পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৩০
উপেন্দ্রকিশাের রচনাসমগ্র

 আশ্রমের নিকট আসিয়া আর তাহার শোভা দেখিয়া সকলের মনেই ভক্তির উদয় হইল, সৈন্যেরা তাহাদের ধূলামাখা বিকট চেহারা লইয়া উহার ভিতরে প্রবেশ করিতে সাহস পাইল না। রাজা তাঁহার রাজ বেশ ছাড়িয়া বিনয়ের সহিত সাধারণ লোকের মত, কেবল অমাত্য আর পুরোহিত সঙ্গে লইয়া মুনির সঙ্গে দেখা করিতে চলিলেন।

 আশ্রমের ভিতরে মুনিগণ কেহ বা বেদগান করিতেছেন, কেহ বা ধর্মের কথা বলিতেছেন, কেহ বা ভগবানের চিন্তা করিতেছেন। রাজা যত দেখেন, ততই বলেন, ‘আহা! কি সুন্দর, কি সুন্দর!’

 আশ্রমের যেখানে কন্ব থাকেন, তাহার নিকট আসিয়া রাজা পুরোহিত আর অমাত্যকে বলিলেন, ‘আপনারা এইখানেই থাকুন, আর ভিতরে গিয়া কাজ নাই।’ তারপর রাজা একাকী ভিতরে প্রবেশ করিয়া উঠানে দাঁড়াইয়া এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিলেন, কিন্তু কন্বকে দেখিতে পাইলেন না, তখন তিনি বলিলেন, ‘কুটীরের ভিতরে কেহ আছ কি? যদি থাক বাহিরে আইস!’

 কুটীরের ভিতর আর কে থাকিবে? শকুন্তলাই সেখানে ছিলেন। রাজা হয়ত ভাবিয়াছিলেন মুনির কোন শিষ্য কুটীর হইতে বাহির হইবে, কিন্তু উহার ভিতর হইতে যে এমন সুন্দর দেবতা বাহির হইয়া আসিবেন, এ কথা তিনি মনে করিতে পারেন নাই।

 শকুন্তলা বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, বাড়িতে অতিথি উপস্থিত। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিলেন, সুতরাং ইহাও তাঁহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, অতিথি সাধারণ লোক নহেন, নিশ্চয় কোন রাজা। মুনি বাড়িতে নাই, সুতরাং অতিথির আদর শকুন্তলাকেই করিতে হইল।

 তাই তিনি রাজাকে বসিবার আসন আর পা ধুইবার জল দিয়া অতিশয় মিষ্ট কথায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মহারাজ, এখানে কিজন্য আসিয়াছেন? আজ্ঞা করুন, আপনার কোন্ কাজ করিতে হইবে।’

 রাজা বলিলেন, ‘ভদ্রে, আমি মহর্ষি কন্বের পায়ের ধূলা লইতে আসিয়াছি। তিনি কোথায়?’

 শকুন্তলা বলিলেন, ‘তিনি ফল আনিতে গিয়াছেন একটু পরে আসিবেন, আপনি বসুন।’

 রাজা শকুন্তলার অপরূপ সৌন্দর্য দেখিয়া যার পর নাই আশ্চর্য হইয়াছিলেন। এখন তাঁহার মিষ্ট কথা শুনিয়া, আর বুদ্ধি আর ভদ্রতা দেখিয়া, তিনি একেবারে মোহিত হইয়া গেলেন। সুতরাং তিনি আর তাঁহার পরিচয় না লইয়া থাকিতে পারিলেন না।

 রাজা শকুন্তলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কে? এই বনের ভিতর কি জন্য বাস করিতেছ? আর কি করিয়াই বা এমন সুন্দর হইলে?’

 শকুন্তলা বলিলেন, ‘আমি মহর্ষি কন্বকেই আমার পিতা বলিয়া থাকি। কিন্তু শুনিয়াছি আমার পিতার নাম বিশ্বমিত্র, আর মার নাম মেনকা। মহর্ষি কন্ব আমাকে মালিনী নদীর ধারে কুড়াইয়া পাইয়া, কৃপা পূর্বক নিজের কন্যার মতন আমাকে পালন করিয়াছেন। আমার নাম শকুন্তলা।’

 শকুন্তলার কথা শুনিয়া রাজা বলিলেন, ‘শকুন্তলা, আমি তোমাকে বড়ই ভালবাসি। আমি তোমাকে সোনালি শাড়ি, গজমতির মালা, আর নানান্ দেশের মহামূল্য মণি-মাণিক্য আনিয়া দিব, আমার রাজ্যে যত ধন আছে, সকলই তোমার হইবে, তুমি আমার রানী হও।’