পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পাঠভেদ
১৫৫

 শান্তি পিছাইয়া পড়িল-বলিল “ছি। কি করিতেছি? স্ত্রীলোক হইয়া যুদ্ধে যাই কেন? আমার ধর্ম ত এ নয়! আমি গাছের বাদর গাছেই থাকি।” এই বলিয়া শান্তি ফিরিয়া আসিয়া গাছের উপর উঠিয়া যুদ্ধ দেখিতে লাগিল।

 জীবানন্দ প্রায় পুল পাইয়াছিল, কিন্তু দুর হইতে বন্দে মাতরং কাণে গেল। জীবানন্দ বলিল “ভাই দূর হইতে বন্দে মাতরং শুনিতেছি, ভাই মরি মরূবে, পুলে কাজ নাই, চল একবার উহাদের সঙ্গে গিয়া বন্দে মাতরং গাই।” জীবানন্দের সেনার আর প্রাণভয়ে পলান হইল না। বন্দে মাতরং গায়িতে গায়িতে সেই হতাবশিষ্ট পঞ্চসহস্র সন্তানসেনা লেপ্টেনাণ্ট ওয়াটসনের দিকে ধাবমান হইল এবং বক্সের মত লেপ্টনাণ্ট ওয়াটসনের সেনার উপরে পড়িয়া তাহাদিগকে খণ্ড বিখণ্ড করিল। এক দিকে জীবানন্দের সৈন্য আর এক দিকে নবীনানন্দের প্রেরিত সৈন্য দুই প্রবল তরঙ্গের আঘাতে দৃঢ়বল পৰ্বততুল্য ইংরেজ সেনা ক্ষয়িত হইতে লাগিল। ক্ষয় হয় তবু ভাঙ্গে না! ইংরেজের অতুল বল, অতুল সাহস, অতুল অধ্যবসায়। রাউণ্ডের পর রাউণ্ড, ফায়ারের পর ফায়ার, বৃষ্টির পর বৃষ্টি, মেঘের উপরে আরো মেঘ! পৃথিবী অন্ধকার হইল, গগন প্রতিধ্বনিতে বিদারিত হইতে লাগিল, কাননে ঝড় বহিল, পশু পক্ষী ভয়ে বিবরে লুকাইল, অজয়ে তুফান উঠিল। নবীনানন্দ বৃক্ষ হইতে ডাকিল মার মার যবন মার। ঐ ওপাশে, এই সেনার পরে জীবানন্দ আছে, যাও ফৌজদারী বাহী ভেদ করিয়া যাও ভাই। মার মার ফৌজদারী মার।” তখন দক্ষিণ বামে বিদ্ধ হইয়া, আহত নিহত বিপ্লুত স্থানচ্যুত বিভ্রাবিত হইয়া লেপ্টেনাণ্ট ওয়াটসনের সেনা ছিন্ন ভিন্ন ভাবে দিগ্বিদিকে পলায়ন করিল। মাঝখানে জীবানন্দের দলে এবং নবীনানন্দের প্রেরিত দলে দেখা হইল। তখন শান্তি আর থাকিতে পারিল না “ছি! নারীজন্মেই ধিকৃ।” এই বলিয়া শান্তি আবার গাছ হইতে লাফাইয়া পড়িল! যেখানে দুই বিজয়ী সন্তানসেনার সম্মিলন হইয়াছে সেইখানে কুরঙ্গীর ন্যায় শান্তি ছুটিয়া গিয়া উপস্থিত হইল। রণক্ষেত্রের মাঝখানে জীবানন্দে নবীনানন্দে দেখা হইল। দুই জনে দুই জনকে আলিঙ্গন করিল। যখন একটু অবসর পাইল তখন জীবানন্দ বলিল “শান্তি, আজ তোমার সমক্ষে মরিলে কি সুখ হইত?”

 নবীনানন্দ বলিল “মরিবার এখনও সময় আছে, তুমি পুরুষ মানুষ তোমার তো বুদ্ধি শুদ্ধি নাই, মরিবার দরকার হলে আমায় বলিও, আমি পথ দেখাইয়া দিব; যাও দেখি যদি ঐ পথে মৃত্যু নামে অমূল্য- নিধি খুঁজিয়া পাও।” এই বলিয়া শান্তি কাপ্তেন হের সৈন্য দেখাইয়া দিল। যাইবার সময়ে জীবানন্দের কাণে কাণে বলিয়া দিল, “আজ মরিতে পাইবে না। সত্যানন্দের আদেশ।”

 তখন বন্দে মাতরং গায়িতে গায়িতে জীবানন্দ অশ্বারোহণে সসৈন্যে কাপ্তেন হের প্রতি ধাবমান হইলেন। শান্তি বিষন্নমনে নারীজন্মকে ধিক্কার করিতে করিতে ফিরিয়া আসিয়া গাছে উঠিয়া গেছে। মেয়ে” বলিয়া আপনার নিন্দা করিতে লাগিল। কাপ্তেন হেও দেখিলেন যে, যাহার পলায়ন অবরোধ করিবার জন্য যাইতেছিলেন, সেই স্বয়ং আবার সম্মুখে আসিতেছে। কাপ্তেন হে ফিরিয়া জীবানন্দকে আক্রমণ করিবার জন্য তাহার অভিমুখী হইলেন। যেমন দুইটী পৰ্বতনিঃসৃত নদী বিপরীত দিক হইতে আসিয়া উপত্যকার এক গহ্বরে পরস্পরকে প্রহত করে—উতুঙ্গ তরঙ্গমালার ফেণনিচয় আকাশে প্রেরিত