পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম খণ্ড—পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
৪৫

 নিমি বলিল, “আমায় মেয়েটি দেবে?”

 জীবানন্দ বলিল, “তুই মেয়ে নিয়ে কি কবি?”

 নিমি। “আমি মেয়েটিকে দুধ খাওয়াব, কোলে করিব, মানুষ করিব— বহুতে বতে ছাই পোড়ার চক্ষের জল আবার আসে, আবার নিমি হাত দিয়া মুছে, আবার হাসে।

 জীবানন্দ বলিল, “তুই নিয়ে কি করবি? তোর কত ছেলে মেয়ে হবে।”

 নিমি। তা হয় হবে, এখন এ মেয়েটি দাও, এর পর না হয় নিয়ে যেও।

 জীবা। তা নে, নিয়ে মরূগে যা। আমি এসে মধ্যে মধ্যে দেখে যাব। উটি কায়েতের মেয়ে, আমি চললুম এখন—

 নিমি। সে কি দাদা, খাবে না! বেলা হয়েছে যে। আমার মাথা খাও, দুটি খেয়ে যাও।

 জীবা। তোর মাথাও খাব, আবার দুটি খাব? দুই ত পেরে উঠবে না দিদি। মাথা রেখে দুটি ভাত দে।

 নিমি তখন মেয়ে কোলে করিয়া ভাত বাড়িতে ব্যতিব্যস্ত হইল।

 নিমি পিড়ি পাতিয়া জলছড়া দিয়া জায়গা মুছিয়া মল্লিকাফুলের মত পরিষ্কার অগ্ন, কাচা কলায়ের জাল, জঙ্গুলে ডুমুরের দানা, পুকুরের রুইমাছের ঝোল, এবং দুগ্ধ আনিয়া ' জীবানন্দকে খাইতে দিল। খাইতে বসিয়া জীবানন্দ বলিলেন,

  “নিমাই দিদি, কে বলে মন্বন্তর? তোদের গায়ে বুঝি মন্বন্তর আসে নি?” নিমি বলিল, “মন্বন্তর আসবে না কেন, বড় মন্বন্তর, তা আমরা দুটি মানুষ, ঘরে যা আছে, লোককে দিই থুই ও আপনারা খাই। আমাদের গায়ে বৃষ্টি হইয়াছিল, মনে নাই?তুমি যে সেই বলিয়া গেলে, বনে বৃষ্টি হয়। তা আমাদের গায়ে কিছু কিছু ধান হয়েছিল—আর সবাই শহরে বেচে এলো—আমরা বেচি নাই।”

 জীবানন্দ বলিল, “বোনাই কোথা?”

  নিমি ঘাড় হেঁট করিয়া চুপি চুপি বলিল, “সের দুই তিন চাল লইয়া কোথায় বেরিয়েছেন। কে নাকি চাল চেয়েছে।”

  এখন জীবানন্দের অদৃষ্টে এরূপ আহার অনেক কাল হয় নাই। জীবানন্দ আর বৃথা বাক্যব্যয়ে সময় নষ্ট না করিয়া গপ গপ, টপ, টপ, সপ, সপ, প্রভৃতি নানাবিধ শব্দ করিয়া অতি অল্পকাসমধ্যে অন্নব্যঞ্জনাদি শেষ করিলেন। এখন ঐমতী নিমাইমণি শুধু আপনার ও স্বামীর জন্য রাঁধিয়াছিলেন, আপনার ভাতগুলি দাদাকে দিয়াছিলেন, পাথর শূন্য দেখিয়া