বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৮
আত্মচরিত

 এইভাবে রাসায়নিক গবেষণার ফল বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। রসায়ন শাস্ত্র সম্বন্ধীয় পত্রিকাসমূহের বিষয়সূচী এবং লেখকদের নাম দেখিলেই তাহা বুঝিতে পারা যাইবে।

 ১৯০৪ সালে একজন আইরিশ যুবক (কানিংহাম) শিক্ষা বিভাগে প্রবেশ করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের সহযোগী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি বাংলা দেশে বৈজ্ঞানিক শিক্ষার উন্নতিকল্পে প্রভূত সহায়তা করেন। তিনি উৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁহার মনে কোন ঈর্ষা বা সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি প্রায়ই বলিতেন যে তিনি ‘জুনিয়র’ হইয়াও ‘ইণ্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিসের’ লোক হিসাবে সিনিয়র বলিয়া গণ্য হইবেন, ইহা খুবই অদ্ভুত কথা। যিনি তাঁহার ‘জুনিয়র’ বলিয়া গণ্য, তাঁহার পদতলে বসিয়া তিনি (কানিংহাম)—শিক্ষালাভ করিতে পারেন। তিনি প্রকাশ্যে এবং কার্যতঃ ভারতবাসীদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানভূতি প্রদর্শন করিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নূতন নিয়ম অনুসারে বি, এস-সি এবং এম, এস-সি উপাধি তখন সবে প্রবর্তিত হইয়াছিল এবং তিনি কেবল প্রেসিডেন্সি কলেজে নয়, বাংলার সমগ্র কলেজে লেবরেটরিতে ছাত্রদের শিক্ষাদান প্রণালীর উন্নতি সাধনে যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে শিক্ষা বিষয়ে বহু পরামর্শ দিয়া সাহায্য করেন এবং বাংলার বহু শিক্ষক ও রাজনীতিকের সঙ্গে তাঁহার বন্ধুত্ব হয়। বেঙ্গল কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের কারখানা তখন মানিকতলা মেন রোডে স্থানান্তরিত হইয়াছে এবং উহার নির্মাণকার্য তখনও চলিতেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি তাঁহার বিশেষ প্রিয় ছিল। তাঁহার মতে দেশীয়দের প্রতিভা ও কর্মোৎসাহের ইহা জীবন্ত প্রতিমূর্তি। দুর্ভাগ্যক্রমে উৎসাহের আতিশয্য বশতঃ কখন কখন তাঁহার বৃদ্ধির ভুল হইত এবং এই কারণে তিনি শেষে বিপদগ্রস্ত হইলেন।

 একবার তিনি বিলাতে তাঁহার বন্ধু জনৈক পার্লামেণ্টের সদস্যকে ব্যক্তিগত ভাবে একখানি পত্র লিখেন। পত্রে পূর্ববঙ্গে, বিশেষ ভাবে গবর্ণর সার ব্যামফিল্ড ফুলারের শাসননীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল। উক্ত বন্ধু বুদ্ধির ভুলে ভারতবাসীদের প্রতি সহানভূতিসম্পন্ন অন্য কয়েকজন পার্লামেণ্টের সদস্যকে ঐ পত্র দেখান, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে ইণ্ডিয়া কাউন্সিলের একজন সদস্য (জনৈক অবসরপ্রাপ্ত অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান) উহার একখানি নকল সংগ্রহ করিয়া ভারত-সচিবকে দেখান। ব্যাপারটি যথা সময়ে বাংলার শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর স্যর আর্কডেল আর্লের নিকট আসিল।

 স্যর আর্কডেল কানিংহামকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং শাসনবিধি ভঙ্গের জন্য তাঁহাকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিলেন। তাঁহাকে বলা হইল যে তিনি যে কাজ করিয়াছেন, তাহাতে অবিলম্বে তাঁহাকে কার্যচ্যুত করা উচিত এবং তাঁহাকে তাঁহার বর্তমান কর্মক্ষেত্র হইতে অপসারিত করাই সর্বাপেক্ষা লঘু শাস্তি। কানিংহামকে অনুন্নত প্রদেশ ছোটনাগপুর স্কুল ইনস্পেক্টর রূপে বদলী করা হইল। ১৯১১ সালে রাঁচিতে তিনি ম্যালেরিয়া জ্বরে প্রাণত্যাগ করিলেন। বেকার লেবরেটরিতে তাঁহার বন্ধু ও গুণমুগ্ধগণ তাঁহার নামে একটি স্মৃতিফলক প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধা ও অনুরাগের পরিচর দিয়াছেন।


    বলিতে পারি যে আমি অনেক পরে এ পৃথিবীতে আসিয়াছি, সুতরাং আমি তাঁহার রাসায়নিক “প্রশিষ্য” হইয়াছি। সার পি, সি, রায়ের ভূতপূর্ব ছাত্র মিঃ অতুলচন্দ্র ঘোষের নিকট আমি রসায়নশাস্ত্রে শিক্ষালাভ করিয়াছি।” (১৯২৮ সনে জানুয়ারীতে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের রসায়ন শাখার প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণ)