বর্তমান বাংলা এবং ১৪শ, ১৫শ, ১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীর ইয়োরোপীয় সাধারণ তন্ত্র সমূহ তথা চীনের মধ্যে পার্থক্য এখন বুঝিতে পারা যাইবে। এ বিষয়ে আমরা তাহাদের বহু শতাব্দী পশ্চাতে পড়িয়া আছি। আমাদের সমাজদেহ জীর্ণ ও দূষিত এবং উহার অভ্যন্তরে ক্ষয় রোগ প্রবেশ করিয়াছে।
জাপান প্রবল চেষ্টায় জড়তা ত্যাগ করিয়া জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে। তাহাদের উচ্চশ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে প্রভেদ চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হইয়াছে। আমরা যখন প্রমাণ করিতে যাই যে, এসিয়ার দেশ সমূহও রাজনৈতিক উন্নতির শিখরে আরোহণ করিতে পারে, তখন আমরা জাপানের দৃষ্টান্ত দিই। কিন্তু জাপান তাহার সমাজ সংস্কারের জন্য কি করিয়াছে, তাহা সুবিধা মত আমরা ভুলিয়া যাই। ১৮৭০ খৃঃ পর্যন্ত জাপানের সামুরাইয়েরা আমাদের দেশের ব্রাহ্মণদের মতই সমস্ত সযোগ সুবিধা একচেটিয়া করিয়া রাখিয়াছিল। এটা ও হিনিনেরা (জাপানের অস্পৃশ্য জাতি) এত অপবিত্র ও নোংরা বলিয়া গণ্য হইত যে, তাহাদিগকে সাধারণ গ্রামে বাস করিতে দেওয়া হইত না। তাহাদের জন্য পল্লীর বাহিরে স্বতন্ত্র বাসস্থান নির্দিষ্ট করা হইত। ভারতের দক্ষিণ প্রদেশে এইরূপে ব্যবস্থা এখনও আছে। কিন্তু ১৮৭১ সালের ১২ই অক্টোবরের চিরস্মরণীয় দিনে, সামুরাইয়েরা দেশপ্রেম ও মহৎ ভাবের প্রেরণায় নিজেদের বিশেষ অধিকারগুলি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করিল, কৃত্রিম শ্রেণীভেদ ও জাতিভেদ তুলিয়া দিল এবং এইরূপে একটি সঙ্ঘবদ্ধ বিশাল মহৎ জাতি গঠনের পথ প্রস্তুত করিল। ১৮৭১ সালে জাপানে যাহা সম্ভবপর হইয়াছিল, এই বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকেও ভারতে তাহা সম্ভবপর হইতে পারিল না। (৩১শ ভারতীয় জাতীয় সমাজ সংস্কার সম্মেলনে মদীয় সভাপতির অভিভাষণ দ্রষ্টব্য; ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯১৭)।
জাপান আরও বুঝিতে পারিয়াছিল যে, ব্যবসা বাণিজ্যে অবজ্ঞা করিলে চলিবে না। গত অর্ধ শতাব্দীতে ব্যবসা বাণিজ্যে জাপান কি আশ্চর্য উন্নতি করিয়াছে, তাহা এখানে বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, বর্তমানে ৪০ লক্ষ টনের জাপানী বাণিজ্য জাহাজ সগর্বে সমুদ্রে যাতায়াত করিতেছে। জাপানের কারখানায় ও তাঁতে উৎপন্ন পণ্য ভারতের বাজার ছাইয়া ফেলিয়াছে এবং বোম্বাইয়ের কাপড়ের কলগুলি জাপানী প্রতিযোগিতা সহ্য করিতে না পারিয়া লুপ্ত হইতে বসিয়াছে। অথচ জাপান এই ভারত হইতেই প্রতি বৎসর ২৯ কোটী টাকার কাঁচা তূলা ক্রয় করে।[১]
ভারতকে তাহার নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্ষতি সহ্য করিতে হইতেছে। জাতিভেদ বুদ্ধি ও প্রতিভাকে কেবল মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ রাখে নাই, ইহা অন্তর্বিবাদ ও কলহের একটা প্রধান কারণ। সংক্ষেপে ভারতীয় মহাজাতি গঠনের পক্ষে ইহা প্রধান অন্তরায়
- ↑ প্রাচীন জাপানে ব্যবসায়ীরা সমাজের নিম্ন স্তরে স্থান পাইত। “কিন্তু নব্য জাপান সভ্যতার পুনর্গঠন করিতে গিয়া দেখিল যে, তাহার বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়—সেই বিরাট কার্যের অযোগ্য। নূতন নূতন শিল্প উৎপাদনের জন্য যে মূলধনের প্রয়োজন, তাহা তাহারা যোগাইতে পারে না। পাশ্চাত্য দেশের মত আগেকার বৃহৎ শিল্প উৎপাদনের অভিজ্ঞতা তাহাদের নাই। তাহারা সমাজের নিম্ন স্তরে অধীনতার মধ্যে থাকিতেই অভ্যস্ত ছিল। সুতরাং উদ্ভাবনী বা প্রেরণা শক্তি তাহাদের নিকট হইতে আশা করা অন্যায়। সুতরাং প্রথম হইতেই—রাষ্ট্রই এ বিষয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিল; নূতন ব্যবসায়ী শ্রেণী ব্যাঙ্কার, বণিক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, প্রাচীন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হইতে আসে নাই,—সামুরাইদের সম্প্রদায় হইতে আসিয়াছিল। এই সামুরাইদের পূর্ব বৃত্তি এবং বিশেষ অধিকার প্রভৃতি তখন আর ছিল না।” Allen: Japan.
রাষ্ট্রের একটা বৃহৎ সম্প্রদায় দূরে অলস ভাবে দাঁড়াইয়া থাকে, সাধারণের হিতের জন্য কিছুই করে না,—তখন বুঝিতে হইবে, ঐ রাষ্ট্রের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।” Renan’s Marcus Aurelius.