বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৩৪
আত্মচরিত

করেন। উহাতে ৩০০টি রণতরী ছিল এবং ঐ সমস্ত রণতরী হুগলী, বালেশ্বর, মুরাং, চিলমারী, যশোর এবং কালীবাড়ীতে নির্মিত হইয়াছিল।

 ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম আমলেও তাঁহারা বাংলার পোতশিল্প গঠনে সহায়তা করেন। এ বিষয়ে তাঁহারা বলিতে গেলে ঢাকায় মোগল রাজপ্রতিনিধিদের দৃষ্টান্তই অনুসরণ করিয়াছিলেন। “১৭৮১—১৮০০ খৃঃ পর্যন্ত মোট ১৭,০২০ টনের ৩৮৫ খানি জাহাজ হুগলী নদীর বন্দরেই নির্মিত হইয়াছিল। ১৮০১—১৮২১ খৃঃ পর্যন্ত হুগলী বন্দরে মোট ১০৫,৬৯৩ টনের ২৩৭ খানি জাহাজ নির্মিত হয়।

 ভারতের বড়লাট লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খৃষ্টাব্দে এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন যে, পোতশিল্পের কেন্দ্র রূপে ভবিষ্যতে কলিকাতা সহর গড়িয়া উঠিবে, এরূপ সম্ভাবনা আছে। তাঁহার মন্তব্য নিম্নে উধৃত হইল:—

 “কলিকাতা বন্দরে ১০,০০০ টন জাহাজ আছে। ঐ সমস্ত জাহাজ মাল বহন করিবার জন্য ভারতেই নির্মিত। কলিকাতা বন্দরে বর্তমানে যত টন জাহাজ আছে এবং বাংলা দেশে পোতশিল্প যেরূপে উন্নতি লাভ করিয়াছে (এবং ভবিষ্যতে আরও দ্রুত উন্নতি করিবে), সেই সমস্ত বিবেচনা করিয়া নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে বাংলার ব্রিটিশ বণিকদের পণ্য লণ্ডন বন্দরে চালান দিবার জন্য যত টন জাহাজের প্রয়োজন হইবে, কলিকাতা বন্দর তাহা সমস্তই যোগাইতে পারিবে।”

 বোম্বাইও এবিষয়ে কলিকাতা অপেক্ষা পশ্চাৎপদ ছিল না। বরং কোন কোন দিক দিয়া উন্নত ছিল। পার্শী জাহাজ নির্মাতাদের সুদক্ষ পরিচালনায় বোম্বাইয়ের সরকারী ডকইয়ার্ড তৎকালে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল। ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে জনৈক পর্যটক বোম্বাই ডকের বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন,—“এই ডকইয়ার্ডটি সুপ্রশস্ত, এখানে জাহাজী মালপত্র রাখার জন্য উপযুক্ত গুদাম ঘর আছে। এখানকার ‘ড্রাই-ডক’ এমন প্রশস্ত এবং সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত যে ইয়োরোপে তাহার তুলনা মিলে না।”[]

 কিন্তু কলিকাতা বন্দরের শ্রীবৃদ্ধি সম্বন্ধে লর্ড ওয়েলেসলির ভবিষ্যৎ বাণী সফল হইল না। “লণ্ডন বন্দরে যখন ভারতের নির্মিত জাহাজ ভারতীয় পণ্য বহন করিয়া উপস্থিত হইল, সেখানকার একছত্রী ব্যবসায়ীদের মধ্যে তখন একটা হুলুস্থূল পড়িয়া গেল। টেমস নদীতে যদি কোন শত্রু পক্ষের জাহাজ উপস্থিত হইত, তাহা হইলেও বোধ হয়


  1. ১৭৩৬ খৃঃ হইতে ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত নিম্নলিখিত পার্শিগণ বোম্বাই সরকারী ডকইয়ার্ডে প্রধান জাহাজনির্মাতার কাজ করেন:—১৭৩৬—১৭৭৪ খৃঃ লাউজী, ১৭৭৪-— ১৭৮৩ খৃঃ মানিকজী ও বোমেনজী; ১৭৮৩—১৮০৫ খৃঃ ফ্র্যামজী ও জামসেঠজী; ১৮০৫—১৮১১ খৃঃ জামসেঠজী ও রতনজী; ১৮১১—১৮২১ খৃঃ জামসেঠজী ও নৌরজী; ১৮২১—১৮৩৭ খৃঃ— নৌরজী ও কারসেঠজী।
     সিন্ধিয়া ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোম্পানীর জাহাজ ‘জলবীরের’ উদ্বোধন উপলক্ষে কিছু দিন পূর্বে ডাঃ পরাঞ্জপে বলেন:—“এই উপলক্ষে যে সময়ে ভারত পোত শিল্পে প্রসিদ্ধ ছিল, সেই অতীতের গৌরব কাহিনী স্মরণ না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না। সেই সব দিনের কথা লোকে বিস্মৃত হইয়াছে। কিন্তু একশত বৎসর পূর্বেও ভারতের নানা স্থানে বিলাতের চেয়েও ভাল জাহাজ নির্মিত হইত। ১৮০২ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ডের সরকারী নৌবিভাগ বোম্বাই বন্দরে একখানি যুদ্ধ জাহাজ তৈরী করিবার ফরমাইজ দিয়াছিলেন। ব্রিটিশ নৌবিভাগের কর্তারা ইয়োরোপীয় জাহাজ নির্মাতাগণকে পাঠাইতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু বোম্বাইয়ের জাহাজ নির্মাতা জামসেঠজী ওয়াদিয়ার কৃতিত্ব জানা থাকাতে তাঁহারা তাঁহাকেই প্রধান নির্মাতা রূপে মনোনীত করেন। প্রায় এক শত বৎসরকাল ওয়াদিয়া বংশের নাম জাহাজ শিল্পের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পোতশিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র রূপে বোম্বাই বন্দরের নাম লুপ্ত হইল।”