বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৩৬
আত্মচরিত

পরীক্ষা দেয় নাই। স্মরণ রাখিতে হইবে কলিকাতায় থাকিয়া একজন এম. এস-সি. ছাত্রের পড়িবার ব্যয় মাসিক ৪০ হইতে ৫০ টাকার কম নহে। সুতরাং দুই বৎসর কাল প্রত্যেক ছাত্রের অভিভাবকের গড়ে এক হাজার টাকা লাগিয়াছে এবং পূর্বোক্ত ৪০ জন ছাত্র মোট ৪০ হাজার টাকা অপব্যয় করিয়াছে। কিন্তু এই নগদ টাকার অপব্যয়েই দুঃখের শেষ নহে। জাতির মনুষ্যত্ব যে ভাবে এই দিকে ক্ষয় হইতেছে, তাহা সত্যই ভয়াবহ।[]

 তারপর এখনও বাঙালী ছাত্রেরা বিদেশে, বিশেষতঃ জার্মানী ও আমেরিকায় যায়, তথাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী ও ডিপ্লোমার মোহে। তাহারা এজন্য নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বন্ধক দেয়, এমন কি বিবাহের বাজারে সর্বোচ্চ দরে নিজেকে নীলাম করিতেও সে লজ্জিত হয় না। কিন্তু দেশে ফিরিয়া সে চারিদিকে অকুল পাথার দেখে। সে ঝোঁকের মাথায় কখন কখন দুঃসাহসিক অভিযান করিতে পারে যথা, সে শ্রমিকদের দোভাষী হইয়া যাইতে পারে, অথবা হংকংএ সৈন্য বিভাগের ডাক্তার কিম্বা কোন সমুদ্রগামী জাহাজের ডাক্তার হইয়া যাইতে পারে। কিন্তু শীঘ্রই বাড়ীর জন্য তাহার মন আকুল হইয়া উঠে। পক্ষান্তরে গুজরাটী, কচ্ছী, সিন্ধীরা, অশিক্ষিত হইলেও সিঙ্গাপুর, হংকং, কিওটো, ইয়োকোহামা, হনলুলু, সান ফ্রান্সিসকো, কোনিয়া, মিশর ও পারিতে থাকিয়া ব্যবসায়ীরূপে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে।

 পরিশেষে আমি পুনর্বার বলিতেছি যে, বাঙালী দুর্ভাগ্যক্রমে বড় বেশী আদর্শবাদী হইয়া পড়িয়াছে, ব্যবহারিক জ্ঞান তাহার অত্যন্ত কম। এই বৈজ্ঞানিক যুগে দ্রুত যাতায়াতের সুবিধা হওয়াতে, সে ইয়োরোপীয় ও চীনাদের সংস্পর্শে আসিয়াছে; মাড়োয়ারী, গুজরাটী, বোরা, পার্শী, হিন্দুস্থানী, পাঞ্জাবী, উড়িয়া, কচ্ছী, সিন্ধী প্রভৃতি অ-বাঙালীদের সঙ্গেও তাহার ঘনিষ্ট পরিচয় হইয়াছে। কিন্তু জীবনের প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে সে প্রতিযোগিতায় হঠিয়া যাইতেছে। তাহার পাচক, ভৃত্য, ফিরিওয়ালা, কুলী, ক্ষেতের মজুর, জুতা-নির্মাতা, মুচী, ধোবা, নাপিত এ সমস্তই বাংলার বাহির হইতে আমদানী হইতেছে। দেশের অন্তর্বাণিজ্য, তথা বিদেশের সঙ্গে আমদানী রপ্তানীর ব্যবসা-সমস্তই তাহার হাত হইতে চলিয়া যাইতেছে। এক কথায়, অন্নসংস্থানের ব্যাপারে, বাঙালী তাহার নিজের বাসভূমিতে অসহায় হইয়া পড়িয়াছে। ২২ লক্ষ অ-বাঙালী প্রতি বৎসর বিপুল অর্থ—১২০ কোটী হইতে ১৫০ কোটী টাকা—বাংলা হইতে উপার্জন করিয়া লইয়া যাইতেছে। আর বাঙালী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বস্তু বলিয়া মনে করিতেছে, এবং এই ডিগ্রী না পাইলে নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে করিতেছে। সে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি চিরদিনই বিরূপ। ইহাকে সে ছোট কাজ বলিয়া মনে করে। সুতরাং অনাহারক্লিষ্ট ডিগ্রীধারীর দল যে বাজার ছাইয়া ফেলিবে, তাহা আর আশ্চর্য কি? খবরের কাগজে যখনই কোন ৫০ হইতে ১০০ শত টাকা মাসিক বেতনের কর্মখালির বিজ্ঞাপন বাহির হয়, তখনই শত শত দরখাস্ত পড়িতে থাকে। যদি বেতন মাসিক ১৫০ শত টাকা বা বেশী হয় তবে দরখাস্তের সংখ্যা হাজার হাজার হয়। গত ২৫ বৎসর ধরিয়া এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখিয়া আমি মনে গভীর বেদনা বোধ করিতেছি। বস্তুতঃ, আর্থিক ক্ষেত্রে বাঙালীর ব্যর্থতার বিষয়ে চিন্তা ও আলোচনা করা আমার একটা প্রধান কাজের মধ্যে দাঁড়াইয়াছে। এই কারণেই স্বজাতির এই দৌর্বল্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া আমি সকলকে সচেতন করিবার চেষ্টা করিতেছি।


  1. আরও দুঃখের বিষয় এই যে ২২ জন ছাত্র ব্যবহারিক গণিতে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে কেহই ‘নিয়মিত ছাত্র’ নহে, অর্থাৎ কেহই প্রথম বার পরীক্ষা দিতে যায় নাই। যাহারা শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেয় না, অথবা পরীক্ষায় ফেল করে, তাহাদের পুনর্বার ‘অনিয়মিত ছাত্র’ রূপে পরীক্ষা হয়। সুতরাং ইহাদের জন্য অভিভাবকদের অতিরিক্ত অর্থবার হয়।