পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১০২

উইকিসংকলন থেকে

শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবীকে লিখিত

১০২
Censored and Passed

স্বাঃ অস্পষ্ট
28/7/26
for D.I.G, I.B., C.I.D.

(১) Bengal
Mandalay Jail

[C/o D.I.G., I.B., C.I.D.
13, Elysium Row
Calcutta]

ইং ২১।৭।২৬

শ্রীচরণেষু—

 মা, অনেকদিন হইল পাটনার ঠিকানায় আপনাকে পত্র দিয়াছি— আশা করি যথা সময়ে তাহা পাইয়াছেন। ১৬ই জুন তারিখে আপনাকে পত্র লিখিতে বসি, কিন্তু কিছু দূর লিখিয়া আর কলম চলিল না। সে পত্র আজও পর্য্যন্ত শেষ করিতে পারি নাই, তাই নূতন করিয়া লিখিতে বসিয়াছি। ইতিমধ্যে আপনার মাথার উপর দিয়া যে ঝড় বহিয়া গিয়াছে তাহা ভাবিলেও বুক কাঁপিয়া ওঠে। ভগবান কি এতই নিষ্ঠুর? এমনই ভাবে কি মানুষকে পরীক্ষা করিতে হয়? ২৯শে জুন বৈকালের কাগজে যখন দুর্ঘটনার সংবাদ পাই, তখন সকলের ইচ্ছায় একটা টেলিগ্রাম করি আপনার নিকট, তারপর আপনাকে পত্র দিবার ইচ্ছা হইয়াছে—কিন্তু লিখিতে বসিয়া ভাষা খুঁজিয়া পাই নাই। কি লিখিব? কি বলিব? কি করিয়া সান্ত্বনা দিব? কি করিয়া শোকের গুরুভার লাঘব করিবার চেষ্টা করিব? কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। দেখিতে বড় ইচ্ছা হয়—কিন্তু সে সাধ পূর্ণ হইবার নয়। জীবনে কখনও হইবে কিনা—তাহা জানি না। আমরা তো এখানে Permanent Settlement-এর জন্য প্রস্তুত। জননী, বঙ্গজননী, বিশ্বজননী—এ সব অত্যন্ত আপনার জিনিষ কারার বন্ধনের মধ্যে আমাদের নিকট সহস্র গুণে পবিত্র, সুন্দর ও প্রিয় হইয়া উঠিয়াছে ও উঠিবে। মানস জগতে তাঁহারা নিত্য বিরাজ করিতেছেন ও করিবেন কিন্তু তাঁহাদের মানস সত্তা বাস্তব জগতের বিচ্ছেদকে আরও তীব্র কবিয়া তুলিবে।

 আকাশের তারার ন্যায় পুণ্য ও মহিমান্বিত সেই সব মুক্তির দিকে মানস জগতে চাহিয়া চাহিয়া কত দিন, কত মাস, কত বৎসর কাটাইতে হইবে তাহার ইয়ত্তা নাই। তথাপি আমি বিশ্বাস করি যে মানুষের আত্মা সত্য, তার জীবন সত্য এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ সত্য। এ জীবনের শেষ হইলেও জীবনের শেষ নাই—জীবনের সম্বন্ধগুলিরও শেষ নাই। পার্থিব শক্তি অমাদিগকে কারারুদ্ধ করিতে পারে, সর্ব্বস্ব অপহরণ করিতে পারে কিন্তু জীবনের শেষ করিতে পারে না—জীবনের নিত্য পবিত্র সম্বন্ধগুলির উপর হস্তক্ষেপ করিতে পারে না। আমাদের গৌরবময় ভবিষ্যতের কল্পনায় ও ধ্যানে আমরা বর্ত্তমানের সকল দুঃখ ও বন্ধন অগ্রাহ্য করিতে সমর্থ ও প্রস্তুত। ভবিষ্যৎ আলোর দর্শনে আমরা বর্ত্তমানের নিবিড় অন্ধকার সহ্য করিতেছি। তাই নিতান্ত অসহায় হইলেও আমরা সুস্থির ভাবে সেই সুপ্রভাতের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছি।

 জগতের মূলে যে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এ কথা অগ্রাহ্য করিতে পারি না। তাই আমি বিশ্বাস করি যে আমাদেরও একদিন আসিবে। তখন আমরা বর্ত্তমান শূন্যতা ও অভাবের শোধ কড়ায় গণ্ডায় তুলিয়া লইব। এই বিশ্বাস আছে বলিয়া আমরা বাস্তবের চাপে নিষ্পেষিত হই নাই বা হইব না।

 যাক্ অনেক বাজে বকিলাম, আপনার জন্য সর্ব্বদা চিন্তা হয়। আপনি কেমন আছেন? মেজদাদা ও বৌদিদি আপনার সহিত দেখা করিতে যান শুনিয়া সুখী হইলাম। এখানকার নূতন খবর কিছু নাই।

ইতি—

আপনাদের সেবক

সুভাষ

পরবর্ত্তী দুইখানি পত্র ভারতী বসুকে লিখিত