পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
৩৩৫

ইহা প্রকাশ করি নাই।”

 তারপর তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “বাবা যুধিষ্ঠির, তোমার মঙ্গল হউক। তোমার যত্নে এতদিন পরম সুখে কাল কাটাইলাম, এখন আমাদিগের পরকালের পথ দেখিবার সময় উপস্থিত। সুতরাং অনুমতি দাও, আমি আর গান্ধারী বনে গিয়া তপস্যা করি।”

 এ কথায় যুধিষ্ঠির নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “জ্যাঠামহাশয়। আমার তুল্য নরাধম আর কেহ নাই। আপনি অনাহারে ভূমিশয্যায় এত কষ্টে কাল কাটাইয়াছেন, আর আমি আপনার সংবাদ না লইয়া নিশ্চিন্ত রহিয়াছি। আপনি যদি কষ্ট পান, তবে আমার সুখের কি প্রয়োজন? দুর্যোধন আপনার যেরূপ পুত্র ছিল, আমাদিগকেও সেইরূপ মনে করিবেন। আপনি বনে গেলে, এই রাজ্য লইয়া আমি কিছুমাত্র সুখ পাই না। আপনি আমাদিগের দিকে চাহিয়া মনকে শান্ত করুন, আমরা আপনার সেবা করিয়া কৃতার্থ হই।”

 ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “বাবা! বৃদ্ধকালে বনে গিয়া তপস্যা করাই আমাদের কুলের ধর্ম। সুতরাং আমার তাহা করিতে বড়ই ইচ্ছা হইতেছে, তুমি ইহাতে আমাকে নিষেধ করিও না।”

 অনাহারে ধৃতরাষ্ট্রের শরীর এতই দুর্বল হইয়াছিল যে, তিনি এইটুকু বলিতে বলিতে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। তাহাতে যুধিষ্ঠিরের অতিশয় দুঃখ হইল বটে, কিন্তু তিনি বহু চেষ্টা, বিস্তর মিনতি করিয়াও ধৃতরাষ্ট্রের মত ফিরাইতে পারিলেন না। ইহার উপরে আবার ব্যাসদেব আসিয়া তাঁহাকে ধৃতরাষ্ট্রের কথায় সম্মত হইতে বলিলে, কাজেই শেষে তাঁহাকে তাহাই করিতে হইল! তখন ধৃতরাষ্ট্র বিনয়বচনে প্রজাদিগের নিকট বিদায় লইয়া, মৃত পুত্র এবং আত্মীয়গণের কল্যাণার্থ অনেক ধন দানপূর্বক বনগমনে উদ্যত হইলেন।

 কার্তিক মাসের পূর্ণিমার দিন, বল্কল এবং মৃগচর্ম পরিধানপূর্বক, ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী, বিদুর এবং সঞ্জয়কে লইয়া গৃহের বাহির হইলে, স্ত্রী পুরুষ সকলে কঁদিতে কাঁদিতে তাঁহাদের সঙ্গে চলিল। কুন্তী এবং গান্ধারীর কাধে ভর দিয়া ধৃতরাষ্ট্র আগে আগে যাইতে লাগিলেন। তাঁহাদের পশ্চাতে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উত্তরা প্রভৃতি সকলেই চলিলেন। সকলেরই চোখে জল, কাহারো মন স্থির রাখিবাব শক্তি নাই।

 নগরের বাহিরে আসিয়া ধৃতরাষ্ট্র সকলকে বলিলেন, “এখন তোমরা ঘরে ফিরিয়া যাও।” এ কথায় আর অন্য সকলেই নিরস্ত হইল, কিন্তু বিদুর, সঞ্জয়, এবং কুন্তী আর ঘরে ফিরিলেন না।

 কুন্তীকে বনে যাইতে দেখিয়া পাণ্ডবদিগের যে কি দুঃখ হইল, আমার কি সাধ্য যে তাহা লিখিয়া জানাই। তাঁহারা অতি কাতরস্বরে সাশ্রুনয়নে কত মিনতি করিলেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁহাকে ফিরাইতে পারিলেন না। তখন অগত্যা তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া সকলকে হস্তিনায় আসিতে হইল।

 এদিকে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, বিদুর আর সঞ্জয় অনেক পথ চলিয়া গঙ্গাতীরে এবং তথা হইতে কুরুক্ষেত্রে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে অনেক তপস্বীর আশ্রম ছিল। সেইসকল আশ্রমের নিকটে থাকিয়া তাঁহারা বল্কল ও মৃগচর্ম ধারণপূর্বক কঠোর তপস্যায় রত হইলেন। এইরূপে কিছুদিন গেল।

 পাণ্ডবেরা ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী এবং কুন্তীকে বিদায় দিলেন বটে, কিন্তু তাঁহারা চলিয়া গেলে পর, আর কিছুতেই স্থির হইতে পারিলেন না। এমনকি, ইঁহাদের শোকে যুধিষ্ঠিরের রাজকার্য