পাতা:ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ - জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৬
ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ

উড়িতেছে। নিয়মিত সময়ান্তরে, তরঙ্গমালা স্ফীত হইয়া, তটভূমির উপর সবেগে ভাঙিয়া পড়িতেছে। বহিঃসমুদ্রের সুনীল মসৃণ ঝিকিমিকি জলের মধ্য হইতে শিকার-অন্বেষী দুবৃত্ত হাঙরদিগের ডানা ও পৃষ্ঠদেশের কিয়দংশ উকি মারিতেছে। নেত্রাভিঘাতী দীপ্ত প্রভার মধ্যে দিগন্ত মিলাইয়া গিয়াছে। যে আবাসগৃহে আমি আজ নিদ্রা যাইব—তাহার কোনো দিক বদ্ধ নহে; ইহার পশ্চাদ্ভাগে, নারিকেলবন যেন হঠাৎ আরম্ভ হইয়াছে; আমার ঘরের জালা দিয়া, যেন একপ্রকার সবুজ আলোকে নিম্নদেশটি দেখা যাইতেছে। উচ্চ তালতরুর খিলান-আকৃতি সুদীর্ঘ সবৃন্ত-পত্রগুলি স্বচ্ছ প্রভায় উদ্ভাসিত এবং তালীবনের হরিদ্বর্ণ গভীর প্রদেশ যেন ভাস্বর হইয়া উঠিয়াছে। ঐ দেখ, একজন ভারতীয় যুবক একপ্রকার পানীয় আহরণ করিবার জন্য পদাঙ্গুলির সাহায্যে স্তম্ভবৎ মসৃণ তালত বাহিয়া কপিসুলভ চটুলতা ও দ্রুততা সহকারে নিঃশব্দে উপরে উঠিতেছে। যে শেষ প্রতিবিম্বটি গ্রহণ করিয়া আমার নেত্র নিমীলিত হইল, সেটি ঐ চতুভুজপ্রায় মনুষ্যমূর্তির প্রতিবিম্ব। লোকটা এত শীঘ্র গাছের উপর উঠিয়া গেল যে, তাহার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

 এই সমুদ্রটি এমন ভাস্বর, এমন গভীর—ইহাকে আজ আমি নিকটে পাইয়াছি, হৃদয়ের মধ্যে যেন অনুভব করিতেছি; ইহার বিপুল স্পন্দন শুনিতে পাইয়া আজ আমার কি আনন্দ!—এই সেই অবারিত মার্গ, যেখান দিয়া সর্ব্বত্র যাতায়াত করা যায়; সেই মার্গ, যেখান হইতে সুদূর পরিলক্ষিত হয়; যেখানে প্রতি নিশ্বাসে মুক্তবায়ু গ্রহণ করা যায়। সেই মাৰ্গ, যাহা আমার চিরপরিচিত। বাস্তবিক ইহার সান্নিধ্যে আমার জীবন যেন উজ্জ্বল হইয়া উঠে; উহাকে পাইলে আমি যেন আপনাকে ফিরিয়া পাই; মনে হয়, যেন এই দূর্ব্বোদ্ধ দুরবগাহ ভারত হইতে—এই ছায়াচ্ছন্ন তরুসমাকীর্ণ বন্ধ ভারত হইতে ক্ষণেকের জন্য বাহির হইয়াছি।