বিষয়বস্তুতে চলুন

নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/অষ্টম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম অধ্যায়

আস্তাবলে বিদ্যালয়

 আলাবামা প্রদেশের পল্লী-সমাজগুলি দেখিয়া আমার কার্য্যের দায়িত্ব বেশ বুঝিতে পারিলাম। আমি কর্ম্মক্ষেত্রে একাকী, অথচ সমাজের সর্ব্বত্রই অভাব, দুঃখ, দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা! এই সমুদয় নিবারণ করা কি একজনের পক্ষে সম্ভবপর? আমার বোধ হইতে লাগিল যেন আমি অসাধ্য-সাধনে ব্রতী হইয়াছি।

 নিগ্রো-পল্লীগুলির মধ্যে একমাস কাল ছিলাম। তাহাতে আমার কার্য্যপ্রণালী সম্বন্ধে অনেক ইঙ্গিত লাভ করিলাম। মোটের উপরে বুঝিয়া লইলাম যে, নিউ ইংলণ্ড অঞ্চলের ইয়াঙ্কি মহলে যে নিয়মে বিদ্যাদান করা হইয়া থাকে, এ অঞ্চলে ঠিক সেই নিয়মে শিক্ষাবিস্তার করিলে সুফল পাওয়া যাইবে না। এখানে একটা সম্পূর্ণ নূতন ধরণের পঠনপাঠনের রীতি চালান আবশ্যক। আমি ভাবিলাম যে, বোধ হয় সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গ হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের জন্য যে নিয়ম আবিষ্কার করিয়াছেন টাস্কেজীর বিদ্যালয়ে সেই নিয়ম প্রয়োগ করা চলিতে পারে। কেবলমাত্র পুঁথিগত বিদ্যায় পণ্ডিত করিয়া ছাড়িয়া দিলে নিগ্রোদিগের উপকার করা হইবে না। নিগ্রো বালকের সমগ্রজীবনই তৈয়ারী করিবার ব্যবস্থা করা কর্ত্তব্য।

 ১৮৮১ সালের ৪ঠা জুলাই তারিখে সেই পোড়ো বাড়ীতে স্কুল খুলিলাম। কৃষ্ণাঙ্গ-সমাজ খুব উৎসাহের সহিত আমার কার্য্যে সাহায্য করিল। শ্বেতাঙ্গ-সমাজের অনেকেই আমার উপর বিরক্ত হইলেন। তাঁহারা নিগ্রোমহলে শিক্ষাবিস্তারের বিরোধী। তাঁহাদের বিশ্বাস নিগ্রোরা লেখা পড়া শিখিলে ক্ষেতের জন্য কুলী পাওয়া যাইবে না—গৃহস্থালীর জন্য চাকর জুটিবে না। নিগ্রোরা আর শারীরিক পরিশ্রম করিতে অস্বীকার করিবে—তাহাদের মধ্যে বিলাস ও বাবুগিরি প্রবেশ করিবে। ফলতঃ দেশময় আর্থিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লব উপস্থিত হইবে।

 শ্বেতাঙ্গদের এরূপ বিশ্বাসের যথেষ্ট কারণও ছিল। এতদিন যে সকল নিগ্রো লেখা পড়া শিখিয়াছে তাহারা সকলেই বাবু! আজ কাল মাথায় লম্বা টুপি, চোখে সোণার চস্‌মা, হাতে গিল্টি করা ছড়ি, পায়ে সৌখীন বুট—ইত্যাদি আমাদের “শিক্ষিত” নিগ্রোর লক্ষণ হইয়া পড়িয়াছে। কাজেই আরও শিক্ষার প্রসার হইলে নিগ্রোরা যে ক্রমশঃ কিম্ভূতকিমাকার জানোয়ার হইয়া পড়িবে এরূপ সন্দেহ করা অন্যায় নহে। কিন্তু বিদ্যাশিক্ষার আদর্শ বদলান যায়, এবং আদর্শ বদলাইতে পারিলে শিক্ষিত লোকের মতি গতি, ভাব ভঙ্গী ইত্যাদিও বদলান যায়। যথার্থ শিক্ষাপ্রচার করিতে পারিলে প্রকৃত ‘মানুষ’ই গড়িয়া তোলা সম্ভব। এই শ্বেতাঙ্গগণ তাহা বুঝিতেন না। এজন্য তাঁহারা আমার কর্ম্মের বিরুদ্ধেও দাঁড়াইলেন।

 যাহ। হউক, টাস্কেজীতে শিক্ষাপ্রচার-কর্ম্মে আমার দুইজন বন্ধু মিলিয়াছিল। একজন শ্বেতাঙ্গ, আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ। ইহাঁরাই সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গকে লোকের জন্য লিখিয়াছিলেন। ইহাঁরা বিগত বিশবৎসর ধরিয়া আমার কার্য্যে সাহায্য করিয়া আসিতেছেন।

 শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির নাম জর্জ্জ ক্যাম্পবেল। ইনি পূর্ব্বে অনেক ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন। এক্ষণে ইনি একজন বড় সওদাগর। শিক্ষাপরিচালনা সম্বন্ধে ইহাঁর অভিজ্ঞতা যৎসামান্য। কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির নাম লুইস য়্যাডাম্‌স্‌। ইনি পূর্ব্বে গোলামী করিয়াছেন, এক্ষণে চামড়ার কাজ ও লোহা পিত্তল দস্তার কাজ করিয়া অন্ন সংস্থান করেন। গোলামীর যুগে ইনি জুতা তৈয়ারী, জুতা মেরামত, ঘোড়ার লাগাম তৈয়ারী, এবং কর্ম্মকার ও সূত্রধরের কার্য্য ইত্যাদি নানাবিধ কারিগরি শিক্ষা করিয়াছিলেন। ইনি কোনদিন বিদ্যালয়ে যাইয়া লেখা পড়া শিখেন নাই কিন্তু দেখিয়া শুনিয়া সামান্যরকমের কেতাবী-শিক্ষা লাভ করিয়াছেন।

 বুঝিলাম, এই দুই ব্যক্তির জীবনে কর্ম্মেরই প্রাধান্য। ইহাঁরা কতকটা ‘আটপীঠে’ কর্ম্মঠ ও ‘করিতকর্ম্মা’ লোক। কাজেই আমার শিক্ষাপ্রণালী ইহাঁরা খুবই পছন্দ করিলেন।

 এইসঙ্গে একটা কথা অবান্তরভাবে বলিতে চাহি। য়্যাডাম্‌সের বিচক্ষণতা এবং চিন্তাশীলতা দেখিয়া আমি বড়ই মুগ্ধ হইয়াছিলাম। চিরজীবন শৃঙ্খলার সহিত শিল্পে, কৃষিকার্য্যে অথবা ব্যবসায়ে লাগিয়া থাকিলে বুদ্ধিশক্তি যথেষ্টই মার্জ্জিত হয়। কর্ম্ম করিতে করিতে চিন্তা করিবার ক্ষমতা আপনা আপনি বাড়িতে থাকে। গ্রন্থপাঠ না করিয়াও সকল বিষয়ে স্বাধীনভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবার যোগ্যতা জন্মে। আমার নিগ্রো বন্ধু য়্যাডাম্‌স্ এই কথার জীবন্ত দৃষ্টান্ত। তিনি গোলামীর যুগে শিল্পকর্ম্মে জীবনযাপন করিয়া উচ্চ অঙ্গের চিন্তাশক্তি অর্জ্জন করিয়াছিলেন। গোলামীযুগের শিক্ষা বাস্তবিক পক্ষে এই উপায়ে অনেক লোককে কর্ম্মঠ ও চিন্তাশীল করিয়া তুলিয়াছে। গোলামীর এই সুফল উল্লেখ করা আমি অবশ্য কর্ত্তব্য বিবেচনা করিতেছি। এমন কি, আমি এরূপও বলিতে চাহি যে, আজকাল দক্ষিণ অঞ্চলের লোকসমাজে কর্ম্মক্ষম ও বিচক্ষণ ব্যক্তিগণের মধ্যে নিগ্রোদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নয়। নিগ্রোদের এরূপ চিন্তাশীলতার কারণ গোলামীযুগের কৃষিকর্ম্মে অথবা শিল্পকার্য্যে অভ্যাস।

 ত্রিশজন ছাত্র লইয়া পাঠশালা খোলা হইল। আমিই একমাত্র শিক্ষক। ছাত্রদের মধ্যে মেয়ে পুরুষ দুই-ই প্রায় সমান ভাবে ছিল। ইহারা সকলেই টাস্কেজীর সমীপবর্ত্তী পল্লীসমূহের অধিবাসী। আরও অনেক ছাত্র ভর্ত্তি হইতে চাহিল। কিন্তু আমরা নিতান্ত শিশু ছাত্র গ্রহণ করিলাম না। পনরবৎসর বয়সের কম কোন ছাত্র আমরা লই নাই। যাহারা পূর্ব্বে কিছু শিক্ষা পাইয়াছে এবং শিক্ষকতার কর্ম্মে নিযুক্ত আছে তাহাদিগকে লইয়া কার্য্য আরম্ভ করিলাম।

 আমরা যে সকল ছাত্র গ্রহণ করিলাম তাহারা অনেকেই ৪০ বৎসরের হইবে। তাহাদের সঙ্গে কয়েকজন ছাত্রও আসিয়াছিল। দেখিতাম, অনেক ছাত্র তাহাদের শিক্ষকগণ অপেক্ষা বেশীই জানে। বিদ্যার্জ্জনের উদ্দেশ্য ও উপায় সম্বন্ধে এই শিক্ষক ও ছাত্রগণের মামুলি ধারণাই ছিল। তাহারা বড় বড় বই পড়িয়াছে—খুব কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করিতে শিখিয়াছে। লম্বা চৌড়া নামওয়ালা বিষয়ের নাম করিতে পারিলেই তাহারা খুসী হয়। তাহারা ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষায় কিঞ্চিৎ জ্ঞানের অধিকারী। তাহারা এই সকল ‘বড় কথা’র জাহির করিয়া বেড়াইতে অত্যধিক লালায়িত।

 বিদেশীয় ভাষা শিখিবার ইচ্ছাটা নিগ্রোসমাজে একটা নেশায় পরিণত হইয়াছিল। আমি আলাবামা প্রদেশে পল্লীপর্য্যবেক্ষণ কালে দেখিতে পাই যে, একটি যুবক অতি কদর্য্য ঘরে অপরিষ্কার কাপড় চোপড় পরিয়া বসিয়া আছে, অথচ তাহার হাতে একখানা ফরাসী ভাষার ব্যাকরণ-গ্রন্থ।

 আমার এই প্রথম ছাত্রদিগের পুঁথিগত বিদ্যার বড়াই দেখিয়া সত্যসত্যই লজ্জিত হইতাম। তাহারা ব্যাকরণের লম্বা লম্বা সূত্র আওড়াইয়া মনে করিত তাহারা কতবড়ই না পণ্ডিত। অথচ ভাষাজ্ঞান তাহাদের কিছুমাত্র হয় নাই। অনেকে গণিতের ফর্ম্মুলাগুলি মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে—সুদকষা, ডিস্কাউণ্ট, ষ্টক সব বিষয়েরই সূত্রগুলি তোতাপাখীর মত বলিতে শিখিয়াছে। অথচ ব্যাঙ্ক কাহাকে বলে চোখে দেখে নাই—এমন কি নামও শুনে নাই। ব্যবসা বাণিজ্যের খাতাপত্র কেমন করিয়া লিখিতে হয় তাহা জানে না। টাকা পয়সার হিসাব রাখিবার নিয়ম কখনই দেখে নাই। বলা বাহুল্য তাহারা সংসারের কাজকর্ম্মের মধ্যে গণিতশাস্ত্রের প্রয়োগ সম্বন্ধে নিতান্তই অনভিজ্ঞ। কাজেই অঙ্কে তাহাদের মাথা একেবারেই খোলে নাই।

 যাহা হউক এজন্য ইহাদিগকে দোষ দিয়া লাভ নাই। তাহারা যে নিয়মে শিখিয়াছে তাহার ফল আর কত ভাল হইতে পারে? তবে তাহাদের আন্তরিকতা, শিখিবার ইচ্ছা, মানুষ হইবার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণমাত্রায়ই বর্ত্তমান ছিল। এ জন্যই আমি হতাশ হইতাম না।

 তাহারা যে বই মুখস্থ করিয়া এবং কতকগুলি সূত্র ও শব্দ আওড়াইতে আওড়াইতে নিতান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন হইয়া পড়িয়াছে তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। তাহাদের সাংসারিক জ্ঞান একেবারেই জন্মে নাই। একজন ছাত্র মানচিত্রের কোন্ স্থানে আফ্রিকার শাহারা মরুভূমি অবস্থিত বিনা ক্লেশেই দেখাইয়া দিল। এমন কি চীন দেশের রাজধানী পর্য্যন্ত সেই মানচিত্রের মধ্যে খুঁজিয়া বাহির করিল। কিন্তু জমির উত্তর দক্ষিণ ভাল করিয়া নির্দ্দেশ করিতে সে শিখে নাই। টেবিলে খাইতে বসিয়া দেখি কোন্ দিকে বাটি কোন্ দিকে গ্লাস রাখিতে হয় তাহার ইহা জানা নাই! কেতাবী শিক্ষার ফলে সত্যসত্যই তাহারা নিরেট মূর্খ হইয়া পড়িয়াছে।

 দেখিতে দেখতে একমাসের মধ্যে ৫০ জন ছাত্র হইয়া গেল। সপ্তাহ ছয়েক পরে আমি আমার কর্ম্মে একজন নূতন সহায়ক পাইলাম। শ্রীমতী ওলিভিয়া ডেভিড্‌সন নামে একজন শিক্ষিতা রমণী বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নিযুক্ত হইলেন। শিক্ষা ও সেবাকার্য্যে তাঁহার যথেষ্ট পটুত্ব ও অভিজ্ঞতা ছিল। নিগ্রো-সমাজের নানা স্থানে তিনি ইতিপূর্ব্বে শিক্ষাবিস্তার কর্ম্মে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েট। জাতিতে তিনি নিগ্রো।

 নানা স্থানে বসবাসের ফলে এবং নানা কর্ম্মক্ষেত্রে কার্য্য করিয়া তিনি বিদ্যাদানের অনেক নূতন নূতন প্রণালীর পরিচয় পাইয়াছিলেন। তাঁহার মাথায় সর্ব্বদা কর্ম্মের নব নব উপায় আসিত। তাঁহার উদ্ভাবিত কার্য্যপ্রণালীর সাহায্যে আমার টাস্কেজী বিদ্যালয়ের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হইয়াছে।

 তিনিও আমারই মত পুঁথি বিদ্যার আদর করিতেন না। আমরা দুই জনে দেখিলাম, আমাদের ছাত্রেরা লেখাপড়ায় মন্দ ফল দেখাইতেছে না। কিন্তু স্বাস্থ্যরক্ষা, শরীরপালন ইত্যাদি বিষয়ে তাহারা কোন যত্নই লয় না। তাহাদের গৃহে এ সম্বন্ধে কোন চেষ্টা নাই। কাজেই বিদ্যালয়েও তাহারা অপরিষ্কার ভাবেই থাকিত। আমরা বুঝিলাম—ইহাদের মধ্যে কেতাবী শিক্ষা বেশী প্রচার করিয়া কোন লাভ নাই। আমরা স্থির করিলাম—প্রথমতঃ ইহাদের শরীর গঠন করিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। দাঁতমাজা, হাত পা ধোয়া, কাপড় পরিষ্কার করা, খাওয়া পরা, ঘর ঝাড়া ইত্যাদি বিষয় ইহাদিগকে প্রথমেই শিখান আবশ্যক। গৃহকর্ম্মে অভ্যস্ত হইতে থাকিলে ইহাদিগের স্বাস্থ্যজ্ঞান ও সাংসারিক জ্ঞান জন্মিতে পারিবে। তাহার পর এক আধটা অন্নসংস্থানের উপায়ও ইহাদিগকে দেখাইয়া দেওয়া আবশ্যক। কেবল দেখান নহে—হাতে কলমে শিখান আবশ্যক। তাহা হইলে ভবিষ্যতের খাওয়া পরার সংস্থানও হইতে থাকিবে। সঙ্গে সঙ্গে কম খরচে ও কম সময়ে বেশী কাজ করিবার চেষ্টা, পরিশ্রমের উপকারিতা, সময়নিষ্ঠা ইত্যাদি নানা সদ্‌গুণেরও ইহারা অধিকারী হইতে পারিবে।

 আমরা দেখিলাম ইহাদের পল্লীতে কৃষিকার্য্যই অন্নসংস্থানের প্রধান উপায়। শতকরা প্রায় ৮৫ জন নিগ্রো চাষাবাদের উপর বাঁচিয়া থাকে। কাজেই আমরা চাষাবাদের উপযোগী করিয়া আমাদের ছাত্রগণের জন্য বিদ্যাদানের ব্যবস্থা করিতে চেষ্টিত হইলাম। যাহাতে তাহারা সহুরে বাবু না হইয়া পড়ে তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখিলাম। লেখাপড়া শিখিবার পর যেন তাহারা আবার জমি চষিতে পারে এবং পশুপালন করিতে প্রবৃত্ত হয়—এই লক্ষ্য সম্মুখে রাখিয়াই আমরা শিক্ষার প্রণালী স্থির করিতে লাগিলাম। তাহারা বিদ্যালয়ের গুরুমহাশয়ও হইতে পারিবে—অথচ কৃষিকর্ম্মেও লজ্জা বোধ করিবে না—এই আদর্শে আমরা টাস্কেজী বিদ্যালয়ের নিয়ম ও কার্য্যপ্রণালী উদ্ভাবন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলাম।

 এক কথায়, অর্দ্ধশিক্ষিত কুশিক্ষিত এবং চরিত্রহীন বাবুসমাজের পরিবর্ত্তে আমরা সুশিক্ষিত চরিত্রবান্ চাষী ও শিল্পীর পরিবার গঠন করিবার জন্য সকল উদ্যোগ করিতে প্রয়াসী হইলাম। আমরা স্থির করিলাম গ্রন্থপাঠকে অতি নিম্ন স্থানে রাখিব। তাহার পরিবর্ত্তে আমরা সংসারের কাজকর্ম্মের সাহায্যেই নিগ্রোপুরুষ ও রমণীগণকে গড়িয়া তুলিব। এই নূতন শিক্ষাপ্রণালী কার্য্যে পরিণত করিবার ইচ্ছা হৃদয়ে পোষণ করিতে লাগিলাম।

 কিন্তু কার্য্য উদ্ধার করা যায় কি করিয়া? আমাদের স্থানাভাব ত যথেষ্ট। কয়েকজন নিগ্রো অনুগ্রহ করিয়া বিনাপয়সায় সেই পোড়ো বাড়ীটা বিদ্যালয়ের জন্য ব্যবহার করিতে দিয়াছেন এই যা রক্ষা। ছাত্র সংখ্যা দিন দিন বাড়িতেছিল। ইহারাই ত আমাদের নূতন আদর্শ পল্লীতে লইয়া যাইয়া ভবিষ্যতের পল্লীসেবক, পল্লী-শিক্ষক, ও পল্লী-সংস্কারক হইবে। এই ছাত্রগণই ত আমাদের যন্ত্র স্বরূপ থাকিয়া সমাজে সকল প্রকার উন্নতির আকাঙ্ক্ষা ও বীজ বপন করিবে। কিন্তু ইহা দিগকে এখন স্থান দিই কোথায়?

 তিন মাস আমাদের বিদ্যালয়ের কার্য্য চলিল। প্রতিদিনই সকল দিকে উন্নতির লক্ষণ দেখিতে পাইতাম। আলাবামার ভিন্ন ভিন্ন জেলা হইতে কত ছাত্র আসিতে চাহিল। বুঝিতাম আমাদের নামও প্রদেশময় ছড়াইয়া পড়িয়াছে।

 এই সময়ে একটা জমির সন্ধান পাওয়া গেল। টাস্কেজীর প্রায় দেড়মাইল দূরে একটা পুরাতন গোলামাবাদ বিক্রী হইবে জানিতে পারিলাম। মূল্য ১৫০০৲। জমির মালিক আমাদের নিকট দুই কিস্তীতে টাকা লইবেন। একে জমিটা সস্তা তাহার উপর এই অনুগ্রহ। কিন্তু হাতে যে আমাদের এক পয়সাও নাই—৭৫০৲ প্রথমেই দিব কিরূপে? বিপদ বুঝিয়া হ্যাম্পটনের ধন রক্ষক মার্ণ্যালের নিকট ধার চাহিলাম। তিনি লিখিলেন “হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের তহবিল হইতে টাকা ধার দিবার নিয়ম নাই। তবে আমি আমার নিজের ৭৫০৲ পাঠাইলাম।”

 ৭৫০৲ পাইলাম। ইতিপূর্ব্বে আমি এক সঙ্গে ২৫০/৩০০৲ টাকাও দেখি নাই। জমিটা কেনা হইয়া গেল। একবৎসরের মধ্যে বাকি ৭৫০৲ দিব স্বীকার করিলাম।

 নূতন স্থানে স্কুল উঠাইয়া লওয়া হইল! জমিতে সর্ব্বসমেত চারিটা পুরাতন ঘর ছিল। গোলামীর যুগে যখন বড় সাহেব এই কুঠিতে থাকিতেন তখন ইহাদের একটা ঘরে রান্না হইত ও একটা খাবার ঘর ছিল। আর দুইটা ঘরে ঘোড়া ও মুরগী থাকিত। কয়েক দিনের মধ্যে কুঠরীগুলি মেরামত ও পরিষ্কার করিয়া লইলাম। আস্তাবল ও মুরগীশালায় পাঠশালা বসিতে লাগিল।

 আস্তাবলেই প্রথমে কাজ চলিতেছিল। পরে ছাত্রসংখ্যা বাড়িয়া যায়। এজন্য মুরগীখানায়ও ছাত্রদের জন্য ‘ক্লাশ’ খুলিতে হইয়াছিল। একদিন সকালে একজন নিগ্রোকে বলিলাম, “মুরগীশালাটা পরিষ্কার করা আবশ্যক। আমাদের ছেলে বাড়িয়াছে। ঐ ঘরটায় নূতন ক্লাশ বসিবে।” সে তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, “কি বলেন মহাশয়, আপনি দিবাভাগে লোক জনের সম্মুখে ঐ ঘর পরিষ্কার করিবেন? সকলে নিন্দা করিবে যে?” চক্ষুলজ্জা এবং লোকনিন্দার ভয় নিগ্রোসমাজে এতদূর পৌঁছিয়াছিল।

 এই নূতন স্থানে ও নূতন গৃহে স্কুল বসান কাজটার মধ্যে কতকটা বিষয় লক্ষ্য করিবার প্রয়োজন। আমরা একজনও বাহিরের কুলী এজন্য নিযুক্ত করি নাই। আমরা নিজেই স্বহস্তে সূত্রধরের কর্ম্ম, কর্ম্মকারের কার্য্য, ঝাড়ুদারের কাজ, ইত্যাদি করিয়াছিলাম। বিকালে স্কুলের ছুটির পর ছাত্রেরা এই সকল কার্য্যে সাহায্য করিত। মেরামত করা, পরিষ্কার করা, ধোয়া, ঝাড়া, যথাস্থানে সাজান—সকলই আমরা সমবেত হইয়া সম্পন্ন করিয়াছিলাম।

 যখন এই আস্তাবলে ও মুরগীশালায় স্কুল বেশ নিয়মিতরূপে চলিতে লাগিল তখন আমাদের জমির সম্মুখের খানিকটা অংশ পরিষ্কার করিয়া লইলাম। ইহাতে শাকশব্জী, ফুল ফল ইত্যাদি বুনিবার জন্য ইচ্ছা ছিল। ছাত্রেরা এ কাজ করিতে প্রথম প্রথম বেশী রাজি হইত না। তাহারা মাটি কোদ্‌লাইতে অপমান ও লজ্জা বোধ করিত। লেখাপড়া শিখিতে আসিয়া কোদাল ধরিতে হইবে—স্বপ্নেও তাহারা পূর্ব্বে ভাবে নাই। লেখা পড়া শিখিবার সঙ্গে মাটি কাটার সম্বন্ধই বা কি—তাহারা বুঝিত না। তাহারা মনে করিত তাহাদিগকে মজুরের কাজ করাইয়া লইয়া স্কুলের পয়সা বাঁচান হইতেছে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আমাদের ছাত্রগণের মধ্যে অনেকেই অন্যান্য পাঠশালার গুরুমহাশয়গিরি করিয়া আসিয়াছেন। তাঁহারা এরূপ নিন্দাকর ও অপমানজনক কাজে একেবারেই নারাজ। তাঁহাদের মনে হইতে লাগিল—সময় বৃথা নষ্ট করা হইতেছে মাত্র।

 কিন্তু আমার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আমি লোক লাগাইয়া জমি পরিষ্কার করিব না। আমার সুচিন্তিত শিক্ষা প্রণালী কোন মতেই অর্জ্জন করিব না। শারীরিক পরিশ্রম করা আমার মতে উচ্চ শিক্ষার প্রধান অঙ্গ। যাহারা হাতে পায়ে খাটিয়া কাজ করিতে অনিচ্ছুক তাহারা আমার বিবেচনায় অশিক্ষিত, এমন কি কুশিক্ষিত। আমি সকল ছাত্রকেই এই নূতন শিক্ষার আদর্শ বুঝাইতে লাগিলাম। কথায় বেশী উপকার হইল না। আমি নিজে একাকী মাটি কাটিতে আরম্ভ করিলাম। জমি অনেকটা পরিষ্কার হইয়া আসিল। তাহাদের সাহায্য না লইয়াই বিদ্যালয়ের চারি পাশ যথেষ্ট সুন্দর করিয়া ফেলিলাম। ছাত্রেরা দেখিল আমার অপমান কিছুই হইতেছে না। ক্রমশঃ তাহারাও আমার কাজে সাহায্য করিতে আসিল। এইরূপে ৬০ বিঘা জমি সকলে মিলিয়া চষিয়া ফেলিলাম।

 এদিকে শ্রীমতী ডেভিড্‌সন জমির দাম শোধ করিবার জন্য নানা কৌশলে টাকা তুলিতে থাকিলেন। তিনি আমাদের বিদ্যালয়ে কএকটা প্রদর্শনী বা মেলা খুলিলেন। এজন্য কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গ দুই মহলেই তিনি সর্ব্বদা ঘুরিয়া বেড়াইতেন। মেলার উদ্দেশ্য ও কার্য্য-প্রণালী সর্ব্বত্র প্রচারিত হইল। টাস্কেজীর লোকেরা কেহ কিছু আলু, কেহ কয়েকটা রুটি, কেহ কোন ফল ইত্যাদি দান করিলেন। এইগুলি বেচিয়া পয়সা আসিল। এইরূপ গোটাকয়েক মেলার ফলে টাকা মন্দ জমা হইল না।

 তাহার পর নগদ টাকার জন্যও চাঁদার খাতা খোলা গেল। কোন নিগ্রো দশ পয়সা, কেহ বা চৌদ্দ পয়সা দান করিতে লাগিল। কেহ একটা রুমাল, কেহ বা খানিকটা চিনি, কেহ বা একখানা সতরঞ্চি দান করিল। একদিন এক বুড়ি ছেঁড়া কিন্তু পরিষ্কার কাপড়-চোপড় পরিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে আমাদের স্কুলে হাজির হইল। সে বলিতে লাগিল, “মহাশয় আপনি ও ডেভিড্‌সন যে কাজ করিতেছেন তাহার জন্য ভগবান্ আপনাদিগকে সাহায্য করুন। নিগ্রোজাতিকে তুলিবার জন্য আপনারা জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন। আপনাদের ধন্য! আর আমিও ধন্য যে এতকাল গোলামী করিবার পর আপনাদের ন্যায় নিঃস্বার্থ সমাজসেবকদিগকে দেখিয়া মরিতে পারিলাম। আপনাদের ন্যায় কর্ম্মবীর যখন তন্ময় হইয়া সমাজ-সেবায় লাগিয়াছেন, তখন নিগ্রোজাতি অতি সত্বরই জগতে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে। আজ আমার জীবনের অন্তিম দশায় সেই আশার আলোক দেখিতে পাইতেছি।” এই বলিতে বলিতে বৃদ্ধার চক্ষু জলে ভরিয়া গেল। তাহার পর সে আবার বলিল, “দেখুন, আমি নিতান্ত দরিদ্র। কাঁচা পয়সা আমি চোখে দেখিতে পাই না। আপনারা পাঠশালার জন্য চাঁদা চাহিয়াছেন। আমি আপনাদিগকে আমার ক্ষুদ্র জীবনের কৃতজ্ঞতা জানাইবার জন্য এই ছয়টি ডিম দান করিতেছি। আশা করি, এইগুলি বেচিয়া আপনারা কাজ চালাইতে পারিবেন।”

 এইরূপ মুষ্টিভিক্ষার ফলে আলু, চিনি, কম্বল, জামা, ডিম ইত্যাদি পাইতাম। পরে, সেইগুলি বাজারে বেচিয়া টাস্কেজীর ধনভাণ্ডারে অর্থ সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। এই উপায়ে সরিষা কুড়াইয়া বেল তৈয়ারী করিতে প্রয়াসী হইলাম। বৃহৎ ব্যাপারেও খুদ কণার সাহায্য কম কার্য্য করে না!