন।

 ফ্রাইয়ের, বাসগৃহের অনতিদূরে আয়র্লণ্ড দেশীয় কৃষকদিগের একটী উপনিবেশ ছিল। ঐ কৃষকেরা অতিশয় হীন বুদ্ধি, অসভ্য ও দুষ্ক্রিয়াসক্ত, সুতরাং দুর্গন্ধময় অস্বাস্থ্য গৃহে বাস ও কুৎসিত দ্রব্য ভক্ষণে, তাহারা নিয়ত রুগ্ন ও অকালে কালগ্রাসে পতিত হইত। ফ্রাই, আপন সদ্ব্যবহারে তাহাদিগের যথেষ্ট ভক্তিভাজন হইয়া উঠিলেন। তিনি কৃষক বনিতাদিগকে গার্হস্থ্য ধর্ম্মের সুশৃজ্বলা সাধনোপযোগী উপদেশ প্রদানে নিরন্তর যত্নবতী থাকিতেন। তাহাদিগের মধ্যে ক্ষুধার্ত্তকে আহার, বস্ত্র হীনকে বস্ত্র ও রোগীকে ঔষধ দান করা তাঁহার প্রধান কার্য্য ছিল। কৃষিজীবিরা তদীয় পরামর্শানুসারে আবাস বাটীর সমস্ত দুর্গন্ধ দ্রব্য স্থানান্তরিত করিল এবং রীতিমত বিদ্যা ও ধর্ম্ম শিক্ষার জন্য স্ব স্ব সন্তানদিগকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করিতে লাগিল। এই রূপে সেই অসভ্য জাতিরা অত্যল্পকাল মধ্যেই বিবিধ বিষয়ের উন্নতিসাধন করিয়া আপনাদিগের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিয়াছিল। ফ্রাই, কেবল উক্ত আয়ল ণ্ডীয়দের উন্নতিসাধন করিয়াই নিরস্ত হন নাই। তাঁহার বাটীর সন্নিহিত এক গলিতে কতকগুলি দৈবজ্ঞ বাস করিত; তাহারা নিতান্ত মুর্খ ও একান্ত ধর্ম্ম হীন। সেই দেশে কোন মেলা উপস্থিত হইলে, তথায় যাইয়া শিবির স্থাপন করত করকোষ্টী দেখিয়া লোকের শুভাশুভ গণনায় আপনাদিগের জীবিকা নির্ব্বাহ করিত। দয়শীলা ফ্রাই, তাহাদের দুরবস্থা দর্শনে অত্যন্ত সন্তাপিতা হইয়া ধর্ম্মোপদেশ, ধর্ম্ম পুস্তক বিতরণ ও অর্থদান দ্বারা তাহাদিগর উপকার সাধন করিতেন।

 লোকহিতৈষী এলিজাবেথ, এই রূপে স্বদেশের হিত ও ধর্ম্মোন্নতি চেষ্টায় কাল যাপন করিতে লাগিলেন। কি গৃহে কি অন্যত্রে সকল স্থানেই তাঁহার পরিশ্রমের ত্রুটী ছিল না, তিনি যে যে কর্ম্মে হস্ত ক্ষেপ করিতেন, তাহা সুসম্পন্ন না করিয়া ক্ষান্ত হইতেন না। পরিশ্রমের আধিক্য প্রযুক্ত তিনি মধ্যে মধ্যে পীড়িত হইতেন। ১৮০৯ খৃষ্টাব্দে তাঁহার পিতার মৃত্যু হইল। শৈশব কালাবধি তিনি পিতাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন, এক্ষণে পিতৃবিয়োগয়োগ নিবন্ধন শোকে অত্যন্ত অভিভূত হইলেন; পিতার সমাধি কালে প্রথমতঃ একটীও কথা কহিতে পারেন নাই, কিন্তু ক্ষণকাল পরে শোকতাপ পরিত্যাগ করিয়া এরূপ গম্ভীরভাবে তথায় ঈশ্বরোপাসনা করিতে লাগিলেন, যে তত্রত্য ব্যক্তিরা এককালে চমৎকৃত হইল। ইতিপূর্ব্বে তিনি লজ্জার অনুরোধে কখন কাহার সাক্ষাতে প্রার্থনা বা বক্তৃতা করেন নাই। এলিজাবেথের ধর্ম্ম বিষয়ে বক্তৃতা করিতে অতি আশ্চর্য্য ক্ষমতা জন্মিয়াছিল; তদ্দর্শনে ১৮১১ খষ্টাব্দে ধর্ম্মসঞ্চারিণী সভার সভ্যেরা তাঁহাকে ধর্ম্ম প্রচারকের পদে অভিষিক্ত করিতে মানস প্রকাশ করিলেন। তিনি প্রথমতঃ আপনাকে এই সুকঠিন পদের অযোগ্যা বিবেচনা করিয়া অস্বীকার করেন। পরিশেষে পুনঃ পুনঃ তাঁহাদিগের অনুরোধ পরতন্ত্র হইয়া অগত্যা তাহা গ্রহণ করিতে সম্মত হন। তিনি উৎসাহ সহকারে ধর্ম্মপ্রচার করাতে অনেকের কলুষিত মনে ধর্ম্মজ্ঞান ও সদ্গুণ সঞ্চার হইয়াছিল।

 ফ্রাইয়ের আবাস গৃহের কিয়দ্দূরে নিউগেট্‌ নামে একটী কারাগারে ন্যূনাধিক ৩০০ তিন শত অপরাধিনী স্ত্রীলোক বহুসংখ্যক সন্তান সন্ততির সহিত অবরুদ্ধ ছিল। তাহারা চারিটী ক্ষুদ্র গৃহে বাস করিত। ঐ গৃহ অপ্রশস্ত, দুর্গন্ধময় এবং উহার তলভাগ এরূপ আর্দ্র যে তাহাতে বাস করা দুঃসাধ্য। যৎকিঞ্চিৎ অন্নজল ব্যতীত তাহাদের জীবন ধারণোপযোগী প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিছুমাত্র ছিল না। সকলেই ভূতলে শয়ন, পীড়াদায়ক দ্রব্য ভক্ষণ, শতগ্রন্থি মলিন বাস পরিধান করিয়া নিরন্তর রুগ্ন ও কৃষ কলেবর হইয়া ক্রমশঃ কালগ্রাসে পতিত হইতেছিল। তাহারা কোন উপযুক্ত কার্য্যে নিযুক্ত না থাকাতে আলস্যের বশীভূত হইয়া নিরন্তর দ্যুতক্রিয়া, মদ্যপান এবং বিবাদ বিসম্বাদ ও শপথ প্রভৃতি অসৎঅনুষ্ঠানে সময়াতিপাত করিত। এই হতভাগিনী স্ত্রীদিগের স্বভাব এরূপ ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিয়াছিল, যে কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক তথায় প্রবেশ করিতেও শঙ্কিত হইতেন। আমাদের দয়াশীলা ফ্রাই, ইতিপূর্ব্বে একদিবস এই সকল ব্যাপার পরিদর্শন করিয়াছিলেন।

 ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে, ফ্রাই সেই কারাগৃহস্থিত ব্যক্তিদি গের দুঃখ দূরকরণার্থ কৃতসংকল্প হইয়া কতিপয় সঙ্গিনী সহিত পুনর্ব্বার সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। তথায় প্রবেশ করিবামাত্র অর্দ্ধনগ্ন, লজ্জাহীন, অবরুদ্ধ বনিতারা, এরূপ বেগে আসিয়া বিকটস্বরে তাঁহাদিগের সন্নিপানে অর্থ প্রার্থনা করিতে লাগিল, যে তাহাদিগকে দেখিলে সকলেরই হৃদয়ে বিস্ময় ও করুণার উদ্রেক হয়। তাহাদের উপদ্রবে তথায় ক্ষণকাল দণ্ডায়মান হওয়াও তাঁহাদিগের পক্ষে সুকঠিন হইয়া উঠিল; পাছে কোন অনিষ্ট ঘটে, এই আশঙ্কায় কারাধ্যক্ষ তাঁহাদিগকে সত্বরে অপসৃত হইবার নিমিত্ত বারম্বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু ফ্রাই সেরূপ স্ত্রীলোক ছিলেন না। তিনি সৎকার্য্য সাধনে কখন পরাঙ্মুখী হইতেন না। যদিও অপরাধিনীদিগের সহিত যৎকিঞ্চিৎ কথোপকথন করিয়া সে দিবস বিদায় হইলেন বটে, কিন্তু কএক দিবস পরে তত্ত্বাবধায়কের অনুমতি লইয়া সেই ভয়ঙ্কর স্থানে একাকিনী গমন পূর্ব্বক হতভাগিনাদিগকে আহ্বান করিলেন। তাহার আহুত হইবা মাত্র তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিয়া বসিল। তখন ফ্রাই, তাহাদিগের মধ্যবর্ত্তিনী হইয়া ধর্ম্মপুস্তকের কএক অধ্যায় পাঠ ও ব্যাখ্যা করিলেন। তাঁহার অপরূপ শান্তমূর্ত্তি দর্শনে ও সুমধুর উপদেশ শ্রবণে, তাহারা সকলেই সানন্দমনে তাঁহার আজ্ঞাবহ হইতে সস্মত হইল। পাঠ সমাপ্ত হইলে কারাবাসিনীরা স্ব স্ব দুস্কর্ম্ম হেতু পরিতাপিতা হইয়া বারম্বার আপন আপন পরিত্রাণের উপায় জিজ্ঞাসিতে লাগিল। তিনি এই সুযোগে ক্রমশঃ আপন আগমনের হেতু ও মনোগত অভিসন্ধি প্রকাশে প্রবৃত্ত হইলেন। ফ্রাইয়ের প্রিয়বাক্য প্রয়োগে, বন্দিণীরা অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া তাঁহার প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি প্রদর্শন করিতে লাগিল। ফ্রাই আদৌ অপরাধিনীদিগের সন্তান সন্ততির শিক্ষার জন্য কারাগার মধ্যে একটী বিদ্যালয় সংস্থাপনের মানস করিয়া তৎসহকারিণীদিগের নিকট প্রস্তাব করিলেন। তাঁহারা তাহাতে অনুমোদন করিলে এক দিবস বন্দিনীগণকে ঐবিষয় জ্ঞাত করিলেন। অনন্তর তথায় বিদ্যালয় সংস্থাপিত হইলে কারাবাসিনীদের মধ্যে কোন এক কামিনীকে শিক্ষা প্রদানের ভার দিলেন। এই রূপে কারাগারস্থ শিশুদিগের রীতিমত শিক্ষাকার্য্য সম্পন্ন হইতে লাগিল।

 অল্পকাল মধ্যেই সুন্দররূপ শিক্ষা প্রাপ্ত হওয়াতে বালক বালিকাদিগের অন্তঃকরণে বিনয়, নম্রতা প্রভৃতি সদ্গুণ সকল ক্রমশঃ আভির্ভুত হইল। বন্দিনীগণ স্ব স্ব সন্তান সন্ততিদিগের জ্ঞানোন্নতি ও দুষ্ট স্বভাবের পরিবর্ত্তন হইতে দেখিয়া, নিজ নিজ দুরবস্থা মোচন এবং ধর্ম্ম শিক্ষার সদুপায়ের জন্য সাতিশয় ব্যগ্রতা প্রদর্শন করাতে, এলিজাবেথ তাহাদিগের প্রার্থনানুযায়ী কার্য্য সম্পাদন করিতে আরম্ভ করিলেন।

 অনন্তর ‘‘কারাবাসিনীদিগের ঊন্নতি বিধায়িনী’’ নাম্নী একটি সভা সংস্থাপন করেন। সভ্যেরা বন্দিনীদিগের দুরবস্থা দূরীকরণের নিমিত্ত প্রতি নিয়ত ধর্ম্ম ও নীতি শিক্ষা দ্বারা অনতিকাল মধ্যেই তাহাদিগকে সমধিক শান্ত ও বিনীত করিয়া তুলিলেন। প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী প্রদান দ্বারা অশন, বসন, শয়ন ও বাস স্থানের যন্ত্রণা মোচনের উপায় করিয়াদিলেন। যে সকল শিল্প কার্য্যে প্রচুর অর্থ উপার্জ্জন হয় ও চতুরতা জন্মে, এরূপ বিষয় কর্ম্মে তাহাদিগকে সুশিক্ষিত করলেন। যে সকল বিদ্যার আলোচনা করিলে সুখ সচ্ছন্দ মনে কারাগৃহ মধ্যে বাস ও মুক্ত হইলে লোক সমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারা যায়; ফ্রাইয়ের একান্ত অধ্যবসায় ও অনুকম্পায় সেই সকল বিদ্যাই তাহারা শিক্ষা করিয়াছিল। এক বৎসরের মধ্যেই নিউগেট্‌ কারাগারের অবস্থার আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন হইল। একজন কামিনীর অধ্যবসায় ও যত্ন প্রভাবে এই মহৎ কার্য্য সম্পন্ন হওয়াতে, ইউরোপ খণ্ডের নানা স্থান হইতে দর্শকমণ্ডলীর সমাগম হইতে আরম্ভ হইল। রাজ্যের প্রধান প্রধান কর্ম্মচারী, ধর্ম্মাধ্যক্ষ, ও বিদেশীয় পর্য্যাটকেরা কৌতুহলাক্রান্ত চিত্তে তথায় আগমন করত কারাগারের এই রূপ উন্নত অবস্থা দর্শনে গুণবতী ফ্রাইকে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। নীতিবেত্তা ও কবিগণ একবাক্যে তাঁহার গুণ দেশময় পরিব্যাপ্ত করিলেন।

 বিবি ফ্রাই, যে কেবল নিউগেট‌্ কারাগারের উন্নতি সাধন করিয়া ক্ষান্ত হইলেন এমত নহে। যে সকল অপরাধিনী স্ত্রী, গুরুতর অপরাধ জন্য নির্ব্বাসিত হইত, তাহারা নানা প্রকার অত্যাচার ও অশ্রাব্য গান প্রভৃতি অতি জঘন্য কার্য্য সকল করিত; ফ্রাই তাহাদিগের সেই দুর্নীতি নিবারণ ও ধর্ম্ম শিক্ষা দিবার জন্য স্বয়ং অর্ণবপোতে যাইতেন। তিনি তাহাদিগের প্রতি অতিশয় দয়াশীলা ছিলেন; একদা তাঁহার একটী সন্তানের পীড়া হয়, তৎকালে প্রবল ঝড় ও মূসলধারে বৃষ্টি হইতেছিল; এমন সময়েও তিনি নির্ব্বাসিতদিগের সদুপদেশ ও উপকারকার সাধন জন্য তাহাদিগের জাহাজে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার একান্ত অধ্যবসায় এবং সদুপদেশ গুণে দুর্ব্বৃত্তা ও কামিনীদিগের চরিত্র সংশোধন হইয়া পরিশেষে তাহারা ঈশ্বর পরায়ণা হইয়াছিল।

 ফ্রাই উল্লিখিত শুভকার্য্য সকল সম্পাদ ন করিয়া সর্ব্বত্র প্রসিদ্ধ হইলেন; সকলেই তাঁহার প্রতি সমুচিত সমাদর প্রদশন করিতে লাগিল। এমন কি তাঁহার নাম শ্রবণ মাত্রেই কি দীনদরিদ্র কি সম্ভ্রান্ত লোক সকলেই পুলকিত চিত্তে তাঁহার প্রতি যার পর নাই ভক্তি প্রদর্শন করিত। তিনি নানা দেশীয় হিতৈষী লোকদিগের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করেন, তৎপরে ইউরোপীয় প্রধান প্রধান নগরস্থ কারাগৃহ, অনাথনিবাস ও বাতুলাগারের অবস্থা পরিবর্ত্তন মানসে নানা স্থানে পর্য্যটন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সমধিক প্রযত্নে কতিপয় স্বদেশ হিতৈষিণী মহিলার সাহায্যে ইংলণ্ডে একটী ‘‘নারী সমাজ’’ স্থাপিত হয়। কারাগার প্রভৃতির সংশোধন করা এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য। ইউরোপীয় সম্ভ্রান্ত কামিনীরা এই সভাকে আদর্শ করিয়া স্ব স্ব জন্ম ভূমিতে এক একটী দেশহিতকরী সভা সংস্থাপন করেন। ফলতঃ বিবি ফ্রাইয়ের যশঃশুধাকর কিরণ রাশি সকল দেশেই তুল্য রূপ বিকীর্ণ হইয়াছিল।

 ১৮২৪ খৃস্টাব্দে এলিজাবেথ ফ্রাই উৎকট পীড়ায় আক্রান্ত হন। তৎকালে তিনি সুনিপুণ চিকিৎসকদিগের পরামর্শানুসারে কিয়দ্দিবসের জন্য সমুদ্র তীরস্থ ব্রাইটন্ নগরে বাস করেন। একদা তিনি সমস্ত রাত্রি পীড়ার অসহ্য যাতনা ভোগ করিয়া প্রত্যুষে গবাক্ষ দ্বারের সন্নিকটে উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে এক জন সাগরতীরবাসী প্রহরী তাঁহার নয়ন পথে পতিত হইল তাহাকে দেখিয়া তাঁহার চিত্তে দয়ার সঞ্চার হয়। অধ্যয়ন ব্যতিরেকে নির্জ্জনবাসিদের অন্তঃকরণে সুস্থতা লাভের অন্য উপায় নাই; এই ভাবিয়া তিনি তাহাদিগের আবাসে উপযুক্ত পুস্তক সংগ্রহ করিয়া দিতে একান্ত যত্নবতী হইলেন। নয় বৎসর কাল চেষ্টা করিয়া অবশেষে প্রত্যেক সমুদ্রকূলবাসী প্রহরিদিগের আবাসবাটীতে বিবিধ পুস্তক পূর্ণ এক একটী পুস্তকালয় সংস্থাপন করেন।

 অতঃপর ফ্রাই ধর্ম্মপ্রচারার্থ স্কটলণ্ড, আয়ার্লণ্ড ও তৎসন্নিহিত দ্বীপ সমূহে পর্য্যটন করতঃ তত্রত্য কারাগার, বাতুলনিবাস ও চিকিৎসালয় প্রভৃতির বিলক্ষা উৎকর্ষ সাধন করিলেন। তিনি যে স্থানে যাইতেন, সেই খানেই যথেষ্ট সম্মান লাভ সহকারে দেশহিতকর কার্য্যাদির নিয়ম প্রণালীর পরীক্ষা করিতেন। কার বাসী অপরাধিদিগের প্রতি ধর্ম্মোপদেশ প্রদান ও তত্তদ্দেশীয় প্রত্যেক সভায় গমন না করিয়া স্বদেশে প্রত্যাগত হইতেন না। কিছুদিন পরে তিনি পারিস্‌ নগরে উপস্থিত হন। তাহাতে তথাকার রাজমহিষী ও প্রধান প্রধান ভূম্যধিকারিরা তাঁহাকে যথোচিত সম্মাননা করেন। তিনি দেশহিতৈষী মহিলাগণের সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া তাঁহাদিগকে সদনুষ্ঠান সাধনে অধিকতর উৎসাহ দেন। অনন্তর তথাকার কারাগারে গমন করিয়া বন্দিনীগণের নিকট করুণরসপূর্ণ এক ধর্ম্মোপদেশ পাঠ করেন; উহা শ্রবণে কি কারাবাসিনী কামিনী, কি নাগরিকগণ সকলেই বিমোহিত হইয়া অশ্রুপাত করিয়াছিল। অতঃপর ফ্রাই, জর্ম্মনি দেশে গমন করেন। তদ্দেশীয় সমুদায় লোকের নিকট তিনি বিশিষ্ট রূপে সমাদৃতা হন। তথায় প্রত্যুষে প্রকাশ্য পথে ভ্রমণ করিতে করিতে দীনহীনদিগের সহিত ধর্ম্ম বিষয়ের কথোপকথন এবং প্রদোষ কালে রাজভবনে রাজা ও রাজপরিবারে বেষ্টিত হইয়া নানাবিধ শুভকার্য্য সম্পাদনের আলোচনা করিতেন।

 তথা হইতে ফ্রাই প্রুসিয়া রাজ্য পরিভ্রমণ করিয়া ডেন্মার্ক দেশে উপস্থিত হন। ঐ দেশের রাজমহিষী তাঁহার আগমন বার্ত্তা প্রাপ্ত স্বয়ং অগ্রসর হইয়া যথেষ্ট অভ্যর্থনা সহকারে তাঁহাকে রাজ প্রাসাদে আনয়ন করেন। অনন্তর রাজা ও মহিষী উভয়ে তাঁহার সহিত আহারাদি সমাপন করিয়া তাঁহাকে রাণীর সংস্থাপিত একটী অনাথবিদ্যালয় দেখাইতে লইয়া যান। ফ্রাই সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রণালী ও ছাত্রদিগের সম্যক্‌ জ্ঞানোন্নতি দেখিয়া সন্তুষ্ট চিত্তে রাজ্ঞীকে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদান করেন। পরিশেষে ছাত্রদিগকে বিবিধ উপদেশ প্রদান করিয়া প্রত্যাগত হন। তাঁহার বাক্‌পটুতা ও উপদেশ গুণে শ্রোতা মাত্রেই আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিল।

 কি স্বদেশ কি বিদেশ সকল স্থানেই ফ্রাইয়ের সমাদরের ত্রুটি ছিল না। সকলেই তাঁহাকে এক অপূর্ব্ব স্ত্রীরত্ন বোধ করিয়া যথোচিত ভক্তি করিত। ইউরোপ খণ্ডে এমন কোন জনপদ ছিল না, যে তিনি তথাকার কারাগারাদির কোন না কোন রূপ উন্নতি সাধন করেন নাই। তাঁহার সুমধুর উপদেশ শ্রবণে সমস্ত কারাবাসিরা শিক্ষিত, বিনীত ও ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া নিয়ত ধর্ম্মপুস্তক অধ্যয়নে রত হইয়াছিল।

 ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে বিবি ফ্রাই মহাক্লেশে পতিত হন। ঋণগ্রস্ত হওয়াতে তাঁহার স্বামীর বাণিজ্য কার্য্য স্থগিত হয় এবং তাহাতে আবাসবাটী পর্যন্ত বিক্রীত হইয়া যায়। ফ্রাই আজন্ম সুখ সম্ভোগে কালহরণ করিতেন, কখন কোন দুঃখ সহ্য করেন নাই, সুতরাং উপস্থিত দুঃখ তাঁহাকে যৎপরোনাস্তি কষ্ট দিতে লাগিল। তখন কি করেন; অগত্যা স্বামীর সহিত লণ্ডননগরে জেষ্ঠ পুত্রের বাটীতে গিয়া কিছু কালের জন্য অবস্থিতি করিলেন। দুঃখ, দুঃখের অনুবন্ধন করে। একে হতসর্ব্বস্ব হইয়া মহাক্লেশে কালযাপন করিতেছিলেন, তাহাতে আবার প্রাণ সংশয় পীড়া উপস্থিত হইয়া অধিকতর দুঃখ ঘটিল।

 এই সময়ে ফ্রাই, বৃদ্ধকাল সুলভ নানাবিধ পীড়াগ্রস্ত হওয়াতে ক্রমে ক্রমে তাঁহার শরীর দুর্ব্বল ও অবসন্ন হইয়া পড়িল। তজ্জন্য সকলেই অনিষ্ট আশঙ্কা করিয়া তাঁহাকে শ্রমসাধ্য কার্য্য হইতে নিরস্ত থাকিতে ভূয়োভূয়ঃ অনুরোধ করিতে লাগিল; কিন্তু তিনি কিছুতেই ক্ষান্ত হইতে পারিলেন না। কিছুকালের পর কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্য লাভ করিলেন বটে, কিন্তু অনতিকাল বিলম্বেই পুনর্ব্বার পীড়াক্রান্ত হইলেন। বার্দ্ধক্য দশায় পুনঃ পুনঃ পীড়িত হওয়া মঙ্গল জনক নহে; ইহা ভাবিয়া তাঁহার আত্মীয় স্বজনেরা, প্রতিক্ষণেই অসুখী হইতে লাগিলেন। তখন চতুর্দ্দিক হইতে কি পরিচিত, কি অপরিচিত, সহস্র সহস্র ব্যক্তি তাঁহাকে দেখিবার নিমিত্ত, তদীয় অবাসে আগমন করিতে লাগিল।

 ১৮৪৫ খৃষ্টাব্দে তাঁহার বান্ধবেরা, সমুদ্রবায়ু সেবনার্থ, তাঁহাকে সাগর তীরের এক বাটীতে লইয়া গেলেন; কিন্তু তাহাতে কিছুমাত্র উপকার দর্শিল না, বরং উত্তরোত্তর পীড়ার বৃদ্ধি হইতে লাগিল। তখন তিনি মৃত্যুকাল সন্নিকট জানিতে পারিয়া, ঈশ্বরের করে আত্মসমর্পণ করিলেন। একদা পীড়ার অত্যন্ত বৃদ্ধি হওয়াতে তিনি আপন পরিচারিণীকে নিকটে ডাকিয়া কহিলেন ‘‘মেরি! আমার অতিশয় যাতনা হইতেছে, বোধ করি অধিক কাল আর ইহলোকে থাকিতে হইবে না। তুমি আমার জন্য ঈশ্বর সন্নিধানে প্রার্থনা কর’’। অতঃপর তাঁহার সকল অঙ্গ নিশ্চেষ্ট হইয়া আসিল, যাতনায় অধৈর্য্য হইলেন, তখন তাঁহার একটী কন্যা, তদীয় শয্যার পার্শ্বে উপবিষ্টা হইয়া ধর্ম্মপুস্তকের কিয়দংশ পাঠ আরম্ভ করিল, তিনিও তাহার সঙ্গে সঙ্গে অতি মৃদুস্বরে বলিতে লাগিলেন “হে প্রভো! আপনার এই চিরদাসীর মঙ্গল করুন”। এই কএকটী কথা কহিয়াই প্রাণ পরিত্যাগ করিলেন। তাঁহার পরলোকগমনে আবাল বৃদ্ধ সকলেই যার পর নাই শোকাকুলিত হইয়া বিলাপ করিয়াছিল।

 এলিজাবেথ ফ্রাই একজন অসাধারণ গুণসম্পন্না স্ত্রীলোক শারীরিক ও মানসিক দুর্ব্বলপ্রকৃতি হইলেও তিনি পরিশ্রম সহকারে সমধিক বিদ্যা ও জ্ঞান উপার্জ্জন করিয়ছিলেন। যাহাতে স্বদেশীয় বালিকারা বিদ্যাবতী হইয়া সাধারণের প্রতিষ্ঠাভাজন ও পরিণামে সুখী হইতে পারে, তজ্জন্য তিনি বিশেষ যত্ন করিতেন। তাঁহার উপচিকীর্ষা বৃত্তি অতি আশ্চর্য্য! যে কোন প্রকারে হউক দীনদুঃখিকে অর্থ, ক্ষুধার্ত্তকে আহার ও রুগ্নকে ঔষধ দান করিতে পারিলেই তিনি আপনাকে চরিতার্থ জ্ঞান করিতেন। কেবল তাঁহারই প্রযত্নে ইউরোপের কারাগার সমূহের উন্নতি সাধন হইয়াছিল। যে স্থানে প্রধান প্রধান রাজপুরুষেরাও গমন করিতে শঙ্কিত হইতেন, তিনি আপন বুদ্ধি কৌশলে তথায় গমন করিয়া দুর্ব্বৃত্তদিগকে উপদেশ দ্বারা স্ববশে আনিয়াছিলেন। যে সমস্ত দুর্নীতি বশতঃ বহুকালাবধি নানাবিধ অনিষ্ট ঘটিয়া আসিতেছিল, ফ্রাই অবলা কামিনী হইয়াও অটল অধ্যবসায় গুণে তাহার মূল উৎপাটন করিয়া আপন নামের গৌরব রক্ষা করিয়াগিয়াছেন। তিনি কেবল স্বদেশের হিত চেষ্টা করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন না। সাধারণের হিতসাধন জন্য দেশে দেশে, গ্রামে গ্রামে ও লোকের দ্বারে দ্বারে ভ্রমণ করিয়া মানবকুলের অসীম কল্যাণ বর্দ্ধন করিয়াছেন। তাঁহার সবিশেষ যত্নে নানাদেশে “নারীসমাজ” স্থাপিত হওয়াতে সর্ব্বদেশীয় স্ত্রীজাতির কি পর্য্যন্ত না উপকার হয়। তাঁহার হৃদয়ক্ষেত্রে ধর্ম্মবীজ অতি আশ্চর্য্য রূপে অঙ্কুরিত হইয়াছিল, ফলতঃ কেবল, ধর্ম্মোন্নতি সাধনের জন্যই, তিনি ধর্ম্মপ্রচারকের পদগ্রহণ করেন। ধর্ম্মের জন্য তাঁহাকে সংসারের অনেক প্রকার ভোগ বিলাসে জলাঞ্জলি দিতে হইয়াছিল। অসাধারণ ধর্ম্মশীলতা ও অসীম গুণগরিমার জন্য, তিনি নানা দেশীয় ভূপতি ও রাজপরিবার মধ্যে সমধিক আদরণীয়া এবং লোক সমাজে পরম হিতৈষিণী বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিলেন। যত কাল পৃথিবীতে সৎকর্ম্মের গৌরব থাকিবে, তত কাল লোকে তাঁহাকে “লোকহিতৈষিণী এলিজাবেথ ফ্রাই” বলিয়া ঘোষণা করিবে।