একদিন শুনিল যে সে রাজার পুত্র, মহারাজ উত্তানপাদ তাহার পিতা। এ কথা শুনিবামাত্র পিতাকে দেখিবার জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইল। সে ভাবিল আমি এখনই পিতাকে দেখিতে যাইব।’
রাজা উত্তানপাদ সিংহাসনে বসিয়া আছেন, সুরুচি তাঁহার নিকটেই দাঁড়াইয়া, সুরুচির পুত্র উত্তম রাজার কোলে। এমন সময় ধ্রুব সেখানে আসিয়া তাঁহার কোলে উঠিবার জন্য তাহার ছোট হাত দুখানি বাড়াইয়া দিল। রাজার হয়তো তাহাকে কোলে লইতেন খুবই ইচ্ছা হইয়াছিল, কিন্তু সুরুচির বিষম ভ্রুকুটি করিয়া নিতান্ত কর্কশভাবে ধ্রুবকে বলিলেন, ‘‘ছেলের আস্পর্ধা দেখ। এত কষ্ট কেন করিতেছিস্ বাছা? জানিস না কি যে তুই সুনীতির ছেলে? উনি তোর পিতা হইলে কি হয়? আমি তো তোর মা নই। রাজাসনে বসা তোর কপালে নাই, সে শুধু আমার ছেলেরই জন্য।” ধ্রুবের প্রাণে এই নিষ্ঠুর কথাগুলি বড়ই লাগিল। সে আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব না করিয়া, ঠোঁট দুখানি ফুলাইয়া মার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। মা তাহার কাঁদ কাঁদ মুখ আর ছল ছল চোখ দুটি দেখিবামাত্র তাহাকে কোলে লইয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে বাবা? কেহ কি তোমাকে কিছু বলিয়াছে?”
ধ্রুব কহিল, “মা আমি বাবার কোলে উঠিতে গিয়াছিলাম, সৎমা বলিলেন, আমি তোমার ছেলে বলিয়া নাকি তাঁহার কোলে উঠিতে পাইব না; আমার নাকি কপালে নাই।”
ধ্রুব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে এই কথাগুলি বলিল; তাহা শুনিয়া সুনীতির যে কি কষ্ট হইল তাহা লিখিয়া বুঝাইবার সাধ্য নাই। তিনি কোনো মতে চোখের জল থামাইয়া ধ্রুবকে বলিলেন, “বাবা, সুরুচি সত্যই বলিয়াছে। তোমার কপাল মন্দ, তাই তুমি আমার মতো অভাগিনীর পুত্র হইয়াছ। তোমার কপাল ভালো হইলে কেহ তোমাকে এমন কথা বলিতে পারিত না। রাজার আসনে বসা, ভালো ভালো হাতি ঘোড়ায় চড়া, এ সকল যাহার পুণ্য আছে তাহার ভাগ্যেই জোটে। সুরুচির ছেলে উত্তম অন্যজন্মে অনেক পুণ্য করিয়াছিল, তাই এখন সে রাজার কোলে বসিতে পায়। তুমি কর নাই তাই তুমি তাঁহার কোলে বসিতে পাইলে না। সুরুচির কথায় যদি তোমার দুঃখ হইয়া থাকে, তবে যাহাতে তোমার খুব পুণ্য হয় সেইরূপ কাজ কর, তাহা হইলেই তোমার কপাল ভালো হইয়া যাইবে।”
ধ্রুব কহিল, “মা আমার মনে যে বড়ই লাগিয়াছে তোমার কথায় তো আমার দুঃখ যাইতেছে না। আমি এমন কাজ করিব যাহাতে সকলের চেয়ে যে ভালো তাহার চেয়েও ভালো স্থান পাইতে পারি। তোমার ছেলে যে আমি, আমার তেজ তুমি দেখ। বাবার যাহা আছে সবই উত্তমের হউক, অন্যের দেওয়া আমি কিছু চাহি না। আমি নিজে এমন জায়গা দেখিয়া লইব যে বাবাও তাহা পান নাই।”
এই বলিয়াই ধ্রুব ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, তারপর একমনে পথ চলিতে চলিতে সে বনের ভিতরে একস্থানে আসিয়া দেখিল যে সেখানে সাতজন মুনি কুশাসনে বসিয়া আছেন। সে তাঁহাদিগকে প্রণাম করিয়া বলিল, “আমি উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুব, আমার মার নাম সুনীতি। আমি মনে বড় কষ্ট পাইয়া আপনাদের নিকটে আসিয়াছি’’ মুনিগণ বলিলেন, “বাছা, তুমি চারি-পাঁচ বৎসরের বালক, তোমার মনে আবার কি কষ্ট হইল।” ধ্রুব কহিল, “আমার বিমাতা আমাকে কটু কথা কহিয়াছেন, তাই আমার মনে কষ্ট হইয়াছে।”