পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ইউরোপ যাত্রা—বিলাতে ছাত্রজীবন——ভারত বিষয়ক প্রবন্ধ
(Essay on India)—‘হাইল্যাণ্ডে’ ভ্রমণ
আমি এখন বিলাত যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম এবং হেয়ার স্কুলে আমার ভূতপূর্ব সহাধ্যায়ী দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীর সাহায্যে প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র ক্রয় করিলাম। জীবন যাপন প্রণালী সহসা এরূপ পরিবর্তিত হইতে চলিল যে, তাহা ভাবিয়া আমি প্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। শিক্ষানবিশ হিসাবে আমি দুই একটা সস্তা রেস্তোরাঁতে গিয়া কিরূপে ‘ডিনার’ খাইতে হয় শিখিতে লাগিলাম। বখশিস পাইয়া তুষ্ট খানসামারা আমাকে দেখাইয়া দিত কিরূপে ছুরি কাঁটা ধরিতে হয় এবং কখন কি ভাবে তাহা ব্যবহার করিতে হয়।
শীঘ্রই আমি জানিতে পারিলাম যে ডাঃ পি, কে, রায়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতা দ্বারকানাথ রায় বিলাতে ডাক্তারী পড়িবার জন্য যাইতেছেন। আমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিলাম। ঠিক হইল যে, আমরা দুইজনে এক জাহাজে বিলাত যাইব। পরিণামে ইনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
আমরা ‘কালিফোর্নিয়া’ নামক জাহাজে প্রত্যেকে ৪০০৲ টাকা হিসাবে প্রথম শ্রেণীর সেলুন ভাড়া লইলাম। জাহাজের কাপ্তেন ছিলেন ‘ইয়ং’ নামক জনৈক সাহেব। ঐ সময় পূরা ‘মনসূনের’ সময় এবং আমরা সরাসরি কলিকাতা হইতে লণ্ডন যাইতেছিলাম। সুতরাং জাহাজের যাত্রী সংখ্যা কম ছিল। আমার বন্ধুরা জাহাজে যাইয়া যখন আমাকে বিদায় দিলেন এবং জাহাজের উপরে উঠিলাম, তখন আমার মনে বেশ স্ফূর্তি হইল এবং একজন ইংরাজ যাত্রীর সঙ্গে আমি মহোৎসাহে গল্প জুড়িয়া দিলাম। যাত্রীটি বলিলেন যে, কথাবার্তায় আমি বড় বড় ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করিতেছি। আমি স্বীকার করি যে, সেকালে আমি জনসনের রচনারীতির একটু ভক্ত ছিলাম। আমাদের জাহাজ ‘পাইলটের’ নেতৃত্বে অগ্রসর হইতে লাগিল এবং ফল্তা হইতে কিছুদর গেলেই, আমি আমার দেহে একটা নূতন রকমের অসুখ বোধ করিতে লাগিলাম। বমনোদ্রেক হইতে লাগিল। বস্তুত আমি “সমুদ্ররোগের” দ্বারা আক্রান্ত হইলাম। ডাঃ ডি, এন, রায় তাঁহার ভ্রাতার বাড়ীতে ইউরোপীয় জীবনযাপন প্রণালী অভ্যাস করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার “সমুদ্ররোগ” হইল না। তিনি জাহাজে আগাগোড়া বেশ সুস্থই ছিলেন। তাঁহার প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল এবং তিনি বেশ খাইতেও পারিতেন। ‘সুপ’ বা ঝোল, আলু ভাজা ও আলু সিদ্ধ এবং ‘পূডিং’ ইহাই ছিল আমার সম্বল। যখন আমি “সমুদ্ররোগের” জন্য খাবার টেবিলে বসিতে যাইতাম না, হেড ষ্টুয়ার্ড আমার উপর সদর হইয়া আমার কেবিনে জমাট দুধ এবং পাউরুঢ়ী দিয়া আসিতেন।
৫।৬ দিন পরে আমাদের ষ্টীমার কলম্বো পৌঁছিল। ভূমি দেখিয়া আমাদের আনন্দ হইল এবং আমরা তীরে উঠিয়া সহরের দৃশ্যাদি দেখিলাম। আমার যতদূর স্মরণ হয়, এই স্থানে আমরা জানিতে পারিলাম যে, ‘টেল-এল-কেবির’-এর যুদ্ধে পরাজিত হইয়া আরবী পাশা বন্দী হইয়াছেন এবং সুয়েজখালের পথে আর কোন বিপদের আশঙ্কা নাই।