পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

সুতরাং খানিক দূর গিয়াই দুইজনে দেখা হইল। কশ্যপ গরুড়কে দেখিতে পাইয়া বলিলেন, “কেমন আছ বৎস? তোমার যথেষ্ট আহার জোটে ত?”

 গরুড় তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল, “ভগবন; আমি ভালই আছি, কিন্তু আহার ত আমার ভাল করিয়া জোটে না! মাকে সাপদিগের হাত হইতে ছাড়াইবার জন্য আমি অমৃত আনিতে চলিয়াছি। মা বলিয়াছিলেন, পথে নিষাদ খাইতে। নিষাদ অনেকগুলি খাইলাম, কিন্তু তাহাতে আমার কিছুই হইল না! ভগবন্, দয়া করিয়া আমাকে আর কিছু খাবার জিনিসের কথা বলিয়া দিন। ক্ষুধায় আমার পেট জ্বলিয়া যাইতেছে, পিপাসায় তালু শুকাইয়া গিয়াছে।”

 এ কথা শুনিয়া কশ্যপ বলিলেন, “বৎস, ঐ যে একটি প্রকাণ্ড সরোবর দেখা যাইতেছে, ওখানে গেলে পর্বত-প্রমাণ একটি কচ্ছপ আর তাহার চেয়েও বড় একটি হস্তি দেখিতে পাইবে। পূর্বজন্মে ইহারা বিভাবসু আর সুপ্রতীক নামে দুই ভাই ছিল। ইহাদেব পিতা কিছু টাকাকড়ি রাখিয়া যান, ছোটভাই সুপ্রতীক সেই টাকা তাহাকে ভাগ করিয়া দিবার জন্য, বড় ভাই বিভাবসুকে বড়ই পীড়াপীড়ি করিত। বিভাবসু রাগী লোক ছিল, তাই সে সুপ্রতীকের পীড়াপীড়িতে অত্যন্ত চড়িয়া গিয়া, তাহাকে শাপ দিল যে, তুই মরিয়া হাতি হইবি!” ইহাতে সুপ্রতীক বলিল, “তুমি মরিয়া কচ্ছপ হইবে!”

 “এখন সেই দুইভাই বিশাল হাতি আর প্রকাণ্ড কচ্ছপ হইয়াছে। ঐ শুন, হাতিটা সরোবরের কাছে আসিয়া কি ভয়ঙ্কর গর্জন আরম্ভ করিয়াছে, আর তাহা শুনিয়া কচ্ছপটা সরোবরের জল তোলপাড় করিয়া, কেমন রাগের সহিত উঠিয়া আসিতেছে, দেখ। ঐ দেখ, উহাদের কি বিষম যুদ্ধ বাধিয়া গেল! হাতিটা ছয় যোজন উঁচু আর বার যোজন লম্বা; কচ্ছপটা তিন যোজন উঁচু, আর তাহার বেড় দশ যোজন; এ দুটাকে খাইতে পারিলে তোমার পেটও ভরিবে, গায়ও খুব জোর হইবে।”

 এই বলিয়া গরুড়কে আশীর্বাদ পূর্বক কশ্যপ চলিয়া গেলেন। তারপর গরুড়ও এক নখে হাতি, আর এক নখে কচ্ছপটাকে লইয়া, আবার আকাশে উড়িল। তখন তাহার চিন্তা হইল যে, ‘কোথায় বসিয়া এদুটাকে ভক্ষণ করা যায়।’ গাছের নিকটে গেলে, তাহা তাহার পাখার বাতাসেই ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত এমন একটা গাছ খুঁজিয়া পাওয়া গেল না, যাহার উপর গিয়া বসিতে ভরসা হয়। তারপর অনেক দূরে অতিশয় প্রকাণ্ড কতগুলি গাছ দেখা গেল। তাহাদের মধ্যে একটা বড় গাছ ছিল, তাহা এতই প্রকাণ্ড যে তাহার একটা ডাল এক শত যোজন লম্বা! গাছটি যেমন বড়, তেমনই ভদ্র। সে গরুড়কে ডাকিয়া বলিল, “গরুড়, আমার এই ডালে বসিয়া, তুমি গজ-কচ্ছপ আহার কর।”

 গাছের কথায় গরুড় তাহার ডালে বসিবামাত্র, ঘোরতর মটমট্ শব্দে ডাল ভাঙিয়া পড়িল।

 যাহা হউক, গরুড় ডালটিকে মাটিতে পড়িতে দিল না। সে দেখিল যে, পিঁপড়ার ন্যায় ছোট ছোট অনেকগুলি মুনি মাথা নিচু করিয়া, বাদুড়ের মত সেই ডালে ঝুলিতেছেন। ইঁহারা বালখিল্য মুনি; ইঁহারা ঐ ভাবে তপস্যা করিতেন। ইঁহাদিগকে দেখিয়া গরুড়ের বড়ই ভয় আর চিন্তা হইল, কেননা ডাল মাটিতে পড়িলে আর ইহাদের কেহই বঁচিয়া থাকিতেন না। সুতরাং সে দুইপায়ে হাতি আর কচ্ছপ, আর ডালটিকে ঠোঁটে লইয়া আবার আকাশে উড়িল।