পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২
আত্মচরিত

 সেক্সপীয়রের সঙ্গে আমার পরিচয় ক্রমে ঘনিষ্ঠ বন্ধত্বে পরিণত হইয়াছিল এবং বাল্যকালে আমি যেটকু পড়িয়াছিলাম, তাহার ফলেই অমর কবির নাটকের প্রতি—বিশেষতঃ, বিয়োগান্ত নাটকের প্রতি—আমার অনুরাগ বৃদ্ধি পাইল। স্কুলে আমার ছাত্রজীবনের কতকগুলি ঘটনা এখনও আমার মনে আছে। ক্লাশের বার্ষিক পরীক্ষায়, প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপকেরা আমাদের পরীক্ষক থাকিতেন। প্যারীচরণ সরকার আমাদের ভূগোলের এবং মহেশচন্দ্র ব্যানার্জি ইতিহাসের পরীক্ষক ছিলেন। এই দুইটি বিষয় আমার খুব প্রিয় ছিল, এবং সহাধ্যায়ীদের মধ্যে আমিই এই দুই বিষয়ে বেশী নম্বর পাইতাম। পর পর দুই বৎসর মৌখিক পরীক্ষায় মহেশ বাবুর নিকট আমি পুরা নম্বর পাইলাম। প্রশ্ন করা মাত্র আমি সন্তোষজনক ভাবে তাহার উত্তর দিতাম। একবার তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন,—“তোমার বাড়ী কোথায়?” আমি বলিলাম “যশোর”। এই উত্তরে তিনি বেশ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, মনে হয়।

হেয়ার স্কুল

 বর্তমানে যেখানে প্রেসিডেন্সী কলেজ অবস্থিত, পূর্বে সেখানে খোলা ময়দান ছিল এবং এটি আমাদের খেলার মাঠরূপে ব্যবহৃত হইত। স্থানের সঙ্কুলান না হওয়াতে ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে হেয়ার স্কুল নূতন বাড়ীতে (এখন যে বাড়ীতে আছে) স্থানান্তরিত হয়। বিদ্যালয় গৃহের একটি ক্লাশের দেয়ালে গাঁথা মর্মরফলকে ডেভিড হেয়ারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত কয়েক লাইন ইংরাজী কবিতা আছে। উহা ডি, এল, রিচার্ডসনের রচিত।

“Ah! warm philanthropist, faithful friend,
Thy life devoted to one generous end:
To bless the Hindu mind with British lore,
And truth’s and nature’s faded lights restore!”

 —হে পরোপকারী বিশ্বস্ত বন্ধু, তোমার জীবন একমাত্র মহৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হইয়াছিল। সে উদ্দেশ্য, ব্রিটিশ জাতির জ্ঞান বিজ্ঞান দ্বারা হিন্দু জাতির মনকে জাগ্রত করা এবং সত্যের—তথা প্রকৃতির যে আলোক তাহাদের মনে ম্লান হইয়া গিয়াছে, তাহাকে পুনঃ প্রদীপ্ত করা।

 কবিতাটি আমার বড় ভাল লাগিয়াছিল এবং এখনও আমি উহা অক্ষরে অক্ষরে আবৃত্তি করিতে পারি।

 তখন গিরিশচন্দ্র দেব হেয়ার স্কুলের এবং ভোলানাথ পাল প্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দু স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন। গভর্ণমেণ্ট কর্তৃক পরিচালিত এই দুই স্কুল তখন বাংলাদেশের মধ্যে প্রধান বিদ্যালয় ছিল এবং উভয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলিত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় কোন স্কুলের ছাত্র প্রথম স্থান লাভ করিবে তাহা লইয়া বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলিত। তখনকার দিনে কলিকাতায়, শুধু কলিকাতায় কেন, সমস্ত বাংলায় বে-সরকারী স্কুলের সংখ্যা খুব কম ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপালরূপে জেমস সাট্‌ক্লিফ হেয়ার ও হিন্দু উভয় স্কুলের কর্তা ছিলেন এবং তিনি প্রতি শনিবার নিয়মিত ভাবে আমাদের স্কুল পরিদর্শন করিতে আসিতেন। আমার পড়াশুনার বেশ অভ্যাস ছিল, কিন্তু তাই বলিয়া আমি পুস্তক-কীট ছিলাম না। স্কুলের নির্দিষ্ট পাঠ্য পুস্তকে আমার জ্ঞান-তৃষ্ণা মিটিত না। আমার বই পড়ার দিকে খুব ঝোঁক ছিল এবং যখন আমার বয়স