বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
২০৭

সে যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররূপে গণ্য হইবেন। এই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যের ফলে জগতের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধিশালী হইবে।”

(৭) বিদেশী উপাধির মোহ—দাস মনোভাব—হীনতা-বোধ

 পরাধীন জাতির সহস্র প্রকার দুর্ভাগ্যের মধ্যে একটি এই যে, সে তাহার আত্ম-সম্মান ও মর্যাদাজ্ঞান হারাইয়া ফেলে এবং প্রভুজাতির মাপকাঠিতেই সমস্ত বস্তুর মূল্য নির্ণয় করিতে থাকে। আমাদের শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে এই শোচনীয় মনোবৃত্তির কথা আমি অনেকবার বলিয়াছি। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি এই ভাবে ক্রমে ক্রমে অজ্ঞাতসারে আমাদিগকে জয় করিয়াছে। আমাদের শাসকরাও নানা ভাবে এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়াছেন।

 এমার্সন যথার্থই বলিয়াছেন—“আত্মানুশীলনের অভাবেই ‘দেশ-ভ্রমণের’ সম্বন্ধে এক প্রকার কুসংস্কার জন্মিয়াছে। শিক্ষিত আমেরিকাবাসীরা মনে করে যে বিদেশ ভ্রমণ না করিলে কোন উন্নতি হইতে পারে না। এই কারণেই ইটালী, ইংলণ্ড, মিশরের মোহে তাহারা আচ্ছন্ন। যাহারা ইংলণ্ড, ইটালী বা গ্রীসকে কল্পনায় বড় মনে করে, তাহারা স্থাণুর মত এক জায়গাতেই স্থির হইয়া থাকে। মানুষের মত যখন আমরা চিন্তা করি, তখন বুঝিতে পারি, কর্তব্যই সর্বাপেক্ষা বড় জিনিষ। বিদেশ ভ্রমণ নির্বোধেরই কল্পনার স্বর্গ।”

 আমাদের দেশের যুবকদের উচ্চতর সরকারী পদ লাভ করিতে হইলে ইংলণ্ডে যাইতে হইবে এবং সেই বহুদূরবর্তী বিদেশে থাকিয়া বহু কষ্টে, বহু অর্থব্যয়ে বিদেশী ভাষার সাহায্যে শিক্ষা লাভ করিতে হইবে; এবং এত কষ্ট ও অর্থব্যয়ের পর, প্রবল প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় সাফল্যের উপর তাহার ভাগ্য নির্ণীত হইবে। এই উপায়ে, গত ৫০। ৬০ বৎসরে অল্প সংখ্যক ভারতবাসী ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের সিভিল, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে প্রবেশ লাভ করিতে পারিয়াছে। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরাও ঐ সমস্ত বিভাগে প্রবেশ করিয়াছে, কিন্তু তাহাদের পদ-মর্য্যাদা পূর্বোক্ত ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের লোকদের চেহে হীন। এইরূপে এক শ্রেণীর নূতন জাতি-ভেদ গড়িয়া উঠিয়াছে। আই. সি. এস., আই. এম. এস., এবং আই. ই. এস. নিজেদের উচ্চস্তরের জীব মনে করে এবং তথাকথিত নিম্নতর সার্ভিসের লোকদের করুণার চক্ষে দেখে।

 বিদেশী বিশেষতঃ ব্রিটিশ ডিগ্রী বা যোগ্যতার মোহে আমাদের বহু অর্থ, শক্তি ও সময়ের অপব্যয় হইতেছে। সম্প্রতি লণ্ডনস্থ ভারতের হাই কমিশনারের আফিস হইতে তথাকার শিক্ষাবিভাগের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতে জানা যায় যে, ইংলণ্ড, ইয়োরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় ছাত্রদের মোট সংখ্যা ২৫০০ এর কম নহে। হিসাব করিলে দেখা যাইবে যে, এই সব ছাত্রদের শিক্ষার জন্য বৎসরে প্রায় এক কোটি টাকা ভারত হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে, কিন্তু তাহার প্রতিদানে ভারতের বিশেষ কিছু লাভ হইতেছে না। উক্ত রিপোর্টে নিম্নলিখিত সারগর্ভ মন্তব্য লিপিবদ্ধ হইয়াছে:—

গুরুতর অপব্যয়

 “ভারতে বর্তমানে সরকারী কাজে অধিক সংখ্যায় ভারতীয়দের নিয়োগ করা হইতেছে। যে সমস্ত পদে বিলাত হইতে লোক নিযুক্ত করা হইত, তাহার অনেকগুলিতে ভারতেই লোক নিযুক্ত করা হইতেছে,—ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার যোগ্যতাও সমান ভাবেই