নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/পরিশিষ্ট (ক)

উইকিসংকলন থেকে

পরিশিষ্ট

(ক)

 ইতিপূর্বেই আমরা আজাদ হিন্দ বাহিনীর কয়েকজন বীর ও বীরাঙ্গনার নাম জেনেছি। সর্বশেষে যাঁরা তাঁদের অমিত বিক্রম ও দেশপ্রেমের জন্য সমস্ত ভারতবাসীর প্রাণাপেক্ষা প্রিয় হয়ে উঠেছেন তাঁদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নীচে দেওয়া হল—

 শাহনওয়াজ: পাঞ্জাবের এক বিখ্যাত অভিজাত বংশে তাঁর জন্ম। সুদৃঢ় দেহ এবং প্রসারিত বক্ষ সত্যিই তাঁর এই সেনানায়কের পদের উপযুক্ত। আজাদ-হিন্দ সপ্তাহে কোলকাতার মিছিলে তাঁর সেই দৃপ্ত দেহভঙ্গী যে দেখেছে সেই শ্রদ্ধায় মাথা নীচু করে স্বাধীন ভারতের এই মহারথকে অন্তরের অভিনন্দন জানিয়েছে। শোনা যায় তাঁর বংশে কমপক্ষে ৬২ জন আত্মীয় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আছেন। ইম্ফলের যুদ্ধে তিনি বৃটিশ সেনার অন্তর্ভুক্ত তাঁরই এক ভায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর পরিচালনাধীনেই আজাদ-হিন্দ বাহিনীর এক দল সেনা মণিপুর থেকে ইংরাজ ও আমেরিকান সৈন্যদের বিতাড়িত করে প্রথম ভারতের বুকে প্রথম স্বাধীন ভারতীয় হিসাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। সমগ্র ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করে দিল্লীর বুকের ওপর উত্তোলিত জাতীয় পতাকার নীচে কবে আবার তিনি এসে দাঁড়াবেন ভারতবাসী উৎকণ্ঠার সঙ্গে তারই দিন গুন্‌ছে।

 গুরবকশ সিং ধীলন— ১৯১১ সালে লাহোরের এক অভিজাত শিখ পরিবারে ধীলনের জন্ম। ধীলনের পিতার নাম সর্দার ঠাকুর সিং। সর্দার ঠাকুর সিং নিজে তাঁর আর দুই ছেলে এবং তাঁদের আরও অন্যান্য আত্মীয় ভারতীয় সেনা বাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন বা আছেন। ধীলনের স্ত্রীর নাম বসন্ত কাউর। মণ্টগোমারী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সামরিক পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে তিনি উচ্চপদে উন্নীত হন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের সঙ্গে মালয়ে ছিলেন। তারপর আরও উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কিছুদিনের জন্য ভারতে আসেন এবং পরে উত্তর মালয়ের জঙ্গলে প্রেরিত হন। সেখানে জাপানের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালান এবং তার জন্য বহু ভারতীয়ের প্রাণ রক্ষা হয়। পরে অবশ্য তিনি জাপানের হাতে বন্দী হন। তারপর ব্যাংককে অনুষ্ঠিত পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় নেতাদের সম্মেলনে অন্যান্য যুদ্ধ বন্দীদের সঙ্গে মোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীনে আজাদ-হিন্দ-ফৌজে যোগদান করেন।

 পি, কে, সায়গল— ১৯১৫ সালে সায়গলের জন্ম। তাঁর পিতার নাম সার অশ্রুরাম—তিনি লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি। দেরাদুন সামরিক শিক্ষালয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভারতীয় সেনা বাহিনীর দশম বালুচ রেজিমেণ্টে যোগ দেন। সিঙ্গাপুরে বৃটিশের পরাজয়ের পর তিনি আজাদ-হিন্দ-ফৌজে যোগদান করেন। আজাদ-হিন্দ বাহিনীতে তিনি কর্নেলের পদে ভূষিত হন এবং সামরিক সম্পাদকের পদ প্রাপ্ত হন। আজাদ-হিন্দ-বাহিনীর ইতিহাস বিখ্যাত বিচারের সময়ে তাঁর ভগিনীগণ ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে তাঁর কপালে চন্দন তিলক অঙ্কিত করে দেন এবং তার ফলে বিচারালয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও আনন্দ কোলাহলের সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি জানা গিয়েছে যে তিনি নাকি শীঘ্রই তাঁর বাগদত্তা বধূকে বিবাহ করবেন।

 বাসবিহারী বসু—অল্পখ্যাত মহা বিপ্লবী বীর রাসবিহারী বসুই প্রথম আজাদ হিন্দ-বাহিনীর স্রষ্টা। ১৯১২ সালে রাজ প্রতিনিধি বড়লাট হার্ডিঞ্জের এক শোভাযাত্রায় বোমা নিক্ষেপের ফলে তিনি ঐ দলের নেতা হিসাবে পুলিশের নজরে পড়েন। তাছাড়া তিনি আরও কয়েকটি স্বদেশী ডাকাতির পরামর্শদাতা ও দলপতি হিসাবে অভিযুক্ত হন। তাঁর সঙ্গীদের অনেকেই ফাঁসি কাষ্ঠে জীবন দান করেন। কিন্তু তাঁকে ধরবার জন্যে ১২ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষিত হলেও তিনি গুপ্ত জীবন যাপন করতে থাকেন এবং বিপ্লবীমূলক কার্য চালিয়ে যেতে থাকেন। পরে তিনি বৃটিশকে ফাঁকি দিয়ে ১৯১৫ সালে জাপানে গিয়ে হাজির হন। জাপানে গিয়ে চীন থেকে অস্ত্রশস্ত্রাদি ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন কিন্তু তাঁর এই গোপন অভিসন্ধি বৃটিশ কর্তৃপক্ষ জানতে পারে এবং বৃটিশের অনুরোধে জাপান কর্তৃপক্ষ তাঁকে পাঁচদিনের মধ্যে সাংহাই ত্যাগ করতে আদেশ দেন। পুনর্বার আট বৎসর কাল তিনি গুপ্ত জীবন যাপন করেন। তারপর স্থানীয় ভারতীয়দের নিয়ে তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সঙ্ঘ গঠন করেন এবং শেষে এই সঙ্ঘ নেতাজীর হস্তে সমর্পণ করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত আজাদ-হিন্দ-সরকারের পরামর্শদাতারূপে যুক্ত ছিলেন। তিনি জাপানী ভাষায় ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বই লেখেন এবং ডাঃ স্যাণ্ডারল্যাণ্ডের India in Bondage বইখানির জাপানী তর্জমা করেন। তাছাড়া তিনি একখানি জাপানী পত্রিকার সম্পাদনা করতেন এবং জাপানের বহু সংবাদপত্রে লিখতেন।

 সুভাষবাবুর মিথ্যা বিমান দুর্ঘটনা রটনার সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছিল যে ঐ দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সে কথা পরে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় এবং প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৪ সালে যুদ্ধের মধ্যেই এই বীর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।

 জগন্নাথ রাও ভোঁসলে—৩৯ বৎসর আগে শিবাজী স্মৃতি ধন্য মহারাষ্ট্রে তিরোদ গ্রামে এঁর জন্ম। ইনি দেরাদুনের প্রিন্স অব ওয়েলস সামরিক বিদ্যালয়ে সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কোয়েটায় ল্যাঙ্কাশায়ার রেজিমেণ্টে যোগদান করেন। পরে তিনি রাজকীয় মারাঠা পদাতিক বাহিনীতে যোগ দেন। কুনুরে কয়েকজন বৃটিশ কর্মচারীকে সমুদ্র গর্ভ থেকে রক্ষা করে তিনি বিশেষ পদকলাভ করেন এবং তাঁকে ক্যাপ্টেন উপাধি দান করা হয়। তাঁর পূর্বপুরুষদের মত তিনি লণ্ডনে সম্রাটের অভিষেক উৎসবে যোগদান করেন। ভারতে ফিরে তিনি সাধারণ সামরিক শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হলেন। এই পদে তিনিই প্রথম ভারতীয়। পরে বেরিলী থেকে সিঙ্গাপুরে জেনারেল ষ্টাফের লেফটনেণ্ট জেনারেল রূপে তিনি স্থানান্তরিত হলেন। সিঙ্গাপুরের পতনের পর তিনি আজাদ-হিন্দ-ফৌজের সর্বাধিনায়করূপে নিযুক্ত হন। জগন্নাথ রাও নিজেও যেমন অভিজাত বংশের তেমনি তিনি বিবাহও করেছেন বরোদার রাজবংশের আত্মীয়া চন্দ্রিকা বাঈকে। তাঁর তিনটি কন্যা বর্তমান।

 ডাঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথন—ইনি মাদ্রাজের বিখ্যাত কংগ্রেস নেত্রী শ্রীমতী আম্মু স্বামীনাথনের কন্যা। এঁর বয়স বর্তমানে ৩২ বৎসর। ইনি মাদ্রাজ থেকে ১৯৩৭ সালে সিঙ্গাপুরে বেড়াতে এসে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। তাঁর প্রথম স্বামী বৈমানিক বি, কে, নানমুন্দা রাওর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তাঁর ডাক্তারী কলেজের পূর্বতন বন্ধু সিরিয়ান খৃষ্টান এব্রাহামকে বিবাহ করেন। সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন তিনি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং আজাদ-হিন্দ-ফৌজ গঠনের পর তিনি মহিলা বিভাগ—রাণী ঝাঁসী বাহিনীর নেত্রীর পদে সম্মানিত হন। তাঁর অধীনে ১২০০ মহিলা রণক্ষেত্রে এবং হাসপাতালের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। জাপানীদের পতনের পর তিনি কালেওয়াতে আজাদী সৈন্যদের সেবা শুশ্রূষার ভার নিয়েছিলেন। তারপর তিনি বৃটিশের নিকট আত্মসমর্পণ করেন।

 বেলা দত্ত—এঁর জীবনী সম্বন্ধে বিশেষ কোন পরিচয় পাওয়া যায় নি। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে মাত্র ষোল বৎসর বয়সে তিনি যে বীরত্ব ও মানসিক বলের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই ভারতীয় নারীর পক্ষে গৌরবের বিষয়। দিনের পর দিন রাত্রিব পর রাত্রি অবিরাম বোমাবর্ষণের মধ্যেও তিনি অসমসাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে হাসপাতালেব কাজ চালিয়ে গেছেন। একবার ৮৫ জন রোগীর সেবার ভার সম্পূর্ণ একা তাঁকে বহন করতে হয়েছিল।

 শ্রীচন্দ্রপ্রকাশ—ইনি নেতাজীর জার্মানী থেকে জাপানে আসার পথে তাঁর সঙ্গে চালক হিসাবে ছিলেন। নেতাজী তাঁকে একটি হাতঘড়ি ও একটি স্থিতিস্থাপক কোমর-বন্ধনী উপহার দেন। তিনি বলেন নেতাজী স্বয়ং সাধারণ সৈনিকের মত সৈনিকদের সঙ্গে সাজসজ্জা খাওয়া থাকা করতেন। সম্মুখ সমরে নিজে উপস্থিত থেকে সৈনিকদের উৎসাহ দিতেন। বোমাবর্ষণের সময় সৈনিকরা আশ্রয় না নেওয়া পর্যন্ত নিজে আশ্রয় গ্রহণ করতেন না। নেতাজী বিমানপথে বাংলা ও আসামের সহরের ওপরে দিয়ে উড়ে গেছেন। বোমাবর্ষণের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য তিনি জাপানীদের ভারতবর্ষে নিরীহ জনসাধারণের ওপর বোমাবর্ষণ করার থেকে নিরস্ত রাখেন। তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রেও ভারতীয় সৈনিকদের (বৃটিশ বাহিনীর) যথাসম্ভব বাঁচিয়ে গুলি বর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

 বিক্রম সিং—উদয়পুর নিবাসী ভারতীয় জাতীয় সেনা বাহিনীর এই সৈনিক বলেন যে কোলকাতায় বোমাবর্ষণের পর একখানি চিত্র নেতাজীর হস্তগত হয়। ঐ চিত্রখানি কয়েক মিনিট স্তব্ধ দৃষ্টিতে দেখার পর নেতাজীর মন এতই বিচলিত হযে ওঠে যে তিনি জাপানীদের বাংলা ও আসামে অযথা বোমা নিক্ষেপ না করতে আদেশ দেন।

 মেজর হাকিমজী—আজাদ হিন্দ সরকারের শ্যাম বেতার কেন্দ্রের প্রচাবকর্তা এই ভদ্রলোক সম্প্রতি বলেছেন যে আজাদ হিন্দ সরকার বৃটিশের বন্ধু রাশিয়া ও চীন দেশের প্রতি নিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করতেন। এক সাংবাদিক সম্মেলনে নেতাজী বলেছিলেন যে, চীনের প্রতি তাঁর যথেষ্ট সহানুভূতি আছে। কারণ ভারত ও চীনের উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উভয়েই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বিমুক্ত হবার সংগ্রামে লিপ্ত।

 মিঃ হাসতান—ইনি ফ্রীস ইণ্ডিয়েন বা জার্মানীস্থ ভারতীয় সেনা বাহিনীর একজন অন্যতম বিশিষ্ট সামরিক কর্মচারী ছিলেন। ইনি নেতাজীর সঙ্গে জার্মানী থেকে জাপানে আগমন করেন। এই ফ্রীস ইণ্ডিয়েনের আরও কয়েকজন বীর সৈনিকের নাম— জামিল খান, আলী খান, ডাঃ ইশাক, ওরবাচান সিং, ডাঃ পটনেকার ও গুরুমুখ সিং। এঁদের বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৩৫০০— ১৫টি দলে বিভক্ত।

 খাওয়াজ আলী—এঁর দেশ রাওয়াল পিণ্ডি। তিনি জার্মানীতে আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে ছিলেন। ৮ই মে ১৯৪৫ পর্যন্ত তিনি জার্মানীতে ছিলেন এবং জার্মানীকে আত্মসমর্পণ করতে স্বচক্ষে দেখেছেন। আত্মসমর্পণের পর জার্মানীরা আজাদী ফৌজকে জার্মাণী পরিত্যাগ করতে আদেশ দেয় নতুবা দ্যগলের সৈন্যদের হাতে নিহত হবে বলে ভয় দেখায়। কিছুদিন আত্মরক্ষা করে থাকবার পরও তাঁরা দ্যগলের সৈন্যদের কবলে পড়েন। তখন খাওয়াজ আলি দ্যগলকে জার্মানদের পরাজিত করার জন্য সম্বর্ধনা জানিয়ে এক পত্র লেখেন এবং সে পত্রে আরও জানান যে আসলে আজাদী ফৌজ বৃটিশেরই তথা মিত্র শক্তিরই অনুগামী, জার্মানদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়েই তাদের দলে যোগ দিয়েছে ইত্যাদি।····এই ধাপ্পার সাহায্যে তাঁরা মুক্তি পান।

 আনন্দমোহন সহায়— আজাদ হিন্দ মন্ত্রিসভার সাধারণ সম্পাদক আনন্দমোহন সহায় ভাগলপুরে পুরানিসরাই গ্রামে এক দরিদ্র কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী লালমোহন সহায়। আনন্দমোহন দেশবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯২০ সালের স্বদেশী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন এবং এক সময়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদের প্রধান মুন্সীরূপে নিযুক্ত ছিলেন।

 আনন্দমোহন আবাল্য দুঃসাহসী। এবং একবার গোপনে কোলকাতার এক সিন্ধী বণিকের সঙ্গে তিনি জাপানে পালিয়ে যান। পরে অবশ্য তাঁর ছোট ভাই সত্য দেও তাঁর সঙ্গে জাপানে গিয়ে যোগ দেন। যাই হোক এই জাপানে আসার ফলেই আনন্দমোহন বিপ্লবের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। এই বিপ্লবের গুরু স্বনাম খ্যাত রাসবিহারী বসু। প্রকৃত পক্ষে এঁরা দুজনেই বিদেশে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। বলা বাহুল্য বৃটিশ গোয়েন্দা তাঁকে উত্যক্ত করে তোলে। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই বক্তা লেখক ও সাংবাদিকরূপে বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯২৮ সালে আনন্দমোহন কোলকাতায় এসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভগ্নী ঊর্মিলা দেবীর সপত্নী-কন্যা শ্রীমতী সতী দেবীকে বিবাহ করেন। এবং পরে জাপানে ফিরে গিয়ে দুজনেই বিপ্লবে আত্মনিয়োগ করেন। ফলে বৃটিশ পুলিশ তাঁর ভারতস্থ পরিবারবর্গের ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। বৃদ্ধ পিতাও এই লাঞ্ছনার হাত থেকে অব্যাহতি পান নি। জাপানে আনন্দমোহনের তিন কন্যা ও এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। ১৯৪২ সালে নেতাজীর আগমনের পর আনন্দমোহন ও সতীদেবী দুজনেই নেতাজীর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন ও বিশিষ্ট অংশ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে জাপানের আত্মসমর্পণের পর হ্যানয় সহরে একজন বৃটিশ অফিসারের কারসাজির ফলে তিনি এবং কর্ণেল চ্যাটার্জী গ্রেপ্তার হন।

 কর্ণেল এ, সি, চ্যাটার্জি—আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করার আগে অর্থাৎ ভারতবর্ষে থাকাকালীন তিনি বাঙ্গলাদেশে জনস্বাস্থ্যের পরিচালক বা Director of Public Health ছিলেন। এখানেই তিনি রাজনৈতিক জীবনে যুক্ত ছিলেন ব্রহ্মদেশে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এমন কি জনপ্রিয়তার দিক থেকে একমাত্র নেতাজীর পরেই ছিল তাঁর স্থান। কথা ছিল স্বাধীন ভারতে বাঙ্গলা দেশের গভর্ণর হবেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের অধীনে শৃঙ্খলিত অবস্থায় তিনি ভারতে আনীত হয়েছেন। তাঁর প্রতি কঠিন ব্যবহার করার জন্য একটি সরকারী আদেশপত্র শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র বসু সম্প্রতি ফাঁস করে দিয়েছেন।

 মিঃ ইকবাল সৈইদী, মিঃ নিরঞ্জন সিং ও অজিত সিং:— ১৯৪২ সালের জুন মাসে লিবিয়ার মুদ্ধক্ষেত্রে স্বনামখ্যাত মার্শাল রোমেল ২৫ হাজার মিত্রসৈন্যকে বন্দী করলেন তখন তাঁদের মধ্যে অনেক ভারতীয় সৈন্য ছিলেন। তাঁদের বেনগাজীতে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁদের মধ্য থেকেই জন্ম নেয় এক আজাদ হিন্দ বাহিনী এবং এঁদের সংগঠনের ভার নেন ইকবাল সৈইদী ও নিরঞ্জন সিং। তাঁদের চেষ্টায় প্রায় দুই হাজার ভারতীয় সৈন্য এই বাহিনীতে যোগ দেন। তাঁদের এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে একমাত্র ভারতের স্বাধীনতার জন্যই ভারত সীমান্তে তাঁরা যুদ্ধ করবেন—লিবিয়াতে বা অন্যত্র নয়। তারপর ইটালীতে আবেজানো সৈন্যবাসে তাঁদের স্থানান্তরিত করা হল। ওদিকে সৈইদী ও বাবা অজিত সিংএর চেষ্টায় মাত্র ১০০ জন সৈন্যকে কেন্দ্র করে গঠিত আর একটি আজাদী সৈন্য বাহিনী এসে মিলিত হল তাঁদের সঙ্গে।

 ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যভাগে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম দলটিকে রোমে পাঠানো হল সামরিক শিক্ষার জন্য। সেখানে তাঁদের কিছু কিছু সামরিক শিক্ষাও দেওয়া হয়েছিল এবং কয়েকজনকে প্যারাসুট বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে একদিন একজন ইটালীয় মেজর হুকুম দিলেন যে তাঁদের অনতিবিলম্বে লিবিয়াতে যুদ্ধ করবার জন্য তৈরী থাকতে হবে। আজাদী ফৌজের কার্যকরী সমিতির এক অধিবেশনে স্থির করা হল যে আজাদী সৈন্যরা একমাত্র আজাদী নেতাদের নির্দেশই মেনে চলবে। ফলে ইটালীর মন্ত্রিসভা এই আজাদী ফৌজ ভেঙ্গে দিয়ে তাঁদের সকলকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক করলেন।

 শ্রীউত্তমচাঁদ—১৯৪১ সালের ১৫ই জানুয়ারী সুভাষচন্দ্র মৌলবীর বেশে নিজ বাসস্থান ত্যাগ করে বরাবর পেশোয়ারে এসে হাজির হন। সেখান থেকে এক দরিদ্র পাঠানের বেশে তিনি কাবুলের ব্যবসায়ী শ্রীউত্তমচাঁদের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। এইজন্যে ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে আফগান সরকার উত্তমচাঁদকে আফগানিস্থান থেকে বহিষ্কৃত করে দেন। আফগান পুলিশ তাঁকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় জালালাবাদে নিয়ে এসে এক অন্ধকার কুঠুরীতে দুদিন আবদ্ধ করে রাখে। তারপর ১৯৪২ সালের ১লা জুন আফগান থেকেও তাকে বহিষ্কৃত করে দেওয়া হয়, ফলে ব্রিটিশ পুলিশ পেশোয়ারে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৪৩ সালে রাওলপিণ্ডিতে তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। এই বন্দীদশায় তিনি নেতাজীর পলায়নকাহিনীর এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস রচনা করেন। সেই ইতিহাস বর্তমানে প্রকাশিত হয়েছে। কারারুদ্ধ করে রাখা, শারীরিক ক্লেশ দেওয়া ছাড়াও ভারত সরকার তাঁকে জানিয়েছেন যে তাঁর প্রায় লাখ টাকার সম্পত্তি আফগান সরকার মাত্র ১২০০০ টাকায় নীলাম করে নিয়েছেন। তাছাড়া তাঁর বহু পণ্য বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়েছে। এমন কি তাঁর ব্যবসার খাতাপত্রও তাঁকে দেওয়া হয়নি। সেই সব খাতাপত্রে বহু পাওনার হিসাব আছে। নীলামের টাকাও এখন তাঁর হাতে পৌঁছায় নি। সমস্ত সুখসম্পদের বিনিময়ে এই নির্ভীক দেশপ্রেমিক তাঁর কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করতে এতটুকুও দ্বিধা করেন নি। তিনি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র।