পদাবলী-মাধুর্য্য/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
মান
মানুষের যতগুলি ভাব প্রণয়-ব্যাপারে বর্ণিত হইয়াছে, তাহার সবগুলি কবিরা রাধা-কৃষ্ণ-লীলায় আরোপ করিয়াছেন। ধরুন—মান। কোথায় সেই অব্যক্ত, অনন্ত, শত শত বিশ্বের অধিপতি, সর্ব্বব্যাপী, সর্ব্বশক্তিমান্ ঈশ্বর—আর ধূলি-কণার কোটী-কোটীর অংশের একটি নগণ্য রেণুর মত মানুষ! সেই রেণু ভগবানের সঙ্গে মান করিবে এবং তিনি সেই রেণুর পা ধরিয়া মান ভাঙ্গাইবেন? সাধারণের নিকট এই তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে অনধিগম্য, সিন্ধুর সহিত বিন্দুর মান, ইহা শিশুর কল্পনা।
কিন্তু তিনি তো অণু হইতেও অনীয়ান্; এত বড় তিনি, কিন্তু ক্ষুদ্রের উপরও তাঁহার পূর্ণ দৃষ্টি, পূর্ণ ভালবাসা। পর্ব্বতের ছায়া বিশাল জলধির বক্ষে যেরূপ পড়ে, একটি ক্ষুদ্র জলবিন্দুর উপরেও তেমনই পূর্ণভাবে পড়ে। ক্ষুদ্রের নিকট তিনি ক্ষুদ্র। এই বিরাট্ বিশ্বের কর্ম্মশালায় কত সহস্র, কত কোটী বৃহৎ যন্ত্র কাজ করিতেছে; আবার একটি জীবাণুর শরীরেও সূক্ষ্ম শিরা, উপশিরা তেমনই পূর্ণভাবে ক্রিয়াশীল—ক্ষুদ্র বলিয়া তাহার আভ্যন্তরীণ সূক্ষ্ম যন্ত্রগুলির কোনটিই অপূর্ণ বা অঙ্গহীন নহে। সেই বহুরূপী বিরাট্ পুরুষবর আমার কাছে আমারই মত হইয়া আসেন। ভগবানের এই সর্ব্বব্যাপক, সূক্ষ্ম ও স্থূল উভয়ের উপযোগী, বৈষম্যহীন রূপভেদ স্বীকার করিলে মান-লীলা, দান-লীলা, নৌকা-বিলাস বুঝিতে কষ্ট হইবে না। এক সাধু আমাকে বলিয়াছিলেন—“রাধা-কৃষ্ণ লীলা দেখিবে? সৌর-কেন্দ্রে সূর্য্য তাঁহার জ্যোতিষ্কমণ্ডলীকে লইয়া কতই খেলা করিতেছেন—তাহাদিগকে অনুরাগের বন্ধনে বাঁধিয়া কখনও কাছে আনিয়া, কখনও দূরে রাখিয়া ঋতুভেদে লীলা করিতেছেন—আমার কাছে ইহাই রাধাকৃষ্ণের লীলা। আবার একটি ক্ষুদ্র ফুলকে লইয়া ভ্রমর কত কথাই না গুঞ্জন করিয়া বলিতেছে—কখনও ফুলটি নতমুখে তাহা শুনিতেছে, কখনও ঘাড় নাড়িয়া ভ্রমরটিকে ‘যাও, যাও’ বলিয়া সরাইয়া দিতেছে—আমার কাছে ইহাই রাধাকৃষ্ণের লীলা। প্রেমের অঞ্জন চক্ষে পরিয়া এস, দেখিবে জগৎ ব্যাপিয়া এক অফুরন্ত লীলা চলিতেছে; গাছে গাছে, পল্লবে পল্লবে, নদীতে ও সিন্ধুতে গ্রহ-উপগ্রহে—সকলেই ভালবাসায় ধরা দিয়াছে—ইহাই নিত্যবৃন্দাবনের নিত্য উৎসব।”
এই জগৎকে প্রেরণা দিতেছে বাসনা। খাদ্য, আশ্রয়, ধন, মান, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, ঐশ্বর্য্য, ক্ষমতা ইত্যাদির লোভে মানুষ সারাজীবন প্রতিনিয়ত প্রবৃত্তির পথে ঘুরিতেছে। কাম্যলাভের ব্যপদেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঝগড়া বিবাদ ও লড়াই চলিতেছে। এই কাম্যের পাছে পাছে দিবারাত্র খুনোখুনি ব্যাপার—উহা এবিসিনিয়া বা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধই হউক, বা সামান্য জ্ঞাতিঘটিত মোকদ্দমাই হউক। কিন্তু যে ফিরিয়া বসে, যে বলে এই সকল কাম্যবস্তুর কিছুই আমি চাই না, এগুলি ক্ষণস্থায়ী ও অসার, বাহিরের ঘটা দেখিয়া সে ভোলে নাই; কিন্তু যে বিশ্বের প্রাণস্বরূপ, জীবের প্রাণস্বরূপ, যিনি মনের মন, প্রাণের প্রাণাধিক, যাঁহার শ্রীমুখের অণু-পরমাণু শোভা লইয়া সরসীতে পদ্ম ও বনে-উপবনে গোলাপ-কুন্দ-যূঁই-মল্লিকা ফুটিতেছে, যাঁহার অপরূপ লাবণ্যের এক তিল প্রিয়তমার মুখে ও শিশুর হাস্যে প্রকাশ পাইয়া আমাদিগকে মুগ্ধ করিতেছে, শত কুসুম ও শত চন্দনতরুর সুঘ্রাণে যাঁহার অঙ্গগন্ধ ঘোষিত হইতেছে, শত মধুচক্র, খর্জ্জুর-আম্র-পনস-ইক্ষু যাঁহার অমৃতরসের সন্ধান দিতেছে, যিনি সমস্ত সৌন্দর্য্য-মাধুর্য্য ও আনন্দের উৎস-স্বরূপ—তাঁহাকেই মাত্র যদি কেহ চাহিয়া, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের গতি-মুখ ফিরাইয়া তাঁহারই জন্য প্রতীক্ষা করে—সেইরূপ অসামান্য ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব অন্যদেশ সহসা বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু তাহা ভারতে অবিদিত নহে। যে ব্যক্তি এইভাবে বৈষ্ণবী মায়া কাটাইয়াছে, সে তাঁহার সহিত সমান আসনের দাবী করিতেছে। দেবতার মধ্যে একমাত্র শিব ও ব্রহ্মা এই বৈষ্ণবী মায়ায় ধরা দেন নাই। এদিকে বিষ্ণুও নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। কৈলাসের রত্নময় পুরী শিবকে দিয়া তিনি কুবেরকে তাঁহার ভাণ্ডারী নিযুক্ত করিয়া দিলেন; কিন্তু শিব শ্মশানে-মশানে ফিরেন, বুড়ো বলদের উপর শওয়ার হন, উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া বা ঐরাবত হাতীর দিকে ফিরিয়াও তাকান না। চন্দন, অগুরু প্রভৃতি গন্ধদ্রব্যের তাঁহার কাছে কোন মূল্যই নাই; ভস্ম-চন্দন ও শ্মশানের নর-কঙ্কাল তাঁহার অঙ্গের সৌষ্ঠব সাধন করে।
শিব ও ব্রহ্মা—এই দুই দেবতামাত্র বিষ্ণুমায়ায় অভিভূত হন নাই। নিবৃত্তির স্বর্গে আর কোন দেবতার প্রবেশাধিকার নাই।
গ্রাম্য কবি লিখিয়াছেন—
‘‘বিকায় নাকো অন্য সুতো, বিনে তাঁতি নন্দের সুত
সে হাটের প্রধান তাঁতি, প্রজাপতি, পশুপতি,
আর যত আছে তাঁতি, তাঁদের শুধু যাতায়াত।’’
স্বয়ং বিষ্ণুর ছাপ-মারা সুতোই এই হাটের একমত ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্য। বিষ্ণু নিজে চৈতন্যপার্ষদ পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির মত ভোগের মুখোস-পরা নিবৃত্তির দেবতা। তাঁহার আবাস-স্থান তিমি-নক্র-তিমিঙ্গিল-সঙ্কুল উত্তাল তরঙ্গ ও আবর্ত্তময় মধ্য সমুদ্র, তথায় তাঁহার শয্যা একটি বট পত্র, মস্তকোপরি শতশীর্ষ বিষধর ভীষণ অনন্ত নাগের লেলিহান জিহ্বা; এই ভয়ঙ্কর স্থান ও পরিবেষ্টনীর মধ্যে তিনি যোগ-নিদ্রায় নিদ্রিত—এই অবস্থায় কি কাহারও চক্ষে ঘুম আসিতে পারে, কিন্তু পরম নির্ব্বিঘ্ন যোগেশ্বরের যোগ-সমাধির ইহাই উপযোগী স্থান। ঈদৃশ দেবতার নিকট যে ভক্ত যাইতে ইচ্ছা করিবে, শত কষ্টিপাথরে কষিয়া সে মেকী কিনা তিনি পরীক্ষা করিয়া লইয়া থাকেন। যে ভোগৈশ্বর্য্যবিমুখ হইয়া নিবৃত্তির পথে যাইতে চাহিবে, বৈষ্ণবী মায়া তাহাকে ফিরাইবার জন্য কত প্রলোভন ও কত বিভীষিকা প্রদর্শন করে, তাহা যিশুর সয়তান কর্ত্তৃক প্রলুদ্ধ হওয়ার কাহিনী, বুদ্ধদেবের মারের সহিত সংঘর্ষ ও শিবকৃত মদনভস্মের পরিকল্পনায় কবিরা আঁকিয়া দেখাইয়াছেন। এই নিবৃত্তিপন্থীকে টলাইবার জন্য ইন্দ্রদেব সর্ব্বদা অপ্সরীদিগের শরণ লইয়াছেন, সে সকল গল্প পুরাণকারেরা রচনা করিয়া এই সত্য প্রমাণ করিয়াছেন যে, যাঁহারা ভোগের পথ ছাড়িয়া যোগের পথে যাইতে চাহেন, প্রকৃতি তাহাদিগকে লুব্ধ করিবার জন্য সতত প্রয়াসী। ভিখারী রাস্তায় রাস্তায় সারাদিন চীৎকার করিয়া মুষ্টি ভিক্ষা পাইতেছে না, কিন্তু ভোগবিমুখ নিবৃত্তিকামী সাধুকে ভুলাইবার জন্য ধনকুবেরগণ তাঁহাদের ভাণ্ডার মুক্ত করিয়া দিতেছেন; সন্ন্যাসী তাহার নেংটী ছাড়িতেছে না, দিগম্বর সন্ন্যাসী সেই নেংটীটুকুও ফেলিয়া দিয়াছেন। এ যুগের প্রধান অস্ত্র অর্থের মুখ ভোতা হইয়া গেল, গান্ধিজী তাঁহার আটহাতী খদ্দর ছাড়িলেন না, এবং চার্চ্চহিলের কটুক্তি তাঁহার কাছে পুষ্পবৃষ্টির মত বোধ হইল।
সুতরাং এবম্বিধ ত্বৎ-সমর্পিত প্রাণ—একান্তভাবে ত্বদগত ও ত্বদবলম্বিত ব্যক্তির মান ভাঙ্গিতে যে ভগবান সাধ্যসাধনা করিবেন, বৈষ্ণবদের এই কল্পনার ভিত্তি-মূলে কতকটা পারমার্থিক সত্য নিহিত আছে, তাহা স্বীকার করিতে হইবে। বৈষ্ণবেরা নিবৃত্তির পথ মধুরাদপি মধুর করিয়াছেন—তাহা অনুরাগের দ্বারা পুষ্পাকীর্ণ করিয়া। মান-অধ্যায়ের ভূমিকা-স্বরূপ এইটুকু বলিয়া আমরা পদাবলীর উদ্যানে পুনরায় প্রবেশ করিব। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ও গোবিন্দ দাসের পরে মান সম্বন্ধে কীর্ত্তনীয়ারা যাঁহাদিগকে প্রধানতঃ অবলম্বন করিয়া থাকে, রায়শেখর ও শশিশেখর তাঁহাদের অন্যতম।
আমরা শশিশেখরের একটি পদ অবলম্বন করিয়া এই প্রসঙ্গ আরম্ভ করিব।
প্রথমেই কীর্ত্তনীয়া সখীগণপরিবৃতা রাধাকে মানের অবস্থায় শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে উপস্থিত করিল। কৃষ্ণ তাঁহার পদযুগল ধরিয়া আছেন। শুক-শারী বিবাদ করিতেছে; একজন কৃষ্ণ-পক্ষে, অপরে রাধা-পক্ষে। সখীরা ব্যধিকাকে গঞ্জনা করিয়া বলিতেছে, “শ্যামকে না দেখিলে মরবি, দেখিলেও মান করবি” এই রকমের উক্তি; কিন্তু চিত্রার্পিতা মূর্ত্তির ন্যায় রাধা বসিয়া আছেন, মুখে কোন কথা নাই। আপনারা বাজারে এই ভাবের অনেক চিত্র দেখিয়া থাকিবেন। এদিকে “চরণ-নথ রমণী-রঞ্জন ছাঁদ। ভূতলে লুটাইল গোকুলচাঁদ”—এই পদটি লইয়া অনেক টীকাকার ভুলের একটি দস্তুর-মত জাল তৈরী করিয়াছেন। বিদ্যাপতির একজন প্রসিদ্ধ ভক্ত ও টীকাকার লিখিয়াছেন “চরণনখর মণিরঞ্জন” অর্থ নখ-রঞ্জিনী বা নরুণ। কৃষ্ণ ও নরুণ, উভয়ের বর্ণই কালো, সুতরাং পদটির অর্থ হইল যে, গোকুলচন্দ্র কৃষ্ণ একটা নরুণের মত ভূতলে পড়িয়া আছেন। এই উপমার আর একটি সার্থকতা এই যে, নরুণ দিয়া পায়ের নখ কাটা হয়। গোকুলচন্দ্রও রাধার পায়ের কাছেই পড়িয়া আছেন। বিদ্যাপতির মত এত বড় কবির তাঁহার একজন ভক্তের কৃত এরূপ নরসুন্দরী টীকার লাঞ্ছনা আমি কল্পনা করিতে পারিতাম না। পদটি কোন কোন সংস্করণে এইভাবে লিখিত হইয়াছে:—“চরণ-নখর-মণি-রঞ্জন ছাঁদ” এইভাবে লিখিত হইলে উহাকে টানিয়া বনিয়া কতকটা পূর্ব্বোক্ত ব্যাখ্যার পরিপোষক করা যাইতে পারে; তথাপি “নখরঞ্জিনী” না হয় নরুণ হইল, কিন্তু “নখরমণিরঞ্জিনী” যে নরুণ হইবে, ইহাও নিতান্ত কষ্ট-কল্পনা না করিলে সিদ্ধ হয় না। বিশেষতঃ মানুষের পায়ের নখকে নখর বলে না, বাঙালায় নখর বলিতে পশু-পক্ষীর নখ বুঝায়—মিথিলায় কি বুঝায় বলিতে পারি না। কিন্তু এই নরুণের উপমা অন্যদিক্ দিয়া সমর্থিত হইলেও, কবিত্বের দিক্ দিয়া উহা একবারে মারাত্মক। পদটী এইভাবে লিখিত হওয়া উচিত “চরণ-নখ রমণীরঞ্জন ছাঁদ” এবং ইহার অর্থ—এই যাহার পদনখের দ্যূতি, রমণীর মনোরঞ্জন করে, সেই শ্যামচন্দ্র রাধিকার পাদমূলে লুটাইয়া পড়িলেন। এই উক্তি-দ্বারা একদিকে শ্রীকৃষ্ণের রমণী-মন আকর্ষণ করিবার অসামান্য শক্তির ইঙ্গিত করা হইয়াছে, (সেই কৃষ্ণ যাঁহার পদ-নখ দ্যুতিতেই রমণী মুগ্ধ হয়), অপর দিকে তিনি রাধার পায়ের কাছে ভূতলে লুটাইয়া পড়িলেন—এই উক্তি দ্বারা তাঁহার গৌরবের সম্পূর্ণ ধ্বংস ও নতি স্বীকারের পরাকাষ্ঠা তুলনায় প্রদর্শিত হইয়াছে।
মান শব্দটির প্রতিশব্দ আর কোন ভাষায় আছে কি না, জানি না। কোমল মনোভাব বুঝাইতে বাঙালীরা অনেকগুলি শব্দ সৃষ্টি করিয়াছে মানটি তাহাদের অন্যতম, ইংরেজীতে ইহার প্রতিশব্দ থাকা তো দূরের কথা, ইহার ভাবার্থ বুঝানও একরূপ অসম্ভব। ইহার অর্থ রাগ, ক্রোধ, গোস্মা বা খাপ্পা হওয়া নহে। এই সকল কাঠ-খোট্টা শব্দে মানের মাধুর্য্য বুঝান শক্ত। ইহা কৃত্রিম রাগও নহে; কারণ মূলে উপেক্ষার আঘাত আছে। ইহা প্রণয়ীর চিত্তের প্রেমের গভীরতা পরীক্ষা করিবার একটা কষ্ঠিপাথর; যিনি মান করেন, তিনি প্রেমিককে ছাড়িতে চাহেন না, বরং আরও কাছে আনিতে চাহেন—যদিও ইহা বাহ্যে কঠোর, ইহার ভিতরটা একবারে কুসুমকোমল। মানিনী যাহা চাহেন না বলেন, তাহাই আরও বেশী করিয়া চাহেন, অথচ মুখ মুখ ফুটিয়া কিছুতেই বলিবেন না—ইহা গভীর প্রেমের ছদ্মবেশ। এক বাঙালী কবি নিম্নলিখিত কয়েকটি ছত্রে মানের স্বরূপ বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন
‘‘এক চক্ষু বলে আমি কৃষ্ণরূপ হেরব,
অপর চক্ষু বলে আমি মুদিত হয়ে রব।
এক পদ কৃষ্ণ-পাশে যাইবারে চায়,
আর পদে বার বার বারণ করে তায়।’’
যাহা হউক, এখন মানের মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যা’ক। সখীরা রাধাকে নানারূপ মিষ্ট ভর্ৎসনা করিতেছে:
‘‘ভাগে মিলল ইহ সময় বসন্ত,
ভাগে মিলল ইহ শ্যাম রসবন্ত!
ভাগে মিলল ইহ প্রেম-সঙ্ঘতি।
ভাগে মিলল ইহ সুখময় রাতি।
আজি যদি মানিনী তেজবি কান্ত,
জনম গোঙাঙিবী রোই একান্ত।’’
কৃষ্ণ পদ স্পর্শ করিয়া আছেন, সেই স্পর্শের গৌরবে রাধা আবিষ্ট হইয়া আছেন—তাঁহার বাহিরের জ্ঞান নাই। স্পর্শরসে তিনি আত্মহারা। হতাশ কৃষ্ণ এবার ফিরিয়া যাইতেছেন—রাধাকুণ্ডে প্রাণত্যাগ করিতে। কিন্তু একবার কতকটা যাইয়া ফিরিয়া চাহিতেছেন, রাধার মান ভাঙ্গিল কি না দেখিতে। এইভাবে পুনঃ পুনঃ থামিয়া থামিয়া কৃষ্ণ চলিয়া গেলেন।
কৃষ্ণের কোমল স্পর্শে আত্মহারা হইয়া রাধার মন বাস্তব জগতে জাগিয়া উঠিল, তখন মান আপনা হইতেই ভাঙ্গিয়া গেল এবং কৃষ্ণের জন্য মন হাহাকার করিয়া উঠিল। তাঁহাকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য রাধা সখীদের সাধিতে লাগিলেন। অনেক কথার কাটাকাটি হইল, সখীরা সময় পাইয়া বেশ দু’কথা শুনাইতে ছাড়িল না। রাধা বিলাপ করিয়া বলিলেন: “নারী জনমে হাম না করিলু ভাগী। এখন মরণ শরণ ভেল মানকি লাগি।” নারীজন্মে আমি কোন ভাগ্যই করি নাই, এখন মানের জন্য আমার মৃত্যুর শরণ লইতে হইল। কৃষ্ণকমল গেঁয়ো কথায় “আমি অতি পাষাণ-বুকী, সে মুখে হ’লাম বিমুখী–সে যে কেঁদে কেঁদে সেধে গেল গো” বলিয়া হৃদয়ের তীব্র ব্যথা বুঝাইয়াছেন; তাঁহার আর একটি পদ এইরূপ “আমি নহি প্রেমযোগ্য, করেছিলাম প্রেমযজ্ঞ, যোগ্যাযোগ্য বিচার না করে”–—এই যজ্ঞের আমি যোগ্য নই, যজ্ঞেশ্বর কেন আমার যজ্ঞ গ্রহণ করিবেন?
রাধার এই মর্ম্মান্তিক কষ্টের এই দৃশ্য কি সখীরা সহিতে পারে? তাহারা তাঁহার আপনার, গালি দিয়াও তাহাদের প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিল। বৃন্দা চক্ষের জল মুছিতে মুছিতে কৃষ্ণের সন্ধানে চলিল। বৃন্দার সাশ্রু আঁখি বৃন্দারণ্যের সমস্ত স্থান খুজিতে লাগিল। কৃষ্ণ কোথাও নাই। ধীর মন্থর গতিতে বৃন্দা যাইতেছে, বংশীবট, যমুনাতট—যেখানে কৃষ্ণ রাধার প্রতীক্ষা করিয়া বাঁশীতে রাধাকে সঙ্কেত করেন, তিনি কোথাও নাই। নিশ্চয়ই রাধার নিষ্ঠুর ব্যবহারে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। বৃন্দার চক্ষের জল গণ্ডে গড়াইয়া পড়িতেছে, সে তাহা আঁচলে মুছিয়া আবার চলিতেছে। শ্যামকুণ্ড, মদনকুঞ্জ ও রাধাকুণ্ডের পার বৃন্দা বারংবার খুজিঁয়াছে। গোবর্দ্ধন পাহাড়ের উপত্যকা-পথে তন্ন তন্ত্র করিয়া তথাকার দ্বাদশ বনের প্রতিটি বন সন্ধান করিয়াছে। বড় আশা করিয়া বৃন্দা গোচারণের মাঠে ছুটিয়া গেল। হয়ত সেখানে কৃষ্ণ আছে। কারণ “সেও তে ধেনুর রাখাল বটে!” ধেনুর রব সখাদের কোলাহল শুনিয়া সে আশা করিয়াছিল, সেখানে হয়ত কৃষ্ণ আছেন, কিন্তু সেখানে শ্রীদাম, সুদাম ও মধুমঙ্গলাদি কৃষ্ণসখাদিগকে দেখিতে পাইল, আর দেখিতে পাইল বলরামকে, কিন্তু গোপীগণের নয়নাভিরাম কোথায়? বৃন্দা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। রাধা-কুণ্ডের পারে কৃষ্ণের পদচিহ্ন দেখিয়া বুঝিল, কৃষ্ণ নিশ্চয়ই অভিমানে সেই কুণ্ডে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন! তখন সে সেই পদচিহ্নের উপর লুটাইয়া পড়িল।
‘‘জিতি কুঞ্জর, গতি মন্থর, চলল বর নারী,
বংশীবট যমুনাতট-বন সঘনে নেহারি।
শ্যামকুণ্ড, মদনকুঞ্জ রাধা-কুণ্ড-তীরে,
দ্বাদশ বন-হেরত সঘন শৈলহি কিনারে।
যাঁহা ধেনু সব করতহি রব,
তাঁহা চলতি জোরে,
(দেখে) শ্রীদাম, সুদাম, মধুমঙ্গল হেরত বল বীরে।”
হঠাৎ যমুনাকূলে কদম্ববৃক্ষমূলে তাহার দৃষ্টি পড়িল, সেখানে সে হারাণো রতন কুড়াইয়া পাইল। কৃষ্ণের অবস্থা দেখিয়া এই দুঃখের মধ্যেও বৃন্দার হাসি পাইল। একদিকে বাঁশীটি পড়িয়া আছে—এত সাধের বাঁশী—সুখ-দুঃখের সঙ্গী বাঁশী কৃষ্ণের হস্ত-চ্যূত; কৃষ্ণ ধূলায় ধূসর, অপর দিকে, ময়ুরপুচ্ছের কত গৌরবের চুড়াটি—তাহাও শির-চ্যুত, ধুলায় লুটাইতেছে। কৃষ্ণের কম্পিত ওষ্ঠ এই অবস্থায়ও “হা রাধে, হা রাধে” বলিতেছে, এত দুঃখেও কৃষ্ণ নাম ছাড়েন নাই, এ যুগে নাম সত্য,—সেই নাম ছাড়েন নাই। এদিকে তাঁহার হাতছাড়া বাঁশীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে পবন হিল্লোলিত হইতেছে, ‘রাধানামে সাধা বাঁশী’ তখন আপনা হইতেই “জয় রাধে শ্রীরাধে” বলিয়া বাজিয়া উঠিতেছে। কারণ বাঁশী আর কিছু জানে না। ওষ্ঠাধরের সেই অর্দ্ধস্ফুট রাধানাম ও বাঁশীর আকুল ‘রাধা রাধা’ ধ্বনি সেই নীপমূলে অদৃশ্য চিত্তহারী কল্পলোকের সৃষ্টি করিয়াছে। সেই কল্পলোকে উন্মত্তের ন্যায় পরিবেদনা বিমূঢ়, আর্ত্ত, ধূলিধূসর কৃষ্ণ পড়িয়া আছেন।
‘‘যমনুকূলে, নীপহি মূলে, লুট বনওয়ারী,
শশিশেখর ধুলিধূসর, কহত প্যারী প্যারী।’’
উপরে আমি এই পদটির যে বিবৃত্তি দিয়াছি, তাহার একটি কথাও আমার নিজের নহে, কীর্ত্তনীয়াদের আখর হইতে পাওয়া।