পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৭৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

হায়! শব্দে দেবতারা চিৎকার করিয়া উঠিলেন। হায় হায়!’ শব্দে যোদ্ধাগণ কাদিতে লাগিল। শরীরে এত বাণ বিধিয়া ছিল যে, রথ হইতে পড়িয়াও ভীষ্ম শুন্যেই রহিয়া গেলেন; তাহার শরীর মাটি ছুঁইতে পাইল না। লোকে মৃত্যুর সময় কোমল বিছানায় শয়ন করে কিন্তু ভীষ্মের হইল শরশয্যা’, অর্থাৎ বাণের বিছানা।

 সেই মহাবীর শরশয্যায় শুইয়া স্বর্গের কথা ভাবিতে লাগিলেন। তখন আকাশ হইতে দেবতারা জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মহাবীর! হে মহাপুরুষ! সূর্য এখন আকাশের দক্ষিণভাগে রহিয়াছে। মহাপুরুষের মৃত্যুর ইহা সময় নহে। তুমি এমন সময়ে প্রাণত্যাগ করিবে?”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আমি তো প্রাণত্যাগ করি নাই।”

 মানস সরোবরবাসী হংসগণ আকাশে উড়িয়া যাইতেছিল। তাহারা বলিল, “এখন সূর্যদেব আকাশের দক্ষিণভাগেই রহিয়াছে;মহাত্মা ভীষ্ম কি এমন সময়ে প্রাণত্যাগ করিবেন?”

 ভীষ্মদেব সেই হংসগণকে দেখিয়া ক্ষণকাল চিন্তা করিলেন। উহারা তাহারই মাতা গঙ্গা দেবীর প্রেরিত হংসরূপী মহর্ষিগণ।

 তাই তিনি বলিলেন, “হে হংসগণ! পিতার বরে আমি মৃত্যুকে বশ করিয়াছি। সত্য কহিতেছি সূর্যদেব আকাশের উত্তরভাগে না গমন করিলে আমি প্রাণত্যাগ করিব না।”

 ভীষ্ম রথ হইতে পড়িবামাত্র যুদ্ধ থামিয়া গেল। পাণ্ডবদের দলে মহাশঙ্খ বাজিয়া উঠিল; ভীম আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। দ্রোণ এ সংবাদ শুনিবামাত্র অজ্ঞান হইয়া রথ হইতে পড়িয়া গেলেন। তারপর যোদ্ধাগণ কবচ পরিত্যাগ করিয়া হেঁটমুখে জোড়হাতে সেই মহাবীরের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন।

 তখন ভীষ্ম বলিলেন, “হে মহারথগণ! তোমাদের মঙ্গল তো? তোমাদিগকে দেখিয়া বড়ই সুখী হইলাম। দেখ, আমার মাথা ঝুলিয়া পড়িয়াছে, বালিশ দাও।”

 রাজা মহাশয়েরা তৎক্ষণাৎ রাশি রাশি কোমল রেশমী বালিশ আনিয়া উপস্থিত করিলেন। তাহা দেখিয়া ভীষ্ম হাসিয়া বলিলেন, “এ বালিশ তো এ বিছানার উপযুক্ত নয়। বৎস অর্জুন, উপযুক্ত বালিশ দাও।”

 অর্জুন কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “দাদামহাশয়! কি করিতে হইবে আজ্ঞা করুন।”

 ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! তুমি ধনুর্দ্ধরগণের শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান আর ক্ষত্রিয়ের ধর্মে শিক্ষিত। মাথা ঝুলিতেছে, উপযুক্ত বালিশ দাও।”

 তখন অর্জুন, ভীষ্মের পদধূলি লইয়া, তিন বাণে তাহার মাথা উঁচু করিয়া দিলেন। তাহাতে ভীষ্ম পরম সন্তোষের সহিত অর্জুনকে আশীর্বাদ করিয়া সকলকে বলিলেন, “এই দেখ, অর্জুন আমার উপযুক্ত বালিশ দিয়াছেন।”

 তারপর ভীষ্ম আবার বলিলেন, “যতদিন না সূর্যদেব আকাশের উত্তরভাগে যাইবেন, ততদিন আমি এইভাবেই থাকিব, সূর্যদেব আকাশের উত্তরভাগে আসিলে আমি প্রাণত্যাগ করিব। আমার চারিদিকে পরিখা করিয়া (অর্থাৎ খাল কাটিয়া) দাও। আর তোমরা শত্রুতা ছড়িয়া যুদ্ধে ক্ষান্ত হও।”

 তারপর দুর্যোধন ভালো ভালো চিকিৎসক ও ঔষধ লইয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলে, ভীষ্ম বলিলেন, “উহা দিয়া আমার কি হইবে? এখন আমার চিকিৎসার সময় নহে, আমাকে পোড়াইবার সময়।”