এদিকে দ্রোণের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের বিষম যুদ্ধ চলিতেছিল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাহারো জয়-পরাজয় বুঝা গেল না। বাণ, শক্তি, গদা, দুজনে কতই ছুঁড়িলেন দুজনেরই সমান তেজ। কিন্তু ইহার পরেই দ্রোণ যুধিষ্ঠিরের ঘোড়া আর ধনুক কাটিয়া, তিনটি ভয়ংকর বাণ মারিলে তাহার এমনি বিপদ হইল যে, তখন রথ ঘড়িয়া অস্ত্র ফেলিয়া হাত তুলিয়া দাঁড়ানো ভিন্ন ভিন্ন আর উপায় নাই। দ্রোণ দেখিলেন এই তাহার সুযোগ। অমনি তিনি, সিংহের ন্যায় যুধিষ্ঠিরকে ধরিতে ছুটলেন। হায় হায়! মহারাজা ধরা পড়িলেন!’ বলিয়া চারিদিকে চিৎকার উঠিল। ভাগ্যে সহদেবের রথ কাছে পাইয়া, যুধিষ্ঠির তাহাতে উঠিতে পারিলেন, আর সহদেবের ঘোড়াগুলি দ্রোণের ঘোড়ার চেয়ে অনেক ভালো ছিল, নহিলে সেদিন সর্বনাশই হইত।
এদিকে রাক্ষস অলঘুষ, খানিক পাণ্ডবদিগকে খুবই জ্বালাতন করিয়া, ভীমের তাড়ায় পলায়ন করে। তারপর সে অন্যত্র গিয়া আবার দৌরাত্ম্য আরম্ভ করাতে, ঘটোৎকচের হাতে আছাড় খাইয়া চুর্ণ হয়। তারপর অনেকক্ষণ দ্রোণের সহিত পাণ্ডবদিগের তুমুল সংগ্রাম চলে।
এমন সময় দুর হইতে কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের শব্দ শুনা যাইতে লাগিল। গাণ্ডীবের শব্দ এত দূর পৌঁছায় নাই, কাজেই তাহা কেহ শুনিতে পাইল না। এদিকে কৌরবেরাও সিংহনাদ করিতেছে। কাজেই যুধিষ্ঠির ভাবিলেন, বুঝি অর্জুনের কোনো বিপদ ঘটিল। তাই তিনি সাত্যকিকে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি শীঘ্র অর্জুনের কাছে যাও।
সাত্যকি বলিলেন, “অর্জুন আমাকে আজ আপনার পাশ ছড়িতে নিষেধ করিয়াছেন, আমি কি করিয়া যাই? আপনি অর্জুনের জন্য চিন্তা করিবেন না। আপনাকে রক্ষা করাই আমাদের প্রথম কাজ।”
কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে অর্জুনের জন্য বড়ই ব্যস্ত দেখিয়া শেষে সাত্যকিকে যাইতে হইল। যুধিষ্ঠির ভীমকেও তাহার সঙ্গে পাঠাইতেছিলেন; কিন্তু সাত্যকি তাহাকে বলিলেন, “আমার মতে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করাই তোমার কর্তব্য।” কাজেই ভীম রহিয়া গেলেন।
সাত্যকি কৌরবদিগের সহিত ক্রমাগত যুদ্ধ করিয়া অগ্রসর হইতেছেন, এমন সময় দ্রোণ আসিয়া তাহাকে আটকাইলেন। দ্রোণ বলিলেন, “অর্জুন আজ আমার সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে কাপুরুষের মতো পাশ কাটিয়া পলায়ন করিল। তুমি যুদ্ধ না করিলে আজ তোমাকে বধ করিব।” বুদ্ধিমান সাত্যকি অমনি বলিলেন, “গুরু যাহা করেন, শিষ্যও তাই করে। আমি অর্জুনের কাছে চলিলাম।”
সেদিন সাত্যকির বিক্রম কৌরবেরা ভালো করিয়াই জানিতে পারিল। দ্রোণের নিকট হইতে ভোজের নিকট; ভোজের সারথিকে কাটিয়া, কৃতবর্মাকে ঠেঙ্গাইয়া, জলসন্ধ ও মহমাত্রকে মারিয়া আবার দক্ষিণের দিকে, এইভাবে সাত্যকি চলিয়াছে। এমন সময় আবার দ্রোণ আসিয়া তাহার সম্মুখে উপস্থিত। সঙ্গে সঙ্গে দুর্মর্ষণ, দুঃসহ, বিকর্ণ,দুর্মুখ, দুঃশাসন, চিত্রসেন, দুর্যোধন প্রভৃতিও আসিয়া একসঙ্গে তাহাকে আক্রমণ করিয়াছেন। কিন্তু তাহাকে পরাজয় করে কাহার সাধ্য? দুর্যোধন পলায়ন করিলেন, কৃতবর্মা অজ্ঞান হইলেন। তারপর যুদ্ধ চলিল, কেবল দ্রোণ আর সাত্যকিতে। ভয়ংকর যুদ্ধের পর দ্রোণকে হার মানিতে হইল। তারপর সুদর্শন মরিল, কম্বোজ, শক ও যবন—সৈন্যগণ পরাস্ত হইল, দুর্যোধন