পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৩৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

করাই অসম্ভব হইয়া উঠিল। সুতরাং একদিন তিনি সকলকে লইয়া ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি দেখিবার জন্য বনে যাত্রা করিলেন।

 ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমের কাছে আসিয়া, তাঁহারা তপস্বীগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাদের জ্যাঠামহাশয় কোথায়?” তপস্বীরা বলিলেন, “তিনি যমুনায় স্নান করিতে গিয়াছে। আপনারা এই পথে যান।”

 সেই পথে খানিক দূরে গিয়াই তাঁহারা দেখিতে পাইলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী আর সঞ্জয় স্নানান্তে কলসী হাতে আশ্রমে ফিরিতেছেন। সহদেব কুন্তীকে দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিলেন, অন্য সকলেরও চক্ষে জল আসিল। তখন তাঁহারা দ্রুতপদে গিয়া, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী এবং কুন্তীকে প্রণামপূর্বক, তাঁহাদের হাত হইতে কলসী গ্রহণ করিলেন।

 তারপর তাঁহারা ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমে আসিয়া তাঁহাকে ঘেরিয়া বসিলে সেই সময়ের জন্য তাঁহাদের মনের সকল দুঃখ দূর হইয়া গেল। তখন ধৃতরাষ্ট্রের বোধ হইতে লাগিল, তিনি হস্তিনাতেই রহিয়াছেন। আশ্রমে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী আর সঞ্জয় মাত্রই আছে, কিন্তু বিদুর কোথায়? বিদুরকে দেখিতে না পাইয়া, যুধিষ্ঠির ব্যাকুলচিত্তে ধৃতরাষ্ট্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “জ্যাঠামহাশয়! বিদুর কাকা কোথায়?”

 ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “আহার ত্যাগপূর্বক ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিয়াছেন। তপস্বীরা বনে মাঝে মাঝে তাঁহাকে দেখিতে পান।”

 এমন সময় সেই আশ্রমের নিকটেই বিদুরকে দেখিতে পাওয়া গেল। তাঁহার মস্তক জটাকুল, শরীর কর্দমাক্ত, অস্থিচর্ম সার এবং পরিচ্ছদ বিহীন। একটিবার মাত্র তিনি আশ্রমের দিকে তাকাইয়াই, আবার প্রস্থান করিলেন। যুধিষ্ঠিরও তৎক্ষণাৎ তাঁহার পশ্চাতে বনের দিকে ছুটিতে ছুটতে বলিতে লাগিলেন, “কাকা! আমি যে আপনার যুধিষ্ঠির, আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি।”

 তখন সেই বিজন বনে বিদুর একটি গাছ ধরিয়া দাঁড়াইলে, যুধিষ্ঠির তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া আবার বলিলেন, “আমি আপনার যুধিষ্ঠির, আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি।”

 এই বলিয়া যুধিষ্ঠির তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইবামাত্র, সেই মহাপুরুষের আত্মা তাঁহার দেহ ছাড়িয়া যুধিষ্ঠিরের দেহে আসিয়া প্রবেশ করিল। তাঁহার দেহটি তেমনিভাবে গাছ ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের বোধ হইল যেন তাঁহার বল দ্বিগুণ বাড়িয়া গিয়াছে! অমনি দৈববাণী হইল, “মহারাজ! তুমি ইঁহার দেহ দাহ করিও না। ইঁহার জন্য শোকও করিও না, কেননা ইনি স্বর্গে আসিয়া অতি উচ্চ সম্মান লাভ করিবেন।”

 তখন যুধিষ্ঠির আশ্রমে ফিরিয়া এই আশ্চর্য ঘটনার কথা সকলকে বলিলেন। বিদুর যে কে, তাহা পরদিন ব্যাসদেব সেখানে আসিলে তাঁহার নিকট জানা গেল। মাণ্ডব্য মুনির শাপে ধর্মকে মানুষ হইয়া জন্মগ্রহণ করিতে হয়, তিনি ছিলেন বিদুর।

 সেইসময়ে ব্যাসদেব, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী প্রভৃতির মনে সান্ত্বনা দিবার নিমিত্ত, অতি আশ্চর্য কাজ করিয়াছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যত বীর মারা গিয়াছিলেন, সকলে ব্যাসের ডাকে, পরলোক হইতে ধৃতরাষ্ট্রের নিকট আসিয়া উপস্থিত হন। ইহাতে তখন সেই আশ্রমে কি আনন্দের ব্যাপার যে হইয়াছিল, তাহ কি বলিব। ব্যাসের বরে সে সময়ের জন্য ধৃতরাষ্ট্রের চক্ষুও ভালো হইয়া গেল। সুতরাং তিনিও পুত্রগণকে প্রাণ ভরিয়া দেখিয়া লইলেন।